সেদিন ঢাবি টিএসসি’র সামনে হঠাৎ এক ভাইয়ের সাথে পরিচয়। কাপড় চোপড়ে মলিন হইলেও চেহারায় দারুণ বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। জিগাইলাম, ভাইজানের কি করা হয়? জিজ্ঞাসামাত্রই কিছুটা যেন উদাস হয়ে গেলেন, দৃষ্টি চলিয়া গেল ঊর্ধ্ব পানে; কাঁপা কাঁপা ভরাট কণ্ঠে উত্তর আসল- আমি রাজনীতি করি, একজন প্রতিষ্ঠিত বাম রাজনীতিবিদ।
শুনিয়া চমকিত হইলাম, বেশ খাসা লোক দেখা যাইতেছে!! শুধাইলাম- তো ভাই বিম্পি, আম্লীগ তো বুঝি; আপনাগো রাজনীতিটা একটু বুঝাইয়া দেন না।
নেতা বলিল- দেখুন, শুধু আমরাই মানুষের দুঃখ, কষ্ট, ব্যাথা দূর করার জন্য রাজনীতি করি।
এইবার রীতিমত টাস্কি খাইলাম, হেরা তাইলে ব্যাথাও দূর করে, তাগো রাজনীতির মইদ্যে আবার কোন কবিরাজি কারবার আছে নাকি নাকি!!
ডরে জিগাইলাম, ভাই আপনেরা ব্যথা দূর করার জইন্য কি কোন তেল বা মলম দেন??
এইবার তিনি স্মিত হাসি দিলেন, বলিলেন- আমরা মানুষের মনকে জাগ্রত করি, মনের ব্যাথাই আসল; মন ঠিক থাকলেই সব ঠিক।
তারপর আশেপাশে তাকাইয়া নিচু স্বরে বলিলেন- ধরেন, আমার কথাই বলি; একবার ইভটিজিং করিতে গিয়া ব্যাপক বিপদে পড়েছিলাম। পাবলিকে পাছায় কষিয়া লাথি দিছিল, তাহাতে কিছুই লাগে নাই কিন্তু যখন ভিক্টিম ফুলবানু তাহার জুতা খুলিয়া আমার বাম গালে বসাইয়া দিছিল; ইচ্ছা হইছিল ৭০হাত মাটির তলে ঢুইকা যাই।
এরপরে তো ভাই আমার জীবন, যৌবন সব বৃথা হইয়া গেল, সারাক্ষণ দেহ-মন ন্যাতাইয়া থাকিত। এমনই সময় সন্ধান পেলাম বাম রাজনীতির। বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া এখন আমার ব্যাথা অনেকটাই উপশমের পথে। আর এই রাজনীতি করিতে হইলে অনেক জানিতে হয়, প্রচুর পড়াশুনা করিয়া আজ আমার পড়া সোনাও খাড়া হইয়া গিয়াছে।
বলা শেষে আনমনে একটু বাঁ গালে হাত বুলাইলেন।
আর আমি হা হয়ে যাওয়া মুখখানা কোনমতে চাপিয়া বলিলাম- কস্কি মমিন!!
উনি আবার বলিতে লাগিলেন- এর চেয়েও বড় তেলেসমাতি আছে জনাব, আমাদের এক কমরেড একবার বোমার আঘাতে বাম িচি হারাইয়াছিল। কিন্তু এই বাম রাজনীতির গুণে, সে এখন পূর্ণ শক্তিতে লুলামি করিয়া যাইতেছে। ঠিকমত বাম রাজনীতি কাজে লাগাইতে পারলে, ইহা ভায়াগ্রার চাইতেও ফলদায়ক।
এইবার জিজ্ঞাসা করিলাম, তো ভাই ব্যাথা উপশম ছাড়া সমাজের প্রতি আর কোন দায়িত্ব নাই আপনাগো??
এই প্রশ্ন শুনিয়া যেন নেতার শরীরে জোশ আসিল। একটু আশেপাশে চাহিয়া গলা খাকাড়ি দিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত জনগণকে হারানো অধিকার ফিরাইয়া দেবার এবং অত্যাচারী শোষকের কালো হাত ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য মহান চে’র মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আমরা আমাদের এই মহান বিপ্লবের সূচনা করিয়াছি। আজ হইতে শত বর্ষ পরে আমাদের এই বিপ্লব সফল হইবে। এই প্রসঙ্গে ভলতেয়ার বলিয়াছেন...’ এইটুকু বলা মাত্রই কোন এক অত্যাচারীর থাবা পিছন হইতে আসিয়া তাহার গলা চাপিয়া ধরিল। প্রথমে ভাবিলাম র্যাব বুঝি, কিন্তু না; ভালোমত চাইয়া দেখি টিএসসি’র সিগারেট বিক্রেতা হাশমত।
হাশমতের রুদ্র মূর্তি দেখিয়া ভাবিলাম, নেতার ভাষণে তাহার নিপীড়িত দেহের রক্ত গরম হইয়া গিয়াছে; বিপ্লবের সূচনা এইবুঝি হইল বলে। কিন্তু না, হাশমত তাহার কলার ছাড়িল না।
গলা চাপিয়া একখানা ঝাঁকি মারিয়া বলিল- তোমার বিপ্লবের খেতা পুড়ি, আমার ৩৬০টাকা পাওনা শোধ কর আজকে। কুনু চুদুর বুদুর করবা না। লীগের মামু গো কইয়া তুমার ট্যাংগি ভাংগমু নাইলে।
কি আশ্চর্য! এইরূপ অপমানেও নেতার কোন ভাবাব্যক্তির উদয় হইলনা।
আগের মতই হাসি মুখে বলিল- হাশমত, তোমাদের লইয়া বড় বিপদ! বড়ই অধৈর্য তোমরা। আরে সুদিনের জন্য অপেক্ষা কর, তোমাদের জন্যই তো আমরা রক্ত জল করে বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছি। তখন ধনী-গরীবে কোন ভেদাভেদ থাকবেনা। তোমারও বাড়ি, গাড়ি হবে। আর এই বিপ্লবে ৩৬০টাকা দানকারী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় তোমার নামও জ্বলজ্বল করবে।
শুনিয়া হাশমত বলিল- এম্নেই ট্যাকার দুক্কে জ্বলতাসি, আর ইতিহাসে জ্বলনের ইচ্চা নাই। হুদা তাই না, ঐদিন রাইতে পার্কেও আঙ্গুরীরেও কাম শেষে ট্যাকা দেন নাই। পাইছেনডা কি আপনে??
