ছবিঃ বিভিন্ন কাজে ব্যাবহৃত ওপেন সোর্স টুলস
আজকের কথা না, এই বছরদশেক আগের কথা, বাংলাদেশে প্রথমবারের মত কম্পিউটার কেনা আর ব্যাবহার মেইনস্ট্রীম হওয়া শুরু করেছে। আজকাল জিপিএর সিস্টেমে মহাপড়ুয়াদের আলাদা করা যায়না, তখন স্ট্যান্ড করা নামে একটা ব্যাপার ছিল আর যারা স্ট্যান্ড করত তাদের মোটামুটি সবারই নামছবি রেজাল্টের মাসখানেকের মধ্যেই সব পত্রিকার স্পেসফিলার হিসেবে কাজে লাগত। এখনকার অবস্থা খুব একটা ভাল জানিনা।
সেই সময়ের কথা মনে আছে, যখন আমরা সবে স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তির চিন্তাভাবনা করছি, যেকোন বোর্ডেরই যেকোন স্ট্যান্ড করা ছাত্রকেই যখন প্রশ্ন করা হত, আগামী জীবনে কি হবার ইচ্ছা, বিজ্ঞানবিভাগের মোটামুটি সবারই একবাক্যে উত্তর হত, কম্পিউটার 'সাইন্টিস্ট' হব। পিছন ফিরে যখন এর কারণগুলো দেখতে চাই, তখন যেটুকু মনে হয়, দক্ষ কম্পিউটার পেশাজীবি হলেই বিশাল টাকার চাকুরী, বিদেশ যাবার সুনিশ্চিত সূযোগ, সামাজিক স্ট্যাটাসের একদম ওপরের দিকে একলাফে উঠে যাবার সুযোগ সর্বোপরি পাস করে বেকারত্বের ভূতের সাথে দেখা না হবার নিশ্চয়তা ইত্যাদি ছিল সারা দেশের সেরা মেধাবীদের একবাক্যে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি নিজেদের কমিটমেন্ট দেখানোর মূলমন্ত্র।
ছবিঃ ওপেনসোর্সে উইন্ডোজ এর ছায়া
তাই প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আর সরকারী বিদ্যাপীঠগুলোতে কম্পিউটারে চান্স পাওয়া মানেই কেল্লা ফতে আর সেই সুযোগেই আমার মনে হয় বাংলাদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেজরিটি টিকে গেল। বিবিএ আর কম্পিউটিং এর কোর্স না থাকলে এদ্দিনে কয়টা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান টিকে থাকত কে জানে।
তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দশকের ক্রান্তিকালে তথ্যপ্রযুক্তির মোহ মনে হয় কেমন যেন একটু মিইয়ে গেছে বাংলাদেশে। আর এই একই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশেই না, মনে হয় সারা বিশ্বেই কম্পিউটিং পড়ার জন্য দেশের সেরা মেধাবীদের লাইন ছোট থেকে ছোটই হচ্ছে আর শুধু তাই না অনেক যায়গাতেই যথেষ্ট পরিমানে ছাত্রের অভাবে কোর্স কমিয়ে আনতে বা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। তার একদিকের কারণ হল, এই খাতে একপর্যায়ের সেচুরেশন চলে এসেছে। অর্থাৎ যারা নব্বই বা দুহাজারের প্রথমদিকে আইটির ওপরে পড়াশোনা করেছিলেন আজকে তাদের দিয়েই চাহিদার অধিকাংশ পূরণ হচ্ছে আর দ্বিতীয়ত মনে হয় একটা কম্পিউটিং ডিগ্রি থাকলেই ধুমধাড়াক্কা চাকরী হয়ে যাবে তার নিশ্চয়তা আর নেই মনে হয়।
আর এই একই সময়ে প্রযুক্তি উন্নয়ন ও বিপণনের দুইধারা নিয়ে কিছুটা মনে হয় আলোচনা হওয়া উচিৎ। প্রযুক্তির উন্নয়নের (মতলব সফটওয়ার বা টেকনলজী ডেভেলাপমেন্টের ) জন্য নির্মাতারা ওপেনসোর্স বা ক্লোজড সোর্স যেকোন এপ্রোচই নিতে পারেন। যেখানে একদিকে প্রোজেক্টের সোর্স ওপেন করে দিলে সেটি সবার জন্য দৃশ্যমান, যে কেউ অরিজিনাল সোর্সকোড ডাউনলোড করে নিজের মত কম্পাইল করে নিতে পারেন আর কোডিং এ কোন খুঁত থাকলে সেটি যে কেউ ধরিয়ে দিতে পারেন। ফলে এক দিক থেকে সবখানের ডেভেলাপারদের মূল্যবান টাইমের ফ্রী এডভান্টেজ নেয়ার জন্য ওপেন সোর্স চমৎকার আইডিয়া। আর অন্যদিকে সোর্স নিজেদের মধ্যে রাখলে সাধারণত কোডের দুর্বলতা বাইরে সবার কাছে প্রকাশ পায়না, একই সাথে ডকুমেন্টেশন আর সোর্স ম্যানেজমেন্ট সাধারণত মজবুত হয়।
ছবিঃ ওয়েবসার্ভার ম্যানেজমেন্ট টুলস
