কিষাণীর স্মৃতি থকে- ১৫
হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে হলে ফিরে এল। ভাল হয়ে যাবার আপ্রান চেষ্টা, এন্টিড্রাগস গুলোর প্রতিক্রিয়া কম ছিল না। ঘুমঘুম ভাব লেগে থাকতো। হয়তো ওর আরো কোন কষ্টও হতে পারে আমার জানা নেই। কিছুদিন ভালো চলল। শহরের ডাক্তারের কাছে ফলোআপের জন্য যেতাম, দুজন একসাথে। একসময় বলল অষুধগুলো খেতে কষ্ট হচ্ছে, তা ছাড়া এখন তো সে বেশ ভালো, অষুধের ডোজ কমিয়ে আনা যায় কিনা। আমাকে স্বাক্ষী করে ডাক্তারের কাছ থেকে অষুধের ডোজ কমিয়ে আনলো, আমি ভাবলাম অমানিষার অন্ধকার এই কাটলো বলে। তখনকার ডাক্তার কোন কাউন্সিলিং নেই শুধু অষুধ দিয়েছিল! কিন্তু সব হিসাব যদি এত সহজ হত তাহলে তো কথাই ছিল না। অষুধের ডোজ একদিকে কমলো আর একদিকে ওটা বাড়লো। আমাকে হলে পৌঁছে দিয়ে তার নিজের হলে যাবার কথা, ঘন্টাখানেক পর আমার হলের বারান্দা থেকে দেখি, ওমা তিনি সেইসব বন্ধুদের সাথে রিকশা করে শহর থেকে ফিরছেন; একেবারে পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে অবস্থা। তারপর একরাশ মিথ্যার ফুলঝুরি, ঝগড়া, মিথ্যা প্রতিজ্ঞা..........।
দুঃসময় যখন আসে তখন একা আসে না। এটাই তখন শুধু মনে হত। এই কষ্টের সাথে দুজন দু ক্লাশে থাকাটা যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। আমরা তারপরও দুজনের যখন ক্লাশ থাকতো না তখন একসাথে পড়তাম, আলাদা আলাদা পড়া.......ওর তাতেও কষ্ট হত। বেশীর ভাগ সময় ও পড়তো আমি ওর সাথে বসে থাকতাম। আমি আমার পড়া পড়তে গেলে তার অভিমান হত, সারা মুখ আষাঢ়ের কালো মেঘে ছেয়ে থাকতো। একদিকে তার শারিরীক মানসিক টানাপোড়েন, আমি সব সময় তার মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করি যাতে কোনভাবে মনে কষ্ট না পায়। এতে আরো খারাপ হল, কৃষকের আবদার আরো একটু বাড়লো। এটা কে আবদার না বলি, হয়তো তার মনে কিষাণী কে হারাবার ভয় কাজ করছিল, তাই সে কিভাবে কিষাণীকে কাছে রাখা যায় সে পরিকল্পনা করতে ব্যাস্ত। কিষাণী যে তার কাছ থেকে একটা সুস্থ স্বভাবিক জীবন পেলেই বর্তে যায় এই সহজ হিসেব টা তার মাথায় এলনা। সে ঘুর পথে আরো পরিকল্পনা করে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুললো।
পরিকল্পনাটা ছিল এরকম: হাইপোথিসিস হল, যেহেতু সে এখন জুনিয়র তাই আমি তাকে সময় কম দিব এবং এক সময় তাকে ছেড়ে চলে যাব। কাজেই একশন হল.... আমাকেও তার মত ইয়ার লস দিতে হবে!!!!!!!! কোন একসময়, যখন সুসময় ছিল এরকম কথা আমি ওকে বলেছিলাম, দেখো আমরা তো ক্লাশমেট, আবার জুনিয়র হয়ে যেওনা তাইলে কিন্তু আমি নাই! এ কথাকে ভিত্তি করে সে আমাকে ফান্দে ফেলার চেষ্টা করলো, অথবা হয়তো সত্যিই ভয় পেত। আমি বলেছিলাম , ঠিকমত পড়, যাতে এবার পাশ করতে পারো, নাহলে আবারো ফেল করবে। আর সুস্থ হও। আমাকে টেনে নামাচ্ছো কেন? কে শোনে কার কথা।কৃষক সারান এই এক কথা জপতে লাগলো কানের কাছে।
ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমার পরিবার অনেক অনেক বেশী স্বাধীনতা আমাকে দিয়েছেন।সেই স্বাধীনতা আমার উপর খানিকটা দায়িত্ববোধ ও চাপিয়ে দেয়। যাতে আমি যা খুশি তাই করতে পারিনা। নিজের ভালোমন্দ টুকু বুঝে চলতে পারি।আমার উপর তোমার যতখানি অধিকার আমার বাবা মায়ের তার থেকে কোন অংশে কম না। আমি কোন প্রানে সেধে তাদের কষ্ট দিতে যাব? আমাকে পড়াতে তো আমার বাবার কষ্টে অর্জিত টাকা খরচ হয়। এটা তুমি তোমার বাবা মার জন্য উপলদ্ধি কর তো নাইই, উল্টা আমাকে একটা ভুল কাজ করতে বলছো। আর আমার রেজাল্ট ভালো, হঠাৎ করে আমি ফেল করি কিভাবে, এগুলা কি বল? চাইলেও তো ফেল করতে পারবো না! সে আমার মূল কথাগুলো কিছুই মন দিয়ে শুনলো না। বরং কিভাবে ইয়ার লস দেয়া যায় তার নানা পন্থা আবিস্কার করতে লাগলো। আমি বেশী কিছু বললে আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল তো আছেই। তাই আমি পড়লাম একদম শাখের করাতের মধ্যে। শাখের করাত যে কি সেটা তখন হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
