শত শত কোটি টাকার মালিক আপন জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারীর গুণধর পুত্র শাফাত আহমেদ এবং তার চারজন সঙ্গী মিলে ২০১৭ সালের ২৮ এ মার্চ দিবাগত রাত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থীকে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে শাফাতের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত পার্টি শেষে গন ধর্ষণের শিকার হন। ঘটনা ঘটার প্রায় সাড়ে চার বছর পর বিচারক নামধারী জজ মোসাম্মৎ কামরুন্নাহারের আদালতে সকল ধর্ষককে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
তথাকথিত জাজ মোছাম্মত কামরুন্নাহার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনাল ৭ এর একজন বিচারক ছিলেন। রায়ে এই বিচারক অপ্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করেন যে ধর্ষণকারীদের সাথে এই দুইজন ধর্ষিতার পূর্ব সম্পর্ক ছিল। এবং ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেছে তারা দুজনই যৌনকাজে পূর্ব থেকেই অভ্যস্ত । সেক্সুয়াল ঘটনা যা ঘটেছে তা তাদের সম্মতিতেই হয়েছে। কারণ তারা নিজের ইচ্ছেতেই পার্টিতে গিয়েছে, একসঙ্গে নেচেছে, মদ খেয়েছে এবং সুইমিং পুলে সাঁতার কেটেছে।
যেহেতু ঘটনা ঘটার ৩৮ দিন পর মামলা দায়ের হয়েছে সুতরাং মেডিকেল রিপোর্টে কোন ডিএনএ নমুনা, ফরেনসিক বা সিমেন সেম্পল পাওয়া যায়নি। ঘটনা ঘটার ৩৮ দিন পর যদিও এসব স্যাম্পল পাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকেনা, তবুও অভিযুক্তদের খালাসের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি এসব অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। তিনি অদ্ভুতভাবে ভিকটিমের কারেক্টর এসাসিনেশন করতেও দ্বিধা করেননি। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ব্রিটিশ আমলের সাক্ষ্য আইনের দুইটি ধারা অনুযায়ী ভিকটিমের চরিত্র হননের যে চেষ্টা করেছেন তাও অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন।
এমনকি একজন পেশাদার যৌনকর্মীকে তার মতের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করা, ও একজন সাধারণ নারী ধর্ষণ করা আইনের চোখে একই অপরাধ- আইনের সাধারণ এই ধারাটি অত্যন্ত বোধগম্য কারনে এই অথর্ব তথাকথিত জাজ ও আইনজীবীদের চর্চা করা উচিত ছিল। দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান ইত্যাদি সম্পর্কে এই তথাকথিত জাজের পর্যাপ্ত ধারণা ছিল না বলে যে কথা বলা হচ্ছে - সেটা সত্যি বলে মানা যায় না। তার কার্যকলাপের পিছনে কাজ করেছে অন্য একটি এনার্জি যা সহজবোধ্য। তদন্তে এবং চার্জশিট দাখিলে পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা বা সরকার পক্ষের আইনজীবীর ভূমিকা কি ছিল সেটাও তদন্তের দাবি রাখে। তবে যেখানে একই আদালতে চার্জশিট গৃহীত হয়েছে, সুতরাং সেখানে কোনো অসঙ্গতি থাকলে চার্জশিট গ্রহণের পূর্বে পুনঃতদন্তের আদেশ দেওয়া যেত। সমস্ত ব্যাপারগুলি তদন্ত সাপেক্ষে পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
মামলার রায়ের অবজারভেশন পর্বে তিনি আরো উল্লেখ করেন ৭২ ঘন্টা পার হবার পর যেন পুলিশ ধর্ষণের কোন মামলাই না নেয়। অবাক কান্ড! এই মহিলা কি আসলে কোনো জাজ! না পাগল? আসামিপক্ষ থেকে বারবার আর্গুমেন্টের চেষ্টা হয়েছে যে ধর্ষণের ডেফিনেশন অনুযায়ী অপর পক্ষের সম্মতি ছাড়া যৌনসঙ্গম আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তারা পার্টিতে ইচ্ছে করে গিয়েছিল, নেচেছিল বা সুইমিংপুলে সাঁতার কেটে ছিল এটি কোন বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। কিন্তু তথাকথিত এই জাজ এসব বক্তব্য আমলে না নিয়ে সকল আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন, যেটা এত কথা বলার পেছনে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল।
