স্কুল পালিয়ে প্রথম বাংলা ছবি " কেয়ামত থেকে কেয়ামত " দেখার পর মনের মধ্যে যে কি কেয়ামত শুরু হয়েছিল, এখনো ভাবলে ভয় লাগে ।এক অন্য রকম অনুভূতি ছিল তখনকার সময় । বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল ছবিটা ।সম্ভবত এইটা নায়িকা মৌসুমীর প্রথম ছবি ছিল ।তবে প্রথম বা দ্বিতীয় এটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বেপার ছিল মৌসুমীর উপস্থিতি । তখনকার সময়ের প্রচন্ড আবেনদনময়ী এই নায়িকার CRASH খাননি এমন পুরুষ ছিল না বললেই চলে ।
আর আমি বা আমার বয়সের সবার কাছে মৌসুমী ছিল একটা ফ্যান্টাসি । যাই হোক , এই রকম ফ্যান্টাসি হয়তো সময়ের সাথে সাথে অনেক বার আসে আর চরিত্রও হয়তো বদলায় । কিন্তু জীবন এর প্রথম বার বলে হয়তো কিছু কথা থাকে । স্কুল পেরিয়ে কলজে , কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি অনেক বড় হয়ে গেলাম , এর পর চাকরি , বিয়ে , ছেলে মেয়ে , সংসার ,আট- দশ জন বাঙালির মতো ক্রেডিট কার্ড নির্ভর একটা জীবন ।
সবার জীবনের কাহিনীতেই টুইস্ট থাকে । কারো বড় ,কারো ছোট । জীবন এর এই নাটকীয় টুইস্ট গুলো নির্ভর করে আপনার উপর । মানে আপনি যত বড় মাপের মানুষ , আপনার টুইস্ট তত বড় । ধরুন আপনি বাস এ করে অফিস থেকে বাসায় আসার সময় সর্বোচ্ছ আপনার সাথে টিভির উঠতি কোনো প্রেসেন্টের বা নায়িকার সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে , কিন্তু আপনি যদি রেডিসন বা ভালো কোনো হোটেল এর দরজা দিয়ে বের হন, হয়তবা আপনার সাথে আপনার ফ্যান্টাসিতে ভোগা কোনো নায়িকার সাথে ধাক্কা লেগে যেতেও পারে ।চিন্তা করুন , সিনেমার মতো হটাৎ দমকা হওয়া আর নায়িকা মুচ্কি হেসে বললো সরি । Sorry এমনটি সিনেমাতেই হয় , বাস্তবে এমনটা হবার চান্স খুবই কম । কারণ নায়িকার গায়ে ধাক্কা খাওয়ার জন্য আপনার আগে অনেক সিরিয়াল আছে । সে যাই হোক , কবে কোথায় ধাক্কা খাবো এই ভেবে কি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো ? মোটেও না , জীবন চলতে থাকে ।
চাকরির সুবাদে একবার একটা টিভি এড বানানোর সুযোগ হয় আমার । আমি ছিলাম, ব্র্যান্ড ম্যানেজার । কাজের অংশ হিসাবেই আমাকে আমার ব্র্যান্ড এর জন্য প্রমোশনাল এড বানাতে হয় । আমার কাজটা ছিল , আমার ম্যানেজমেন্টকে প্রেসেন্টেশন এর মাদ্ধমে প্ল্যান দেয়া , কিভাবে কি করে এই নামহীন ব্রান্ডকে সুনামধন্য ব্র্যান্ড এ পরিণত করা যায় । বেপারটা এতো সহজ কিছু না । অনেক টাকার পয়সার বেপার , প্রতি মাসে প্রায় কোটি খানেক টাকার বাজেট । সেই যায় হোক, টাকা তো আর আমার না । তবে ধাক্কা একটা খাওয়ার সুযোগ আছে , এতেই আমি খুশি । ঘটা করে এজেন্সী ঠিক করা হলো, স্ক্রিপ্ট থেকে শুরু করে আরো কত কি । কিন্তু আমরা কোনো ভাবেই কোন নায়িকাকে দিয়ে এডটা বানাবো , ঠিক করতে পারছিলাম না । এজেন্সী থেকে রেফার করা অনেক নায়িকার মধ্যে থেকে এবার বেছে যাবার পালা । সাধারণত এই বেছে যাবার কাজটা ম্যানেজমেন্ট এর উওপর এর লেভেল এর বস বা MD , Charman ইনারা করে থাকেন । কিন্তু , এইবার আমার MD আর চেয়ারম্যান দায়িত্বটা আমার উপর দিলেন । আমি প্রচন্ড একটা ধাক্কা খাওয়ার আশায় আমার ছোট বেলার ফ্যান্টাসি মৌসুমীকে বেছে নিলাম আমার ব্র্যান্ড এর জন্য । আমার ব্র্যান্ড এর জন্য আমার প্রিয় নায়িকা মৌসুমী কাজ করবে , চিন্তা করতেই তো কত ভালো লাগছিলো । ধাক্কা আমার কপালে আছেই ।
প্রথম ধাক্কা
