কিষাণীর স্মৃতি থকে- ১৪
একসাথে রোল হয়ে আমাদের তেমন কোন সুবিধা হয়নি। আমাদের সময়ে প্রতি সাবজেক্ট এ পাশ নম্বর ছিল ৪০, তবে তাতেই হত না। এভারেজে ৪৫% না হলে পাশ হত না। তাই আলাদা করে প্রতি সাবজেক্টে শুধু পাশ করলে হবে না। ৪৫% তোলার জন্য কিছু সাবজেক্টে স্বভাবতই বেশী পেতে হবে। আগেই বলেছি কৃষক সেকেন্ড ইয়ারে পড়াশোনায় কিছুটা অমনযোগী ছিল, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে মেতে থাকতো। যেখানে আমাদের সেকেন্ড ইয়ারে আরো ভালো রেজাল্ট করার কথা সেখানে কৃষক সব বিষয়ে পাশ করলো কিন্তু তার এভারেজে ৪৫% হল না। খবরটা খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না। যে আশংকা নিয়ে আমি সারাক্ষন ওর সাথে রাগারাগি করতাম আমার সে আশংকা সত্যি হয়ে গেল। রেজাল্ট খারাপ করার জন্য শুধু কম্পিউটার দায়ী না সাথে আরো কিছু ছিল........আমি দুষতাম কম্পিউটার কে।
নতুন ইয়ারে আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেল। দুটো বছর আমরা প্রায় সবকিছু একসাথে করেছি, এখন আলাদা হয়ে করা যে কতটা কঠিন সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ওর বেশী কষ্ট হত, একে তো আমি পাশে নেই তার উপর জুনিয়রদের সাথে ক্লাশ করা। সব মিলিয়ে বেশ এক অস্থির অবস্থা। আমি তাকে কোন সান্ত্বনা দিয়েছিলাম কিনা মনে নেই, তবে স্বাভাবিক ছিলাম, যতটুকু পারা যায়। আগের মত পাশেপাশে ছিলাম, ছায়ার মত।
আমাদের ক্যাম্পাসের এত রঙ তারপরও জীবনের সব রঙ যেন ধুসর হয়ে যেতে লাগলো। না শুধু তার রেজাল্ট খারপ করার জন্য নয়, রেজাল্ট খারপটা হল ফলাফল। চারদিকে রঙগুলো ফেকে হয়ে গেল, কৃষকের ভুবনে অন্য কিছু রঙের আবির্ভবের জন্য, পরীক্ষায় খারপ করা, যার একটা পরিনতি ছিল।
সেকেন্ড ইয়ারে আমাকে যখন সময় কম দিত আমি ভাবতাম শুধু কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে মেতে আছে। আসলে ব্যপারটা তা নয়। কৃষক বরাবর চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে, কোন কিছু নিয়েই সিরিয়াস না। সব ব্যাপারে সীমাহীন কৌতুহল, একেবারে ভিতরে ঢুকে সব কিছুর রহস্য উদঘাটন করতে চায়, সেটা ভাল মন্দ যাই হোক না কেন। সে ছিল একটা পাগলা ঘোড়ার মত, মাঝে মাঝে মনে হত এইতো বেশ আমার বশ মেনে আছে; পরক্ষনেই আবার দেখতাম, না, সে তো তার আপন ভুবনে মত্ত। আমার সাধ্য কি তাকে বশ করে রাখি। এই পাগলা ঘোড়া, খেয়াল আর এডভেঞ্চারের বশে বন্ধুদের সাথে তাল মিলাতে যেয়ে নীলবিষ চেখে দেখলো। ভাবলো কি আর হবে। এই একবারই তারপর আর নয়। বন্ধুরা হয়তো যেত এক কদম, বড়াই করতে যেয়ে সে যেত তিন কদম। নীল বিষ তাকে আষ্টেপৃষ্টে বাধলো, চোরাবালিতে কখন সে ডুবে যেতে থাকলো সে নিজেও বূঝতে পারলো না, আমিও না। সেজন্যই তার পড়ায় মন বসতো না, প্রেয়সীর সাথে সময় কাটানোতে ছন্দপতন হত। এটি বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। প্রথম প্রথম যখন যা কিছু করতো আমাকে বলতো, আমি যখন আপত্তি করা শুরু করলাম তারপর থেকে কিছু কিছু কথা আমাকে গোপন করা শুরু করলো। মিষ্টি করে মিথ্যা সাজিয়ে বলে দিত, আমি অবলীলায় তার সব কথা বিশ্বাস করতাম। ভালোবাসলে মানুষের যুক্তি বুদ্ধি কমে যায়, দুরদৃষ্টি কমে যেয়ে একরকম অন্ধ হয়ে যায় ...........আমার একেবারেই সে রকম অবস্থা ছিল। আমার অবস্থা এমন ছিল কৃষক যদি ভয়াবহ কোন অপরাধ করে আসে, সারা দুনিয়ার মানুষ তাকে দুশছে। আর ও আমাকে এসে বলে, কিষাণী আমার চোখের দিকে তাকাও বল আমি এটা করতে পারি? আমি অবলীলায় বলতাম, সবাই ভুল বলছে কৃষক সত্যি বলছে।
আমাদের দুজনের একটা সুন্দর সাবলীল জীবন ছিল। অর্থনৈতিক কোন ব্যাপারে কোন ভাবনা ছিল না। দুজনের পরিবারই দুজন কে যথেষ্ট স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছলতা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়েছিল। ক্যাম্পাসে আমরা নজরকাড়া, সকলের ভালবাসায় সিক্ত, ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর একটা জুটি। আমার পরিবার আমাদের সম্পর্কটি নীরবে মেনে নিয়েছিল,তার পরিবার থেকেও আপত্তি হবার কোন কারন ছিল না। কারন তার বাবা মা তাকে অনেক ভালোবাসতেন। সবকিছু যখন এত অনুকূলে তখন শুধুমাত্র খেয়ালের বশে এডভেঞ্চার করতে যেয়ে কৃষকের মত প্রাণবন্ত, ঝলমলে একটা তরুন নীলবিষকে কাছ থেকে দেখতে যেয়ে নিজেই তার বশে চলে গেল। কিষাণীর স্থান ছিল কৃষকের হৃদয় জুড়ে, আর নীলাভ কালসাপ দখল করলো ওর রক্ত , শরীরের কোষ এবং মস্তিস্কের নিউরোন।
চোখের সামনে একটা ঝলমলে ছেলে কেমন শুকনো পাতার মত মলিন হয়ে গেল। তার বেশভূষায় মলিনতা, আমি যদি জিজ্ঞেস করি কাপড় পরিস্কার নেই কেন, আজ সেভ করনি কেন, গোসল করনি কেন, সব প্রশ্নের একটা জবাব কোথা থেকে তৈরী থাকতো সেই জানে। অতি মাত্রার বিশ্বাস থেকে তার এই ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া কেন যে আমি বুঝতে পারিনি!
