ষড়ঋতুর এই দেশে - ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যলয়ের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পরিবর্তন আমাদের ভালবাসার মাঝেও এনে দিতো ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। আগে ঋতু পরিবর্তন হতো তার নিজস্ব নিয়মে কিন্তু এখন তার পরিবর্তন আমি টের পাই নিজের মাঝে, নিজের সত্ত্বায়, আমার মাঝেও আন্দোলিত হয় ঋতু পরিবর্তনের হাওয়া।
গ্রীষ্ম
বৈশাখের প্রথম দিনের ভোরবেলা ব্রহ্মপুত্রে পাড়ে ঘুরতে যাওয়া হয়ে উঠেছিল আমাদের বাৎসরিক রুটিন। মনে আছে খুব ভোরবেলা ১নং গেটের কাছা কাছি মেলা শুরু হতো। আমরা যথারীতি সেখানে গিয়ে হাজির। পান্তা ইলিশের কথা মনে না থাকলেও সেখানে ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে। কিছুক্ষন সেখানে থাকার পর বসতাম শান্ত নদীর পারে। এরপর ফিরে আসতাম টিএসসি তে বা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতাম। বিকেলে অবধারিত ভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো আর আমরা সেখানে হাজির। অবশ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার চেয়ে হলের নির্ধারিত সময়ে বেশ কিছুক্ষন বাইরে থাকা যায় এটাই আমার কাছে বেশী পাওয়া বলে মনে হতো।
গ্রীষ্মের প্রখর দুপুরে হাতে যখন কোন কাজ থাকতো না তখন বোটানিক্যালের দীর্ঘ গাছের ছায়া আর নদীর শান্তরূপ আমাদের মনে বুলিয়ে দিতো শান্তির পরশ। এর মাঝে বাড়তি পাওনা হিসাবে যোগ হতো এক পশলা হিমেল হাওয়া। নদীর পাড়ে বসে থাকতে থাকতে মনে হতো আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।
তবে বৈশাখের আম, আর জৈষ্ঠ্যের কাঁঠাল আমার ভাগ্যে খুব একটা জুটেনি কারণ পুরো গ্রীষ্মে ছুটির বেশীর ভাগ সময় থেকে যেতাম ক্যাম্পাসে। বাসায় গেলেও ৪-৫দিনের বেশী থাকা হতো না। গোলাপ, বকুল, বেলী, টগর, জবা এই গুলি চোখে পড়তো এই সময়। তাকে কোনদিন বকুল কিংবা বেলী ফুলের মালা দিয়েছিলাম কি ? মনে পড়ছে না তবে ফুল দিয়েছিলাম এতে কোন সন্দেহ নেই।
কিষাণীর কথা
..... আমি যখন পোষ্ট দেই কৃষক তখন চুপচাপ পড়ে কোন মন্তব্য বা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তবে সে যখন পোষ্ট দেয় আমি একদম নির্বিকার থাকতে পারিনা। তাই মাঝখানে এসে আমার কথাগুলো জুড়ে দেই।
বৈশাখের প্রথম দিনে আমি খুব সাজতাম, শাড়ী পড়তাম, খোঁপায় ফুল দিতাম এটা বলে নাই। আমার সাজগোজ কখনো চোখ মেলে দেখেছে কিনা আল্লাহ মালুম।
গ্রীষ্মকালে কৃষ্ঞচূড়া ফুটতো, আর ছিল জারুল। নদীর ধার ঘেষে জারুল গাছ গুলো যে কি অদ্ভুদ সুন্দর ছিল, আর জব্বারের মোড় এবং ১ নং গেট এর রাস্তা বরাবর কৃষ্ঞচূড়া গাছ।
বেলি ফুল দিত আমাকে, আর বকুল ফুলের গন্ধ আমার একবিন্দু পছন্দ না। তাই ওটার মালা দিতে চাইলে ও আমি নিতাম না।
বর্ষা
