শামীম কবীর: বিচ্ছিন্নতাবোধই তার কবিতার শক্তি
লেখক: বীরেন মুখার্জী, কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক
( Click This Link )
স্বল্পায়ু এক কবি প্রতিভার নাম শামীম কবীর। প্রতিভার পূর্ণ স্ফূরণের আগেই তিনি ছিটকে গেছেন জীবন থেকে। শামীম কবীর স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছেন। স্বেচ্ছামৃত্যুর ‘স্বাদ’ কী, কী তার বর্ণ বা গন্ধ—তা জীবিত মানুষের পক্ষে জানা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যে বোধ কবিতার সরোবরে রেখে গেছেন, তার মাঝে ডুব দিয়ে তার ‘ব্যক্তিগত উপলব্ধির’ সারাৎসার কিছুটা হলেও আত্মস্থ করা যেতে পারে। সত্য যে, শামীমের কবিতার গভীরে যে দাহময় অগ্নি ক্রমেই বাড়বাগ্নি, লেলিহান হয়ে দেখা দিয়েছিল, তা গাণিতিক নিয়মের বাইরে—ভিন্নকিছু এবং ভিন্নচিন্তার। সমাজ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজস্ব অবস্থান ও জীবন নিরীক্ষণের গভীর মনন তিনি অর্জন করেছেন বিচ্ছিন্নতার ভেতর থেকে। ফলে পারিপার্শ্বিক জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের ভিন্নধর্মী প্রচেষ্টা তার কবিতায় তীব্রভাবে ফুটে ওঠে। কবিমাত্রই সংবেদনশীল, কিন্তু শামীমের কবিতা পাঠে তাকে ‘অতি সংবেদনশীল’ অভিধায় চিহ্নিত করতে হয়। অতি সংবেদনশীলতার কারণে সব ছেড়ে-ছুঁড়ে কবিতায় সুস্থির হতে চেয়েও পারেননি তিনি। অন্যায়, অসত্য, কলুষ ইত্যাদি সামাজিক নেতিবাচক প্রপঞ্চের সঙ্গে কোনোরূপ আপোষ-রফা করেননি। সঙ্গত কারণে তাকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়েছে বস্তুবাদী সমাজ-সংসার থেকে। তিনি বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ কিংবা বাজারী সাহিত্যের ছায়াতলে দাঁড়াতে কুণ্ঠিত হয়েছেন। বেছে নিয়েছেন সেই জীবন যেখানে যন্ত্রণার ভাষায় ফুল হয়ে ফোটে জীবনের বোধগুলো। এভাবেই ক্ষত-বিক্ষত-আহত শামীম মানসিকভাবে প্রতিবেশের সব কিছু থেকে নিজেকে গোপন করতে চেয়েছেন, মৃত্যু চেয়েছেন, যাবতীয় কোলাহল থেকে মুক্তি চেয়েছেন। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে উৎসারিত হয়েছে তার কাব্যজ্যোতি। নিচের কবিতাটি লক্ষ্য করি—
খেলতে খেলতে ভেঙে যায় ছাদ
এবড়ো থেবড়ো কংক্রীটের কোণা ধরে কোনোক্রমে কোলে
এ’ আর ও’
তারা শুধু মৃত্যু আশা করে ক’রে থাকে
এখন কতটা নিচে মেঝে তার অঙ্ক কষে আতঙ্কিত হয়
সেই ছাদে চাঁদ ঝরে একাগ্র পলক আর
আঁচহীন আদুরে আলোর ঝাণে
পিছলে যাচ্ছে কংক্রীটের ঢাল
[এ’ আর ও’কে নিয়ে খণ্ড খণ্ড]
ইন্দ্রিয়ঘন রূপকে সামনে টেনে আনার কৌশলের মধ্য দিয়ে কবির বিবেচনাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘বোধ’ হলো এক ধরনের শূন্যতার উপলব্ধি। ফরাসি সাহিত্যে যেমন বোদলেয়ার এ ব্যাপারটি কবিতায় এনেছেন তেমনি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও এমনটি দেখা যায়। বস্তুত তিরিশ পরবর্তী কবিরা বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্য দিয়েই চেতনার জাগরণ ঘটাতে চেয়েছেন; অস্পষ্টতাই যার নিয়তি। ‘শিল্প ও সৌন্দর্যের একটি মূল উদ্দেশ্য যেহেতু বিষণ্ণতা, সুতরাং অস্পষ্টতাই এর মূলধর্ম’— এ ভাবনার মধ্য দিয়ে শামীমের কবিতা এগিয়ে যায়। একটি কবিতা লক্ষ্য করি—
আমি শুধু চিরকাল ঘরের কথাই কবো
ঘর আমি দেখি নাই বুঝি নাই
খালি জানি বৈশ্যদের খলহাস্য ঘরময় থাকে
না জেনেই ঘরের প্রলুব্ধ—কথা বলে যাবো
[স্রোত ও শামুকাসন]
শামীম ঘর-প্রত্যাশী। কিন্তু ঘর তাকে আটতে রাখতে পারেনি। বার বার তিনি স্থির বিন্দু থেকে সরে গেছেন অলক্ষ্যের দিকে। এ এক ‘বিচিত্র রশ্মির ধ্যান’। সময়ের বিপন্নতাবোধের মধ্য দিয়ে যার উল্লম্ফন ঘটে বহিরাবরণের দিকে। সঙ্গত কারণেই বোহেমিয়ান ভাবনা-তাড়িত হয় কবিসত্তা। তার কবিতা পাঠে বার বার বিচ্ছিন্নতাবোধই সামনে চলে আসে। বোঝা যায় পাশ্চাত্যের সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ-প্রীতি।
কবি পরম্পরায় মানসিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিশ্বসাহিত্য এমনকি বাংলাসাহিত্যের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি রাখলে এটি বেশ বোঝা যায়। শার্ল বোদলেয়ারের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের মানসিক ঐক্য ও সহমর্মিতার সন্ধান মেলে, তেমনি শামীমের সঙ্গেও বোদলেয়ারের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি। জীবনানন্দ দাশ এবং বোদলেয়ার, ‘উভয় কবিকেই বলা হয় অন্ধকারের কবি। অন্ধকারের মধ্যে উভয়ই খুঁজেছেন একটা নতুন চৈতন্য-সত্তার খোঁজ।... বোদলেয়ারের মতনই কবি জীবনানন্দও অন্ধকারের মধ্যে সম্পৃক্ত হয়েও খুঁজেছেন মুক্তি, একটা আলোর ইশারা সন্ধান।’ বোদলেয়ার, জীবনানন্দ ও শামীম অন্ধকারের মধ্যেই থাকতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে খুঁজেছেন মৃত্যু, ভয় ও বেদনা। তাহলে প্রশ্ন জাগতেই পারে শামীমের কবি-সত্তার সত্যদর্শনটি কী? অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়িয়ে আত্মমগ্নতাকে যিনি ধ্যানী-প্রেমিকের মতো চৈতন্যে লীন করতে পারেন, তাকে প্রকৃত কবি হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে—এমন মত কাব্যবোদ্ধাদের। শামীম কবীরের ক্ষেত্রেও এ ভাবনাটি প্রাসঙ্গিক। কারণ তিনি তার স্বল্পায়ু জীবনে নানামাত্রিক যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে নিজের আত্মবিশ্বাসকে হারিয়ে যেতে দেননি। উপরন্তু স্বপ্ন আর সৌন্দর্যের পালিশে আত্মবিশ্বাসকে আরো উজ্জ্বল করে তুলতে সচেষ্ট থেকেছেন। পাশাপাশি আরেকটি সত্য হলো তিনি প্রচল কাব্যবোধের বিপরীতে দাঁড়িয়েই নিজস্ব জগত বিস্তৃত করেছেন।
আপন বরণ আমি খুলে দিতে পারি
কিন্তু হায়
অনাথ মাথার দাম দিতে হবে বলে
ছিলো রাজ্ঞী যে
এখন তার সূত্রপাত খড়গভ্রমণ
মৃত্যু কামনার মধ্যদিয়ে শামীম নিজেকে মৃত্যুপথের যাত্রী হিসেবে দেখতে পেতেন। পাশাপাশি আধুনিক মানুষের নানা অন্ধকার, নৈরাজ্য, হতাশা, ভয় ও একঘেঁয়েমি ইত্যাদি আধুনিক যাপনের সব উপাদান একীভূত করে তা অভিজ্ঞতার কষ্ঠিপাথরে ঘষে মেজে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এভাবে ধীরে ধীরে এক অজানা কুহকের অন্তরালে তিনি নিয়ে গিয়েছেন তার কাব্যবোধের জগতকে। তাকে ‘লিবিডো’ আক্রান্ত মনে হতেই পারে। কারণ তিনি নিজের ‘শিশ্ন’ বিসর্জন দিতে চেয়েছেন কিংবা ‘স্বমেহন’-এ জুড়াতে চেয়েছেন নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা। কবিতার যে গলিপথ ধরে হেঁটেছেন শামীম তাকে ‘বিচ্যুতির সীমারেখা’ হয়তো বলা যায়, কিন্তু যাপনের অসঙ্গতি বিবেচনায় সে পথে হাঁটা কি সত্যিই অন্যায়?
