জীর্ণ, প্রাণহীণ শ্যাওলাচ্ছন্ন একটা ঘরে চারদেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে কয়েকটা শব্দ। “আমাকে একা থাকতে দাও” শব্দ গুলো কি আমিই করছি? মনে হচ্ছে আমার চেতনার একটা অংশ বিকারগ্রস্ত কিন্তু আরেকটা অতিক্ষুদ্র অংশে এখনো কিছু অনুভুতি রয়ে গেছে। চারদেয়ালের দিকে তাকালাম। নাহ! কোন দরজা নেই। কোন জানালা ও দেখতে পাচ্ছি না। আবারো প্রতিফলিত শব্দ গুলোকে দেয়াল চারটি তাচ্ছিল্যভরে ছুড়ে ফেলে বার বার! বিকারগ্রস্ত উদভ্রান্ত আমি ধুলিধুসরিত আয়নায় নিজেকে দেখার জন্যে আকুল হয়ে উঠি। আয়নায় আলোর প্রতিফলন আমাকে দেখায় কোটরগ্রস্ত চোখে সাদা হয়ে যাওয়া একজোড়া মণি। ওরা আমার রক্ত হিম করে দিয়ে বলে আমি জীবন্মৃত! আশ্চর্য আমার সব প্রয়োজন আজ ফুরিয়েছে। এক মৃত্যুমাত্রিক পৃথিবীতে আমি পদার্পণ করলাম।
মৃত সম্মেলন:
আমার মৃত্যুমাত্রিক পৃথিবীতে আপনাদের স্বাগতম। আর এই মৃত সম্মেলনে দয়া করে জীবিত কেউ আসবেন না।
- এই যে আপনি হ্যাঁ আপনাকেই বলছি আপনি মৃত নাকি জীবিত?
- আমি জানি না।
- দেখি এদিকে আসেন চোখ দেখলেই বুঝবো।
- আচ্ছা।
- হুম আপনি মৃত। চোখর মণি নিষ্প্রাণ সাদা। আসুন আপনি ভিতরে আসুন।
হ্যাঁ যা বলছিলাম। অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম নিজের মতো একটা পৃথিবী সাজাবো। আমিই হবো সেই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। আমি জীবন সৃষ্টি করতে পারি না তাই মৃত দিয়ে সাজিয়েছি পৃথিবী। এই পৃথিবী শুধুই আমার।
জীবিত পৃথিবীতে অনেক মানব মানবী মৃত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা জানেও না তারা মৃত। শুধু তাদের জন্যেই এই পৃথিবী সাজালাম। এই খানেও সূর্য ওঠে। তবে পঁচা ডিমের কুসুমের মতো রং। এখানে আকাশ নীল নয়। ধূসর আর ফিরোজার মাঝামাঝি একটা কালার। এই খানে আকাশের দিকে কেউ তাকায় না। তাকালেও ক্লান্ত ডানায় উড়তে থাকা হাড্ডিচর্মসার গায়ে ঘা হয়ে যাওয়া পাখিদের রক্তহিম করা ডাক শুনতে হয়। এই পাখির প্রিয় খাদ্য মৃত মানুষের চোখ। গলে পড়া মাংশ। পাখিগুলো যত খায় তত মৃত হয়। তখন আর তারা উড়তে পারে না।
এই খানে কোন আয়না নেই। মৃত মানুষদের তো রুপচর্চা করতে হয় না। তাদের অনেকেরই চোখ পাখি খেয়ে ফেলেছে। এটা নিয়ে অবশ্য কারো কোন অভিযোগ নেই। কারণ পরে বলছি। কোন রং খেলা করে না তাদের চোখের রেটিনায়। দরকারও নেই। কারণ মৃত্যুমাত্রিক পৃথিবীতে তারা যে রং দেখতে পায় সেটা জীবিতোদের দেখতে পাওয়া অসম্ভব। আর এই রং দেখার পরে চোখ না থাকলেও কোন আফসোস নেই।
জীবিতদের থেকে মৃতরা বেশী স্বাভাবিক। কেন ? জীবিতোদের বেঁচে থাকার জন্যে উদ্দেশ্য খুঁজতে হয় প্রতিনিয়ত, প্রতিমুহুর্ত। অস্বাভাবিক সব কাজ করতে হয়। দৌড়াতে দৌড়াতে বাসে ট্রেনে ওঠা, নয়টা পাঁচটা কাজ করা, সন্ধ্যায় বাসায় বাজার হাতে ফেরা, স্ত্রীর বাক্যবাণে বিদ্ধ হওয়া অতঃপর খানিকের নিশিপ্রেমে পাগল হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। নতুবা জৈবিক চাহিদায় পাগলপ্রায় কতিপয় মানষের অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে পাঠ্য বইয়ে স্বীকৃতি পাওয়া এক শ্রেণীর স্পিসিসের উপর ঝাপিয়ে পড়া। তা সে যত বয়সেরই হোক না কেন। সতেরো দুগুণে চৌত্রিশ বছর বা সতেরো বছর বা সতোরো মাস। এদের আবার সামাজিক ভাবে নারী বলে অভিহিত করা হয়। মুক্তখাঁচায় স্বেচ্ছাশেকল পড়া পাখিদের একোন ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ? ইউনিভার্সিটি কলেজ পড়ুয়াদের রঙ্গিন চোখের স্বপ্নগুলোও অস্বাভাবিক। কোন স্বপ্ন নয় এগুলো ! সমাজ পরিবর্তন? হা হা হা....ওপস! জীবিতোদের নিয়ে মৃতদের হাসতে মানা। বিপ্লব! হা হা হা .....স্যরি এবার না হেসে পারলাম না। আমি মৃতের হাসি দেখে পিলে চমকে গেছে কার কার? যার গেছে সে এখান থেকে উঠে চলে যেতে পারেন। কারণ আপনি জীবিতো এখনো।
