রাতারগুল, বাংলাদেশের একমাত্র মিঠা পানির বন বা বনাঞ্চল । অর্থাৎ জলের বন বা সোয়াম্প ফরেস্ট । যে বনের গাছ পালা পানিতে ডুবে থাকে । সারা পৃথিবীতে এরকম বন দেখা যায়, যেমন : আমাজান, মিসিসিপি, বাংলাদেশের সুন্দরবন। তবে সুন্দরবন হল লোনা পানির বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। বাংলাদেশে এই রকম এক বন আছে সিলেট জেলার গোয়াইন ঘাট উপজেলায়, এই বনের নামই রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট । রাতারগুলে বর্ষায় ৪/৫ মাস পানি থাকে । বনের সমস্ত গাছ পানিতে ডুবে থাকে, দেখতে খুবই ভাল লাগে। এ যেন বনের মধ্যে বন্যা ।
রাতারগুলের খবর পাই গত বছর, যখন কিছু অ্যাডভেঞ্ছার প্রিয় মানুষ রাতারগুল ঘুরে আসে এবং তারা সেই ছবি ফেসবুক এ শেয়ার করে । আমিও সময় পেলে বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্ছার করতে চলে যাই। সেই থেকে মনে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল রাতারগুল যাবার । বিভিন্ন জায়গায় খবর নিয়ে জানতে পারলাম রাতারগুল যাবার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল । তাই এই বছর আগে থেকেই একটা পরিকল্পনা ছিল সময় করে একবর যাবই যাব । এর মধ্যে কথা হয় ট্রেকারস অফ বাংলাদেশের প্রধান তারিক ওবাইদা ভাইয়ের সাথে । সে জানায় সেও বর্ষায় রাতারগুল যাবার পরিকল্পনা করছে। তাকে আমার মনের কথা জানাই, সে সাগ্রহে রাজি হয় । শুরু হয়ে যায় রাতারগুল সম্পর্কে তথ্য জানার কাজ। তারিক ভাই অনেক কষ্ট করে রাতারগুল বনবিট কর্মকর্তার ফোন নাম্বার জোগাড় করে বনবিট কর্মকর্তা হুমায়ন কবিরের সাথে যোগাযোগ করে । হুমায়ন কবির জানায় বর্ষায় যে কোনো দিন আমারা যেতে পারি রাতারগুল । সে আমাদের সকল প্রকার সাহায্য করবে । আমরা জুন মাসের ২৯ তারিখ যাবার পরিকল্পনা করি । তারিক ভাই জানায় তার কিছু বন্ধুও যাবে, সব মিলিয়ে ২৫ জন । আগে থেকে ট্রেনের টিকেট করা হয় যাতে এত গুলো সিট পাওয়া যায় । কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা বুঝি অন্য কিছু । গতকিছু দিন সিলেটে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে যার ফলে বিভিন্ন জায়গায় বন্যা দেখা দেয় । গোয়াইন ঘাট উপজেলায়ও বন্যা দেখা দেয়। তারিক ভাই বন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানতে পারে রাতারগুল এলাকা এখন সম্পূর্ণ বন্যা কবলিত । এমন কি ফরেস্ট অফিসের ভিতরও হাঁটু পানি, গ্রামের মাঝিদের ঘরে পানি, তাদের থাকার জায়গা নেই বলে তারা তাদের নৌকায় আশ্রয় নিয়ে আছে ।
তারিক ভাই আমাদের এই খবর জুনের ২৬ তারিখ জানায় এবং বলে এই অভিযান বাতিল হতে পারে । আমারা সবাই খুব মন খারাপ করি । ২৭ তারিখও বন কর্মকর্তার সাথে কথা হয়, কোনো ভাল সংবাদ পাওয়া যায় না । আমারা আশাহত হই, তাহলে কি আমাদের রাতারগুল যাওয়া হচ্ছে না। বিধাতা বোধহয় আমাদের মনের কষ্ট বুঝতে পারেন । ২৮ তারিখ বন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায় বন্যার পানি অনেক নেমে গেছে, আমরা চাইলে ২৯ তারিখ যেতে পারি । আনন্দে আমাদের সকলের মন নেচে ওঠে । আমাদের ট্রেন রাত ৯.৫০ এ উপবন এক্সপ্রেসে । আমারা একে একে ২২ জন কমলাপুর স্টেশন হাজির হই, একজন শ্রীমঙ্গল থেকে আমাদের সাথে যোগ দিবে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি বাকি দুই জনের জন্য। তারা আর আসে না, এদিকে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে এবং যথারীতি বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন দেরীতে ছাড়ার যে বদনাম আছে তা ঘুচিয়ে সময়মতই ট্রেন ছেড়ে দেয় । বাকি দুই জনের আর আমাদের সাথে যাওয়া হয় না । এদিকে ট্রেনে আমরা যারা আছি তারা আড্ডায় গল্পে মেতে উঠি, রুহি ভাইয়ের বন্ধুরা মিলে হই হুল্লোড় শুরু করে দেয়, অন্য যাত্রীরা বেশ বিরক্ত হয়, অনেকেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তাদের ঘুম শিকোয় ওঠে । কু ঝিক ঝিক করে ট্রেন এগিয়ে চলেছে সিলেটের পথে । এর মাঝে আপনাদের রাতারগুল সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে রাখি। রাতারগুল বনের আয়তন ৩৩২৬ একর। ১৯৭৩ সালে বনের ৫০৪ একর বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এলাকা ঘোষণা করা হয় । বন বিভাগ থেকে প্রাকৃতিক বনের পাশাপাশি হিজল, কদম, বেত, করচ, মুর্তাসহ আর জলপোযোগী গাছ লাগানো হয় ।
ভোর ৫টায় আমরা সিলেট এসে পৌছাই। আমাদের এখন গন্তব্য সিলেটের আম্বরখানা। ইতিমধ্যে বন কর্মকর্তার সাথে কথা হয়, সে আমাদের জন্য ৬টি নৌকা নিয়ে গোয়াইন ঘাটের শ্রীঙ্গী এলাকায় অপেক্ষা করছে। আমরা আম্বরখানায় সকালের নাস্তা করে নেই । তারপর সিএনজি অটোরিকসা ভাড়া করা হয় শ্রীঙ্গী যাবার জন্য। আমাদের যাত্রা শুরু হয়, শ্রীঙ্গী থেকেই আমাদের রাতারগুল যেতে হবে ।
Click here for newspaper link :
View this link