মাঠে ঝ’রছে তর্জনী ও ধারা : মাঠ নেই
বিদ্ধ বিদ্ধ দিক আর প্রচুর বাজের সমতালে
গজায় টাওয়ার এক
আমি তাতে ব’সে
তর্জনীয় ঝড় দেখি, মাঠ নেই নেই
[মাঠ]
কিংবা—
‘যে স্বপ্ন প্রত্যহ দেখি, সকাল ও প্রসারিত দিনের অন্তিমে,
যার সমুজ্জ্বল প্রেম হৃদয়ের স্পৃহা থেকে পারি না লুকাতে।
নিঃশব্দে, শিশুর মতো বয়সের ঘনভার বেড়া ভেঙে ভেঙে
দু’দ- পাখির সাথে মগ্ন আলাপের রেশ নিয়ে, অবিরত
গোলক ধাঁধায় যাকে খুঁজি নিত্য সমর্পিত অপেক্ষার শ্লেষে—
কতোদিন দীপ্ত বনপথে তাকে দেখেছি প্রখর হেঁটে যেতে।
[যে স্বপ্ন প্রত্যহ]
শামীম কবীরের কবিতা কখনো ‘শূন্যমার্গে ওড়ে’ আবার কখনো ‘মাটি ও মাচান ফুঁড়ে তেড়ে ওড়ে ভূগোলক’-এ। কবি মজনু শাহ্ শামীম কবীর সমগ্রের ভূমিকায় বলেছেন— ‘শামীম কবীর, একদিন যে চেয়েছিল কেবল আয়না-ই তাকে গুড়িয়ে যেতে দেখুক; কুজো খেজুর গাছের ছায়া না মাড়িয়ে ঘুরে যেতে চেয়েছিল যে— কি অমোঘ নিয়তি, তার পায়ের কাছে, প্রায় তার সমবয়সী এক খেজুর গাছ ছায়া দোলাচ্ছে, আজ’। সত্যিকার অর্থে শামীমের কবিতা সেই সত্যের মুখোমুখি নিয়ে যায় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত গোলকধাঁধা, মহাশূন্য। যে অভিজ্ঞানের ছায়ার শামীম নিজেকে ক্রমেই বিপন্ন করে তুলেছিল, তা মৃত্যু। বলা যায় খুব সাহসিকতার সঙ্গেই তিনি মৃত্যু নামক ‘বোধ’-টিকে সারাক্ষণ বুকের মাঝে জাগিয়ে রাখতেন। ‘কী এক কথার লোভে বেঁচে থাকি/ মৃত্যু দূরে নয়/ ইচ্ছার পালক হ’য়ে মৃত্যু জেগে থাকে’— বস্তুত এই বিচ্ছিন্নতাবোধই শামীমের কবিতার প্রধান শক্তি হিসেবে শনাক্তযোগ্য।
‘কবিতা হচ্ছে কবির প্রোজ্জ্বল অভিজ্ঞতার সরস রূপায়ণ। সেই বিরল অভিজ্ঞতাকে পাঠকসঞ্চারী করতে কবি বেছে নেন শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যমরূপে কাব্যপ্রকরণকেই’। কাব্যপ্রকরণ ও ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও শামীমের পৃথক সত্তার সন্ধান মেলে। তিনি গতানুগতিক ভাষা প্রয়োগের বাইরে বিক্ষিপ্ত অথচ ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন শব্দ প্রয়োগের দিকে ঝুঁকেছেন। ‘আধুনিক কবিতার অন্যতম চিৎপ্রকর্ষ এই যে, তাতে এ যাবৎ অনুসৃত ও বহুপ্রচল প্রতীক, উপমা, চিত্রকল্প ইত্যাদির গতানুগতিক প্রয়োগ থাকে না’। শামীম কবীরও বহুল ব্যবহৃত শব্দ-সমবায় সচেতনভাবে ত্যাগ করেছেন। ফলে তার কবিতায়, ‘কৃষ্ণচূড়া পুচ্ছ’, ‘ফ্লুরোসেন্ট ভালোবাসা’, ‘পঞ্চম স্তন’, ‘নকল প্রভাত’, ‘ধর্ষিতাসুবাস’, বেশ্যাচারী গৃহস্ত’, ‘দুঃখের দক্ষিণা’, ‘মোমদৃঢ় নাড়ি’, ‘পতিতা মা’, ইত্যাদি শব্দবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায়।
শামীমের কবিতা কতখানি ‘আধুনিক’ কিংবা ‘উত্তরাধুনিক’ তা প্রশ্নসাপেক্ষ এবং গবেষণার বিষয়। তবে সৌরিন্দ্র মিত্রের ভাষায় বলা যায়, ‘আধুনিকতার একটা ব্যাপক অর্থ আছে, সেটা হল অধুনার সঙ্গে অর্থাৎ বর্তমানের সঙ্গে চৈতন্যের যোগ। এই অর্থে যথার্থ কবিমাত্রেই আধুনিক কবি এবং যথার্থ কবিতামাত্রেই আধুনিক কবিতা।’ কবিতার আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতার একমাত্র লক্ষণ না হলেও সৌরিন্দ্র মিত্রের বক্তব্য অনুযায়ী শামীমের কবিতা যে আধুনিক, সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে না। আবার শামীমের কবিতার গভীরে বস্তু থেকে শূন্য পর্যন্ত কেন্দ্রচ্যুতির যে আভাস জেগে থাকে তাতে তার উত্তরাধুনিক মানসিকতার বহিপ্রকাশ লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য, আজকের এই শতধাভঙ্গুর পৃথিবীতে কেন্দ্রাতিগ সুস্থিরতা মানুষের আরাধ্য নয়, বরং বিচ্ছিন্ন, অনিকেত মানসিকতাই তার ধ্যানের জগৎ-অবধারিত নিয়তি। নৈরাজ্যকর অসহায়ত্ব ও সচেতন আত্মপীড়ন তার জীবনের পরিধিকে করেছে ছিন্নমূল, গন্তব্যচ্যুত; আর এই অস্তিত্বের গাঢ় ভিত্তিভূম অন্বেষণে শামীম কবির আত্মদহনের জ্বালা, ভাঙন, স্বপ্নবোধ ও প্রত্যয়ঘন বাসনা নিয়ে বিচরণ করেছেন কবিতার জগতে। তার ১৯ এপ্রিল কবিতাটি লক্ষ্য করি—
তোমাকে যে কথা বলা হবে
তার সব নিয়ে গ্যাছে চান্দ্র ড্রাগনেরা
চান্দ্র ড্রাগনেরা ভালো ভদ্র সদাচারী
কেবল তোমার জন্য কথা আনতে গিয়ে
ড্রাগনের শ্বাসে পুড়ে শক্ত হলো ঘাড়
[১৯ এপ্রিল, ক]
কিংবা,
মায়ের সাথে বাক্যালাপ হয় আধা-বৈষয়িক। একদিন
সে আমাকে বল্ল: তোর জীবনটা ছন্নছাড়া ভাবে কেটে
যাবে। আমি কিছুই ভাবলাম না এ বিষয়ে।
[১৯ এপ্রিল, খ]
এটা স্পষ্ট যে— তার কবিতায় যেমন আছে সম্মোহন, তেমনি রয়েছে বিচ্যুতির ঘোর। তবে যাপনের বহুবিধ আলো-ই তার কবিতাকে আলোকিত করে রেখেছে, হোক তা মৃত্যুর দিকে হাঁটা কিংবা ‘উত্তরাধুনিক যৌবনাদ্য রোগ’। শামীম কবিরের কবিতার নিবিড়পাঠে তাকে হতাশাদগ্ধ কবির প্রতিকৃতি হিসেবে আবিস্কার করা যায়। যে ‘হাতমুখ ধু’য়ে একটা ঘর’ বানালেও তার ছায়া হয় না। যার চোখে ভাসে ‘মন্থর গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে’ থাকা পৌঢ় ট্রেন চালকের দৃশ্য। যে আর একবারও পিছন ফিরে তাকায় না। শেষতক শামীম কবিরও মৃত্যুর মাঝে চূড়ান্ত মজার সন্ধান করেছেন।
‘বেঁচে থাকার কত মজা আছে।
জীবনের কত মজা।
তবে তো মৃত্যুতে থাকে চূড়ান্ত মজা।
নেশাকর অনন্তর মজা। আর এ জীবন তো মানুষের
কীটের নয় পতঙ্গের নয় গিনিপিগের নয়।
এ হয়তো মৃত্যু নয়।
আরেকবার আরেক রকমের জন্ম সেইটি
যাকে মৃত্যুই বলা যায়
সে হয়তো অন্যতর জীবন।’
[শেষ নোট]
