নারীবাদ একটা মতাদর্শের নাম, একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের নাম । বাংলা সিনেমায় দেখা নায়কের পিঠের উপর নায়িকার হাই হিল পরা পায়ে দাঁড়ানোর নাম নারীবাদ নয় । যে সমাজ কথায় কথায় নারীদের অন্দরমহল চেনায় সে সমাজের বিরুদ্ধে নারীরা সোচ্চার নাহলে, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের ডাক না দিলে আজকে আপনি আমি বাইরের হাওয়া গায়ে লাগাতে পারতামনা ।
সুতরাং নারীবাদী বলে কাওকে নিয়ে হাসাহাসি করার আগে আপনার আরো কিছু বিষয় জানা দরকার । আজকে আপনাকে যদি ভোট দেয়ার অধিকার না দেয়া হয়, বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করার অধিকার, পাবলিক বাসে ওঠার অধিকার না দেয়া হয় তখন কি করবেন ? জ্বী, আজকে থেকে মাত্র একশ বছর আগেই আপনার আমার ভোটাধিকার ছিলনা । আজকে এই সময় হিজরাদের ভোটাধিকার না থাকলে আপনার যেমন কোন মাথাব্যাথা হয়না, তৎকালীন পুরুষতন্ত্রও একসময় নারীদের ভোটাধিকার নিয়ে তেমনি নিস্পৃহ ছিল ।
শিক্ষাদীক্ষায় যে আজকে আপনি আমি ছেলেদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে ফার্স্ট সেকেন্ড হচ্ছি এটাও একদিনের অর্জন না । ভাগ্যিস বেগম রোকেয়া বলে উপমহাদেশে কেউ ছিল যে স্বার্থপরের মত নিজে শিক্ষিত হয়ে বসে থাকেনি বরং অন্দরমহলের বাইরে এসে নিজেই নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছিলেন ।
ঘরের কাজ, স্বামী-সন্তানের প্রতিপালন করেও আপনি যে সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি অফিসে পুরুষের পাশের ডেস্কে, তার সমান একই মাইনেতে, একই সময় ইনভেস্ট করে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন সেই সুযোগ আপনাকে আমাকে বাড়ি বয়ে এসে কেউ দিয়ে যায়নি । এটার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়ানো হয়েছে, সেটা আপনি পোড়াননি বলে আপনার গায়ে লাগছেনা কিন্তু কেউ না কেউ কিন্তু পুড়িয়েছে ।
অনেকেই যুক্তি দেন, নারী আন্দোলন যদি নারী পুরুষ সবাই মানুষ এবং একে অপরের সমকক্ষ হবার আন্দোলন হয় তো সেটা মানবতাবাদ না হয়ে নারীবাদ কেন হল ? একই যুক্তিতে নারীদিবস পালনের জন্যও অনেকে সমালোচনা করেন । কথা হচ্ছে, আপনার পায়ের তলায় মাটি না থাকলে কিসের উপর দাঁড়িয়ে গলা ফাটাবেন ? যে সমাজ পুরুষদের মানুষের স্ট্যান্ডার্ড ধরে, সেখানে নারীরা শুধুমাত্র একজন নারী, তারও অনেকপরে মানুষ । সুতরাং আপনি পুরুষদের মানুষের স্ট্যান্ডার্ডে ফেলেন আর নাই ফেলেন আন্দোলনটা মানবতাবাদী আন্দোলন বলে চালিয়ে দেয়া যায়না । সব সেক্টরে পুরুষের সমান অধিকার আর স্বাধীনতা পেয়ে গেলে তখন মৌলিক ইস্যু নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন, সেটা মানবতাবাদী আন্দোলন হবে । যতদিন পুরুষকে ভাল না বেসে সমীহ করে বাঁচতে হচ্ছে, সমন্বয় করে বাঁচার পরিবর্তে মন যুগিয়ে চলতে হচ্ছে ততদিন নারীবাদ নিয়ে না বুঝে উল্টাপাল্টা কথা বলা বন্ধ করেন ।
যুগের পর যুগ আন্দোলন করে নারীবাদীরা আমাকে আপনাকে আজকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে । যে পুরুষগুলোর গলায় গলা মিলিয়ে আপনি নারীবাদ আর নারীবাদীদের কথা শোনাচ্ছেন তাদের জন্যই আপনাকে ডমিস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হতে হত । সভ্য পুরুষরা নারীদের সভ্যতার অর্ধেক অংশই মনে করে । যারা আপনাকে ভুংভাং বুঝিয়ে ঘরে থেকে কাজ করতে বলে, পুরুষকে সমীহ করে চলতে বলে সে আর যাই হোক কখনোই আপনাকে আপনার প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছেনা; যা দিচ্ছে সেটা করুণা । এই পুরুষরাই আপনি ধর্ষিতা হলে, বন্ধ্যা হলে, তাদের জন্য রান্না না করে দিলে আপনাকে ঘর থেকে বের করে দেবে ।
সুতরাং, কাওকে সমীহ করার আগে, কারো মিষ্টি কথায় গলে যাবার আগে নিজেকে সমীহ করেন । প্রকৃতি প্রদত্ত হাত,পা,চোখ,কান ব্যবহার করে নিজের অধিকার বুঝে নেন তারপর নারীবাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আলাদা করে নারীবাদকে ঘৃনা করেন, তার আগেই দয়া করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে নিজের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটাবেননা প্লিজ ।