তপু বাবা ওঠ, আর কত ঘুমাবি বাবা? তপুর মনে হল অনেক দূর থেকে কেউ তাকে ডাকছে। চোখ খুলতেই ইচ্ছা করছে না তপুর। ২১ ঘন্টা জার্নি আর ১১ ঘন্টার ট্রানসিট শেষে আবার এয়ারপোর্টে লাগেজ হারালো, সেটার অভিযোগ করে বাড়ি ফিরে বাবা-মায়ের সাথে ভালো করে কথা ও বলা হয়নি। তপু চোখ না খুলেই মাথাটা তুলে মার কোলে রাখলো। মা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে যেন আরো ঘুম পারিয়ে দিচ্ছে। ইস তোর কত চুল পেকে গেছেরে বাবা! তপু এবার শব্দ করে হেসে উঠে, মা তোমার ছেলে বুড়ো হয়ে গেছে হা হা হা। যাহ, বলেছে তোকে? তেল দিস না তাই এমন হয়েছে। তপু হেসে বলে আচ্ছা তুমি তেল দিয়ে দিও । এবার ওঠ না বাবা একদিন ধরে পরে আছিস বিছানায়, তোর বাবা আর আমি ঘণ্টায় ঘন্টায় রুমে চক্কর দিচ্ছি এই বুঝি তোর ঘুম ভাঙবে। বাবা কই মা? আর কই, টেবিলে বসে আছে । কত করে বলছি খেয়ে নেও খেয়ে নেও, কে শোনে কার কথা? বল্লো না তপু উঠুক একসাথে খাবো । তপু আস্তে করে উঠে বলে, আচ্ছা যাও তোমরা বস আমি ফ্রেশ হয়েই আসছি।
পাভেল রহমান আলমিরা থেকে গত দুই বছরে পাওয়া গিফটগুলো এক এক করে বের করেন। দুইটা হাত ঘড়ি, একটা টাই, তিনটা কাফ্লিং বক্স, ১২ টা কলম, ৫টা ডায়েরি, একটা পেপার ওয়েট, ৩টা পেনহোল্ডার। তরু রুমে ডুকে জিজ্ঞেস করে এই কি করছো ? পাভেল রহমান স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই বলেন তপুকে দিব তাই বের করছি । তরু ভ্র-কুচকে বলেন ছেলে কি আজই চলে যাচ্ছে নাকি ? পরে দিও । পাভেল বিরক্তি নিয়ে বলেন তুমি চুপ করো, খালি বেশি কথা । তপু মাথা মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে দেখে বাবা-মার তর্কযুদ্ধ চলছে । এইগুলো কি বাবা? ওইগুলো তোমার বাবা এই দুবছরে গিফট পেয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সব তুলে রেখেছেন তোমার জন্ন্য , সেকি গতবার যে কলম দিয়েছো সেইগুলোইতো আছে এখনও । আমি তিনটে অবশ্য গিফট করেছি আমার আডভাইসরকে । তাই নাকি ? পাভেল সাহেবের মুখটা হাশিতে ভরে গেল । যাক কাজেতো লেগেছেরে , কি বলিস? হ্যা বাবা । এইগুলো নিয়ে যাহ , গিয়ে আডভাইসরকে দিস খুশি হবে । আচ্ছা বাবা রেখে দাও আমি পরে নিব । এই না না তোর ঘরে রেখে আসি আমার মনে থাকবে না পরে, আমি রেখে আসি টেবিলে , তুই নিয়ে যাস, কলম লাগলে ব্যবহার করিস । আমাকে দাও বাবা আমি নিয়ে যাচ্ছি, মা খাবার দেও খুব ক্ষিধে পেয়েছে ।
তরু রান্না ঘর থেকে একে একে খাবারের বাটিগুলো টেবিলে রাখসেন । পরোটা, গরুর মাংস, ডিম পোচ, পায়েস, মিষ্টি, তেহারি । তপু বলল মা এতোকিছু? তরু বললেন, তেহারী কালকে রাতের, তুইতো উঠলিইনা তাই তোর বাবাও খায়নি । বেঁড়ে আনলাম যদি খাস? আমাকে আগে তেহারী দেও মা । তপুর তেহারী খাওয়া দেখে পাভেলও প্লেটে তেহারী নিলেন, তরু চেঁচিয়ে বললো সেকি তুমিও তেহারী খাবে নাকি এখন? হ্যা কালতো খাইনি? প্রেসার বাড়লে দেখো আমি কি