আমাদের পারিপার্শ্বিক জটিলতা নাকি সামাজিক রুগ্ন বাস্তবতা শামীম কবিরকে মৃত্যুর দিকে ক্রমেই ঠেলে দিয়েছে— তা একটি জিজ্ঞাসা; যার উত্তর প্রকাশ্য না হলেও হয়তো অন্তরে-অলক্ষ্যেই বহন করতে হবে।
নভেরা হোসেন (Click This Link)
১৯৯০ সালের এপ্রিল মাস। লিটল ম্যাগাজিন, ফ্রানৎস কাফকা, সুবিমল মিশ্র, ঢাকার শিল্প-সাহিত্য-এই সবকিছুর সাথে বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে কবি শামীম কবীরের সাথে পরিচয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শামীমের সংবেদনশীল চরিত্র আর তীক্ষ্ম মেধার পরিচয় পেলাম। ধনেশ পাখির মতো গম্ভীর অথচ ভেতরে ভেতরে অশান্ত কবির অবয়ব। সেঁকোবিষ আর পোড়া মদ দিয়ে তৈরি যার তারুণ্য; করতোয়ার স্রোতহীন জলের সাথে অন্তর্গত বাক্যালাপের পর নিরন্তর সে গেঁথে চলেছিল একটার পর একটা কবিতার ব্রীজ। একমুখী সে ব্রীজে ভরশূন্য পরিভ্রমণ। নিজস্বতায় ঋদ্ধ নাগরিক ব্যক্তির- নৈঃসঙ্গ্য, যন্ত্রণা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি আর বিচ্ছিন্নতাবোধের চর্মহীন কঙ্কাল যেন শামীমের কবিতা। তবে লোকজ ও স্থানিক উপাদান তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। তিরিশের কবিদের ধারাবাহিকতায় বাংলা কবিতায় আধুনিক নিঃসঙ্গ মানুষের যে নৈর্ব্যক্তিক উপস্থিতি; শামীম কবিতায় তারই ব্যবচ্ছেদ করেছেন মর্গের দমবদ্ধ ঘরে। সাড়ে চব্বিশ বছরের স্বল্পায়ু জীবনের প্রায় অনেকটা সময়জুড়ে কাটিয়েছেন কবিতার অনুষঙ্গে। “বিনিদ্র লাল কালো অনেকগুলো চোখ ফুটে চেয়ে আছে নলাকার কাঠ থেকে”— এই ছিল তাঁর দেখবার যন্ত্র। জীবনের ভেতরে থেকে দর্শক হয়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ শেষে আরও একটি চাঁদের দেখা পেয়েছিলেন শামীম। আর সে অভিযাত্রায় চান্দ্র ড্রাগনের শ্বাসে ঘাড় পুড়ে শক্ত হয়ে গেল। অতর্কিত একটি পিছল কাঁখ তাঁকে বহন করে নিয়ে যায় যুদ্ধের বাইরে— যে গর্তে তলা নেই তার। জ্ঞানী কবরের স্কন্ধে চ’রে তাঁকে বলতে দেখা যায়-“কাঁদে বালিহাঁস/কাঁদে উঁচু চিল/ কাঁদে মধ্যবর্তিনীরা আর সবুজ ফাঙ্গাস/ আমি জানিনা আমি কী খুঁজি/ আমি ক্যানো যে কাঁদি না।” কখনও আবার তাঁকে লিখতে দেখি-“তোমার বিপুল গড়নের মধ্যে কোনোখানে এক টুকরো জটিল উল্লাস আছে তার স্পর্শে বদলে যায় প্রভাতের ঘ্রাণ”-এরকম সব আপ্তবাক্য।
ঢাকায় আশির দশকে শুরু হওয়া লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের কবিতায় শামীম বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে লিখে গেছেন। ঔপনিবেশিক প্রাতিষ্ঠানিকতা ও আগ্রাসী, শোষণধর্মী কাঠামোর প্রতি শামীমের নঞর্থকতা শুধুমাত্র লেখার মধ্যে প্রকাশিত হয়নি; তাঁর জীবনদর্শন ও আচরণেও তা প্রকাশ পেত। শামীমের ভেতরে বোহেমিয়ান সত্তার উপস্থিতি ছিল প্রবল। প্রচলিত ধর্ম, মূল্যবোধ, লৈঙ্গিক ও শ্রেণীগত রাজনীতি ইত্যাদির অসারতা, নির্মমতা, প্রাণহীন অস্তিত্ব তাঁকে বাধ্য করেছিল সকল ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক অবয়বের বাইরে থাকতে—যা হয়তো একজন সংবেদনশীল কবির সহজাত স্বভাব। নব্বই থেকে চুরানব্বইয়ে ঢাকার সমসাময়িক তরুণ কবিদের সাথে লেখালেখি, তরল-কঠিন-বায়বীয় নানা ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পরিভ্রমণ কবিকে নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল।
তাঁর স্বেচ্ছা জীবন- প্রক্রিয়া, মনস্তত্ত্ব, কবিতার ধরণ অনেকটাই বোধগম্যতার বাইরে ছিল অনেকের কাছে এমনকী সাহিত্য পরিমণ্ডলেও, যা এখনও অনেকটা রয়ে গেছে। তাঁর কবিতার আলোচনা মূলধারার সাহিত্যে খুব কমই দেখা যায়। কবিতায় পুরাতন, অন্তঃসারশূন্য চিন্তাকে আঘাত করে নতুন চিন্তা ও শব্দের ব্যবহার শামীমকে করে তুলেছিল স্বতন্ত্র, নিজস্ব স্টাইলে দক্ষ যা সমসাময়িককালোত্তীর্ণ। কবিতায় তাঁর প্রকাশভঙ্গি ছিল ব্যক্তিগত যে জন্য তাঁর পাঠকও মুষ্টিমেয় এবং বলা যায় পরবর্তী সময়ের ও নতুন ভাবনার পাঠকের জন্যই তৈরি হয়েছিল তাঁর কবিতা। “হয়তো আমরা দুইজনই পৃথিবীতে সবুজ পাতাঅলা গিরিবাজ তৈ তৈ তৈ তৈ তৈ….” এরকম সব বাক্য লেখার পর শামীম তৈরি করেছেন “ম্যান সাইজ আরশি কিংবা আত্মহত্যা বিষয়ে গল্প’র মতো কবিতা। এই সব মর্মভেদী কবিতা লিখে মাত্র ২৪ বছর ছয় মাস বয়সে, ২ অক্টোবর, শামীম আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
আশার কথা, দ্রষ্টব্য থেকে প্রকাশিত ’শামীম কবীর সমগ্র’-তে কবির অধিকাংশ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে শামীমের স্বেচ্ছামৃত্যু‘র দু-বছর পর। তারও অনেক বছর পর ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয় “নির্বাচিত কবিতা : শামীম কবীর”। এ গ্রন্থগুলিই শামীম কবীর স্মারক হিসেবে রয়ে যাবে ভাবিকালের পাঠকের সংগ্রহে।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হচ্ছে শামীম কবীরের কয়েকটি কবিতা:
অনুসরণ
একজন অবিকল আমার মতোন লোক আজ সারাদিন
আমার সামান্য পিছে চলমান, যে রকম বিশ্বস্ত কুকুর
যে দিকেই যাই আমি, এলেবেলে ঘুর পথে, খুব শব্দহীন
পেছনে পেছনে সে-ও চলে; পার্কে, নদীর ধারে—শিষ্ট ময়ূর
য্যান পেখম গোপন কোরে আমার পেছনে চলে উদাসীন
পথিকের মতো। অকস্মাৎ পেছনে তাকালে দেখি, অল্পদূর-
আনমনে ধরাচ্ছে সিগার সে, অথবা কখনো খুব মিহিন
রুমালে মোছে গরদানের ঘাম; বোঝো সে ক্যামন সুচতুর!
