"বোহেমিয়া" শব্দটার সাথে আমার প্রথম আলাপ শার্লক হোমস পড়ে।তখন আমি ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি।"এ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া" নামের একটা গল্প ছিল!এরপর আরেকটু বড় হয়ে "বোহেমিয়ান লাইফ" নামের একটা টার্ম শুনলাম।কলেজে ওঠার পর থেকে বাবা প্রায়ই বলতেন,"তোমার এই বোহেমিয়ান লাইফস্টাইল না পাল্টালে কপালে অশেষ দুঃখ আছে।"
তো,সেদিন আর থাকতে পারলাম না।হোয়াট দ্যা হেল ইস দিস বোহেমিয়ান কালচার!আমি এত কিছু ছেড়ে বোহেমিয়ান কেন হতে যাবো?বোহেমিয়া জায়গাটা এগজ্যাক্টলি কোথায়?এমন অদ্ভুত সব প্রশ্নেরা আমায় ঘিরে কোলাহল শুরু করল।অগত্যা ফোন করলাম আমার ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড পানকুকে,
"হ্যালো"
"আমি তোপসে বলছি,বাবার ফোন থেকে,আমারটায় ব্যালেন্স নেই-"
"সে আর কবে থাকে?বল।"
"কাল ফ্রি আছিস?বোহেমিয়া যাবো।"
"মানে! কখন?"
"তুই দুপুর দুপুর তাম্রলিপ্ত চলে আয়।"
"উম...ওকে"
দুপুর দেড়টা,বারাসাত স্টেশন।
আমি আর পানকু প্ল্যাটফর্মে রোদের মধ্যে গাধার মত দাঁড়িয়ে আছি।পানকু বলল,
"এবার?"
"আমি কি জানি?"
"আমি কি জানি মানে!বোহেমিয়া যাওয়ার প্ল্যান তোর,আমার নয়!"
আমি অল্প থতমত খেলাম।সত্যিই তো,বাওয়াল দিয়ে তো বেরিয়ে গেলাম,এরপর কি?ওদিকে রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে,পানকু খচে যাচ্ছে বুঝতে পারছি।একটু পরে বুদ্ধি খুলল।আমি প্ল্যাটফর্মের এক চা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম,
"দাদা,এই প্ল্যাটফর্ম দিয়ে নেক্সট ট্রেন কি যাবে?"
চা ওয়ালা আমার দিকে নিষ্পলক নয়নে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,"হাসনাবাদ।"
হাসনাবাদ লোকাল।চামারের মত ভিড় ট্রেনে আমি আর পানকু চিপকে দাঁড়িয়ে আছি।সামনে বসা এক ভদ্রলোককে বললাম,
"দাদা,কোন স্টেশন আসছে?"
লোকটার বোধহয় মুড খিঁচড়ে ছিল,গম্ভীর গলায় বলল,
"কাজিপাড়া"
"তারপর?"
"কদম্বগাছি"
"তারপর?"
"কালিবাড়ি"
"তারপর?"
ভদ্রলোকের মুখ এবার দেখার মত হল।পরিষ্কার বুঝতে পারলাম কাকা মনে মনে আমায় হুল্লাট খিস্তি দিচ্ছে।কিন্তু মনের ভাব মনের মধ্যে রেখে,অসম্ভব সংযমের পরিচয় দিয়ে কাকা আমাদের জিজ্ঞেস করল,
"তোমরা নাববে কোথায়?"
পানকুটা বলদ।দুম করে বলে বসল,"জানিনা" আর এই কথাটার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম ট্রেনের প্রায় দশটা মাথা আমাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে!একজনের তো মনে হয় স্পষ্ট ধারণা হল আমরা মাওবাদী!সে বলল,
"জানিনা মানে! ইয়ার্কি?"
আমি কোনোমতে ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার জন্য বললাম,"আসলে আমরা একটা টেলিফিল্ম শুট করার জন্যে স্পট খুঁজছি।একটু কাশফুল থাকবে,একটা নদী থাকবে..."
সিনেমা শূনে মাওবাদী অল্প ঠান্ডা হল,"তা নদী তো হেই হাসনাবাদে পাবা।ইছামতী।তবে ওখানে কাশফুল তো হবেনা।"
আমি "ও আচ্ছা" বলে চুপ করে গেলাম।পাশে পানকুর দোদুল্যমান ভুঁড়ি দেখে বুঝলাম ব্যাটা প্রাণপণে হাসি চাপার চেষ্টা করছে আর সেই চেষ্টায় বিফল হয়ে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গার মত দুলছে।ট্রেন ষন্ডালিয়া ছাড়ালে (এখন আর মুডি কাকুকে জ্বালাচ্ছি না,নিজেরাই দেখছি) আমরা বসার জায়গা পেলাম।
বাকি ট্রেন জার্নিতে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি।শূধু ভ্যাবলা হল্টে যখন ট্রেন ঢুকছে,একজন লোক কেন জানিনা প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে বলল,"হুরি বোকাসুদা!"