তথাকথিত প্রাক্তন জাজ মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার যে কী কারণে ধর্ষকদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন তা সকলেরই বোধগম্য এবং দিবালোকের মত পরিষ্কার। অথচ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ভিকটিম ৭২ ঘন্টা
নয় - এমনকি ৭২ মাস পরেও ধর্ষণের মামলা দায়ের করতে পারেন। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে কোন অবিবাহিত মেয়ের পক্ষে ( তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে ) ধর্ষণ মামলা দায়ের করা অত্যন্ত কারেজিয়াস একটি ব্যাপার। চট করে এমন মামলা দায়ের করার মতো মানসিক শক্তি সকল মেয়ের থাকার কথা নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৯৯৫ এর ফলে অথবা ১৯৯৬ এর স্প্রিংএ 'জেন কেরল' (Jean Carroll ) নামে একজন সাংবাদিক কলামিস্টকে ম্যানহাটনের পঞ্চম এভিনিউ এর 'ব্রেকডরফ গুডম্যান' ( Bergdorf Goodman) ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ড্রেসিং রুমে ধর্ষণ করেন। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে আমেরিকার ফেডারেল কোর্টে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দায়েরের সময় ভিকটিম 'জেন কেরল' ধর্ষণের প্রকৃত সাল তারিখ পর্যন্ত মনে করতে পারেননি। কিন্তু এর ফলে তখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ধর্ষণের অভিযোগ এবং বিচার থেকে অব্যাহতি মেলেনি। ভিকটিমের নিজের স্টেটমেন্ট ধর্ষণ মামলা চলার জন্য যথেষ্ট বলে বিচারক মত দিয়েছেন। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প জেন কেরলের মামলা দায়েরের পর তিনি যে Elle ম্যাগাজিনের কলাম লেখক ছিলেন - সেখান থেকে প্রেসিডেন্টের প্রভাব খাটিয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করেন। এতে ক্যারল মোটেও দমে যাননি। মামলাটি বর্তমানে আমেরিকার ফেডারেল কোর্টে ধর্ষণ মামলা হিসেবে চলমান।
যেখানে ২৬ বছর পর দায়ের করা মামলা আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আমেরিকার মত দেশের ফেডারেল আদালতে চলমান - সেখানে বাংলাদেশের তথাকথিত একজন পক্ষপাত দুষ্ট মহিলা প্রাক্তন অযোগ্য জাজ লিখিত ভাবে পুলিশকে শত প্রবৃত্ত হয়ে পরামর্শ দেন যে ৭২ ঘণ্টার পর কোন ধর্ষণ মামলাই গ্রহণ না নিতে। এখানে অযোগ্য (?) এই জাজের 'অফেন্স ইজ দ্যা বেস্ট ডিফেন্স' টেকনিকটি লক্ষণীয়।
ফরেনসিক এভিডেন্স ছাড়া সার্কামস্টান্সেসিয়াল এভিডেন্স এবং ভিকটিমের প্রদত্ত জবানবন্দিতেই যে ধর্ষণ মামলা প্রমাণ করা যায় - সেটা অনুধাবন করা বাংলাদেশের এই অযোগ্য, লোভী, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী জাজের ছিল না অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে বিশেষ কারণে তিনি এ জঘন্য একপেশে রায় দিয়ে, ঘোরতর অপরাধীদের বাঁচানোর প্রচেষ্টা নিয়েছেন তা প্রশ্নাতীত নয়।
ইতিমধ্যে মাননীয় সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তার বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন। এটা যদিও একটি সুসংবাদ - তবে পর্যাপ্ত নয়। এই অপরাধী জাজকে অবিলম্বে চাকরি থেকে প্রচলিত নিয়ম মেনে অপসারন ও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা দায়ের করা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত জরুরি। অন্যথায় এই তথাকথিত বিচারক চাকরি হারালেও সারা জীবন আয়েশে চলতে পারবেন তা বলা বাহুল্য মাত্র। তাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা এবং কিছুদিন পর তদবিরে বা অন্য পন্থায় ( যা বাংলাদেশ অত্যন্ত প্রচলিত অস্ত্র ) তিনি আবার কোন একটি জাজের আসন যে অলংকৃত করবেন সেটার সম্ভাবনা ষোল আনা।
একই সাথে মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট তার প্রদত্ত বেকসুর খালাসের রায় বাতিল ঘোষণা করার সর্বময় ক্ষমতা রাখেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি অবিলম্বে আইনের শাসনের স্বার্থে তার সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন বলে দেশবাসী আশা করে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:৫০