বুঝি না, সে কী কারণে এমন নাছোড় চলে, এ-তার ক্যামন
ব্যবহার : অবিকল আমার নকল কোরে মুখের গড়ন,
দৃষ্টির খরতা আর জটদার চুলের বহর, বেশবাস—
ক্যাবল ভিন্ন চলার প্রকৃতি তার; আমি চলি একা, আপন
খেয়াল, আর সে আমার নিবিড় পেছনে ধায় জ্বলন্ত শ্বাস
কোরে সয’ত্ন-গোপনে, অদৃশ্য সঙ্গীন হাতে, নিজস্ব সন্ত্রাস।।
অথচ আমার চোখ
কেউ কেউ বলে বটে—এ আমার ভুল প্রেম। এ-রকম—খোঁড়া
নর্তকীর সাথে রাস্তায় বেড়ানো, আশে-পাশে লক্ষ মানুষের
খুব ঝাঁঝালো অবস্থিতি অগ্রাহ্য কোরে—খোলা সড়কদ্বীপের
ধারে পা ঝুলিয়ে বোসে তার তেজী নৃত্যকলাময়—সুতো ছেঁড়া
অতীতের নিখাদ মলিন গন্ধ শোঁকা, খুব অন্যায়। তা-ছাড়া
যে সুরের রেশ নেই বর্তমানে, নিহত যে পাখি, এ-তো ঢের
বোকামী—তার দগ্ধ পালকের নিচে প্রচ্ছন্ন অবচেতনের
ঘোরে প্রকৃত উষ্ণতা অন্বেষণ; এ-তো অতি স্বপ্নেরও বাড়া।
অথচ আমার চোখে বিস্ফোরণের মতো লাল-নীল, ঈষৎ
ম্লান জ্বলে ওঠে দীপ্র ঝাড়বাতি, চন্দ্রালোকি জলসাঘর—
তবলায় তুফান, তুমুল নূপুর ধ্বনি, তন্ময় নহবত
কানে বাজে অবশেষে—কুয়াশায় নর্তকীর হিল্লোলিত ঊরু,
পদ্মের পাতার মতো পায়ের কাঁপন আর বক্ষ তোলে ঝড়
আমি দেখি, আবার—খোঁড়া নর্তকীর পায়ে তীব্র নাচের শুরু।
মুক্তি
আমার ভূমি কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার ওপর আকাশ। পায়ের নিচে আকাশ। সামনে ডানে পেছনে বাঁয়ে আকাশ। এই রকম আকাশময়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি ভূমি কাঁধে নিয়ে। বহুস্তর শিলা খনিজ কাদা আর খড়িমাটির গড়া একফালি ভূমি। অনেকদিন আগে হাঁটছিলাম। তারপর কখন য্যানো এইভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছি।
কাঁধ জমে গ্যাছে। বহুবার কাঁধ বদল করেছি। দু’কাঁধেই কড়া দাগ। একটুকু ভূমির ভারও অসাধ্য মনে হচ্ছে। আরেকবার কাঁধ বদল করলাম। তাতে একটু আরাম হয়। এরপর সামনে মনোযোগ করে মেঘেদের রঙ বদল গ’লে যাওয়া আর বিদ্যুতের ‘লাফালাফি’ দেখলাম অনেকণ। ঠিক আলো নয়, এক রকম আভার মধ্যে দাঁড়িয়ে এসব দেখতে দেখতে ফাঁকা। বহু দূরে একটা ছুটন্ত ধুলিকণার পুচ্ছ খুব জ্বলছে। সবদিকে অনেকগুলি তারা টিপ টিপ করছে। দেখতে দেখতে এইসবের মধ্যে দৃষ্টি ক্রমশ শূন্য হ’য়ে আসলো। একদিকে অনন্তর তাকিয়ে রইলাম আর কিছুই ভাবলাম না। হঠাৎ একটা উল্কা একেবারে পাশ দিয়ে ছু’টে চলে যায়। ঘোর কেটে যায় তার ঝাপটায়। চমকাই। তারপর একটা ঝাঁকি দিয়ে আলগোছে কাঁধ থেকে ছুঁড়ে ফেল্লাম ভূমি খণ্ডটি।
জন্মান্ধের ভূমিকা
জন্মাবধি অন্ধ হোয়ে আছি—সশরীর, এড়িয়ে ধুলোর মতো—
গাঢ় রৌদ্রালোক দুইচোখে। বয়েসী বটের মূলে গুপ্ত ক্ষত
দেখিনি তাকিয়ে কোনোদিন, অথবা আড়ালে থেকে নির্নিমেষ—
জ্যোৎস্নালোভী নারীদের পাহাড়ী গ্রীবার ভাঁজে তীব্র অনুদিত
গোলাপ শিশু; পরিবর্তে আমার চৈতন্য স্রোতে কি দগ্ধ শেষ
নিঃশ্বাস ফেলে ছায়া হয় ইতস্তত ছিন্ন মেঘেরা; ঘুমন্ত
ঈশ্বরের মতো, মনে হয়—বহুকাল প’ড়ে আছি জলশেষ
শুকনো কাদায়, ত্বকের নিচেও আছেও খুব গাঢ় ছদ্মবেশ।
আমার গুহার বার্ণিশে সবুজ সতেজ অর্কিড প্রতিদিন
রৌদ্র খায়, বাতাসের উন্মুক্ত গালিচায় নির্ভেজাল প্রাচীন
অশথ্থের মতো ছড়ায় শেকড়; ক্যাবল স্মৃতিনষ্ট আফিমে
আচ্ছন্ন রোয়েছি বোলে, গুহার আঁধারে আমি মায়াবী পিদিমে
খুঁজি রৌদ্রের প্রতিমা, আর ক্রটিহীন জন্মান্ধতা হেতু—করি
আরাধনা নর্তকীর : নির্ভুল মুদ্রায় নেচে যদি পাই সিঁড়ি।।
পৃথক পালঙ্কে
(কবি আবুল হাসানকে নিবেদিত)
তুমি ঠিক পলাতক নও। আমিতো এখনো দগ্ধ তৃণভূমি
থেকে পাই উপবাসী ভেড়াদের বিক্ষুব্ধ শিং-সংঙ্কেত; তুমি
কি উটের মতো জ্বলস্ত ক্যাকটাসের জমাট জল তরঙ্গ
এখনো শুনতে চাও, নাকি ঘুমের ভেতরে শুয়ে—সমকামী
আর হিজড়েদের ত্রুটিহীন ব্রহ্মনৃত্য দেখবে? স্বপ্ন ভঙ্গ—
জানি তুমি অক্লেশে সোয়ে নাও, তবু—রাত্রির মতো নিম্নগামী
কালো জলে ভেসে যদি যায়—জননীর মতো অসহায়—বঙ্গ
তোমার, তুমিও তো পারবে না ঠিক এড়াতে যন্ত্রণার সঙ্গ।
তোমার মর্মমূলে নিসর্গের শীর্ণ লাশ সর্বদা কল্লোলিত
শ্মশানের প্রেতী গান গায়, অরণ্য-মঞ্চে এক অন্ধ নায়ক
রাতদিন তোমার অনুকরণে করে বৃপজা,স্বপ্নাতঙ্কে
নীল কিশোরীর বুকে মোহন তোমার বাঁশি বাজে—উন্মোচিত
সত্য-সম জানি সব, হে-পাতক স্বর্গের বাগান পলাতক
নও তুমি, নির্বাসিত হোয়ে আছো—স্বপ্নহীন পৃথক পালঙ্কে।।
এই ঘরে একজন কবি
এই ঘরে একজন কবি আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে
কুয়াশার মতো—তার নিদ্রামগ্ন ‘ভাসমান চোখে ধীর লয়ে
শীর্ণ এক নদীর প্রতিমা ফ্যালে সুরময় ছায়া, শতাব্দীর
শুদ্ধতম শিলাখণ্ড শিয়রে তার—ঠিক একগুঁয়ে
ধীবরের মতো : ছিন্নভিন্ন—ছেড়াঁ জালে কৌশলে মরা নদীর
শ্রোণী থেকে অপরাহ্নে রূপালী ইলিশ ছেঁকে নেবে; পচা ঘা-য়ে
গোলাপের মধু ঢালা—অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে ভ্যান। ভীষণ অস্থির
হাতে সে ক্যাবল বিষণ্ণ খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির।
কবির আঙ্গুল থেকে অনর্গল রক্ত ঝরে আর মূর্তিবৎ
অন্ধকারে প’ড়ে থাকে সে—ক্যামন মর্মন্তুদ অদৃশ্য বল্কলে
ঢেকে অস্তিত্বের ক্ষত। অবশ্য মাঝে মাঝে বদ্ধ ঘরময়
গলিত বাতাস কাঁপে—অন্তর্গত সজীব গর্জনে : বাঁধা গৎ
ভুলে গিয়ে—নিদ্রিত কবির বীণা সহসা কী প্রখর আদলে
গড়ে সুরের প্রতিমা, অথচ খোলে না তার অন্ধ চক্ষুদ্বয়।।
রাত
আমি মেশিনের বরপুত্র, বৈদ্যগিরি জানা ছিলো ভালো
বলো তুমি কাঁদছো ক্যানো?
এমন যে কাঁচা কাজ, শ্বাসাঘাতহীন কান্না শোনা যায়
তুমি আমাকে বলছো না ক্যানো কথা?
সারা বাড়ি রঙ হলো, এবং আছে বাতাস নেবার
পেকে ওঠো
তারপর অস্ত্র পাচার করি চোখভর
জানালা খুলেই এক মহাশূন্য
অন্তহীন আলো
ফলে কিছুই দ্যাখার বাকি রইলো আর নয়
নুয়ে এসে মন্ত্র নাও মেশিনের, এতো রাতে
রাজহংস শিকারের ঊরুজলে ডুবে মরা ভালো
ফাঁকা
শহরে আগুন লেগে কাণ্ড শুরু হলো
রাস্তা দিয়ে উঠে এলো ভূগর্ভের ড্রেম বেঁকেচুকে
সবশেষে কার্বনের ফ্রেম হ’য়ে সবকিছু বয়
কয়েক শতাব্দী পার করে দিতে
এরকম সমগ্র পৃথিবী
তার মধ্যে একা এক কাঁধ
ঘোরে ফেরে
কোনো কিছু বহনের নাই কোনো আর
ও চাঁদ
যে চাঁদ মাস্তুলে বাড়ি খেয়ে ভেঙে গ্যালো
যে চাঁদ সাগরে টুকরো টুকরো হ’য়ে
ঝ’রে পড়লো
যে চাঁদ সমুদ্রের নিচে শুয়ে আছে
খণ্ড বিখণ্ড হয়ে
সে চাঁদ তুমি নও
তুমি তার প্রেতাত্মা
আমার ঘর
এখন সময় হ’লো
আমার লাল ঘোড়ার গাড়িতে ফেরার
আমি দুপায়ের হাড় বাজিয়ে ফিরবো
আমার ঘরে
না কোনো ফুলের ঝাড়
কেবল মৃত্যু
আমার ঘরে কী সুন্দর সাজানো
বাঁধ
রাত্রি কি ব্যথায় মোড়া
রাত্রি কি উত্থান
বিপুল পাপের ভারে নুয়ে পড়া গভীর স্বপন
আর আমাদের এই ছোটো ছোটো অসীম জীবন
আজ এক রেখায় মিলে যায়
নগরীর প্রাচীন হাড়ের শব্দ লকলকিয়ে ওঠে
ঘেয়ো কুত্তার মলচাটা জিভের আগায়
এবং একটি মৃত্যুর সম্ভাবনা দাঁড়িয়ে থাকে
আগাগোড়া ব্যান্ডেজ জড়ানো বন্ধুর চেতনে
আজ দেখি নৈশ কালো ট্রেন
তার যৌনকাতর জীবাশ্ম ফেলে ফেলে
মাতাল ট্রেন তার উপচানো শিস ঢেলে ঢেলে
তার অস্থির বৃষ্টির হাওয়া ছেড়ে ছেড়ে
আবছা আকাশের দিকে যেতে যেতে
ঘোরহীন পেলব মৌনতা বাজিয়ে চলে যায়
এই রাত্রি আমাদের
গল্পঘরে পড়ে থাকা অজস্র খুলির ভীড়
ভেদ করে কেশর দোলানো
এই রাত্রি আমাদের সতেজ সূচক
আর খুলি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা
পুরোটা গল্পের জন্ম এই বাঁধ থেকে
স্রোতে... স্যান্ড্রা! ফালি ফালি চাঁদ ভেসে যায়
একবার জাল ফেলেছিলাম গলুইয়ে ব’সে
তখন চাঁদ ছিলো না
আমি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম পানির জীবন
ক্যামন নোনতা আর চ্যাপ্টা তার কোষতন্ত্র
আর উল্লাস রাগে কী রকম থরথরিয়ে কাঁপে তার বাড়
অথচ উঠে এলো ভাঙাচোরা
একটা দ্বীপের টুকরো টুকরো অঙ্গ রাশি
আর তাদের ভেতর শক্ত হয়ে বসা একটা
মৎস্য দম্পতির বাসা
স্যান্ড্রা প্রিয় মম
এই যাত্রায় আমাকে যেতে হবে বহুদূর
প্রায় অসীমের কাছাকাছি
চক্ষু কর্ণ জিহ্বা নাসিকা ত্বক আর
সমুদয় অর্থ সাথে নিয়ে
আর ঝিমাই হাঁটু গেড়ে রাতের পর রাত
যেখানে ঢেউ ছিলো এখন সেখানে শুধুই জ্যোৎস্না
সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত হয় স্রোতের ওপর
জাল থেকে একটা একটা করে খুলে
সমস্ত দ্বীপের টুকরো ছুঁড়ে ফেল্লাম স্রোতে
কিন্তু ততোক্ষণে দম আটকে মরে গ্যাছে মাছ দুটো
এতো অনায়াসে তারা মরে গ্যালো
হে স্রোতের উপর ভেসে থাকা ফালি ফালি চাঁদ
তোমরা উড়াল দাও
আমাকে যে জেগে থাকতেই হবে এই জলকষ্ট নিয়ে
দ্বীপ
একটা সুন্দর শাদা দ্বীপ আছে। তার গা’য় কালো কালো ছোপ। আমি তার ওপর ব’সে চারপাশের থৈ থৈ দেখি। একটা বৈঠা আছে ছোটো কদম কাঠের। বৈঠা বেয়ে একটু একটু এদিকে সেদিকে বেড়ানো যায়। চারপাশে ভেসে যায় কতো কতো দ্বীপ আরও। দ্বীপগুলি বাড়ি খায় না। আলগোছে একে অপরের পাশ কাটায়। ব’সে ব’সে চারপাশে দেখি আর বহুবিচিত্রি শুনি...