অবশ্য এটাকে কোনোভাবেই ঘটনা বলা যায়না।
দুপুর পৌনে তিনটে,হাসনাবাদ স্টেশান।
জায়গাটা বেশ শান্ত।শ্মশানের মত ফাঁকা নয়,তবে চুপচাপ।আমরা সামনের একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চা খেলাম।মনে ছিল মাওবাদী বলেছে হাসনাবাদে ইছামতী নদী আছে।তাই কথায় কথায় দোকানদার কে বললাম,"দাদা,এখান থেকে ইছামতী কদ্দুর?"
"ইসামতী?হে তো হাডাপথে পাস মিনিট,হেয়ান দিয়া সোজা বেরায়ে যাও।"
চায়ের দাম মিটিয়ে যখন ইছামতীর উদ্দেশ্যে হাঁটছি,পানকু গর্বের সাথে ঘোষণা করল,চাওয়ালার জয় বাংলা হয়েছিল,আমি খেয়াল করিনি।
ইছামতীর তীরে এসে চরম হতাশ হলাম।ভেবেছিলাম ঘাটে বসে দুই বন্ধুতে সুখ-দুঃখ নিয়ে গভীর আলোচনা করব...ওমা!এসে দেখি মেলা বসেছে!ঘাটের ওপাড়ে যাওয়ার জন্য ভিড় গিজগিজ করছে।একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম নৌকায় চড়ার আগে ঘাটের গেটে আট আনা আর নৌকায় ওঠার পর দু টাকা দিতে হবে।এত কম খরচ দেখে বেশ অবাক হলাম!যাই হোক,একটু পরে আমাদের নৌকো এল।সাঁতার জানিনা বলে আমার বরাবর জলে ভয়,তারপর গোদের উপর বিষফোড়ার মত জানলাম এই নৌকাগুলোয় দাঁড়িয়ে যেতে হয়।ওদিকে নৌকায় ওঠার পর থেকেই আমার পা ঠকঠক করে কাঁপছে।তাই দেখে মাঝির বোধহয় আমার ওপর মায়া হল।লোকটা আমাদের বলল,"তোমরা দুজন বসে পড়।"
নৌকা ছাড়ল।নদীর সৌন্দর্য,রোদের চিকচিক...এসব নিয়ে পাবলিক প্রচুর লিখেছে বলে আর হ্যাজাচ্ছি না।শুধু একটা ঘটনা বলে আমার এই নৌযাত্রার ইতি টানবো।আমাদের নৌকা যখন মাঝ নদীতে,দেখলাম ওপারে আবার নৌকা বোঝাই হচ্ছে-একটা নৌকায় এবার দুটো বাছুর আর একটা মোটর সাইকেল উঠল!
ঘাটের ওপারে তো গেলাম,তারপর?শরীর যখন জবাব দেয়,তখন সমস্ত আঁতলামি,ছেলেমানুষি,বাওয়াল ফুস করে উবে যায়।পানকু বলল,"শালা খিদে পাচ্ছে..."
খিদে আমারও পেয়েছিল,বেশ ভালোই পেয়েছিল,কিন্তু কাছে পিঠে কোনো খাবারের দোকান না থাকায় সে খিদে চেপেই রাখতে হল।ততক্ষনে ধুলো মেখে,ক্লান্তিতে আমাদের জোকারের মত চেহারা হয়েছে।আরেকটু এগোনোর পর একটা বাস ডিপো চোখে পড়ল।বাপ রে বাপ!বাস তো নয়,যেন মুরগির খাঁচা!বাসের ছাদ,জানলা,গেট-কোথায় প্যাসেঞ্জার নেই?
ঠিক হল ওই বাসে উঠে যদ্দুর যাওয়া যায়,যাবো।এই "যদ্দুর" ডিপেন্ড করছে সময়ের ওপর।বিকেল হয়েছে,আলো কমে আসছে,বাড়ি ফিরতে হবে।
সে যাই হোক,কোনমতে ঠেসেঠুসে ড্রাইভারের পাশে একটু দাঁড়ানোর যায়গা পেলাম।বাস ছাড়লো,আর আমরা প্রাণ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।রাস্তার যা দশা,হাসনাবাদ কম,খাইবার পাস বেশী লাগছিল।
আমি আমার অনেক বন্ধুকে দেখেছি খিদে পেলেই ভাট বকে।ভিড় বাস,পেটে ডাইনোসর ডন দিচ্ছে,এর মধ্যে শুরু হল পানকুর রককীর্তন।
"বসিরহাটে ফসিলস শো করতে এসেছিল জানিস?"
"আসতেই পারে,তো?"
"না...মানে কয়েকটা লুঙ্গি পড়া লোক একলা ঘর শুনতে শুনতে মাথা নাচাচ্ছে-এটা ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে না?"