বাঙ্গালী মন বর্ষায় আন্দোলিত হয় না এমন মানুষ পাওয়া দুস্কর। বর্ষা এলে ব্রহ্মপুত্র তার কানায় কানায় পূর্ণ হতো । আমি চোখ মেলে তার পরিবর্তিত রূপ দেখতাম। গাছের পাতা গুলি তাদের সমস্ত ময়লা ঝেড়ে ফেলে হয়ে উঠতো আরও সবুজ, আমি নয়ন ভরে তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতাম। এক সময় ঈশা খা হলে টিনসেডে যখন ছিলাম বাড়তি পাওনা হিসেবে পেতাম বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ।
বৃষ্টির মধ্যে পর্দা টাঙ্গানো রিক্সায় ঘুরা ছিল আমাদের নিত্য দিনের কাজ। খুজে খুজে মোটা পর্দার রিক্সা ভাড়া করে শহরের দিকে যেতাম । পর্দাটা মুখ পর্যন্ত তুলে দিয়ে বসে থাকতাম। আর একটু বেশী করে কাছাকাছি থাকা।
গন্ধরাজ, জুই আর কদম ফুল চোখে পড়তো এই সময়। স্পষ্ট মনে আছে প্রতি বর্ষায় তার হাতে অন্তত একটি হলেও কদম ফুল তুলে দিয়েছি।
কিষাণীর কথা
বর্ষার এক অসাধারন রূপ ছিল আমাদের ক্যাম্পাসে। জায়গাটা এমন বৃষ্টি যখন শুরু হোত, আর থামার নাম থাকতো না। একটানা তিন দিন, সাত দিন বৃষ্টি। তারপরও কোথাও পানি জমতো না। সবুজ যেন আরো সবুজ হয়ে যেত। আমরা হেঁটে হেঁটে ক্লাশে যেতাম। তারপরও কোন অভিযেগ নেই। ঝুম বৃষ্টি হলেই রিকশায় ঘোরা। আমি ছাদে উঠে ভিজতাম, চারপাশে কোন উচু বিল্ডিং ছিল না, আহা কি যে মজা, বোঝানো যাবে না।
শরৎ
ব্রহ্মপুত্রের চরে ছিল প্রায় দিগন্ত বিস্তৃত কাশবন। শরতের মেঘলা আকাশের নীচে কাশবন সৌন্দর্য্য ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। নদী পাড়ে বসে থেকে কাশবনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কতদিন অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছি ।
এই সময় দূর্গাপুজা হতো। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় বিশাল আকারে দূর্গাপুজা হতো শহরে । আমরা যথারীত ঘুরবার নাম করে সেখানে হাজির।
শিউলী, মল্লিকা আর কামিনী ফুল চোখে পড়তো বোটানিক্যাল এ । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থপনায় এবং বিশাল লেন্ডস্ক্যাপিং এ পৃথিবী বিখ্যাত লোকেরা তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে এমন একটি পরিবেশ আমাদের উপহার দিয়েছেন যেখানে প্রতিনিয়ত খেলা করে ভিন্ন রং, ভিন্ন আমেজ। আর আমরা ভিন্নতার স্বাদ পাই প্রতি নিয়ত।
শরৎ এর পড়ন্ত বিকেলে যখন সূর্যের তেজ কমে আসে বা আরশোলা রঙের গোধূলীতে তার হাতে হাত দিয়ে ভালবাসার পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।
কিষাণীর কথা
তার সাথে প্রথম আমার কাশের বন দেখা হয়।
তবে ভাদ্রমাসে প্রচন্ড গরম পড়তো, অনেক বেশী আর্দ্রতা থাকার ফলে সারাক্ষন ঘাম হোত। ঠিক ভাদ্র মাসটার পরই ফাইনাল পরীক্ষা গুলো হোত। ফ্যানের নীচে বসে ঘামতাম আর পড়তাম এজন্য মনে আছে। আমি সারাক্ষন বলি, ওখানে গরম, শীত এবং বৃষ্টি তিনটাই বেশী। এমন অদ্ভুদ আবহাওয়া আমি আর কোথাও দেখিনি।
দূর্গাপূজার চেয়ে কালীপূজায় আমরা মজা পেতাম বেশী।
হেমন্ত