তো যা বলছিলাম মৃতদের কোন উদ্দেশ্য খুঁজতে হয় না মৃত থাকার জন্যে। আমাদের কাজ কি তাহলে? আমাদের কাজ হলো জীবিতদের মাঝে লুকিয়ে থাকা মৃতদের খুঁজে বের করা।
মৃত্যুমাত্রিক পৃখিবীতে সবকিছু ধূসর বালি কঙ্কর ময়। এখানে সূর্যোদয় সূযাস্ত নিয়ে আহ্লাদি নেই। জীবিতদের কাছে তো সূর্যাস্ত মানে আধা ন্যাংটো হয়ে সী বিচে শুয়ে থাকা। তবে চন্দ্র ভালোই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। শুক্লপক্ষে মৃত মানুষগুলোর কি যেন হয়। আমারো তাই হয়। চাতকের মতো চেয়ে থাকি ধূসর আকাশের মাঝে জ্বলজ্বল করতে থাকা গোল রূপার থালার মতো একটা বস্তুর দিকে। জীবিতরা দেখতে পায়না এমন হাজারো রং এসে প্রতিফলিত আমাদের চোখের কর্ণিয়ায়। এই রং জীবিতরা দেখতে পাবে না কোন দিন। কেউ জীবিত যদি থেকে থাকেন এই খানে তাহলে তার নিশ্চয় আফসোস হচ্ছে! জীবিতদের নিয়ে এই একটাই যন্ত্রনা। শুধু আফসোসময় তাদের জীবন। অথচ আমাদের মরণ কত সুন্দর। এইখানে কোন আফসোস নেই, না পাওয়ার বেদনা নেই, অসহ্য যন্ত্রনাকে প্রতিনিয়ত কাছে ডাকি তাই সে আসাই ছেড়ে দিয়েছে!
আরেকটি কথা বলবো? এই খানে কোন জেন্ডার নেই। এখানে কোন “হি” অর “শি” নেই। জীবিতদের পৃথিবীতে সামাজিক ভাবে স্বীকৃত বলশালী প্রাণী ছেলেরা একমুহুর্তের জন্যেও ভুলে থাকতে পারে না পাশের মেয়েটির বুকের একযুগল স্তনের কথা। অনেকে আবার কদম্ব বলে! ফাক ইট! আর সামাজিক ভাবে স্বীকৃত দুর্বল প্রাণী মেয়েটাও ভুলতে পারে না পাশের ছেলেটির পুরুষালী(আশ্চর্য এক শব্দ) বাইস্পেস ট্রাইসেপস এর কথা। নিজের চোখে মুখে রং মেখে কিম্ভুতকিমাকার সেজে থাকে তারা। নিজেদের ফিগার ৩৬ - ৩০ - ৩৬ এ ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টায় হাস্যকর সব কাজ করে। নিজেদের তারা যোগ্য পরগাছা করে গড়ে তোলে। এই মৃত্যুমাত্রিক পৃথিবীতে কিন্তু এসব নেই। এই খানে সবাই সমান। প্রত্যেকেই নিজেদের সম্মানিতো মৃত বলে পরিচয় প্রদান করে। জীবিত পৃথিবীও কিন্তু মৃত্যু ছাড়া অসম্পূর্ণ না। প্রতিনিয়ত তাদের মরতে হয়, প্রতিমুহুর্তে। মানসিক এবং শারিরীক ভাবে। আগে তাদের হাস্যকর মানসিক মৃত্যুর কথা বলে নিই। প্রতিমুহুর্তের কৃত অন্যায়গুলোর জন্যে তারা যখন অনুতপ্ত হয় না তখন তারা থাকে বিকৃত স্বত্তা। তাদের স্বত্তাকে কোন না কোন সময় জেগে উঠতেই হয়। এছাড়া পথ নেই। তখন তারা সয়ংক্রিয় ভাবে মৃত হয়ে যায়। আর অপেক্ষাকৃত জাগ্রত স্বত্তা গুলো তো প্রতিনিয়ত মরতে মরতে বেচে আছে। শারিরিক মৃত্যুর পরে শুরু হয় আরেক আদিখ্যেতা।
জীবন মৃত্যু ছাড়া অচল অথচ মৃত্যু স্বয়ংসম্পূর্ণ! আজকের এই মৃত সম্মেলন শেষে সবাই মৃত্যুমাত্রিক এক পৃথিবীতে প্রবেশ করবো। হাত তুলুন কে কে প্রবেশ করতে চান!
(গল্পটার নাম প্রথমে ছিল শুধু মৃত্যুমাত্রিক। কিন্তু অন্য একটি গল্পের নামের সাথে মিলে যাওয়ায় নাম চেঞ্জ করলাম। )