আজকের বাজারে আপনি যদি একজন সাধারণ ব্যাবহারকারী হন তাহলে আপনার জন্য ওপেন সোর্স প্রোজেক্টগুলো ফাটাফাটি জিনিষ, হাজার হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হয় এরকম অসংখ্য সফটওয়ারের সমমানের চমৎকার সব সফটওয়ার পাওয়া যায় যেকোন প্ল্যাটফর্মের জন্য বিনামূল্যে এবং প্রায় একই ক্ষমতার এমনকি কখনো আরো বেশী সুবিধাসমৃদ্ধ। আর ব্যাবহারবান্ধব অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে লিনাক্স তো গত এক দশকে অনেক এগিয়ে এসেছে। এখন অনেক পুরনো ব্যাবহারকারীও উইন্ডোজের মত হেভীওয়েট ছেড়ে উবুন্টু বা ফেডোরা ব্যাবহার করেন।
কিন্তু সমস্যা হল আপনি যদি ওপেনসোর্স ডেভেলাপমেন্টের সাথে যুক্ত থাকেন, আর দিব্যি কপালজোরে আপনার কোনার রুমে বসে বসে যেই কোড লেখা শুরু করেছিলেন সেটি জনপ্রিয় হয়ে মোটামুটি হিট করে যায়। ফলে আপনাকে জনাপাঁচেক ফুলটাইম ডেভেলাপারের দরকার হয় আর ডেভেলাপিং কমিউনিটি দিব্যি হাত বাড়িয়ে দেয় আপনার সাথে। তখন ওপেনসোর্স কোড চিপে পয়সা বের করা তেমন সুখকর বিষয় না।
কারণ যদি আপনি সফটওয়ারের জন্য টাকা চান, তাহলে সেটি হবে হাস্যকর। কারণ সেটির জন্য কোড আপনি আগেই উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, যে কেউ কম্পাইল করে নিলেই হল। দি আইডিয়া ঠিক করলেন সফটওয়ার যারা কিনবে তারা টেক সাপোর্ট নিবে আপনার থেকে, এইখানেও কিঞ্চিৎ ভ্যাজাল আছে, দেখা গেল রাস্তাঘাটের ডেভেলাপাররা, (মতলব আপনার কোম্পানীর বাইরের) দিব্যি সাপোর্ট দিচ্ছে ক্লায়েন্টদের আপনার বদলেই। আর দ্বিতীয় বিষয় হল, ওপেন সোর্স কোড বেশ শক্তপোক্ত হয়, তাই তেমন ঝুটঝামেলা করেনা যে রোজ টেকসাপোর্ট ডাকবে। কিছু পয়সা আসতে পারে ট্রেনিং সার্টিফিকেশন ইত্যাদি থেকে। আর আপগ্রেড ইত্যাদি তাও ফ্রীই থাকছে। কারণ সেই আগের মতই সোর্স ওপেন। আরেক বুদ্ধি হল, আপনার সফটওয়ারের সাথে কিঞ্চিৎ বিজ্ঞাপন ইত্যাদি ঢুকিয়ে দিলেন কিন্তু তাতে দেখবেন ক্লায়েন্ট নাখোশ আর আপনার প্রিয় ডেভেলাপাররা দিব্যি বিজ্ঞাপনফ্রী একটা কম্পাইলেশন করে জনগণের মধ্যে সুন্দর ছড়িয়ে দেবে।
ছবিঃ ওপেনসোর্স কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম
এখন সবদিক থেকে হিসেব করলে ব্যাবহারকারীর জন্য ওপেন সোর্স চমৎকার জিনিষ, কিন্তু আপনি কম্পিউটার পেশাজীবি হিসেবে, ওপেনসোর্স ডেভেলাপমেন্টকে যদি বেছে নিতে চান, তাহলে হাইফাই বাড়িগাড়ী করার তেমন কোন রাস্তা দেখছি না। বিদেশের বেশীরভাগ ওপেনসোর্স প্রোজেক্টই মনে হয়, ডোনেশন আর ফান্ডিং এর ওপর নির্ভর করে মূল খরচটুকু চালিয়ে নেয়, আর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া কোন ওপেন সোর্স প্রোজেক্টের নাম এখন পর্যন্ত মনে করতে পারছি না।
এই লম্বা লেখা পড়ার মত যদি কারো ধৈর্য্য থাকে তাহলে এতোক্ষণে আমার বিরুদ্ধে একগাদা যুক্তি তৈরি করে ফেলার কথা। কিন্তু বিশেষ করে আমার প্রিয় প্রায় সব প্রযুক্তিবিদই ওপেনসোর্সের এডভোকেট। ওপেনসোর্স নিয়ে এই বিশাল বিতর্কের গোড়াতে আমি না, এই নিয়ে এক ভেজাইল্যা আর্টিকেল কদিন আগে পড়লাম স্টুয়ার্ট কোহেনের। স্টুয়ার্ট এখন আছেন কোলাবরেটিভ সফটয়ার ইনিশিয়েটিভের সিইও হিসেবে আর তার আগে বহুদিন কাজ করেছেন ওপেন সোর্স ডেভেলাপমেন্ট ল্যাবস এর সিইও হিসেবে। ওপেন সোর্সের ব্যাবসায়ীক দিক সম্পর্কে অত্যান্ত অভিজ্ঞ এই প্রবীণ বোদ্ধার এই মহা 'বিতর্কিত' প্রবন্ধ নিয়ে প্রযুক্তিমহলে বেশ হইচই চলছে। কিন্তু আমার এক দিক থেকে ওনার যুক্তিগুলো খারাপ লাগেনি।
Open Source: The Model Is Broken
মাইক্রো সাইজের ড্যামস্মল লিনাক্সের জনক লিখেছেন ওপেন সোর্স থেকে কিভাবে সারভাইভ করতে হয়।
http://damnsmalllinux.org/income-guide/
বিভিন্ন কাজে ব্যাবহৃত ওপেন সোর্স সফটওয়ারের তালিকা