কিষাণীর স্মৃতি থেকে-১৭
আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু
আমারে দেবোনা ভুলিতে
আমি বাতাস হইয়া জড়াইবো কেশ
বেণী যাবে যবে খুলিতে.....
কিষাণী মুখ ফিরিয়ে নিল, আর কৃষক সেই যে চলে গেল, আর কখনো ফিরে এলোনা!!!!!!
কৃষক বিহীন ক্যাম্পাসে আমি কিষাণী ঠিকই পার করলাম আরো তিনটা বছর, একা একা, দুঃসহ স্মৃতির বোঝা বুকে নিয়ে। কেন নয়, অভিনয় তো ততদিনে ভালোই শিখেছিলাম। দিব্বি স্বভাবিক হয়ে জীবনযাপন করেছি।অবশ্য কেউ কখনো ভুল করেও আমার সামনে এ বিষয়টা তুলতো না। তবে আড়ালে তো এটা ছিল ক্যাম্পাসের হট কেক। শুধু একবার সার্ভেয়িং করার জন্য মধুপুরে আমাদের একটা ট্যুর হয়, সেখানে যখন সবাই হৈ চৈ করছি, আনন্দ করছি। এমন সময় আমাদের এক বন্ধু যে কৃষকের খুব কাছের ছিল, নেশার সঙ্গী ছিল........আমাকে জেরা করেছিল.......একটা পাহাড়কে তুমি এক ধাক্কায় ভেঙ্গে ফেলতে পারো?.....নাকি পারা যায়? চারদিকে সবাই আছে সবার সামনে এ প্রশ্ন। আমি অনেক তর্ক করেছিলাম .... আমারটাই ঠিক, এটা প্রমাণ করানোর চেষ্টা করেছিলাম।
সে বছর পরীক্ষা দেয়া নিয়ে অনেক অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, কি যে সংগ্রাম আর ধকল গেছে, সে শুধু আমি জানি............একেবারে ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়াবার মত করে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম।
আমার কাছের বন্ধুরা ও হয়তো আমাকে কাঁদতে দেখেনি আর কখনো। তবে নির্ঘুম রাতগুলোতে আকাশের ঐ তারা গুলো জানে কত কত রাত আমি চোখের পানিতে ভেসেছি। উদাস দুপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনের কোকিলটা যখন ডেকে ডেকে অস্থির হয়ে যেত, তখন কি যে কষ্ট!!!!!!প্রতিটা সন্ধ্যা কি অসহনীয় ছিল আমার জন্য!! আমার আপন দুঃখ, আপন আনন্দ একান্তই আমার হয়ে ছিল। মনে মনে কত উনমুখ হয়ে থাকতাম একটা ভালো কোন খবর যদি পাই। ভুলে থাকার অভিনয় করা যায়, ভুলে যাওয়া কি যায়? অনেকদিন পর আমাদের এক ঘনিষ্ট বান্ধবীর কি একটা ট্যুর ছিল, সেটা কৃষকের বাড়ী যেখানে, সেখানে হবে। আমি একবারও তাকে বলিনি কৃষকের খবর নিও। ও ফিরে এসে বলল, কৃষকের বাড়ী গিয়েছিলাম। বললাম কেমন আছে? ও বলল, দেখলাম কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেমন মনে হল, সুস্থ? ও বলল তাইতো মনে হল, তবে পুরোটা হয়তো না। কৃষক সেই বান্ধবীকে একবারও আমার কথা জিজ্ঞেস করেনি।
ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবার পর ওটাই ছিল দুর থেকে পাওয়া কৃষক সম্পর্কে আমার শেষ তথ্য। কৃষক ক্যাম্পাসে আর কখনো আসেনি। অথচ আমি ঠিকই থাকতে পেরেছিলাম, থাকতে হয়েছিল। মেয়েরা মনে হয অনেক কিছু পারে। যে মেয়েটা ভালবাসার মানুষটার সাথে সামান্য অভিমানে বুক ভাসিয়ে কাঁদে, সে মেয়েটাই আবার মা হবার মত, সন্তান লালন করবার মত কষ্ট অবলীলায় হাসিমুখে সহ্য করে। সেজন্য বুকের সব কথা কোন অতলে গোপন সিন্দুকে ভরে রেখে, আমি আবার চলেছি সেই ক্যস্পাসে। কষ্ট যে হত সেটা বলার অপো রাখে না। তার অনুপস্থিতি, সব জায়গায় সেই দিনগুলোর স্মৃতি ছাড়াও বাস্তব কষ্ট হল একা একদম একা পড়াশোনা করা, যেটা ভুলেই গেছিলাম। মনে হত যেন জীবন যুদ্ধ করছি। যে ক্যাম্পাসের প্রতিটা জায়গায় আমাদের পদচারনা ছিল.....কত কত দিন সে জায়গাগুলোতে যাওয়া হয় না। কত পূর্ণিমা আসে কত বসন্ত আসে আবার চলেও যায়..........খবর ও রাখা হয না। দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করে চলতে তখন অভ্যস্থ হয়ে গেছি।
দিন পেরিয়ে যায়.... বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সাঙ্গ হয়। আমার কর্মজীবন এবং সংসারজীবন দৃটোই প্রায় একই সাথে শুরু হয়। এর মাঝে কিষাণী একটি সন্তানের গর্বিত মা হয়েছে।
অতীতের স্মৃতিচারন প্রায় শেষ। ২০০৮ সালের মার্চ মাসের মত হবে। ফেসবুকে কিষাণীর একটি প্রোফাইল আছে। সেখানে আকাশ নামে একজন এড রিকোয়েষ্ট দিয়ে জানালো সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। আমি এড করলাম। বললাম কোন ফ্যাকাল্টি তুমি? বলল অমুক ফ্যাকাল্টি। ভাল কথা ঐ ফ্যাকাল্টির আকাশ নামে আমি কাউকে চিনি না। তবে যেহেতু আমরা মোটামুটি আমাদের প্রেম ঘটিত কারনে বিখ্যাত ছিলাম তাই আমাকে অনেকেই চিনতে পারে ভেবে আর কিছু বললাম না। ঐ ফ্যাকাল্টির অন্য যারা আছে তাদের খোঁজ খবর দিলাম, কে কোথায় আছে। ঐ বন্ধুটি মাঝে মাঝে মেসেজ পাঠায়...অমুক কোথায় আছে জানতে চায়। একদিন আমাদের এক বান্ধবী আমরা ডাকতাম পিচ্চি অমুক ....তার কথা জিজ্ঞেস করলো, পিচ্চি অমুক কই আছে। আমি অবাক! পিচ্চি কে যে পিচ্চি বলে ডাকা হয় এটা খুব ঘনিষ্ট সার্কেল ছাড়া কেউ জানবার কথা না। আমি বললাম, তোমার ছবি দাও না কেন? আমার ই মেইলে ছবি দিও। কোন কথা বলে না। অন্য বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি আকাশ নামে কাউকে চিনিস, ওরাও চেনেনা।
একদিন বলে তোমার তো বিয়ে হয়েছে অনেকদিন বাচ্চা এত ছোট কেন? আর তোমার হাসবেন্ড কোথায় আছে?