হঠাৎ স্বপ্নটি ভাঙার পর দেখি তেপান্তরে লম্বা খাড়া সরু এক আঙ্গুলের ডগায় ব’সে আছি একা পা ঝুলিয়ে আর দশ পাশে অনর্গল খালি তর্জনী উড়ছে ঝোড়ো বাতাসে। ব’সে ব’সে তর্জনীয় ঝড় দেখি। দেখিতেছি। অনেক দূরে প্রায় দিগন্তে এক বিশাল ঢালাই লোহার কড়াই বসানো। তার মধ্যে চুয়ে এসে জমা হ’চ্ছে সমস্ত আকাশ থেকে অবিরল একধারা নীল। আকাশটাকে দেখাচ্ছে এক পশলা ফ্যাকাশে হাড়ের মতো এখন।
রেডিয়োতে গান
যে মতে ধুলার স্মৃতি হ’লো ছারখার
সে মতে ফিরিলা তুমি ফিরিলা আবার
অশরীরী পুড়ে খাক শরীরী অনলে
আর তার বায়ুঘের ধিকিধিকি জ্বলে
সুর ক’রে গায় সকলে। আনন্দিত নয় উৎকণ্ঠিত নয় ভক্তিতে গদগদ নয় এমনকী নিস্পৃহও নয়। সকলে সমম্বরে টেনে টেনে সুর ক’রে হায় চিকন ও ভারি বহু স্বরে। তাদের ভঙ্গি খুব সাদামাটা ও সাঙ্গিতিক আর উচাটন নয়। স্বর মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যায় আবার তীক্ষ হ’য়ে ওঠে তবে সুর অবিচল টানা টানা।
অশরীরী পুড়ে খাক্ শরীরী অনলে
আর তার বায়ুঘের ধিকিধিকি জ্বলে
না দেখো চর্মের চক্ষে সেই সঙ্গপনা
নকল ঘরেতে নিশি দিবস যাপনা
সকলে গাইতেই থাকে। শুধু গাইতেই থাকে। এমনকি চোখের পাপড়ি নাড়াতে পর্যন্ত ভুলে যায়। আর শ্বাস ফেলতেও মনে থাকে না। কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। কেউ উত্তরে কেউ পশ্চিমে কেউ কোনোকুনি তাকিয়ে অনর্গল গাইতে থাকে। বাতাস বয়ে যায় শিরশির ক’রে। সকলের গা ঠাণ্ডা হয়ে গ্যাছে। কিন্তু তারা নড়ে না চড়ে না খালি গায়।
না দেখো চর্মের চক্ষে সেই সঙ্গপনা
নকল ঘরেতে নিশি দিবস যাপনা
ঝুলন্ত বিষের থলি ঘরের ভিতরে
আরও আছে সখা সখি উভকাম করে
শুধু একটানা ও বিলয় বিহীন গাওয়ার শব্দ। তার মধ্যে আর কিছু নেই। সেই শব্দ বহুস্বর মিশ্রিত হ’য়ে টান টান ফাঁপা হ’য়ে উঠেছে আর সেই ফাঁপা নলের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছে গানের পূর্বাপর রেশগুলি। চল্কে চল্কে যাচ্ছে তার অনুরণন।
ঝুলন্ত বিষের থলি ঘরের ভিতরে
আরও আছে সখা সখি উভকাম করে
বাদ্য বাজে বদ্যি গাছে রোগের পশম
আর কাহারও নাহিকো লাজ করিছে গরম
বয়স্কদের হাঁপ ধরে না। কচিদের গলা চুলকায় না। পরনের কাপড়গুলো যে ধূসর হ’য়ে ঝুমঝুম ক’রে খ’সে যাচ্ছে তারও খেয়াল নেই। শরীর জমাট বেঁধে যাচ্ছে তারও বোধ নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেয়ে চলেছে সেই একটানা মোচড়ানো সুর মোতাবেক ধীরে ঐকলয়ে। তাল উৎক্ষেপিত। কী রকম য্যানো। লৌকিক তবে একঘেয়ে মনে হ’তে পারে। কিন্তু খুব সরল গতিতে চ’লছে সেটা যে বিরক্তিকর নয়। আনন্দিত নয়। একটানা। ফেঁসো।
বাদ্য বাজে বদ্যি গাছে রোগের পশম
কাহারও নাহিকো লাজ ক’রিছে গরম
অঙুলি হেলিয়া পড়ে দুধের বাটিতে
সে কেমন সাপ মরে ভঙ্গুর লাঠিতে
মাঝে মাঝে হঠাৎ বাতাস পেঁচিয়ে গিয়েই বা শিস্ ওঠে। তার প্রতিধ্বনি হয় আর ফালি ফালি হয়ে যায় বাতাস। কিন্তু তারা নিরুদ্ধে থাকে। একেকবার শিস্ ওঠে আর তারপর অনেক বহুক্ষণ চ’লে যায়। আর তারা গাইতে থাকে অনড় হ’য়ে। মুখ হাঁ।
অঙুলি হেলিয়া পড়ে দুধের বাটিতে
সে কেমন সাপ মরে ভঙ্গুর লাঠিতে
আর তারপরে অন্য কথা পরিচয়
কতোকাল কেটে গ্যালো হ’য়েছে প্রলয়
অকস্মাৎ দুম ক’রে ব্যাটারীর আয়ু শেষ হয়
গানটির জন্য পুঁথিপাঠের লোকায়ত সুর টান ও ধ্বনি ভঙ্গিমা সহকারে সমবেত পঠন ও ধূয়াসহ বিলম্বিত গায়ন প্রযোজ্য।
মা'র সঙ্গে বাক্যালাপ
দেয়ালের চোখ নেই
কেবলই স্বচ্ছতা মাখা খাড়া
কতোকাল
আর এইখানে
মাঠের মধ্যম কোণে রোপিত রাখাল
ভাসমান
বা আমি জেনেছি বিন্দু
বিন্দু
কপালের গোরো বিলীনতা জমেছে বিরাট প্রান্তে
বহু বছরের খাওয়া
ছাদ অলা
এ বিরাট শল্যকেশী হাওয়ার বিরক্ত প্রান্তে
অম্লান
অম্লান
ও দীঘল
(ফোলা ফাঁপা)
কাঁপা কাঁপা)
না আমি জেনেছি
এই স্বপ্নমধ্যে অনুষ্ঠিত জাগা
একটি দুটি তারা ঝরছে এরকম দিনে
তখন এটা খণ্ডিত পছন্দের ভস্মচিহ্নে চেপে
তোমার আকৃতি নিয়ে
একটু একটু হাসি ছড়াতে ছড়াতে
বহু তীব্র শীর্ষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
এক ধরনের ভালো ও ভেঙ্গে পড়া জ্যান্ত (শূন্যতা নয়)
আকাশ ভেদ ক’রে
প্রলেপের ওপর নেমে আসছি
আমি
শাদা ছায়া এবং উপরে
নতুন
ঝিল্লীগ্রাণ
অনুলিখন
আধপোড়া সিগারের খণ্ডটি দূরে ছুঁড়ে দিয়ে
বুড়ো ভাবলেন শোধ হ’লো
তারপর গিয়ে ঐ গোল বাড়িটার মধ্যে
উঠানের নিচের সিঁড়িতে
কাত হ’য়ে বসলো তাঁর মায়া
এবার ফুৎকারের লোভে
কিন্তু আজ প্রতিবিম্ব বেয়ে ওঠা, মেঘের ফ্রীলের মতো কাজ করা, হরিণাভ, পাটল মাড়ির কোপ্তা ঘন হ’য়ে এদেহ, গ্রন্থিল
কষ, অভিলাষ, ভেদবমি, দেহতাপ, টাংস্টেন ফ্ল্যাডের শুভ, গভীর গমনকালীনতা লেগে ধাত্র, ভয় লাগে, কী রকম উঁচু মন চারদিকে,
ভাঙা মই, দশদিকে, প্রেম থেকে ওড়া মাছি, ক্যানো
বুড়ো দেখলেন সার করা শাদা বাটখারা মেঝে থেকে
প্রতিটি ছাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে টন টন তুলা
আর দশলক্ষ সূর্যকুচি ভরা সিগারের
বলকানো
পেঁজা
নীল স্ট্র্যাপ (দূরে)
ফিকে বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে বেড়ায়
সংক্রামক
গাঢ়
স্বুচ্ছ ফিলামেন্ট
দ্যাখা যায় এরা নয়
বৃক্ষ বৃক্ষা এইসব
তবে
আমি শিখতে জানি না পুড়ে হওয়া
নুন
জল ছুঁয়ে ছিলো দেহ
অধিকৃত শরীরের কায়া
আমার অদৃষ্ট আমি হারিয়েছি আর
আমার অদৃষ্ট আমি হারিয়ে ফেলেছি
শুধু আর তোমার আঙ্গুল
হেঁটে বেড়ায় আমার থ্যাঁতলানো গরম চাঁদিতে
আর
আর
আর মাটি
সমোদরা জেনে মাতা
তোমার
যৌবন
ছুঁয়ে
যাই
দেহ পেয়ে গাইবার জন্য গান
১
সারাক্ষণ হাতে চাই গানের বাকশো
যেতে যেতে গান গাবো
তাই
সারাক্ষণ হাতে চাই গানের বাকশো
যেতে হবে গান গেতে গেতে
নানা রঙের উদগ্র আকৃতিঅলা ফাটাফাটি গান
আহা পথনিদ্রা উৎযাপন
তোরই টান...