করি? পাভেল বললেন কেন কাল খেলে কি প্রেসার বাড়তো না? কালকেরটা আজ খাচ্ছি, একইতো কথা । তপু বলল বাবা খাওতো , আমার সাথে খেলে প্রেসার বাড়বে না । ছেলের কথা শুনে পাভেল হা হা করে হাসতে লাগলো । তরু রাগে বিড় বিড় করতে করতে রান্না ঘরে চলে গেলো । তপু চিৎকার করে ডাকল এই মা? তুমি খাবে না? কই গেলে? এসো । তরু চায়ের কাপ নিয়ে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তপু বলল মা বাসায় কাজের লোক নেই? তুমি একা একা করছো সব। পাভেল বলল না বাসায় কাজের লোক নেই, দুজন মানুষ মাত্র, কাজের লোক দিয়ে কি হবে? তোর মা একাই করে । তাছাড়া কাজের মাঝে থাকলে শরীরও ভালো থাকে । পাভেলের কথা শুনে তরু মুখ কালো করে রান্না ঘরে চলে গেল। তপু হা্ত ধুতে ধুতে বলল বাবা আমার মনে হয় একটা কাজের লোক রাখা উচিত। মারতো বয়স হয়েছে, তাছাড়া বাড়িতে একা থাকেন, সাথে কেউ থাকলে মার সময়ও কাটবে আবার কাজেরও সাহায্য হবে । তুমি একটা কাজের লোক রেখে দাও । খালাকে বলো না, খালাই ব্যবস্থা করে দিবে।
তপু চায়ের কাপ নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো । তরু বাটিতে খাজকাটা পিঠা নিয়ে তপুর রুমে ঢুকলেন, তপু শার্ট পরতে পরতে বলল আবার কি এনেছো মা? পিঠা তুইতো খুব পছন্দ করিস চায়ের সাথে। এখন আর খাবো না মা, রেখে দাও পরে খাবো । তুই কি কোথাও বের হচ্ছিস নাকি? হ্যা মা, খালার বাসায় একটূ ঢু মেরে আসি । গাড়ি নিয়ে যা । ড্রাইভার আছে নীচে । নাহ মা আমি রিক্সায় যাব বাতাস খেতে খেতে । মা কিছু টাকা হবে? আনছি আমি তুই চা শেষ কর । তপু চট করে ব্যাগপ্যাক থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করলো, উর্বির জন্ন্য কিনেছে । একটা পারফিউম আর ম্যাকের দুটো লিপিষ্টিক। খালার জন্ন্য একটা ফুট ম্যাসেজার এনেছিল, কিন্তু সেটা মিসিং লাগেজে রয়ে গেছে, আর পাওয়া যাবে কিনা কে জানে? বাবার জন্য ইলেক্ট্রিক প্রেসার মেসিন, মার জন্ন্য ব্যাক ম্যাসাজারও ছিল, সবই বোধহয় গেল। আচ্ছা ঢাকাতে কিনতে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে? উর্বিকে জিজ্ঞেস করতে হবে । ও নিশ্চই জানবে । তরু ৫০০০ টাকা নিয়ে ফিরে এলেন, এই নে। এতো টাকা লাগবে না মা। আমাকে ১০০০ দাও, তাতেই হবে । সেকি বাইরে যাচ্ছিস রাখ না, লাগতেওতো পারে। তখন কই পাবি? আমি ডলার ভাঙ্গাবো মা ফেরার পথে । আচ্ছা তাও রেখেদে না ।আচ্ছা দাও । কখন ফিরবি তুই? দুপুরে খাবি না? এখনিতো দুপুর মা, আর তেহারীতো খেলাম, আবার রাতে এসে খাব । আচ্ছা খালার বাসায় কিছু খেয়ে নিস । তপু মাকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল আচ্ছা, তুমি এতো টেনশন করো নাতো ।
