[কিছুদিন আগে অন্যত্র প্রকাশিত, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে কিঞ্চিত পরিবর্ধিত]
এই মনে করেন আপনি অনলাইনে কাজকর্মে মাঝারি থেকে বেশীরভাগ অংশই সারেন। আপনার আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবের সামাজিকতার একটা বড় অংশও ফেসবুকের কল্যাণে তেমন সমস্যার না। আর কাউকে চটজলদি পেতে হলে তো মোবাইল আছেই এক রিং দিলেই পৃথিবী হাতের মুঠোয়। আপনার মত প্রযুক্তিমনস্ক মানুষকে নিয়ে আপনার পরিচিতরাও খুশী আর আপনারো আপত্তি নেই। যাদের বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইনে পদচারণা তাদের জীবনের এক বড় অংশ দেখা যাচ্ছে অনলেইনে সংরক্ষিত হয়ে থাকছে। এই অনলাইন সংগ্রহশালার মধ্যে এমন বহু তথ্য বা ছবি বা স্মৃতি থাকে যা আপনার নিতান্তই ব্যাক্তিগত। আর সেগুলো প্রকাশ হয়ে গেলে আপনার ব্যাবসায়িক বিড়ম্বনা, বা ব্যাক্তিগত সমস্যার মুখোমুখি হবেন অথবা অন্যান্য কারণে সমস্যা হতে পারে। তাই অনলাইনে আপনার ব্যাক্তিগত তথ্যাদি যেন ব্যাক্তিগত থাকে তার জন্য কম্পিউটার নিরাপত্তা বিশারদরা দিনরাত কাজ করে যান আর ব্যাবহারকারীদেরও নিরাপদে থাকার জন্য উপদেশ দিয়ে থাকেন।
এখন আপনার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে প্রধানত দুভাবে। প্রথমত আপনার একাউন্ট যদি কেউ হ্যাক করে। এটি একটি অতি প্রচলিত ইস্যু আর এই ঝুঁকি থেকে মোটামুটিভাবে বাঁচা তেমন কঠিন কিছু না। যেই কম্পিউটার আপনি ব্যাবহার করবেন সেটি মোটামুটি ভাইরাস, স্পাইওয়ার ইত্যাদি পোকামাকড় থেকে মুক্ত রাখলে আর আন্দাজ করা মুশকিল এমন জটিল পাসওয়ার্ড ব্যাবহার করলে গড়পড়তা হ্যাকিং থেকে বাঁচা সম্ভব। ব্যাক্তিগত তথ্য বিঘ্নিত হবার দ্বিতীয় ঝুঁকি হল সরকার যদি আপনার সম্পর্কিত তথ্য আপনি যেই ওয়েবসাইট ব্যাবহার করেন তাদের থেকে চায় তাহলে। আমার জানামতে খুব কম ব্যাবহারকারীই এই বিষয়ে কখনো চিন্তা করেন বা ভেবে দেখেন কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের কাছে আমাদের ব্যাক্তিনিরাপত্তা মোটামুটি অর্থহীন।
আমেরিকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে একটি পরিচ্ছেদ যোগ করা হয় যার অর্থ মোটামুটি এই যে – একজন নাগরিক তার বাড়িতে, কার্যক্ষেত্রে, দলিলাদিতে অন্যায্য সরকারী জেরা ও যব্দের হাত থেকে নিরাপদ থাকবে যদি না আইন/বিচারবিভাগ প্রয়োজনীয় সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করে।
এই আইনের আওতায় যেকোন নাগরিকের ব্যাক্তিগত জীবনে হাত দিতে গেলেই সরকারকে প্রয়োজনীয় ওয়ারেন্ট ইস্যু করা লাগে ও তার বিপরীতে একজন সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয় ও তার ব্যাক্তিগত তথ্যাদি তদন্ত করা হয়। প্রচলিত পরিস্থিতিতে এই আইন কার্যকর হলেও অন্তর্জালীন যোগাযোগের যুগে এই আইনের হালনাগদ করার দরকার হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৮৬ সালে আমেরিকায় আরেকটি নতুন আইনের প্রবর্তন হয় যেটি ইলেক্ট্রনিক কমিউনিকেশনস প্রাইভেসী এক্ট । এই আইনের আওতায় সরকার চাইলে কোন ব্যাবহারকারীর ইমেইল তাকে না জানিয়েই এবং কোন সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু না করেই পড়তে পারবে (তবে তার জন্য মেইলের বয়স ১৮০ দিনের বেশী হওয়া লাগবে, মেইলটি গ্রাহকের আগে থেকে পড়া লাগবে আর মেইলটি সার্ভারে সংরক্ষিত হওয়া লাগবে ইত্যাদি)। আর এই আইন নিয়ে এখন আমেরিকায় প্রচুর বাদানুবাদ হচ্ছে আইএসপি, টেকনলজী প্রোভাইডার আর সরকারের মধ্যে ভাল যুদ্ধ চলছে। সরকার চায় হল সে চাইলেই যেকোন নাগরিকের যেকোন তথ্য নিতে পারে। আর টেকনলজী কোম্পানী নীতিগতভাবে চায় যে সে তার কাস্টোমারের গোপনীয়তা ও ব্যাক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করবে।