টানের বিপুল বাঁধা উথলানো চরণেরা যান
যানেদের পুত্র যান আর
তার দিকে যে উড়ূক্কু সিঁড়িটাকে আলগোছে পান
ক’রেছি এবং ভুলে গেছি
তাতে গোলা গহ্বর ছিলো আমাদের
উষ্ণতম
কিউবিক
ঝালার পালায়
হায়
যদি মৃত্যু নির্মাতার ঘরে টিক দিয়ে ছুঁড়ে দিই
অ্যাস্ট্রোলোবানের আঁকে বাঁকে স্তর ক’রে
...........উঠে গ্যালো টানা পুল
...........ভেসে গ্যালো বাঁশের দোকান
............তখন সেই উৎবিদিত ফাঁকাটায় ঝুলে
মা
আমার যে রকম লাগে চক্রাকারে
সে রকম মুর্ছা
সিঁড়ি হারিয়ে আর কে কোথায় পেয়েছিলো
কবে
২.
সারাক্ষণ হাতে চাই গানের বাকশো খান
কাঁখে বাকশো আর আকণ্ঠ পান
কখনও আবার
কাঁদে বালিহাঁস
কাঁদে উঁচু চিল
কাঁদে মধ্যবর্তিনীরা আর সবুজ ফাঙ্গাস
আমি জানিনা আমি কী খুঁজি
আমি ক্যানো যে কাঁদি না
সেনোটাফ
ঞ্জানী কবরের স্কন্ধে চ’রে ফিরে এখানে এলাম
ছোটো ছোটো অট্টহাস্য মাখা ধুলা ঘাস ও বাতাস
এখানের এই নাম অন্যপুর নিহিত রেখেছে
ধাবন্ত আগুনে ছাওয়া এ যে সেই খাঁ খাঁ পারগেটরি
(তন্ত্র)
এই কি সাধনা নয়
যে
চিত্ত হবেনা ক্ষয়
লুপ্ত মেধের এই সব ঐ গুপ্ত ঔসময়
এবারেও যদি হেরে যাই গুরু
সে তোমার দোষে জেনো
এক পাঠ কাল জনৈক প্রাতে
মৃত্যু আমার চিবিয়ে খেযেছো
ঔরসময় গৃহী সুহৃদেরা দেখেও দেখেছে শুধু
সেই থেকে আমি মৃদু হ’য়ে গেছি মৃদু
যে যাই বলুক
ঘাস কেটে অমি এই সময়ের
শ্রেষ্ঠ টিকাটি নেবো
অফুরান হাতে কচি কাঁচা স্বাদু
ঘেসো প্রান্তর খেয়ে ক্রমে চ’লে যায়.....
এভাবেই চ’লে চ’লেছে ঔরসময়
মহেীষধের দিকে
আমার গোপন প্রাণ গভীরে গিয়েছে না কি
তলিয়ে গিয়েছে বলে দু:খ হয়
তবু
উচ্চমূল্য পরিহিত কর্মকারী ও তাহার
আকরবিহীন সুতা উহ্য হ’য়ে থাক
এসময়
ভাবিতেছি যেতে যেতে ভিক্ষাক্ষেত উবে গ্যালো কিনা
ভোরটেক্স
আমার অশান্ত আত্মা
ঐযে......
.........কী
.........ধুলিঝড়
ধুলিঝড় ধুলিঝড়ে সাজানো গোছানো
ধুলিঝড় ধুলিঝড়ের ভিতরে ও বাঁকএ
ধুলিঝড় ধুলিঝড়ের মাজায় প্যাঁচানো
ধুলিঝড় ধুলিঝড়ের বোঁটায় উদ্যত
আমার অশান্ত আত্মা
আর ধুলিঝড়ের শরীর থেকে খ’সে পড়ে যাওয়া
ধুলায় ধুলায়
সে থাকে তখনো জলে প্রতিসৃত নানা তৃষ্ণা রং
আমিতো উন্মাদ মাত্র
আর বাদবাকী শখের গোসল
১৯ এপ্রিল বারবার
আর একবার ঘুরে পেছনে তাকাবো
কি তাকাবো না
ভেবে
সমস্ত ভাঙ্গা টুকরো গুছিয়ে কুড়িয়ে আবার
আমাকে জোড়া লাগালাম
কিন্তু হাত কই
তোমার বিপুল গড়নের মধ্যে
কোনোখানে
এক টুকরো জটিল উল্লাস আছে
তার স্পর্শে বদলে যায় প্রভাতের ঘ্রাণ
আর আমি
ভয়ে ভয়ে
মানুষ হ’য়ে
উঠে দাঁড়াই
কিন্তু পা কোথায়
হা হরতন হো ক্যুইট
জগত বিশাল এক পটভ‚মিকায় ঠেস ক’রে
অচেনা হেলান পেতে শুয়ে আছো
এই নিরুদ্বেগ স্বকালের মোহে
আর স্বয়ম্ভু গতির আঁশ বুনে বুনে
ঝিমুনরি তালে
আ আ আমার রেশম ক্ষুধা
এটা খাবো
ওটা খাবো
সেটা খাবো
সব খাবো
তুমি
শ্বেতরোগী
সেবিকা
মা
বুক দিয়ে মুখ ধুয়ে দাও
জানালায় কাটা রাইফেল
এই পথে একদিন চিঠি এসেছিলো
একটা ভারি ঢিল আর পিঠ ভর্তি স্বচ্ছ কথা নিয়ে
একটা সরল সোজা ব্যারেলের উষ্ণ গহ্বর নিয়ে
এ অবধি
ঐ পার
লম্বা খাড়া দুই রণপার মাঝে
পড়ে আছে ঘ্রাণ খোয়ানো খোসা তার
ঘরের যে কাঠ গর্জায় শুনি
তরঙ্গহীন ইশারার ধ্বনি
বাটখারা পেশা হতাশার গান
অদৃশ্যপাতে হবে খান খান
দেহপাতানোর গল্পের কোনাকুনি
আঙ্গুলের মতো
তুলোট কিন্তু নয়
টেবিল হারানো যুবা
বারেক সামনে চেয়েছিলো ঝাপটানো পাল্লা
ক্যানো...........
তোমরা জানো নি
শীত পোড়াবার জন্য সে বর্গক্ষেত্র ধার করে
হ’য়ে যায় তিন কোণা তাঁত
তাতে বাকশের বাহির থেকে চেয়ে থাকা চোখ
ছাপা হয়
আরেকটি জানালা
আরও অন্যজন আছে শরীর নিয়ে
ঐ ঐ আকারের
নাম রোগতাড়ূয়া
তিন চার তাক ভরা...