তপু নিচে নামতেই ড্রাইভার আর দারোয়ান ছুটে এলো, ভাইজান ভালো আছেন? গাড়ি বের করবো ভাইজান? তপু হেসে বলল হ্যা ভালো আছি । আপ্নারা ভালো? দুইজনই স্বর মিলিয়ে বলল জী ভাইজান ভালো আছি আল্লাহর ইচ্ছায়। আমি কাছেই যাবো গাড়ি লাগবে না। দারোয়ান বলল তাইলে রিক্সা ডাইকা দেই? লাগবে না। তপু কিছুদুর হেটেই রিক্সা পেলো। বনানী সিগনালে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে। তপু একটা সিগারেট ধরাবে কিন্তু সাথে লাইটার নেই। তপু বলল মামা ম্যাচ আছে? রিক্সাওয়ালা লুঙ্গির কোচের ভিতর থেকে একটা ম্যাচ বের করে দিল। তপু সিগারেট জ্বালিয়ে ম্যাচটা আবার ফিরিয়ে দিল। সামনেই লোকজনের একটা লাইন দেখা গেল, তপু বলল মামা এটা কিসের লাইন? রিক্সাওয়ালা বলল বিরিজ পার হইত হেই জন্ন্যে লাইন ধরছে, ওই পোলাপাইনের আন্দুলুন হইল না? হেইথিকা লোকজন এট্টু মানুষ অইছে। পুলিশেও রাস্তার কাডা বন্দ কইরা দিছে যাতে হাইট্টা পার না হয় তাও খবিস কতগুলান হাইট্টাই পার অয়, ব্যাদ্দপ কোনহানকার । বলেন কি তাই নাকি? জ্যা মামা । আপনি কি ব্রিজ দিয়ে পার হন মামা? আমি হারাদিন রিক্সা টানি মামা আমি কেমনে বিরিজ দিয়া পার হমু? তয় আমার পোলাপানরে কইছি যে বিরিজ দিয়া পার হবি যদি বাপের পোলাপান হস! মাইয়্যাটা বেজায় দুষ্টু ওইটা পার হয়না আমি জানি । তপু হাহা করে হেসে উঠে। নামার সময় তপুর ইচ্ছা করছে কিছু টাকা বেশি দিতে কিন্তু মামা কিছু মনে করে কিনা? তপু বুদ্ধি করে বলে মামা আমি আপনার ম্যাচটা রেখে দেই , আমার সিগারেটের নেশা উঠলে আবার কই কিনতে যাবো। আপনি এই ১০০ টাকা রাখেন, ভাড়া আর ম্যাচের দাম। রিক্সাওয়ালা তপুর মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে টাকাটা নেয়। তপু কি মনে করে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা এগিয়ে দেয়, নেন মামা আপনি খায়েন। রিক্সাওয়ালা হেসে বলে মামা আপনে সিগারেট খাওয়ার লিগা ম্যাচ নিলেন, আবার সিগারেটই আমারে দিয়া যাইতাছেন, ম্যাচও লইয়া যাইতেছেন? তপু রিক্সাওয়ালা মামার তাৎক্ষনিক বুদ্ধিমত্তায় অবাক হয়ে যায়, অরে মামা আপনেতো সেই, আচ্ছা নেন ম্যাচও আপনার হাহাহা এইবার ঠিক আছে? হ্য দেন । আপনি খুশি হয়ে দিছেন তাই নিলাম। ভালা থাকেন।
কলিংবেল চাপ দিতেই খালা দরজা খুলে দিল। ওমা তপু! কেমন আছিসরে বাবা ? ভালো আছি খালা। তুমি কেমন আছো? এইতো ভালরে । আর সবাই কই খালা? তোর খালু অফিসে, উর্বি গোসল করে, মিশু ওর রুমে পড়তেছে। তপু মিশুর রুমে নক দিল, আবার কি হইছে আম্মা? বলছি না টোকাইবা না, পড়তাছি । তপু আবারও নক করলো, মিশু রেগে এসে দরজা খুল্লো । আরে ! তপু ভাই, আসো আসো । কিরে কেমন আছিস মিশু? ভালোনা ভাই ভালোনা , আমার গজব টাইম যাইতেছে ব্রো । তপু হেসে বলল কেনরে গজব টাইম কেনো? ্ব্রো কি বলব, ইউ নো কি হইছে? না জানি না, কি হইছে ? আরে তুমি সোসাল মিডিয়া ইউজ করো না? দেখ না কি হইতেছে? তুই বলনা শুনি কি হইছে? ঢাকা ইউনির্ভাসিটিতে এগজাম দিসিলাম ব্রো, ঘ ইউনিটে টিকছিলাম ব্রো, আই অয়াজ চিলিং ব্রো । বাট ওই এগজাম বাতিল করে দিছে , প্রশ্ন আউট হইছিল তাই । বলিস কি? তাই নাকি? হু । আমি