দেখতে দেখতে জীবনের কতগুলো বসন্ত কেটে গেল। সময় যে কত দ্রুত যায় তা ভাবতে আজও অবাক লাগে। দিনে দিনে কি সামনে এগোচ্ছি নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি সেটা নিয়ে আমি খুব দ্বিধান্বিত। আমার জীবনের শুরুটা হয়েছিল টিনশেড ঘরে, আজ আমি থাকি চোদ্দশ স্কয়ার ফিটের আধুনিক ফ্ল্যাটে। কিন্তু আমার চোখে আজও ভাসে টিনশেডের ঘরে রাতে যখন ঘুমাতে যেতাম তখন জানালার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলো। কোথায় যেন সেই আলো রিফ্লেক্ট হয়ে সিলিঙে ঠেকত। আমি তখন জানতাম না স্বপ্ন কি। শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতাম ঐ চাঁদের আলোটাই বুঝি স্বপ্ন।
বন্ধুর সংখ্যা ছিল কম। আমার বাবা তার ছেলের সঙ্গীদের বাছাইয়ে সচেতন ভূমিকা পালন করতেন, ছেলে যেন কোনভাবেই বখে না যায় সে জন্য। শেষতক সেটা আমার জন্য ভালোই হয়েছে। ভালো হয়েছে এই কারণে যে আমি বখে যাই নি। আর অন্য দিকে একটা সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে কারণ বন্ধু বাছাইয়ে এখনও আমি খুব খুঁতখুঁতে। চট করে যারা অন্যের সাথে ভাব করে ফেলতে পারে, তাদের পাশে আমার নিজেকে অনেকটা খুঁত খুঁতে অমিশুক বুড়োর মত লাগে। এ জিনিসও আমার বাবারই অবদান।
ছেলেবেলার বন্ধুদের মাঝে অনেকের কথাই মনে পড়ে। তাদের সাথে এ জীবনে আর দেখা হবার সম্ভাবনা নেই, আমার আসলে দেখা করার ইচ্ছে নেই। তারা আমার কাছে স্মৃতি এবং স্বপ্ন। আজ তাদের সাথে দেখা হলে হয়ত বা আমি আশাহত হব। আমি আমার স্মৃতিদের ব্যাপারে কখনও আশাহত হতে চাই না।
আমার বর্তমান বন্ধু যারা তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। তারা এখন সর্বক্ষণই আমার পাশে আছে - মোবাইল, ইন্টানেট এবং আরো অনেকভাবে। তাদের সাথে আমার দিনে একশটা এসএমএস চালাচালি হয়। ইয়াহু, এমএসএন, ফেসবুকে প্রতিনিয়ত তাদের স্ট্যাটাস আপডেট জানতে পারি। কিন্তু তবুও কেন যেন বন্ধুত্বে অতীতের স্বাদটা আর পাই না।
বন্ধুত্বের জন্য আমার সর্বশেষ জায়গা হল ব্লগ। ব্লগিং করতে না এলে আমি একসাথে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমারোহ দেখতে পেতাম না। কত বিচিত্র মানুষ যে দেখলাম এই ব্লগে এসে। হাসিব, অমি রহমান পিয়াল, বৃত্তবন্দী, নাফিস ইফতেখার, ক-খ-গ, অক্ষর, আখসানুল, কাঁকন, জেরী, অরণ্যচারী, শূন্য আরণ্যক, রেজওয়ান শুভ, অলৌকিক হাসান, সুজনবাঙালী, হিমালয়৭৭৭, নুশেরা - এরা সবাই আমার প্রিয় চরিত্র। অপছন্দের চরিত্র কারা সেটা না হয় নাই বা বললাম।
আমাকে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে তুমি কি কর, আমি তখন বলি আমি একজন ছাত্র এবং আমি একজন ব্লগার। উত্তরের দ্বিতীয় অংশ অনেকে বুঝতে না পেরে জানতে চায় ব্যাপারটা কি, আবার অনেকে ভান করে যেন তারা বুঝেছে, কিন্তু আসলে বোঝে নি। আমি বলি ব্লগ লিখুন। শুধু ফেসবুকে হাবিজাবি অ্যাপলিকেশন ইউজ করে কোন লাভ নেই। সময়টা ব্লগে কাজে লাগান।
অনেকেই বলে কি লিখব? আমি বলি যা ইচ্ছা লিখেন। শুধু কপি পেস্ট করবেন না, আর বাংলা ব্লগে ইংরেজি লেখা দেবেন না। আমার পরিচিত কারো বাংলাদেশ বিরোধী কোন কিছু লেখার সম্ভাবনা নাই, তাই সে ব্যাপারে সাবধান করি নাই।
একজন বলল, ব্লগে তো দেখি ফাটাফাটি ঝগড়া হয়। আমি কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম, হ্যাঁ, হয়। ব্লগ তো আমাদের সমাজেরই একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ। আমাদের সমাজে যেমন রেশারেশি দলাদলি আছে ব্লগেও সেটা থাকবে স্বাভাবিকভাবেই। এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই।
ব্লগের কারো সাথে আমার সরাসরি দেখা হয় নি, কথাও হয় নি। ইমেইল বিনিময় হয়েছে এবং কয়েকজনের সাথে চ্যাট হয়েছে। বেশিরভাগ ব্লগার আমার কাছে এখনও ভার্চুয়াল চরিত্র। আমার এই নিকে কেউই আমাকে চেনে না, চেনানোর ইচ্ছাও নেই। আমি নিজে অনেকদিন বাস্তব চরিত্র হিসেবে থেকেছি, এখন কয়েকটা দিন ভার্চুয়াল থেকে দেখি কেমন লাগে। খুব একটা খারাপ লাগার কথা না।
ব্লগের বন্ধুরা হল আমার নিদ্রাহীন রাতের সঙ্গী। সারা দিন ক্লাস করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছি, তারপরও সময় পাওয়ামাত্রই ব্লগে ঢুকেছি, প্রত্যেকটা পোস্ট পড়েছি। রাত পার হয়ে কখন যে ভোরের দিকে রওনা দিয়েছে সেটা টেরই পাই নি। আড্ডা চলেছে, গল্প চলেছে, বিরামহীন। রাজাকার মার্কা পোস্টের উৎপাত ছিল। কিন্তু আমি এটাকে বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়েছি। ব্লগে ত্রিভুজ, অমি রহমান পিয়াল, আরিফ জেবতিক কিংবা লোকালটক, সবাই থাকবে। নানা ধরনের চরিত্র ধারণ করে দেখেই তো ব্লগ এত বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমাদের সমাজে যতদিন রাজাকারমনস্ক মানুষ থাকবে, ব্লগেও তারা ততদিন থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।
ব্লগের এই উন্মাতাল নেশা আমার কোন দিন কাটবে কিনা বলতে পারছি না। মনে হয় না। তবে আপাতত অন্য নিকের ব্লগিং বন্ধ রেখে শুধু এই নিকটাই চালু রাখলাম। শুধুই বৈচিত্র্যের খোঁজে।
সবাইকে শুভেচ্ছা। হ্যাপি ব্লগিং।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ৮:১৯