ক্লাশ করতে পারতাম না, করলে মুখ ভারী। তাকে নাকি পড়াতে হেল্প করিনা। ক্লাশ লাটে উঠলো, বান্ধবীরা হায় হায় করতে লাগলো। এদিকে তার গোপন অভিসন্ধি কাউকে বলাই যাবে না। আমি জানি এটা অসম্ভব তারপরও তার মতন করেই চলতে লাগলাম, ক্লাশ করতাম না। তবু যদি সে একটু পড়ে। আমাদের ক্লাশ উপস্থিতি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার ছিল, না হলে সেশনাল এ নম্ব র দিবে না। এরপর যখন পিরিওডিক্যাল পরীক্ষা শুরু হল আমি পরীক্ষা দিচ্ছি, তার মাথা গরম। ঝগড়া,রাগারাগি। কিছু পরীক্ষা দিতে পারলাম, কিছু বাদ গেল। একটা পরীক্ষা সময় সূর্যগ্রহন ছিল, ব্যাস শুরু হল তার কথা, সূর্যগ্রহন এ বের হবা না, এই হবে, সেই হবে, মূল কথা পরীক্ষা দিবা না। সে পরীক্ষা দিতেই পারলাম না। বিরাট ঝামেলা, একূল রাখি না ওকূল রাখি। আমার অবস্থা ও সঙ্গীন হতে থাকলো, এ রকম চলতে থাকলে আসলেই ফেল করতে হবে।
এরই মধ্যে আমি আর একখানা মাতব্বরী করলাম। কৃষক আমাকে বোঝাতো যে সে প্রায় সুস্থ। অথচ ওর বাবা মা নাকি এটা বিশ্বাস করেন না। আমি তখনো তাকে বিশ্বাস করি, নিয়মিত অষুধ কিনতো, খেত, কাজেই নিশ্চয়ই ঠিক পথেই আছে। আমি ওর বাবাকে একখানা পত্র লিখলাম (কি বুঝে লিখেছিলাম আল্লাহ জানে!), যে কৃষক তো এখন ভালো ....ইত্যাদি। ওর বাবা অসম্ভব ভালো একজন মানুষ, উনি আমাকে অনেক আদর মাখা একটা উত্তর দিয়েছিলেন। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল তুমি কিভাবে এত নিশ্চিত যে কুষক সুস্থ? আমার তো আক্কেল গুড়ম, তাইতো! আমি তো শুধু ওর কথায় বিশ্বাস করেছি। এরপর আমার চোখের ভালোবাসায় অন্ধ থাকাজনিত পর্দাটা চলে গেল। দিব্য দৃষ্টিতে দেখলাম আমি যা বলেছি তা ভুল। বড় একখানা ধরা খাইলাম। এই চিঠি লেখার কথাটা কৃষকও জানতো না, এইপর্ব লেখা শুরু হবার পর কিছুদিন আগে তাকে বললাম।
এদিকে তার অবস্থার কোন উন্নতি নাই। মলিনতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে।একজন মাদকাসক্ত মানুষের যা কিছু সমস্যা থাকে সবই প্রকট হয়ে দেখা দিল। বাড়ী থেকে টাকা পাঠানোর সাথে সাথে তা দিয়ে দেনা পরিশোধ। সারা মাস ক্যাম্পাসের যাকে পেত তার কাছেই টাকা ধার করা। শরীর য়ে আসতে লাগলো, চোখের নীচে কালি, কথা বলতে গেলে মুখ শুকিয়ে আসতো। পোশাক আগের চেয়েও অবিন্যস্ত। মাঝে মাঝে জোর করে হল থেকে কাপড় আনিয়ে ধুয়ে দিতাম। হয়তো বলা হল সেভ কর নাই কেন, বলতো টাকা নাই। যদিও জানি এটাকা দিয়ে আসলে কি হবে। নিপুন অভিনয়, অবিরত মিথ্যা বলা.... সবই চলতো। তখন ব্যাপারটা এভাবে দেখিনি, এখন যেটা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে তখন সেটাকে অন্যায় মনে হত। মনে হত মিথ্যা কেন বলে, যার তার কাছে টাকা কেন ধার করে? এখন বুঝি এ অবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। তখন মনে হত এখন বুঝি আমাকে আর ভালোবাসে না, তাই নিয়ে নিত্য অভিমান, কষ্ট পাওয়া, এখন বুঝি ভালোবাসা না বাসার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। একভাবে বলতে গেলে এটা একটা অসুস্ততা, তাজেই চিকিৎসা এবং নিবিড় পর্যবেন ছাড়া সুস্থতা সম্ভব না। হলে থেকে সেটা হচ্ছিল না। ফলে সমস্যা দিন দিন বাড়ছিল, কমছিল না।