ক ইউনিটে চান্স পাই নাই, ঘ ইউনিটে পাইছিলাম , তাই সবাই বলতেছে আমিও প্রশ্ন পাইছিলাম । হা হা হা । পাইছিলি নাকি প্রশ্ন ? কাউরে বইলো না ব্রো, পাইছিলাম । কিহ? হু । কই পেলি? কে দিল? আই হ্যাভ পিপল ব্রো ! নেটওয়ার্ক ব্রো । কই পাওয়া যায় এই প্রশ্ন ? টাকা থাকলে সব পাওয়া যায় । মানে কি? তুই টাকা দিয়ে কিনেছিলি প্রশ্ন? হু। বিনে পয়সায় এইসব হয় নাকি? টাকা কই পেলি? খালা দিয়েছিল । একচুয়ালি খালা এইচ,এস,সির রেজাল্টাএর পরে মোবাইল কিনে দিতে চাইছিল , আমি টাকা দিতে বলেছিলাম । অই ১০০০০ টাকা দিয়ে কিনছিলাম । কিহ ! ১০০০০ টাকা দিয়ে তুই প্রশ্ন কিনেছিলি? হু । সাচ এ লস ব্রো । এখন রিএগজাম হবে । হাহাহা তাই নাকি? কবে এগজাম আবার? নেক্সট ফ্রাইডে । এইবার পাবি নাকি প্রশ্ন? পাবো । বাট আই হ্যাভ নো মানি ব্রো? হাহাহা । খালা একটা গ্লাস হাতে মিশুর রুমে আসলেন । এই তপু বাবা এই গাধারে পড়তে দে , ওর জন্ন্য আর মুখ দেখাতে পারতেছিনা , ভাবিরা ফোন করে জিজ্ঞেস করতেছে মিশু কি প্রশ্ন পাইছিলো? এইদিনও দেখার বাকি ছিলো আমার ! নে তুও আমের জুস খাঁ । জুস আমের? এখন আমের সিজন নাকি? নারে ফ্রিজে প্রিজার্ভ করছি ইউটিউবে দেখে । বাহ খালা তুমি ইউটিউবও দেখ নাকি? হ্যা। ওই উর্বি শিখায় দিসে, আর কুকিং চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে দিছে , দেখে নাস্তা টাস্তা বানাই আরকি ।খাইছে বলো কি খালা? খালা মিষ্টি করে একটা হাসি দিল । উর্বি মা মা করে মিশুর রুমে এসে বলল মা টাংকিতে পানি নাই আমি আধা গোসল করে বের হলাম। তপুকে দেখে কিছুটা বিব্রত হয়ে বলল আরে তপু ভাই? কখন এসেছো? এই একটু আগে । কেমন আছিস উর্বি? ভালো আছি। তুমি কেমন ছিলে? এইতো ভালোইরে । খালা বললেন এই তপু চল বাইরে বসবি, গাধাটা একটু পড়ুক ।
উর্বি বলল এই তপু ভাই একটু বসো আমি আসছি । রুমে যেয়ে সাজুগুজু করে ফিরে আসলো । আটা ময়দা মেখে আসলি? কই? এহ, আমি চুল আচড়ে আসলাম শুধু। তুমি আমার সাথে এমন করো কেন তপু ভাই? কি করলাম ? বলল্লাম তুই এমনিই সুন্দর এতো সাজার কি দরকার? সুন্দর আমি? কি যে বলো? এক ছেলেকে খুব পছন্দ হইছে বুঝছ? ফেবুতে ফোলো করি, কিন্তু পাত্তা দেই না । তপু মনে মনে হাসে উর্বি যে ছেলের কথা বলছে সেটা আসলে তপুই, অন্ন্য একটা আইডি সে খুলেছিল শুধু উর্বির উপর নজর রাখতে । কিন্তু আসল কথা এইটা না, তপুর ভালো লাগছে উর্বির নাটক দেখতে । ওই আইডি থেকে নক করার পর ওদের মেসেঞ্জারে কথা হয়। রিকুয়েষ্ট তপুই দিয়েছিল। কথায় কথায় উর্বি একদিন বলল সে তার খালাতো ভাইকে লাইক করে কিন্তু সে তাকে পাত্তা দেয় না। তপু অবশ্য ট্রাই করেছে, কিন্তু উর্বি আসলে একই কথা বলে সবসময় । একসময় শুধু দুষ্টামি করার জন্ন্য যে আইডি খুলেছিল সেই আইডিই তাকে উর্বির কাছে নিয়ে আসছে, সেটা উর্বি জানে না তাই হয়ত তপুর দিক থেকে আকর্ষনটা বেশি । আজ তোর ক্লাশ নেই উর্বি? আছে, বিকালে । খেয়ে