এগ্রোনমী ফিল্ড তখন ভরে যেত সোনালী ধানে। মনে হতো এইখানের সবকিছুই সোনায় গড়া। এই সোনালী জগতের বুক চিরে কোন আঁকাবাকা পথ নয়, গিয়েছে কনক্রীটের ঢালাই রাস্তা। রান্তার দুপাশে আমের সারি। একেবারে ছবি মতো সুন্দর করে গড়া। নবান্ন দেখা না হলেও এইখানে এই সময় টাতে বেশ ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যেতো। এই সময় কোন কোন দিন নির্জন প্রান্তরে নিজেদের লাগানো ধান গাছ দেখার ছলে সেখানে হাজির হতাম। নির্জন প্রান্তরে শুধু আমরা দুজন ঘুরে বেড়াতাম। ভোর বেলা ঘাষের ডগায় শিশির এর আভাস দেখা যেত। প্রতিদিন তার পায়ে দলিত হতো অগ্রহায়নের প্রথম শিশির।
শীত
তার শীতে ছিল খুব ভয়। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যেত সে আরও একটু বেশী মোটা হয়েছে। কারন অনুসন্ধানে নেমে দেখা গেল প্রতিদিন সে কয়ক ধাপে কয়েকটি জামা পড়েছে । অবশ্য চারিদিক গাছপালায় পরিপূর্ণ থাকায় ঠান্ডা একটু বেশী অনুভুত হতো। এজন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। শীত কালে তার হলের সামনে ভাঁপা পিঠার আয়োজন করো এক খালা। আমরা ছিলাম তার প্রতিদিনের কাস্টমার। আর প্রতিদিনের খরিদ্দার হওয়ার কল্যানে আমাদের ভাগ্যে জুটতো স্পেশাল বানানো পিঠা। খালা কেমন আছে জানি না । যেখানেই থাকুক ভালো
এবং সুস্থ থাকুক। বসন্তের আগে আগে পুরো বিশ্ববিদ্যলয়ের বাগান গুলো পরিচর্যা এবং নতুন করে গাছ লাগানো ব্যস্ততা শুরু হতো। বসন্তকে বরণ করে নেবার প্রস্তুতি। তবে এর মাঝে কয়েকটি বেড এ - সূর্যমুখী এর গাঁদা ফুটে থাকতো । বোটানিক্যাল এর গাছগুলিকে একটু মলিন মনে হতো। নদীও তার নাব্যতা হারিয়ে শেষ তলানীতে গিয়ে পৌছাতো।
বিভিন্ন অনুষ্ঠান থাকতো প্রায় প্রতিদিন। আর আমরা সেই সুযোগ কখনোই হেলায় হারাতাম না।
কিষাণীর কথা
আমি মোটেই মোটা ছিলাম না। তবে ক্যম্পাসের বৃষ্টির মত শীতও ছিল প্রচন্ড। গাড়ো পাহাড়ের হাওয়া আর পাশের নদী দুটোর সম্মিলিত প্রভাবে শীত পড়তো জাঁকিয়ে। তাছাড়া আসলেই আমি শীতে কাতর হই।এটা এখনো কৃষকের মনে আছে জেনে ভলো লাগছে।
বসন্ত
বছর ঘুরে অবশেষে আসতো বসন্ত। পত্রিকার পাতা যখন দেখতাম লেখা ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হতো এসে দেখে যান এইখানে কত ফুলের সমারোহ আজ। বসন্তের পরিপূর্ণতা আজ এখানেই প্রকাশ পেয়েছে জমকালো ভাবে। নতুন করে প্রকৃতি তার রূপ খুলে দিতো আর আমাদের ভালবাসার ডালপালা গুলিও ভরে যেত নতুন পত্রে। বসন্তে সময় টাতে আমাদের পরীক্ষাগুলি শেষ হয়ে যেত । লেখাপড়ার তেমন চাপ না থাকায় । বসন্তের রোদেলা সকাল, উদাস দুপুর আর পড়ন্ত বিকেল সব সময় তার কাছাকাছি থাকতাম।
সে পাশে থাকাতে সেই উত্তাল যৌবনের দিনগুলিতে প্রাণভরে আমি সেই ঋতু বৈচিত্র উপভোগ করেছি। আমার কাছে এই বৈচিত্রগুলি ধরা দিয়েছে প্রতিবার এক নবরূপে।
- কৃষক
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২৭