পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার অনিবার্য ফল হচ্ছে জামাতে শিবিরের উথ্থান। ১৯৭৬ সালে তাদের ধর্মভিত্তক রাজনীতি নিষিদ্ধের অধ্যাদেশ বাতিলে পর যে জামাত তাদের একাত্তর পুর্ববর্তী রাজনীতে ফিরে যায়(বিশেষ অধ্যাদেশ ০৪ মে ১৯৭৬ এবং বাংলাদেশ সংবিধান, ৫ম সংশোধনী, ২২ এপ্রিল ১৯৭৭)।
এ লক্ষ্যে জামাত এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের কতিপয় নেতা ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ সালে ঢাকায় সমবেত হয়ে পরিবর্তিত নাম ‘ইসলামী ছাত্র শিবির’ ধারণ করে নতুনভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করে।
তাদের কর্মকান্ড হয়তো নতুন করে শুরু করেছিল কিন্তু কৌশল ছিল একই। একাত্তরে বুদ্ধিজীবি হত্যায় পাকিস্তানের জেনারেল রাও ফরমান আলী, হামিদ গুল(পরবর্তীতে আইএসআই প্রধান) জামাতের নিজামী, মুজাহিদ, পাক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাশেম এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ছিল প্রধান। নভেম্বর মাসের কোন এক সময় তারা মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসায় বৈঠক করে। এই আলোচনাতেই বুদ্ধিজীবি হত্যার নীল নকশা প্রণয়ন করা হয় বলে ধারণা করা হয়। তারা ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবি হত্যার মিশন সম্পন্ন করে। কিন্তু পচাত্তর পরবর্তীতে রাজনীতিতে পুর্ণবাসিত হয়ে তারা যে আর কোন “হিট লিস্ট” করেনি সেটা কি ভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি?
জামাত বাংলাদশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ছিল সবসময়েই এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভুমিকা নিয়েও নতুন করে বলার কিছু নেই। পচাত্তর পরবর্তীতে তারা সংগঠিত হতে বেশী সময় নেয় নি যেহেতু তাদের পিছনে ছিল তাদের একাত্তরের দেশী বিদেশী পালনকর্তারা।
সংগঠিত হওয়ার পরে জামাতে অনেক গভীর এবং সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা করে। শিবিরের মাধ্যমে তারা ছাত্র ও যুব সমাজে প্রবেশ করে। আশির দশকে আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে আফগানিস্তানের পক্ষে শিবিরের সদস্যসহ অনেক বাংলাদেশী অংশগ্রহণ করে। এরা কিন্তু আইএসআই এবং আফগান তালেবানদের অধীনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়। এরা প্রায় সবাই পরে বাংলাদেশে ফিরে আসে। এই যুদ্ধফেররা পরে বাংলাদেশে আইএসআই এর এজেন্টহিসেবে যে কাজ করেনি সেটা কিভাবে নিশ্চিত হবো? শুধু আইএসআই? লস্কর-ই-তৈয়বার এজেন্ট হিসেবেও কাজ শুরু করে। আর এভাবেই আশির দশকের পর জামাত সহ মৌলবাদী সংগঠন এবং তালেবানপন্থীরা সংগঠিত হয়ে এদেশে ধর্মীয় রাজনীতির আড়ালে জঙ্গি সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। এদের টার্গেট ছিল বাংলাদেশকে মৌলবাদী এবং তালেবান রাস্ট্রে পরিনত করা। সব রসুনের গোড়া এক আর সব মৌলবাদী আর তালবান পন্থী সংগঠনের গোড়াও জামায়াত এটাতে কোন ভুল নেই।
তাদের বিপক্ষে যারাই কথা বলতে গিয়েছে তাদেরই তারা লক্ষ্য বানিয়েছে। হয়তো আগের বৈরী সরকার এবং মিডিয়ার কারণে তা আমাদের সম্মুখে আসে নাই। কিন্তু মিডিয়া অবাধ হবার পরে আমরা দেখেছি কিভাবে তাদের বিপক্ষে যারাই আওয়াজ তুলেছে তাদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, সাংবাদিক মানিক সাহা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা জিহাদ সহ আরো অনেক সাংবাদিক, ছাত্রসেতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি হত্যা করা হয়েছে। তাদেরকে মুরতাদ ঘোষনা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২১ আগষ্ট ছিল তাদের মরণ কামড়। সর্বশেষ ব্লগার রাজীব হত্যার সকল সন্দেহের তীর জামাতের দিকেই। এবং ১৭ জন ব্লগারের হিট লিস্ট সেই আলামতই বহন করে। তাদের বিরুদ্ধে যারাই প্রতিবাদী কণ্ঠ তুলেছে তাদের হিট লিস্ট করে হত্যা সেই একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের অসমাপ্ত কাজেরই ধারাবাহিক বর্হিপ্রকাশ।
আর বিভিন্ন সময় মুক্তমনা বুদ্ধিজীবিদের উপর তো হামলা হয়েছেই সাথে করা হয়েছে বিভিন্ন অপপ্রচার। অধ্যাপক জাফর ইকবাল, আহমেদ শরীফ সহ অনেক প্রাজ্ঞজনকে মুরতাদ ঘোষনা করা হয়েছে।
হুমায়ুন আজাদের “নারী” বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। “পাকসার জমিন সাদ বাদ” লিখার পরেই একুশের মাসে তার উপর হামলা করা হয়েছিল।
এছাড়া ২০০০ সালে চট্টগ্রামের এইট মার্ডার, অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী সহ আরো অনেকেই তাদের হামলার শিকার হয়েছেন। একাত্তরে তাদের টার্গেট যেমন ছিল মুক্তমনা এবং বুদ্ধিজীবিরা তেমন আজকেও সেটা অপরিবর্তনীয় রয়েছে। একাত্তরে তাদের কাছে সকল দেশবাসী ছিল হিন্দু। এই মুহুর্তে তাদের সকল ক্ষোভ ব্লগারদের উপর। ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তারা তাদের পুরোনো মিশন শুরু করেছে।
এই নাস্তিক আর মুরতাদ আখ্যা দিয়ে হত্যাকান্ড ধারাবাহিকতা হয়তো বাংলাদেশে থাকতে না কিন্তু এটা থেকেছে বিভিন্ন কারণে। এবং জামাত তাদের অপরাজনীতি চালিযে গেছে।
বাংলাদেশে একসময় এমন অবস্থাও ছিল যখন তাদের নাম পর্যন্ত কেউ উচ্চারন করতে ভয় পেত। কিন্তু সময় সবসময় এক রকম থাকে না। এই মুহুর্তে জামাত নিষিদ্ধের জোরালো দাবীতে ফুসে উঠেছে পুরো দেশ। আর জামাত আবির্ভূত হয়েছে তাদর আসল রুপে। পতাকা পুড়ানো থেকে শুরু করে ভাংচুর অগ্নিসংযোগ। তারে পেছনে এই মুহুর্তে তাদের পরীক্ষিত বন্ধুরা রয়েছে। যারা তাদর সকল কর্মকান্ডে নৈতিক সমর্থন দেয়া থেকে শুরু করে সকল প্রকার সহায়তা জারি রেখেছে। বহুদিন পর দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই রকম পরীক্ষা এর আগে শুধু একাত্তরেই দিয়েছে।
তাই এই মুহুর্তে জামাত শিবিরের রাজনীতি এবং সকল প্রকার কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করতেই হবে।