বের হবো। আমাকে কোনো মানি এক্সচেঞ্জের সামানে নামাতে পারবি? হুম পারবো । তুমি বস আমি রেডি হয়ে আসি। এই শোন এইটা নে, কি এনেছো? উর্বি থাপা দিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে নিলো । উম, গরিব মানুষ টুকটাক যা পেরেছি তাই, এই আমার লাগেজ হারিয়েছেরে এয়ারপোর্টে। আচ্ছা আমার কিছু গিফট কিনতে হবেরে, একটু টাইম দিস। যা এনেছিলাম সবিতো গেছে। তপু ভাই একটু ওয়েট করো তুমি, লাগেজ পেয়ে যেতে পারো । কিছুদিন দেখ, তারপর নাহয় কিনো, আর আমাকেতো দিলেই আরকি? হাহাহা ।
তপুর রাতে ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হল । খেয়ে কিছুক্ষন বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে তপু রুমে এসে ঘুমিয়ে পরেছিল । ঘুম ভাঙল একটা বোটকা গন্ধে, একটা পচা গন্ধ এসে দুম করে নাকে লাগলো , তপু এপাশ অপাশ করতেই গন্ধটা আরো জোরালো হোল। তপু উঠে বসলো , বিছানা থেকে নামতেই উষ্ঠা খেয়ে টেবিলে গিয়ে বারি খেলো, ফিরে তাকাতেই দেখলো পিচ্চি এক মেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো , এই কে তুমি? আমার ঘরে এলে কোথা থেকে? মেয়েটা বলল আমি শিউলি , আমারে খালু রাখসে , রান্না ঘরে শুইছিলাম, ঐখানে অনেক ইন্দুর , আপনের রুমের দরজা খোলা ছিল তাই আইসা একটু শুয়ে পরছি । ভাইজান পানি দিব? দাও। মেয়েটা এক গ্লাস পানি এনে দিল। পানি খেয়ে তপু একটা সিগারেট ধরালো । তুমি কি কোন গন্ধ পাচ্ছ এই রুমে? নাহ পাই না, কেন কি গন্ধ পান আপনে ভাইজান? একটা পচা গন্ধ লাগছে নাকে । আমি মুইছা দেই ফ্লোর , শিউলি ফ্লোরটা মুছে দিল। হাল্কা ফুলের গন্ধে রুমটাভরে গেল। তপু বিছনায় আসতেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো।
নাশ্তার টেবিলে বসে পাভেল খবরের কাগজ পড়ছেন , তপু এসে বসলো । মা নাস্তা দাও । তরু ছেলের জন্য ছিট রুটি করেছেন, এনে সামনে দিতেই প্লেটে তুলে নিলো তপু। পাভেল খবরের কাগজ নামিয়ে রেখে বললেন, উত্তরার জায়গাটা বিক্রি করে দিতে চাচ্ছি , তুমি এসেছো ভালো হোল, ওটা তোমার নামে রাখা, তুমি আজ একটু যেয়ে দেখে আসবে আর পেপারস চেক করবে। বিক্রি করছ কেনো? ভালোইতো ছিল। তরু বললেন, তোর বাবা বসুন্ধরায় একটা জায়গা দেখেছে, সুন্দর প্লট, ওইটা নিতে চাচ্ছি। আচ্ছা তোমরা যা ভালো মনে করো। তুই একটু যা আজ বাবা, এইসব জিনিসে টাইম লাগে, আসলি আবার চলে যাবি, কাজটা হয়ে যাক। আচ্ছা আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, তুই কি চিনবি এতোদিন পর? ড্রাইভারকে নিয়ে যা। লাগবে না আমি চিনবো মা। পাভেল বললেন আচ্ছা তুমি তাহলে ড্রাইভারকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাও, আমার একটা কাজ আলামিন করে দিবে। ওকে নামিয়ে তুমি গাড়ি নিয়ে চলে যেও। আর এই প্যাকেটটা ড্রাইভারকে দিয়ে দিও। তপু প্যাকেটটা নিয়ে নিচে নেমে গেলো। নিচে নামতেই দেখলো দারোয়ান আর ডাইভার এক লোকের