রাট প্রায় সাড়ে ১১ টা । আমি আর আমার এক কলিগ মৌসুমীর উত্তরার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে । আজকে উনাকে উনার পেমেন্ট এর চেক দেবার কথা । দীর্ঘ ৩ ঘন্টা বাইরে দাঁড়িয়ে রাখার পর মৌসুমী আসলেন । আমরা উনার ড্রয়িং রুম এ গল্প করছিলাম ।পেমেন্ট এর বেপারটা নিয়ে কথা উঠলো, আর আমি উনাকে পরের দিন চেক দেবার কথা বললাম ।অনেকটা সিনেমার স্টাইলে আমাদের সবাইকে মুহূর্তের মধ্যে পরের দিন আসতে বলা হলো । এক মুহূর্ত দেরি না করে ।
দ্বিতীয় ধাক্কা
নায়িকা মৌসুমীর ড্রাইভার, আমি নামটা ভুলে গেছি , আমাকে ফোন করে বললো, প্রতি দিন শুটিং এর জন্য এক্সট্রা ৪০০০ টাকা করে দিতে হবে উনাকে । কারণটা আরো অদ্ভুত । মৌসুমীর গাড়ির তেল কিনার টাকা এক্সট্রা দিতে হবে । আমি বেপারটা বুজলাম না ।এজেন্সী কে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম । ওরা পরিচিত একটা হাসি দিলো , যার অর্থ , এটা খুবই সাধারণ বেপার । কিন্তু আমি এক্সট্রা ৪০০০ টাকা প্রতি দিন নিজের পকেট থেকে তো দিতে পারি না । দিলাম না ।এর পর ফোন করলো ওমর সানি সাহেব । খুব সুন্দর ভাবে ড্রাইভার কে প্রতিদিন এক্সট্রা টাকাটা দিয়ে দিতে বললো । আমি কিছুই বুজতে পারছিলাম না কি হচ্ছিলো । মাত্র ৪০০০ টাকার জন্য এতো জনপ্রিয় একজন নায়ক আমাকে কেন ফোন দিচ্ছে ।
তৃতীয় ধাক্কা
BKSP তে শুটিং চলছিল । রোজার মধ্যে শুটিং এর সবার জন্য খাবার বেবস্তা করা হয়েছে । কিন্তু নায়িকা শুধু চাইনিস খায় লাঞ্চে , এটা আমাদের কারো জানা ছিল না । মৌসুমীর সেই ড্রাইভার গাজীপুর থেকে প্রায় ঢাকা পর্যন্ত গেলো চাইনিজ আনতে ।তাও এজেন্সিকে টাকায় । পরের দিন সারারাত শুটিং হলো , তেজগাঁওয়ের কোক ফ্যাক্টরি তে ।হটাৎ রাত ১২ টার সময় মৌসুমী কান্না শুরু করে দিলো । আমি বুজলাম না কি হচ্ছে । পরে ডিরেক্টর এসে আমাকে বললো , ওমর সানি হসপিটালে , তাই নায়িকার মন খারাপ । আমার মনটাও খারাপ হলো । আমি ডিরেক্টরকে বললাম শুটিং ক্যান্সেল করে দিতে । এর পর আমার ডিরেক্টর আমাকে যা বললেন তা মি লিখতে পারবো না । তবে মানে ছিল এমন, "ভাই আপনি নতুন এই লাইন এ , একটু ওয়েইট করেন , শট রেডি হোক, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে । রাত বা সকাল ২ টা, শুটিং শেষ, মৌসুমী তার ড্রাইভারকে পেছনের সিট্ এ যেতে বলে নিজে ড্রাইভিং সিট্ এ বসলো । শাড়ি পড়া অবস্থা গাড়ি স্টার্ট দিলো ।কেয় শাড়ি পরে গাড়ি চালাতে পারে আমি আগে দেখিনি । আমার বদ্দমূল ধারণা ছিল , শাড়ি এস্কেলেটর প্যাডেল এ আটকে যাবে । আমি গিয়ে উনাকে বললাম আপনি এতো রাত এ শাড়ি পড়া অবস্থা গাড়ি ড্রাইভ না করলে হয় না ? বললেন, রাত এর বেলায় উনার গাড়ি চালাতে ভালো লাগে , ঢাকার রাস্তা ফাঁকা থাকে । বুজলাম না ওমর সানি কে দেখতে না গিয়ে উনি ঢাকার রাস্তাতে ড্রাইভ দিচ্ছে । কিছুই মিললো না ।
এই রকম আরো শ খানেক ধাক্কা খেয়ে আমার ফ্যান্টাসির ইতি টানলাম আমি । শুটিং শেষ হলো ।টিভিতে এড গেলো ।এখন এই এড নিজেই দেখি ন । এই এড কেন কোনো এড , সিনেমা , নাটক কোনো কিছুতেই আর ফ্যান্টাসি আসে না ।
সাধারণ এই জীবন এর মায়ার সাদ কেন পায় না অসাধারণ মানুষ গুলো ? কাছের মানুষ গুলোর মুখের দিকে কতোক্ষন তাকান আপনি ? কেন ,সারাক্ষন কাছে থাকে বলে ? কখনো যদি দূরে যায় , তবে বুজতে পারবেন কতটা ফ্যান্টাসিতে আপনি থাকেন এই কাছের মানুষটাকে নিয়ে । সব দূরের আর না পাওয়া জিনিস গুলোই সবার চাই , একবার পেয়ে গেলে মায়া কেটে যায় । যা আছে আপনার কাছে তাকে কেন ফ্যান্টাসি করেন না ? একবার তাকান আপনার পরিবার এর দিকে । যদি বিরিক্ত লাগে তবে কিছু দিন দূরে চলে যান সব ছেড়ে , বুজবেন ফ্যান্টাসি কাকে বলে , ধাক্কা কাকে বলে । ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ৮:২৩