"আরে,আমাদের বয়েসি ছেলেপিলে তো সব জায়গায় থাকে,তারা রক শোনে।"
"বাল শোনে।সবাই হুলিয়ে হিন্দিগান শোনে আর ব্যান্ডের গান ম্যাক্সিমাম হলে ওই আদাত।"
"হুম,হতে পারে।"
"অবশ্য বুবুনের বাড়ি বসিরহাটে।"
"বুবুনটা আবার কে!"
"রক ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হয়েছো,বুবুনকে চেনোনা শূওর!ফসিলসের ড্রামার।"
"হতে পারে,গরমের মধ্যে ভালো লাগছে না,কান খাওয়া বন্ধ কর।"
একটু পরে দূর থেকে একটা ইয়াব্বড়ো ব্রিজ দেখতে পেলাম।পানকুকে বললাম,"চ,নামি।আর এগোলে ফিরতে চাপ হবে।"
বাস আমাদের ব্রিজের মুখে নামিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেল।সামনেই সিগারেটের দোকান।আমি একটা ফ্লেক কিনে দোকানদার কে জিজ্ঞেস করলাম,"দাদা,এটা কোন জায়গা?"
"কাটাখালি"
পাশ থেকে পানকু বলল,"গোটা ব্রিজ জুড়ে যে রেটে এয়ারটেলের অ্যাড দেখছি,এয়ারটেল খালি নাম হওয়া উচিত ছিল।"
দোকানদার বেশ রসিক,সে পানকুর কথায় এক গাল হেসে বলল,"এয়ারটেল খালি নাম হলে এয়ারটেলের অ্যাড থাকত না যে!"
কাটাখালি ব্রিজের ঠিক মধ্যিখানে যখন এসে দাঁড়ালাম,তখন সুর্য ডুববো ডুববো করছে।আমার নীচে এখন ইছামতী,নদীতে দু-একটা মাছ ধরার নৌকা দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম।দূরে একটা বিরাট বাঁক,সেখানে সবজে ধানখেত,দু একটা গরুও দেখলাম মনে হল।ব্রিজের ওপর তিন চারটে বাচ্চা খেলা করছিল।তাদের মধ্যে একজনকে ডেকে পানকু জিজ্ঞেস করল,"ভাই ওই দূরে ওটা কোন যায়গা?"
"উডা?উখানে তো বাঙলাদেশ বডার..."
এরপর আমরা ফিরে এসেছিলাম।একই রুট ধরে,একই ভাবে।জীবনের প্রত্যেকটা ফেরা যেমন হয়,আমাদের ফেরাও তেমন হল-ক্লান্তিকর,একঘেয়ে।
এককালে আমি সবাইকে বলে বেড়াতাম,"জীবনে সব করেছি-সব।"
সেদিন ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম মনে হল,কিস্যু করিনি।আমি হাজার চেষ্টা করলেও কোনোদিন ওই নোম্যানস ল্যান্ডে যেতে পারবো না।সেই একটা গান আছে না,
"গেরুয়া পড়েছি
আমি বাউল হতে পারলাম কৈ?"
সত্যি কথা।আমি যতই ওড়ার চেষ্টা করি,রোজ রাত্রে খাটের তলা থেকে কিছু যান্ত্রিক তার বেরিয়ে আমায় ঠিক চেপে ধরবে,আষ্টে পৃষ্টে গিঁট মেরে ফেলে দেবে বিছানায়।আমি গল্প লিখব,কবিতা লিখব...তারপর তাদের ছিঁড়ে,নষ্ট করে ফেলে দেব-এই অবধি আমি বাউল।কিন্তু যখনই সেগুলো সবাইকে বলে পাগল সাজব,আমার একতারা আমাকে থাপ্পড় মেরে বসিয়ে দেবে।
আসল গেরুয়া সেই নৌকোটা ছিল।ডুবন্ত সুর্যের আলোয় চ্যাটচ্যাটে ভেজা একটা নৌকা।সে পারে নোম্যানস ল্যান্ডে যেতে,আমি না।আমি নৌকা নই,আর সে জন্যেই আমার গল্পেরা কোনোদিন শেকড় বাকড়ের গিঁট থেকে বেরোতে পারবে না।দু টাকা দিয়ে শুধু যাতায়াত বেচা শিখেছি,এঘাট থেকে ওঘাট।সে তো ঘাটকাজ,গল্প বেচতে শিখলাম কোথায়?
আমার গল্পেরা তাই আমার মতই অপদার্থ।আর এভাবেই,তাই,আমার গল্পের সাহিত্যমুল্য একদিন শুন্য হতে হতে সংসারী হয়ে যাবে,আমি জানি।
জীবনের প্রত্যেক জার্নি মানুষকে কিছু শিখিয়ে যায়।আমি সেদিন শিখেছিলাম,ইচ্ছামতীর খারাপ গতিপথের জন্য আমার আর কোনোদিন বোহেমিয়া যাওয়া হবেনা...
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:২৬