তাই কিছুদিন ধরে আমেরিকার প্রধান প্রযুক্তি কোম্পানীগুলো একত্রে একটি ফোরাম করে সরকারের কাছে আবেদন করছে যেন আমেরিকান সরকার বর্তমান সময়ের তুলনায় পিছিয়ে পড়া এই আইনটি হালনাগাদ করে। অর্থাৎ বর্তমানে একজন মানুষের অনলাইন পরিচয় তার রক্তমাংসের পরিচয়ের মতই অনেকটি বাস্তব আর সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর বিস্তারের ফলে অনেক ব্যাবহারকারীরই প্রচুর তথ্য অনলাইনে সংরক্ষণ করা হয়। একই ভাবে নিতান্ত পারিবারিক যোগাযোগ রক্ষা করা বা হালকা দাফতরিক চালাচালির বদলে বর্তমানে ইমেইলই হয়ে গেছে বহু যায়গায় যোগাযোগের একমাত্র এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম। তাই ইমেইলের গোপনীয়তার নিশ্চয়তার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। কয়েক বছর আগে চীনে এক ব্যাবহারকারীর ইমেইলের তথ্য চীনা সরকারের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয় ইয়াহু আর সেই তথ্যের ভিত্তিতে সেই মানবাধিকার কর্মীকে জেলে যাওয়া লাগে। সেই ঘটনার পরে অনলাইনে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু আমেরিকার নিজের মাটিতেই অনলাইন নিরাপত্তার বেড়াটি তেমন শক্ত না।
মাইক্রোসফট, ইয়াহু, এওএল, গুগল সহ প্রধান সেবাদানকারীদের এই আন্দোলনের ফলে যদিও আমেরিকান আইন হালনাগাদ করা হয় তবুও মনে হয় আইনের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁক রাখা হবে যেন এই আইন শুধু আমেরিকান ব্যাবহারকারীদের ওপরেই বলবৎ হয়। অর্থাৎ আমেরিকান সরকার যদি বাংলাদেশী বা ব্রাজিলিয়ান কোন নাগরিকের তথ্য ফেসবুক বা গুগলের কাছে চায় তবে দিব্যি তারা দিয়ে দেবে। যাদের জীবন মরণ অনলাইনে তারা নিজেদের অবস্থা আরেকবার চিন্তা করে দেখেন।
আর আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাজেটে কালো অপারেশনের জন্য যেই পরিমানে টাকা বরাদ্দ করা হয় তাতে মনে হয় দু-পাঁচটা বাংলাদেশ দিব্যি চরে খেতে পারবে তাই বিশ্বব্যাপী মানবতার মোড়লদের নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই।
একই সাথে একটু অস্বস্তিকর একটি খবর দেখলাম কিছুদিন আগে। প্রথম আলো রিপোর্ট করছে জননিরপত্তার স্বার্থে গোয়েন্দা বিভাগের হাত থেকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশের ফোনে আড়িপাতার দায়িত্ব। পত্রিকার ভাষ্যমতে “সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা মন্ত্রী ও সরকারদলীয় কয়েকজন নেতার মুঠোফোনে আড়ি পাতে এবং এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতনদের কাছে পাঠায়। এ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে হইচই পড়ে যায়।“ সমস্যার কথা হল, ভিআইপিদের ওপরেই যদি যখন তখন আড়িপাতা হয় (যদিও রাঘব বোয়ালরাই বড়মাপের ‘সুকর্ম’ গুলো করে থাকে) তবে সাধারণ জনগণ যাবে কই। বাস্তব প্রমাণিত সত্য যদিও এই যে মোবাইল নেটওয়ার্কের নজরদারীর কারণে গত কয়েকবছরে বেশকিছু বড়মাপের অপরাধী ধরা পড়েছে, তবুও বাংলাদেশের পুলিশ/ গোয়েন্দাদের ওপরে খুব বেশী ভরসা করতে সাহস হয়না। একই সাথে কোন নির্দিষ্ট ব্যাবহারকারীর তথ্য ‘নির্দিষ্ট ফী’ এর বিনিময়ে যে তার প্রতিপক্ষের কাছে পাচার হবেনা তারই বা নিশ্চয়তা কি, যেখানে যেকারো ওপরে নজরদারী শুরু করতে আইন বা বিচার বিভাগের কোন অনুমতির প্রয়োজন হয়না?
দুনিয়া বড়ই জটিল… একটু সাবধানে থাকবেন
ফরি
পুর্বপ্রকাশঃ
আপডেটঃ সম্প্রতি আরো কিছু ভেজাইল্যা খবর অনলাইনে ইতিউতি করছে। সব মিলায়ে লক্ষণ সুবিধার না
১। অজিদের বহুদিন ধরেই কিঞ্চিত দুর্নাম আছে ইন্টারনেটের ওপরে সর্দারি করার বিষয়ে। বর্তমানের সরকারী দল নতুন আইন প্রণয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে যার আওতায় সরকার চাইলে “খারাপ” ওয়েবসাইটে প্রবেশ সবার জন্য নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তাতে সমস্যা হল, তাহলে প্রতিটি আইএসপির প্রতিটি কর্মকান্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব সরকারের কাছে থাকবে আর তার ইচ্ছেমত ব্যাভার করতে পারবে।
২। ইওরোপের টেলিকম জায়েন্ট ওটু তাদের আয়ারল্যান্ডের গ্রাহকদের জন্য আইএমজিউআর নামের ছবি শেয়ারিং এর সাইটটি বন্ধ করে দিয়েছে। আয়ারল্যান্ডের নতুন আইনের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে এই পদক্ষেপ জানিয়েছে ওটু। যুক্তরাজ্যেও ডিজিটাল ইকনমি আইনের নয়া ভার্সন আসছে।
৩। ব্লগার নৈষাদ জানিয়েছেন ল’ফুল ইন্টারসেপশন নামে এক বস্তু আছে। যার আওতায় আইনের ভেতরে থেকেই দিব্যি জনগণের ওপরে টিকটিকিগিরি করা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১০ সকাল ৯:০৭