কৃষাণীর স্মৃতি থেকে--১১
সেকেন্ড ইয়ারে উঠে আমাদের দু'জনের জীবন যাপনের রুটিনের তেমন কোন পরিবর্তন হল না। সেই একই রুটিন। ভাল লাগার পাখায় ভর করে কিভাবে যে এক একটি দিন পেড়িয়ে যাচ্ছিল ।
নতুন ক্লাশে আমাদের সব সাবজেক্ট গুলো বেশ মজার ছিল।কৃষিকাজ খুব কঠিন ব্যাপার। সেকেন্ড ইয়ারে আমরা সেটা হাত থেকে নিস্তার পেলাম। এবং হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্য ফ্যাকাল্টি থেকে আলাদা ছিল আমাদের সবকিছুই। বেশ ভারী ভারী নামের সব সাবজেক্ট, তাই আমাদের ভাবই আলাদা।
এক একজন টিচার ছিলেন এক এক রকম। ফ্লুইড মেকানিক্স এমনি কঠিন সাবজেক্ট, সেটা যে স্যার পড়াতেন তিনি এমনিতে খুব ভাল ছাত্র ছিলেন তবে পড়াতে পারতেন না। পড়ানোর সময় সব গুলিয়ে ফেলতেন। তার মধ্যে কৃষক উনাকে আরো ক্ষেপিয়ে দিত। স্যার হয়তো একটা টপিক পড়াতে যেয়ে মোটামুটি গুবলেট বানিয়ে ফেলেছেন, এর মধ্যে কৃষক বলতো "স্যার এটা কি এমন হবে? আমার তো মনে হয় এমন হবে।" স্যারের তো মাথা আরো গুবলেট। ধরা খেয়ে রেগে লাল হয়ে যেতেন আর যা বোঝাচ্ছিলেন তা ও ভুলে যেতেন। পরে অনেক কষ্টে ভুজুং ভাজুং দিয়ে ক্লাশ শেষ করতেন। পুরো ক্লাশের সময়টা চলতো দুই ছাত্র শিক্ষকের কথা চালাচালি। ওকে যতই বলতাম স্যারের সাথে এত ঝামেলা করার দরকার নাই। কৃষক তারপরও মজা পায়, বলে ব্যাটা পড়াতে পারে না, ভুল পড়ায় ক্যান, দেখো না এরপর আরো কি করি।
স্যার এরপর থেকে ওকে দেখতে পারতেন না। এর মধ্যে একদিন বিকেলে রিকশা করে ফেরার পথে 'পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে' র মত ঐ স্যারের সামনে পড়লাম। আমি তো মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, নির্ঘাৎ সেশনালে ধরা খাওয়াবে। কারন স্যার আবার ছিলেন একটু হুজুর টাইপ, কথায় কথায় রেগে যেতেন। দুজনকে দেখার পর মনে মনে উনার সব রাগ গিয়ে পড়লো কৃষকের উপর। আমাকে কিছু বলতে পারেন না, আমি ভিজা বিড়ালের মত চুপচাপ থাকি। মাঝে মাঝেই তিনি সে রাগের প্রকাশ ঘটাতেন। অজানা কোন কারনে আমার প্রতি উনার সহানুভূতি ছিল, আর ওর প্রতি ছিল ক্ষোভ। অনেকে হয়তো বলবে মেয়ে বলে আমাকে কিছু বলতেন না।
অনেক পরে আমাদের সেই শিক্ষক এর সাথে আমার একটা সহজ স্বভাবিক সম্পর্ক হয়েছিল। কিছুদিন আগে আমার কর্মক্ষেত্রে একটা কাজে এসে খুব আপন আপন ভাব নিয়ে গল্প করলেন, অনেক ভালো ভালো উপদেশ দিলেন, কাজের প্রশংসা করলেন। যদিও আমি সারাজীবন বলি অমুক স্যার সারাটা জীবন জ্বালিয়েছেন। প্রত্যকেটা বছর তার একটা সাবজেক্ট থাকতো, এবং অবধারিত ভাবে সেটাতে আমরা গণহারে নম্বর কম পেতাম। নম্বর দিতে তিনি ভয়াবহ রকম কৃপন ছিলেন এবং আজো আছেন। সেই স্যার জ্বালিয়েছিলেন আমাদের সবাইকে আর কৃষক জ্বালিয়েছিল উনাকে।
সেকেন্ড ইয়ারে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ছিল। আমার মাথায় সহজে সেটা ঢুকতো না। আর কৃষক যেন "এতদিন কোথায় ছিলে" ...এমন একটা ভাব নিয়ে কম্পিউটার ক্লাশকে ভালোবেসে ফেললো। এমন অবস্থা হল স্যার যেন ওকে পড়াতেই ক্লাশে আসতেন আর কৃষকও যেন সবই বুঝতো। কম্পিউটার রিলেটেড যত বই আছে তার কেনা হয়ে গেল, পড়া হয়ে গেল।
তখন আমরা ওয়ার্ড ষ্টার দিয়ে শুরু করেছিলাম মনে আছে। প্রোগ্রামিং সে ভালো বুঝতো, আমরা অন্যরা প্রায় সবাই গাধার মত কোনরকম বুঝতাম আবার ভুলেও যেতাম। ক্রমেই সে সেই স্যারের প্রিয় হয়ে গেল, কম্পিউটার ল্যাবে যখন তখন যাওয়ার অনুমতি ও তার হয়ে গেল, যেটা আমরা পেতাম না।
এমন হল সে প্রায় সারাদিন কম্পু ল্যাবে পড়ে থাকে। এখন আর আমার পেছন ঘুরঘুর করে না। বরং তাকে খুঁজতে আমি ল্যাবে হানা দিতাম। হয়তো যেয়ে বলতাম "চল অন্য পড়াগুলো শেষ করি। একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়ে থাকলে তো হবে না।" এদিকে ল্যাবে স্যার ও থাকতেন তাই স্যারের সামনে বেশী কিছু বলতেও পারতাম না। আর সে প্রবল উচ্ছাসে আমাকে প্রোপ্রামিং বোঝানো শুরু করতো। আমি কখনো শুনতাম, কখনো রেগেমেগে হলে চলে আসতাম, কখনো সে আমার সাথে পড়তে রওয়ানা হত। এক সময় আমাদের বন্ধুরা কম্পিউটারকে আমার সতীন উপাধি দিয়ে ফেললো। আমার খুব কাঠখড় পোড়াতে হোত ওকে অন্য সাবজেক্ট পড়তে বসাতে। সে হিসেবে আমার নিজের ও কম্পিউটারকে সতীন মনে না হলেও শত্রু মনে হত। আমাদের দুজনের একসাথে পড়ে অভ্যাস, ওকে ছাড়া আমি পড়তেও পারি না, শিখতে বুঝতে সময় লাগে। আবার যদি নিজে পড়ে ফেলি তাহলে সে ঝগড়া লাগিয়ে দিত, আমি কেন একা একা পড়লাম। শুরু হল আমার উভয় সন্কট অবস্থা। ক্রমে ক্রমে এটা বাড়লো।
তার সব ভালোবাসার রূপ পরিবর্তন হয়েছে, তবে কম্পিউটারের প্রতি ভালোবাসার কোন কমতি এখনো হয়নি। যার একটা ফল : আজ আমি ব্লগে এসব লিখছি।
চলবে......
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৪৮