এইবার নেতার মুখে কিঞ্চিত লজ্জার ছাপ পড়িল, আমার দিকে চাহিয়া অজুহাতের সুরে বলিল- আসলে ভাই এইটা খারাপ কিছু নহে, বিপ্লব সফল হইতে হলে সমাজের সর্বস্তরেই উঠাবসা করিতে হয়।
আমি ঢোঁক গিলিয়া বলিলাম- উঠাবসা!! নাকি শোয়া??
নেতা বলিল- ওই আর কি! শোয়ার মাঝেই উঠাবসা করা হইয়াছিল। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে বিপ্লবের আদর্শ সবার ভিতরে প্রবেশ করাইয়া দিতে হইবে। এই বলিয়া তিনি হাশমতের পশ্চাৎদেশে আড়চোখে তাকাইলেন।
এই দৃষ্টি দেখিয়া হাশমত আরও অগ্নিশর্মা হইয়া বলিল- তোমার বিপ্লবের গোয়ায় বাঁশ দিমু। আর তিন দিনের মধ্যে আমার টাকা শোধ করবা।
নেতা আবারো তাহার মধুর হাসি দিয়া বলিলেন- আচ্ছা হবে হবে। এখন এসেছিস যখন, দুটো সিগারেট দিয়ে যা। নগদ দাম পাবি। বলিয়া আমার দিকে চাইলেন।
আমি তাহার ইশারা বুঝিতে পারিলাম আর তাছাড়া লোকটাকে বেশ ভালোও লেগেছিল; কত সুন্দর জ্ঞানের আলাপ দেয়!! তাই সিগারেটের দাম দেবার জন্য একখানা শ’টাকার নোট বাহির করিলাম।
ইহা দেখিয়া নেতা বলিলেন, ‘এক কাজ করুন, তিনখানা বেনসনই দিতে বলুন; হাশমত আমাকে ২০টাকায় তিনটা সিগারেট দেয়। আর এতে গরীব ছেলেটারও উপকার হোল, আপনিও বিপ্লবের খাতায় নাম লেখালেন। উদাহরণ হিসেবে দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন, তারাও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার’।
এইরূপ অকাট্য যুক্তিতে আমিও উৎসাহ পাইয়া আর না করিলাম না।
সিগারেট নেওয়া শেষ হইলে নেতা বলিলেন, ‘আপানার সাথে পরিচিত হইয়া খুবই খুশি হইলাম। আপনি আরও একদিন সময় করে আমার কাছে আসুন। ধর্ম বিষয়েও আমি অগাধ রাখি, আপনাকে শোনাব। তবে আসার সময় আমার জন্য কাওরান বাজার হইতে একটা পোঁটলা নিয়া আইসেন, এতে মাথাটা একটু ক্লিয়ার হয়, আলোচনা করেও শান্তি পাওয়া যায়।’
কিছুক্ষণ ভাবিয়া পুনরায় বলিলেন- আসলে এসব কথা তো সবাইকে বলা যায় না, আপনাকে আপন ভাবিয়াই বলিতেছি। পোঁটলা ছাড়া বিপ্লব কখনো সফল হইবেনা। ওরা আমাকে অনেক দোষ দেয়; বলে, আমি নাকি সংগঠনের জন্য টাকা তুলিয়া তাহা দিয়া গাঁজা খাইয়াছি। আপ্সুস, তাহারা বুঝিতে পারিল না, বিপ্লবীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এই গাঁজা। যেদিন দেশের ঘরে ঘরে সবাই গাঁজা খাবে, সেদিনই বিপ্লব সফল হইবেক।
অতঃপর আমিও পোঁটলাসহিত আবারো সাক্ষাৎ করার আশ্বাসপূর্বক নেতার কাছ হইতে বিদায় লইলাম। না জানি, আরও কত অমূল্য জ্ঞান উনার কাছ হইতে লাভ করিব!! পাঠক ভাইয়েরা সাথেই থাকিবেন, আমি জ্ঞান লাভ করা মাত্রই আপনাদের উদ্দেশ্যে পোষ্ট করিব, সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন।
ইহা একটি বি.এফ.সি. পরিবেশনা