এখনকার সময়ে প্রচার মাধ্যম গুলোতে মাদকাসক্তি অথবা এইডস নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যতটা প্রচারনা চালানো হচ্ছে তখনকার সময়ে, আজ থেকে ১৭/১৮ বছর আগে ব্যাপারটা এরকম ছিল না। এখন সমস্যাটা মহামারীর মত তাই প্রচারটাও ব্যপক, তখন সমস্যার ব্যাপ্তি ছিল অতি সামান্য, সেই অতি সামান্যের মধ্যেই আমরা পরে গেলাম। আর সকলের মত সচেতসতা আমার ও কম ছিল। তাই আমি তাকে হাত ধরে বলতাম, কথা দাও আর ঐসব খাবে না। সে আমাকে বলতো , তোমাকে ছুঁয়ে বলছি কিষাণী আর খাব না। আমি নিশ্চিন্ত মনে বিশ্বাস করতাম। শুধু মুখের কথায় যে কাজ হবে না সেটা বোঝার মত বুদ্ধি আমার ছিল না।
সারা ক্যাম্পাস জানতো সে ঠিক নেই, চোরাবালিতে ক্রমশঃ ডুবে যাচ্ছে, আমি যে কেন জানতাম না! একসময় আমাদের এক কমন বান্ধবী ওর আমনে আমাকে হাসতে হাসতেই বলে যে ও কি করে। ও যথারীতি অস্বীকার করে, তখন আমি বুঝতে পারি যে ও সত্যি বলছে না। সেই মনে হয় প্রথম, কৃষক কিছু বললো আর আমি বিশ্বাস করলাম না।
তবে ও আমাকে দেয়া কথা রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করলো। কিন্তু শরীরের পরতে পরতে যে বাসা বেঁেধছে সে তার অধীকার ছাড়বে কেন? শুরু হল প্রতিক্রিয়া। ওর প্রচন্ড মাথাব্যাথা হত। একসময় মাথাব্যথা নিয়ে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লো। বাড়ী থেকে ওর বাবা মা বড় ভাই ছুটে এলেন। আমি হলে বসে খবর পেলাম, যেতে পারলাম না। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। পরদিন সকালে আমরা বান্ধবীরা ৪/৫ জন ওকে দেখতে গেলাম। বান্ধবীরা ইয়ার্কি করছিল কিষাণী র আজকে শ্বশুড় শাশুড়ীর সাথে দেখা হবে। একদিকে ও অসুস্থ আরেকদিকে উনাদের সাথে দেখা হওয়া দুটো মিলে একটা অ দ্ভুদ অবস্থা ছিল। হাসপাতালে যেয়ে দেখি রোগী বহাল তবিয়তে বেডে বসে আছেন, মুখে সেই পরিচিত হাসি। স্বভাবসুলভ দুষ্টমি চলছে।অষুধ খাবার সময় হল, ঠান্ডা পানি নেই, সে ফাক্স এ রাখা গরম পানি দিয়েই খেল, তাতে আবার ওর মা একটু রাগ করলেন। অসহায় এক বাবা মা কে সেদিন দেখলাম। অনেক বান্ধবীদের ভীড়ে আমাকে আলাদা করে চিনবার কথা না, তবু কিভাবে যেন তাঁরা চিনে ফেলেছিলেন।
পরদিন আবার গেলাম হাসপাতালে, ওর বাবা মা ভাই চলে গেছেন। বন্ধুরা পালা করে হাসপাতাল ডিউটি করছে। প্রচন্ড মাথাব্যথা করছিল।আবদার করলো মাথা টিপে দাও, আমি মাথার কাছে যেয়ে বসলাম, শিশুর মত আমার কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকলো, আমি মাথা টিপে দিলাম, হাত বুলিয়ে দিলাম....পরম মমতায়। জীবনে এর আগে কখনো আমার কোলে মাথা রাখেনি, অথচ সেদিন এতটুকু অস্বস্তি লাগেনি, মনে হয়েছে এটাই স্বাভাবিক। আমি তখন কেঁদেছিলাম কিনা মনে নেই। তবে মনে হচ্ছিল যদি এভাবে তাকে আগলে রাখতে পারতাম সব অনিষ্ট থেকে! শিশুর মত সরল একটা মানুষ ছিল কৃষক, এখনো তাই। সারাক্ষন আমার কাছে তার আবদার, বাড়ীর সবার কাছে যেমনটি করে আমার কাছেও তাই। সব আবদার পূরণ করার সাধ্য আমার আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখেনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১:০০