আমার কলেজ জীবনের একটি ছোট্ট ঘটনা আপনাদের জানানোর ইচ্ছে পোষণ করছি। যে ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে, আমাকে আরো ভাবতে ও জানতে বাধ্য করেছে।
৯৫ সালে চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুল থেকে পাস করা একপাল ভর্তি হলাম চট্টগাম কলেজে। সবাই সায়েন্স থেকে পাস করা, একমাত্র শাকিল ছাড়া বাকি সবাই কলেজের সায়েন্স গ্রুপে গেলাম। শাকিল গেল আর্টস গ্রুপে।
কলেজের প্রথম দিনে ভর্তির যাবতীয় ফর্মালিটিজ সেরে আমরা পাবলিক স্কুল গ্রুপ সামনের ক্যাম্পাসের গাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, আকাংখিত একটি দিন- কিছু আকাংখিত মুহুর্ত, এখন আর স্কুল স্টুডেন্ট নই- কলেজ স্টুডেন্ট। ঠিক তখনিই একজন এসে বলল বড়ভাই ডাকছেন আপনাদের। গেলাম দু তিনজন বড়ভাইয়ের কাছে। তিনি বললেন গাছের নিচে ওভাবে আড্ডা মারা যাবেনা। শাকিল মৃদু প্রতিবাদ করেছিল সাথে সাথে, বলেছিলো- আমরাতো কিছু করছিনা, শুধুই আড্ডা দিচ্ছি।
এভাবে কলেজ লাইফের শুরুতেই ধাক্কা খেলাম, পদে পদে শিবিরের বাড়াবাড়ি। উপায় নেই বলে মেনে নিলাম তাদের বাড়াবাড়িকে। সব সেকশনে থাকত নতুন শিবির সদস্যরা। তারা আবার প্রতিনিয়ত দাওয়াতে আসত আর ক্লাসের সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যপারে গোপন রিপোর্ট করত। নিজেকে খুব অসহায় লাগত আমারই ঐসব ক্লাসমেটদের সামনে।
শাকিল আর্টস গ্রুপে যাওয়ায় তার অনেক মেয়ে বন্ধু, আর্টস গ্রুপের ৯০ ভাগই ছিল মেয়ে। শাকিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও পরিপাটি ছেলে। সবসময় ওয়াকম্যানে ইংলিশ গান শুনত।
শিবিরের আয়োজনে নবীন বরন উতসব, আসবে পাঞ্জেরী গ্রুপ, শোনানো হবে হামদ-নাত, ইসলামী সংগীত। তাই আমরা ভাবলাম প্রোগ্রাম না দেখে বরং ঐ সময়টা ফয়'স লেকে বা অন্য কোথাও যাব। সবাই রেডী কিনতু হঠাত শাকিল উধাও, অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য, ভাবছিলাম হয়তো টয়লেটে। তারপরই একজন দৌড়ে এসে জানাল যে, কয়েকজন শাকিলকে শেরেবাংলা হলে ধরে নিয়ে গিয়েছে। আমরা বুঝতে পারলাম কি হতে চলছে। সাথে সাথেই ফোন দিলাম বন্ধু রনিকে। তার বাবা পুলিশ অফিসার। কিন্তু না তার বাবা অন্য জেলায় জরুরী কাজে। অগত্যা কোন উপায় না পেয়ে গেলাম শিবিরের এক বড় ভাইয়ের কাছে। অনুনয় করলাম, তিনি বল্লেন 'দেখছি আমি'। আমরা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি সেই ৩ তলার রুমের পর্দা ফেলানো জানালার দিকে। কিছুক্ষন পর বড় ভাই আসলেন এবং বললেন 'তার বিরুদ্ধে কিছু ডিসিপ্লিনারী অভিযোগ আছে সম্ভবত। তাই তার বন্ধুরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, তোমরা অপেক্ষা কর। সে চলে আসবে। তিনি চলে গেলেন তার কাজে। বুঝতে পারলাম কি হচ্ছে। পাঞ্জেরীর ইসলামী সংগীত শুনতে পাচ্ছিলাম কিন্তু শুনতে পাচ্ছিলামনা আমার বন্ধুর চিতকার। একসময় সে বেরিয়ে আসল, কলেজের ইউনিফর্ম সাদা শার্ট ছেড়া, চুল আলুথালু, চোখ, নাক, মুখ ফুলে লাল। বেরিয়ে এসে শুধু বল্ল আমাকে একটা বেবীট্যাক্সি যোগাড় করে দে, বাসায় যাব, খুব ক্লান্ত। লজ্জায়,ক্ষোভে,দুঃখে সে সেদিন কিছুই বলতে পারেনি। পরে শুনেছি তাকে জেরা করেছে বড় ভাইরা কিন্তু মেরেছে তারই ক্লাসমেটরা ...ইচ্ছেমত। ব্যাগ খুজে পেয়েছিল কইয়েকটি ইংলিশ গানের ক্যাসেট। ওয়াকম্যান আর ক্যাসেটগুলো পাড়িয়ে ভেংগে তারপর ফেরত দিয়েছে। আরো বলেছে এরপর থেকে যদি আর কোন মেয়ের সাথে তাকে দেখে তাহলে তার কপালে দুঃখ আছে। তারা কৌতুক করে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল কোন মেয়েটাকে সে বিয়ে করতে চায়, এত মেয়ে বন্ধু কেন, কয়টা বিয়ে সে করতে চায় ইত্যাদি। আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই এ কারনে যে সেদিন আমার বন্ধু শাকিল ফেরত এসেছিল, অনেকে ফেরত আসেনি।
(বিঃ দ্রঃ নিপুপাওয়ারফুলের ০৪ ঠা জানুয়ারির একটা পোস্টে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেদিন যদি আমার বন্ধু মরে যেত সেকি শহীদ হত? উত্তর পাইনি। )
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ১:২৪