সাথে বেশ চিৎকার করছে। তপু সামনে যেতেই আলামিন ছুটে আসলো , স্যার গাড়ি বাইর করবো? হ্যা, আমি উত্তরা যাবো, এই প্যাকেট আপনাকে দিতে বলল বাবা আর এয়ারপোর্টে আপনাকে ড্রপ করতে বলল। আলামিন ছো মেরে প্যাকেট নিয়ে নিলো। স্যার আমি আর এয়ারপোর্ট যাবো না। আপনি গাড়ি নিয়ে যান বলেই, সে হন হন করে পিছনে চলে গেলো। তপু গাড়ি ঘুরাতে ঘুরাতে দেখলো প্যাকেটটা আলামিন ওই লোকের হাতে দিল। লোকটা কান্নায় ভেঙ্গে পরছে বার বার , আলামিন ধমক দিয়ে বলছে বশির খবরদার আর বাসায় আসবি না। কান্নাকাটি বন্ধ কর, টাকা নিয়া বিদায় হ ।
তপু গাড়ি নিয়ে কিছুদুর এগোতেই মিররে তাকাতেই দেখে পিছনে পিচ্চি মেয়েটা বসে আছে। এই তুমি গাড়িতে এলে কোথা থেকে? খালু গাড়ির সিট মুছতে বলছিল , আমি গাড়িতেই ছিলাম। তাহলে বের হলে না কেনো যখন স্টার্ট করলাম গাড়ি? ড্রাইভাররে দেইখা ডরাইছিলাম তাই। অনেকদুর চলে আসছি,আবার গাড়ি ঘোরাবো এখন? ভাইজান আমি থাকি? চুপচাপ বইসা থাকবো। তপু জিজ্ঞেস করলো কি যেনো নাম তোমার? শিউলি। আমি বলেছিলাম চিনবো কিন্তু গত দুইবছরে সব রাস্তা তো চেঞ্জড , ডানে না বামে ভুলে গেছি । ভাইজান সামনে যাইয়া ডানের গলি । তপু অবাক হয়ে শিউলির দিকে তাকাল, তুমি চিনো নাকি? শিউলি একটা বিষণ্ণ হাসি দিল। তপু গাড়ি সাইডে পার্ক করে নামল । জায়গাটা এতো সুন্দর লাগছে ! সামনেই সুন্দর ফুলের গাছ, কে লাগিয়েছে কে জানে । শিউলি গিয়ে গাছের গোরায় বসলো । এইটা কি গাছ? এইটা শিউলি গাছ । তাই নাকি? বাহ । তুমি একটু বস আমি সামনে যাচ্ছি পেপারস সাইন করতে হবে। আজকে কেউ নাই অফিসে । শিউলির কথা শুনে তপু অবাক হয়ে বলল তোমাকে কে বলল? এমনি বলছি, মনে হইল। দাড়াও দেখে আসি। তপু ঘুরে এসে বলল আসলেই কেউ নেই, কে যেনো মারা গেছে তাই অফিস বন্ধ, কিন্তু তুমি জানলে কি করে? শিউলি আবার হাসল । আমি খালার বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি, নাহয় মা চিন্তা করবে। তপু শিউলি কে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল ।
ফিরতে ফিরতে বিকাল হয়ে গেলো , শিউলিকে নামিয়ে উর্বিদের বাসায় রওনা দিল । কলবেল দিতেই উর্বি দরজা খুলে দিল। তপু ভাই তুমি দুপুরে আসবা বলে এই বিকালে আসলা? আমি না খেয়ে বসে আছি। ওমা তাই নাকি? সরি রে । সোজা খেতে বস, খুব ক্ষিধা পেয়েছে । তপু হাত ধুয়ে খেতে বসলো । আরে বলিস না, বাসার পিচ্চিটা গাড়িতে উঠে বসেছিল , অকে নিয়ে সেই উত্তরা গেলাম , আবার বাসায় দিয়ে আসলাম। পিচ্চি? কোন পিচ্চি? আরে হেল্পিং হ্যান্ড । তাই নাকি নতুন রেখেছে? আগের মত না মারলেই হয় । উর্বির কথায় তপুর খাওয়া থেমে গেল, কি বললি? মারলে? মানে? কে মারবে? এই তপু ভাই কিছু না ধুর খাও তো তুমি । তপুর মুডটা হুট করে খারাপ হয়ে গেল, হাত ধুয়ে তপু বেরিয়ে গেল ।