যা যা ভালো লেগেছিলো
মাঠে
মঞ্চে
আর
মহামিলনের হেন হেন প্রজাতি বা প্রাশনের বহু ফুর্তি
সার ক’রে রাখা আছে আছে
একদিন এক বসন্তের ভয় দৃশ্য করা কাঁচ
সেই বিনিময় বইতে বইতে ভারি আর
খাটো হ’তে আছে
বাঁচাপূর্ব কালের এক লোভে
আর বা¯Íবিক জেনে হীন উদস্থিতি মান
২.
শার্সিতে অর্ধেক কাঁধ সারারাত ঝুলে থাকে
আর পর্দার ঐপারে লুকানো ছেলেটির
অদৃশ্য দু পায়
আমি ছোটো ছোটো কাগজের বল ছুঁড়ে মারছি
ও যখন টু উ উ দেবে
বাতাস চাখতে চাখতে এগিয়ে আসবে আরেকজন
যার ওকে খুঁজে বার ক’রবার কথা
মাঝরাতে জানালায় কী দেখিতেছিলা
ধনেশ পাখি
৩.
খেলতে খেলতে
ধুলা হ’য়ে গ্যালো আমাদের
খোলা
এক রকমের দুটি
ক ১
শতরঙ্গে ঝালপালা এক গোলকের কেন্দ্র থেকে
গোপনে বেরিয়ে আসা বিন্দু
তার অজানা উত্তাপ ছেড়ে ছেড়ে
ঘাসগুলোকে অবাক ও পলকে আহত ক’রে
বক্রল মিহিন এক রশ্মিমুণ্ডে চেপে
যেতে যেতে
যেতে
আছে
সে জানে দৈর্ঘ্য প্রস্থ বলে কিছু নেই
তবে তাকে থেকে যেতে হবে
আর কেন্দ্র হারা গোলক কিছু বুঝবার আগেই
ভিতরের ফাঁপা চাপে ফেটে
ভিন্ন ভিন্ন হ’য়ে ছড়িয়ে পড়লো বিশাল
এক আত্মকামী শূন্যের ভেতর
শূন্যটি বিশাল আর আত্মকামী
এবং চোখা শীর্ষ অলা ঘাসের
একটা সরু পোড়া লাইন শুধু
এখনও র’য়ে আছে তার মধ্যে ভেসে
একটা কিছু ঘটনার অপেক্ষায়
অথচ বিন্দুটি জানে না আসলে সে অস্থির
ক২
অনিবার্য উচ্চতারা আকাশ অবধি
লম্বা সরু হয়ে একা একা উঠে যেতে আছে
গোড়ালিতে সুঁই ও রসের দাগ
আর অবাধ উর্বর কুয়াশা ভেদী মধ্যমার পরে
আর আমরা কিছু দেখিনি
আমরা কে কে যে
কজন বা কতো
ভুলে হ’য়ে গেছি আমাদের মতো
ওরা যাবে আকাশ অবধি
তবে আমরা তো জানিই যে আকাশটা কতোখানি উঁচু
আর উচ্চতাগুলি অনিবার্য এবং সরু সরু
আর পাতাল থেকে ওঠা তাদের ভিত
নিশ্চয়ই খাঁটি
কারণ অনেক পুরনো কিছু পাতালের ছাপচিত্রে
অবাক করা শাক্তমুদ্রা আমাদের বহু দ্যাখা
বহু পুনর্জন্ম ধ’রে
আর এইসব ভিতের পাশে শুয়ে বসে
দাঁড়িয়ে আমাদের অপেক্ষা
অনিবার্য উচ্চতারা আকাশ অবধি
লম্বা সরু হ’য়ে একা একা উঠে যেতে আছে
এবং যদিও কুয়াশা
তবে আমরা তো জানিই যে আকাশটা কতো উঁচু
হ’তে পারে
আর একদিন পাখা কুড়ানোর জন্য
কী বিশাল একটা ছাদ আমরা পাবো
খোলা
স্বপ্ন
যা মনে হয় তা মনে করার জন্য যা লাগে
তা এক অপার উজ্জ্বল উপত্যকা
ওই সেখানে চ’রে বেড়ায় ভাঁজে ভাঁজে
তোমার গন্ধলোলুপ সন্তান
খেয়ে খেয়ে কর্কশ রুগ্œ পাথর
ও প্রকৃতি
আজ দেখলাম মেঘমন্দ্র উচ্ছ্বলতার দাগ
এবং বাহান্ন জন প্রপিতামাতার
সেইসব চেহারা
আমি আজ
আর দেখলাম সেই
আজ পুত্র শোকে ছেয়ে যাক আকাশ
আকাশ থেকে ঘেমে আসুক
বাতাসের গর্তে গর্তে ভরা গর্বে
এবং পাতালের থেকে ওঠা থাক থাক ঈশ্বরলীলার দেহময়
গোপনে প্রবিষ্ট হও এর প্রাচীনতা
ওঁ মোজেইক ধাম
ও পাথরের শিখা
তুমি আর জ্বালতে জ্বালতে জ্বালতে
পারো না
হায়
আমি
এ
ই
ভা
বে
ই
কি ভেসে ভেসে থাকবো প্রান্তরে
তোমার ঘর আমাকে নিয়েই ছোটে
আর তার গা’য় মেঘ
জ’মে
জ’মে
জ’মে
ঝাপসা হ’য়েছে রং
মেঘ প্রান্তরে শিশুমেষ চমকায়
পুলকে
আলোকে
ঝলকে
উড়ে থাকো আবহ কাঁকাল
উড়ে থেকো
থৈ থৈ
ভেসে যেতে যেতে যেতে যেতে
শোকএ এসে ঠেকলো স্কন্ধহীন পায়া
বদ্ধ শোকে
চারবার
তারপর
তখন আসলে আর কিছুই ছিলো না
হাওয়া আয়না ( Click This Link )
শামীম কবীরের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল বগুড়ার কাহালু গ্রামে নানা বাড়িতে। শৈশব থেকেই শামীম কবিতা অনুরাগী । রংপুর ক্যাডেট থেকে মাধ্যমিক এবং রাজশাহী সরকারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর প্রথাগত পদ্ধতির পড়ালেখার প্রতি অনিহার কারণে একাডেমিক পড়াশোনার সাথে সম্পকের্র ছেদ ঘটে। কিছুদিন বিরতির পর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হলেও তা শেষ করেননি শামীম এবং সেসময়ে লেখালেখির সাথে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। নব্বই দশকে লিটল ম্যাগাজিন-কেন্দ্রিক ঢাকার সাহিত্য জগতের সাথে শামীম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। নদী, প্রান্ত, দ্রষ্টব্য, রূপম, একবিংশ ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হত। ব্যক্তিগত জীবনে শামীম খুব শান্ত প্রকৃতির হলেও ভেতরে ভেতরে ছিলেন প্রচন্ড অস্থির। কবি বন্ধুদের সাথে তাঁর বোহেমিয়ান জীবন-যাপন পরিবার ও সামাজিক দৃষ্টিকোনে অগ্রহণযোগ্য ছিল। শামীমের কবিতা নব্বই দশকের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক। নিজস্বতায় ঋদ্ধ নাগরিক ব্যক্তির- নৈঃসঙ্গ্, যন্ত্রণা, মনস্তাত্বিক ব্যাধি আর বিচ্ছিন্নতাবোধের চর্মহীন কঙ্কাল যেন শামীমের কবিতা। তবে লোকজ ও স্থানিক উপাদানও তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। তিরিশের কবিদের ধারাবাহিকতায় বাংলা কবিতায় আধুনিক নিঃসঙ্গ মানুষের যে নৈর্ব্যক্তিক উপস্থিতি; শামীম কবিতায় তারই ব্যবচ্ছেদ করেছেন মর্গের দমবদ্ধ ঘরে। সাড়ে চব্বিশ বছরের স্বল্পায়ু জীবনের প্রায় অনেকটা সময়জুড়ে কাটিয়েছেন কবিতার অনুষঙ্গে। লেখার পাশাপাশি শামীম ছবি আঁকতেন এবং চমৎকার গান গাইতেন।
দ্রষ্টব্য থেকে শামীম কবীর সমগ্র বের হয় ১৯৯৭ সালে। ২০০৯ এর বই মেলায় অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল -নির্বাচিত কবিতা :শামীম কবীর।