চতুর্থ বারো
49. রোজার ঈদের আগের রাতে টিভিতে ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ গান শোনার জন্যে অপেক্ষা করতাম, ভালো লাগতো আনন্দমেলা। ঈদে আমজাদ হোসেনের নাটক হতো, উচ্চস্বরে ভাঁড়ামী মনে হতো কিন্তু তখন সেটাই দর্শক পছন্দ করতো। সেটার এক পর্বে বিখ্যাত ডায়লগ ছিল, টাকা দেন দুবাই যাবো। হুমায়ুন আহমেদ হাসির নাটকের আঙ্গিকই বদলে দিয়েছিলেন। ঈদে তার নাটক আনন্দ বাড়িয়ে দিতো। হুমায়ুন আহমেদ মানেই ভিন্ন কিছু। খুব মিস করি তাকে।
50. বাংলা সিনেমা কালেভদ্রে টিভিতে দেখানো হতো, পরে তিন মাসে একবার। রাত আটটার খবরের পর শুরু হতো; মাঝে ১০টার ইংরেজি সংবাদের জন্যে বিরতি, সাড়ে ১১টার বাংলা-ইংরেজির খবরের বিরতি, অসীম সময়ের বিজ্ঞাপন তো থাকতোই। মুভি শেষ হতে সাড়ে বারোটাও বেজে যেতো। সে সময় দেখা যেতো টিভি ওয়ালা বাসা থেকে অগুনতি মানুষ বেড়িয়ে আসছে। এখন গার্মেন্টস ছুটির পরে যেমন দেখা যায়।
51. আগে ঢাকাতে প্রতি সন্ধ্যায় কমপক্ষে ১ ঘন্টা করে দুইবার লোডশেডিং হতো। বাংলায় ডিবিং করা আলিফ লায়লা প্রচারের সময় লোডশেডিং হলে দেখা যেতো মজার ঘটনা। লোডশেডিং-এ কবলে পড়া দর্শকেরা ছুটে চলেছে তখন যেখানে কারেন্ট আছে সেদিকে। একদিন যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে, আরেকদিন ওদিক থেকে এদিকে আসছে।
52. বিটিভির মাধ্যমে প্রথম সম্ভবত ১৯৯৩ সালে বিবিসি আর সিএনএন দেখানো হতো। আর ডিস এন্টেনা যুগের আরম্ভ হয় এর কিছু আগে। ভারতীয় জিটিভি তখন দুপুর দুটো থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত চলতো। বাকি সময় একটিই গান বাজতো ‘এক আইডিয়া হে’।
53. সিনেমার বড় বড় বিজ্ঞাপন ছাপতো দৈনিক ইত্তেফাক। ছায়াছবিগুলো সাদাকালো থেকে রঙ্গিন হতে থাকে। কিছু এড-এ লেখা হতো ‘আংশিক রঙ্গিন’ মানে একটি গান বাদে বাকিটা সাদাকালো। সাধুভাষার দৈনিক ইত্তেফাক ছিল সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা। প্রচার সংখ্যার বিচারে একমাত্র বললেও ভুল হবে না।
54. পপ সং-এ গুরু আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ শাই, ফকির আলমগীর, জানে আলম, লাকি আকন্দ, পিলু মমতাজ, নাজমা জামান ও ঝিঙ্গা শিল্পীগোষ্ঠী প্রমুখের ফ্যান অনেক ছিল।
55. ব্যান্ড দলের মধ্যে সোলস, রেঁনেসা, ফিডব্যাক, এলআরবি, মাইলস, অবসকিউর, চাইম, আর্ক, ডিফারেন্ট টাচ, নোভা’র গান ইয়ং জেনারেশনের গলায় থাকতো। যদিও প্রথাগত সঙ্গীতশিল্পীরা ব্যান্ডের গান নিয়ে নাক সিটকাতেন।
56. সিনেমার প্লেব্যাক এ সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, ফেরদৌসী রহমান, এন্ড্রু কিশোর, খুরশীদ আলম, আবিদা সুলতানা, শাকিলা জাফর, উমা খান, কনকচাঁপা, শাহনাজ রহমতউল্লাহ ছিলেন সবচেয়ে ব্যস্ত।
57. এরশাদের সময় পাকিস্থান থেকে উড়ে এসেছিলেন এক বাঙালি, নাম আলমগীর- গায়ক। ঢাকার শান্তিনগরে পৈতৃক বাড়ি। বিটিভির প্রাইম টাইমে তার গানের অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এখানে না এসে থেকে গিয়েছিলেন পাকিস্থানে। আমার কিশোর মনে ভালো লাগে নি। ভালো লাগে নি চিত্রনায়িকা শবনমেরও পাকিস্থানে থেকে যাওয়া। বুড়ি বয়সে শবনম দেশে ফিরেছেন।
58. টিভিতে স্থির বিজ্ঞাপনচিত্র প্রচারিত হতো। দু’টি বিজ্ঞাপনের মাঝে ‘টুউউউ’ শব্দ হতো। টিভিসির লিজেন্ড জিঙ্গেল শিল্পী হলেন সুমনা হক। মডেল হিসেবে নোবেল, পল্লব, ফয়সল, শিমুল, তানিয়া, সুইটি, মৌ, রিয়া, দিতি, শমী, বিপাশাদের কাজ ভালো লাগতো।
59. ফজলে লোহানী উপস্থাপিত ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ছিল বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, হানিফ সংকেত এখানেই প্রথম অংশ নেন; ‘কঅইন চন দেহি’ আর ‘আচ্ছা বলুন তো’ দু’টি কৌতুক পর্ব ছিল তাতে। উপস্থাপকের সহকারী এক তরুনীকে সেই ছোটো বয়সেই বেশ ভালো লাগতো। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান অন্তরালে, এখনই, শুভেচ্ছা, আইন আদালত বেশ দর্শক প্রিয় ছিল। আইন আদালতে গাজী শামসুর রহমানের আইনী পরামর্শের উদাহরণে দবীর-সগীর নামদু’টি আজো মনে দাগ কেটে আছে। অন্তরালে উপস্থাপনা করতেন সদ্যপ্রয়াত ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। ব্যবসায়ে অধিক সময় প্রদানের মানসে তিনি টিভি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
60. বাসায় ছিল চারপায়ার ওপর দাঁড়ানো রেডিওগ্রাম, রেডিও আর ডিস্ক শোনা যেতো। ছিল টেপরেকর্ডার; চাকতিতে টেপ প্যাচানো থাকতো। টেপে প্যাচ লেগে গেলে কী যে ভোগান্তি হতো! পরে এলো ক্যাসেট প্লেয়ার। আমরা পেয়েছিলাম ক্যাসেটের স্বর্ণযুগ, গানের এ্যালবামগুলো ক্যাসেটেই প্রকাশিত হতো। পছন্দ মতো গান রেকর্ড করে নেয়া যেতো। TDK ও Sony ব্র্যান্ড এর ব্ল্যাংক ক্যাসেটই পছন্দ করতাম। ডিউরেশন ছিল ৬০মিনিট, ৯০মিনিট। ১৯৯১ সালে ডলি সায়ন্থনীর রঙচটা জিন্সের প্যান্ট পড়া, রাসপুটিন শ্রোতাপ্রিয় ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:২৮