রাতে বাসায় ফিরে তপু নিজের রুমে ঢুকে গেলো , প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে বিছানায় যেতেই ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝরাতে আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল তপুর , বাজে একটা গন্ধ যেন শ্বাসটা আটকে দিচ্ছে । তপু ওঠে বিছানায় বসলো , নিচে তাকাতেই দেখে শিউলি বসে আছে। কিরে আজকেও ইদুর? শিউলি মাথা নাড়ালো । তপু ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলো । ফিরে আসতেই দেখলো টেবিলে এক কাপ চা রাখা আছে । তপু গিয়ে কাপটা হাতে নিলো । চুমুক দিতে দিতে দেখলো বাবার দেওয়া ডায়রির পাতায় বড় করে একটা নাম্বার লিখা। তপু নাম্বারটা ভালো করে দেখলো, কে লিখতে পারে? বাবা নাকি মা? তখন শিউলির কথা মনে হল , আরে মেয়েটা কই গেলো? তপু রুম থেকে বের হতেই দেখলো বাবা-মার রুমের দরজা খোলা, তপু রান্না ঘরে গেলো , মেয়েটা নেই । কই গেল? বাবা-মার রুমে? তপু আর ওই দিকে গেলো না, নিজের রুমে চলে গেলো। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও তপুর একফোটা ঘুম এলো না। ভোরের দিকে উঠে তপু টেবিলে বসলো , কি মনে করে তপু নাম্বারটা ডায়াল করলো, ওপাশ থেকে একজন বলল কে? হ্যালো কেডা? থানা থিকা?হ্যালো কে কইতাছেন? আলামিন ড্রাইভার? হ্যালো শিউলির কোন খবর আছে? হ্যালো? তপু সাথে সাথে বলল আপনি কে বলছেন? আমি বশির । শিউলির বাপ । শিউলি শিউলি কোথায় , ওর কি হয়েছে? আমি জানি না আমার শিউলি কই? কামে দিছিলাম বড় সাবের বাসায়, শিউলি বলে গয়না নিয়া ভাইগা গেছে । এইটুক মাইয়া কই যাইবো? ৯টা মাস হইলো কোন খোজ নাই মাইয়াটার । ওপাশে বশির অঝোরে কাদছে, এপাশে তপু স্তম্ভিত । একটু আগেইতো মেয়েটা ছিল এখানে, লোকাটা কি বলছে? তপুর মাথা কাজ করছে না। তপু রুম থেকে বের হয়ে ঝরের বেগে বাবা-মার রুমে ঢুকল । বিছানায় বাবা- মা ঘুমিয়ে আছে, আশেপাশে কোথাও নেই মেয়েটা ! তপু বারান্দাও দেখলো কিন্তু নেই, মেয়েটা নেই । তপু ফিরে আসার সময় গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে এলো । দরজাটা খুলে নিচে নেমে মাইন গেইট খুলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো, তার মাথা ঠিকমত কাজ করছে না । গাড়ি যখন থামল তখন তপু খুব ভালো বুঝতে পারলো যে সে উত্তরার প্লটের সামনে । গাড়ি থেকে নামতেই তপুর আরো খটকা লাগলো , কাল এখানে একটা গাছ ছিল, এখন নেই ওটা নেই । তপু ভালো করে দেখলো জায়গাটা । ঠিক এখানেই ছিল গতকাল শিউলি গাছটা। মেয়েটা তাই বলেছিল গাছটার নাম শিউলি। তপু পাশের প্লট থেকে একটা কোদাল নিয়ে জায়গাটা খুরতে লাগলো, বেশক্ষানিকটা খুরার পর মনে হোল কিছু একটা বাধছে , হাত দিয়ে কিছুটা পরিষ্কার করার পর একটা বস্তার মত মনে হল । ক্ষানিকটা খুলতেই তপুর বোঝার বাকি রইলো না যে এটা একটা লাশ ! তপু মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলো ।