এ প্রসঙ্গে বলি, কিষাণীর যার সাথে গাটছড়া বাঁধা হল তিনি ছিলেন চুপচাপ, শান্ত, এবং অত্যন্ত রনশীল। তখন মনে হয়েছিল এই ভাল, বেশী উদার হতে যেয়ে আবার কৃষকের মত সীমা ছাড়িয়ে যাবে । ঘর সংসার কিছুদিন ভালোই কাটলো তবে মনের মিল হলেও মতের মিল হয়নি আমাদের। ...আগেই বলেছিলাম আমি ক্যারিয়ার পাগল মেয়ে....ক্যারিয়ারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন স্বামী....... নানা টানা পোড়েনে সংসার টেকেনি কিষাণীর। দশ বছরের সংসারের গল্পটির সংপ্তি রূপ এরকম, কালপুরুষ দাদার মতে এটা আরেকটা উপন্যাস...তাই এটা এখানেই শেষ। কিষাণী এখন সন্তানকে নিয়ে সুখে আছে, কেউ যেন তাকে আবার দুঃখী ভাববেন না!!!!
ফেসবুকের সেই বন্ধুকে বললাম....আমার প্রোফাইল টা খেয়াল কর নাই, ওখানে লেখা আছে সিঙ্গেল। সে বলল ..সরি আমি খেয়াল করি নাই।
ফেসবুকে আমার সাথে কথা হবার পর কৃষক একটা পোষ্ট দিয়েছিল, কেউ কেউ সেটা পড়েছে। এটা থাকলে সবাই আমাদের শেষটা জেনে যেত, তাই পোষ্টটা কৃষককে ড্রাফট করে ফেলতে বলি। আজ আবার রিপোষ্ট করে দিব। Click This Link
একদিন মেসেজ দেয়, ফেসবুকে তোমার ছবিগুলো দেখলাম, একজনকে চিনলাম......উনি তোমার দুলাভাই। আজব তো আমার দুলাভাইকে আমার ঘনিষ্ট বন্ধুরা ছাড়া কেমনে চিনবে!!!! এটা তাকে বললাম। তুমি তো আমার অনেক কিছু চিনো, আমি তোমাকে চিনতে পারছি না কেন। তুমি অবশ্যই তোমার ছবি দিবা। সে ছবি দেয় না। মাঝে মাঝে মেসেজ দেয়....আমি কোন উত্তর দেই না। ছবি না দিলে কারো সাথে কোন কথা নাই, কে না কে!!!!! আমার মাথায় একবারও আসে নাই যে এটা কৃষক হতে পারে!!!!!!
এর প্রায় মাসখানেক পর কৃষক আমাকে মেইল করে ....আমি কৃষক। আমি তো অবাক। এত এত বছর পর! আমি মেইল করলাম ..সত্যি তুমি? উত্তর এল হ্যাঁ আমি। তখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি ফেসবুকে আকাশ নামে আমাকে এড করেছিলা? বলল হ্যাঁ আমি। আমি বলি, অন্য নামে এড করেছো কেন? বলে কি জানি ভাবলাম আমার নাম দেখলে যদি এড না কর। কথা বলবো না কেন???? ও বলে, তখন এমনই মনে হয়েছিল, এখন বুঝতে পারছি কথা বলতা!!!আমার সেল ফোন নম্বর চাইল, দিলাম মেইল করে, তারটাও দিল।
অথচ আমি ওর নাম দিয়ে ফেসবুকে অনেক সার্চ করেছি, পাইনি । পাবো কিভাবে তার প্রোফাইল সব ছদ্মনামে। এর পর থেকে কৃষক এই পর্বটা শুরু করে। যখন আমি জানতাম না এটা কৃষক, তখন সে আমাকে ব্লগের একটা লিংক দিয়েছিল আমি খুলেও দেখিনি। এরপর আবার শুরু হল কৃষকের সাথে নতুন করে যোগাযোগ।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১১:৫২