বাসায় ফিরতেই তপু বুঝলো বাবা-মা বেশ রেগে আছেন। কোথায় গিয়েছিলি তুই? মা শিউলি বলল ব্যাথা পেয়েছে তাই একটা স্প্রে আনতে গেলাম, কোথাও পাচ্ছিলাম না, তাই দেরি হোল । কে ব্যথা পেয়েছে? শিউলি? বাবা-মা দুইজনই আগুন চোখে তাকিয়ে আছে। কি বলছিস? শিউলি কে? বাবা আরে পিচ্চিটা ওই যে তুমি রেখেছিলে। কি বলিস এই সব? মা মেয়েটা আমার রুমেইতো ছিলো এই কয়দিন রাতে । রান্না ঘরে নাকি ইদুর তাই । সকালে বেড থেকে নামতে গিয়ে ওর পায়ে পারা দিয়ে ফেললাম, বেচারি খুব ব্যথা পেয়েছে মা। এই শিউলি এই দিকে আয় । তরু রেগে বলল কি বলছিস তুই? কিসের শিউলি? কোন শিউলি নেই। তপু বলল আছে মা আছে , এখনই আসবে। না আসবে না শিউলি আসবে না । পাভেল স্ত্রিকে ধরে বললেন প্লিজ শান্ত হও । নাহ শান্ত হব না আমি । হব না শান্ত । কোন শিউলি নেই এইখানে, আমি মেরে ফেলেছি , কোন শিউলি নেই। তরু তার রুমের দিকে চলে গেল । পাভেল আর্তনাদ করে কাঁদতে লাগলো , আমি এনেছিলাম মেয়েটাকে। টুকটাক কাজ করবে , তোর মায়ের সাথে থাকবে। মেয়েটা চঞ্চল ছিল। তোর রুমে ঘুর ঘুর করত , মানা করত তোর মা, তাও যেতো। যেদিন তোর বেডে ঘুমাল, ঘুম থেকে তুলে তোর মা খুব মারলো। আমি ওকে দিয়ে আসতে চাইলাম ওর বাবার কাছে কিন্তু মেয়েটা গেল না। এটা খেয়ে ফেলছে ওটা খেয়ে ফেলছে এই নালিশ দিত ছুটা বুয়াটা তোর মার কাছে। তোর মা মাথা গরম করে মারতো মেয়েটাকে । ঘটনার দিন আমার সাথে ছিল, তোর মা গিয়েছিল বোনের বাসায়। আমি মেয়েটাকে পড়াচ্ছিলাম, মাথা ধরেছে বলতেই তেলের শিশি এনে মাথায় তেল দিচ্ছিল। আমি বললাম তোর খালা এসে দেখলে মারবে , শিউলি হেসে বলল খালা কলবেল দিলেই আমি যামুগা রান্না ঘরে খালু। তোর মা চাবি দিয়ে দরজা খুলে কখন ঢুকল টের পেলাম না। বিছানায় বসে আমার মাথায় তেল দিতে দেখে তোর মার মাথা গরম হয়ে গেলো, হেচকা টান দিয়ে নামিয়ে নিল বেড থেকে এরপর বেদম মার, আমি থামানোর আপ্রান চেষ্টা করছিলাম, শিউলির হাতের তেলের বোতল থেকে তেল পরে গেল , মেয়েটা স্লিপ খেয়ে কাচের সেন্টার টাবিলে পড়ল, সাথে সাথে সব শেষ। রক্তে ঘর ভরে গেলো । আমি নিজ হাতে মেয়েটাকে তোর বেডের নিচে রেখে আসলাম । দুইদিন এইভাবে গেলো। কি করবো কিছু বুঝলাম না। গাড়িতে করে মাঝ রাতে নিয়ে গিয়ে উত্তরার প্লটে পুতে রেখে আসলাম । থানায় ডায়রি করলাম চুরির।
তপু নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আবার সেই তিব্র গন্ধে ঘরটা ভরে গেলো। তপু টেবিলের কাছে যেতেই ডায়রিতে আরেকটি নাম্বার দেখলো । কিছু বোঝার আগেই ফোন নিয়ে নাম্বারটা ডায়াল করছে তপু। পাগলের মত ঘরের এই মাথা ওই মাথা হাটছে , রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। পাভেল দরজায় এসে ছেলেকে ডাকছেন, তপু বাবা মাথা ঠাণ্ডা কর, আয় কিছু খেয়ে নে, মাথা ঠান্ডা কর বাবা। উলটাপালটা কিছু করিস না বাবা। তপু রেগে বলল, বাবা তুমি যাও প্লিজ। তপু নাম্বারটায় রিং দিয়েই যাচ্ছে...... ওপাশ থেকে হুট করে বলল হ্যালো বনানী থানা ।