অফিস থেকে ফিরতেই ডাবলি বাবাকে
জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিল।
মেয়েকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন, কী হয়েছে মা? কাঁদছ কেন?
কোনও রকমে একটু শান্ত করে
ডাবলিকে কোল থেকে নামিয়ে মিস্টার
মজুমদার সোফায় বসতেই রান্নাঘর
থেকে হন্তদন্ত হয়ে ডাবলির মা
ঘটনাস্থলে এসে পড়লেন। ডাবলি মাথা নিচু
করে সোফার অন্য পাশে দণ্ডায়মান। মা
ডাবলির দিকে তাকিয়ে বললেন, জানো
আজ ডাবলি ক্লাস টেস্টে কী
করেছে? মিস্টার মজুমদার ডাবলিকে
কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন, আজকে ক্লাস টেস্ট ছিল বুঝি?
তা কোন সাবজেক্ট, মা? ডাবলির মা
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, বা,
বা, বা, বা, এক জন দায়িত্বশীল বাবার কী
সুন্দর প্রশ্ন? তোমার আশকারাতেই
মেয়েটা দিনে দিনে উচ্ছন্নে যাচ্ছে।
আমি আর তোমাদের বাপ-মেয়ের
কোনও ব্যাপারে নেই। মিস্টার মজুমদার
প্রসঙ্গ পালটে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক
আছে। আজকে ডাবলির ক্লাস টেস্টে
কী হল সেটাই তো জানা হল না। ডাবলিকে
ভর্ৎসনা করে মা বললেন, বলে
ফেলো আজ ক্লাস টেস্টে অঙ্কে
কত পেয়েছ। বলে তিনি চললেন
রান্নাঘরে। ডাবলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে
বলল, সিক্সটিন। শুনেই ডাবলির বাবা উচ্ছ্বসিত
হয়ে বললেন, সিক্সটিন আউট অব
টোয়েন্টি। খুব ভাল মার্কস। এইট্টি
পারসেন্ট নম্বর! এতে কান্নার কী
আছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মেয়েকে আদর করে বললেন,
কেঁদো না মা। আমি তো কোনও দিন এত
নম্বর পাইনি। একটু গলা নামিয়ে বললেন,
জানি না তোমার মা হয়তো পেয়ে থাকতে
পারেন।
এই সব শুনে রান্নাঘরে ডাবলির মা আর স্থির
থাকতে না পেরে এসে বললেন, যে
পড়ায়, তার একটা এক্সপেক্টেশন থাকে।
কোনও দিন তো দেখলাম না মেয়েকে
নিয়ে একটু পড়াতে বসতে। দেবস্মিতা,
অর্ণব সবাই উনিশ, পায়েল কুড়ি। আর
তোমার মেয়ে কি না ষোলো। মানসম্মানটা
থাকে কোথায় বলো? কাল রাতেই পাখিপড়া
করে নিজে বসে বসে সমস্ত অঙ্ক
করালাম। সেই সিলি মিসটেক।
এ বারও চার চারটে নম্বর কাটা। রাগে
গজগজ করতে করতে তিনি রান্নাঘরের
দিকে পুনরায় পা বাড়ালেন।
মিস্টার মজুমদার ডাবলিকে স্নেহভরে
বললেন, ছি ছি ডাবলি, এ রকম সিলি মিসটেক
করলে কেমন করে চলবে? নম্বর কম
পেয়েছ বলে তোমার মা মনে কেমন
কষ্ট পেয়েছেন বলো? অবাক গলায়
ডাবলি বাবাকে প্রশ্ন করল, সিলি মিসটেক
কী বাবা? বাবা পড়লেন ফাঁপড়ে। সিলি
মিসটেক কী, তা কেমন করে ডাবলিকে
বোঝানো যায়, এই ভাবতে ভাবতে তিনি
চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ করে
থেকে তিনি বললেন, ধরো তুমি অঙ্কটা
জানো কিন্তু করতে পারলে না। নম্বরও
পেলে না। ভুল শুধরে আবার তিনি জিভ
কেটে বললেন, না না সেটা ঠিক সিলি
মিসটেক নয়। ধরো তুমি অঙ্কটা ঠিকই
করলে কিন্তু উত্তর মিলল না। না না, সেটাও
ঠিক নয়। অঙ্কটা করতে গিয়ে তুমি
যোগের জায়গায় বিয়োগ করে
ফেললে। না সেটাও ঠিক সিলি মিসটেক
হল না। তা হলে অঙ্কটা করার সময়
অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে। না ঠিক তাও নয়।
তবে সিলি মিসটেক খুব খারাপ। বেশি
অঙ্কে সিলি মিসটেক করলে কিন্তু ফেল
করারও সম্ভাবনা থেকে যায়।
সিলি মিসটেক ক্লিয়ার করতে না পেরে
মিস্টার মজুমদার ডাবলিকে বললেন, অফিস
থেকে ফিরে জামাকাপড়টা পর্যন্ত তোর
জন্য চেঞ্জ করতে পারিনি। বড্ড জ্বালাস।
দাঁড়া, আগে ফ্রেশ হয়ে আসি, তার পর
ইন্টারনেট সার্চ করে তোর সিলি মিসটেক
উদ্ধার করব। বলে মিস্টার মজুমদার
বাথরুমে চলে গেলেন।
ইতিমধ্যে ডাবলি ব্যাগ খুলে বাবার ল্যাপটপ
বের করে সাজিয়ে গুছিয়ে বিছানার ওপর
প্রতীক্ষমাণ। পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত মিস্টার
মজুমদার ডাবলির কাণ্ড দেখে এক গাল
হেসে ল্যাপটপ অন করলেন। এক কাপ
গরম চা নিয়ে সেখানে হাজির ডাবলির মা। চা
খেতে খেতে তিনি সিলি মিসটেেকর
ব্লগ খুলে বসলেন। অনেক কিছু
পড়েও ফেললেন। প্রতি মুহূর্তে ডাবলি
জিজ্ঞেস করে চলল, কিছু পেলে বাবা?
তার চোখে মুখে বিস্ময়, এই বুঝি পাওয়া
গেল। ব্লগ পড়ে অনেক কিছু মিস্টার
মজুমদারের বোধগম্য হলেও, ডাবলিকে
সিলি মিসটেক বোঝানোর কোনও সহজ
উপযুক্ত রাস্তা বেরিয়ে এল না। রাগ করে
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেট
ডিসকানেক্ট করে ল্যাপটপ শাট ডাউন
করে দিতেই, ডাবলি ভীষণ মনমরা হয়ে
পড়ল। তাই দেখে মিস্টার মজুমদার আবার
নিজের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়েই ডাবলিকে সিলি
মিসটেক বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে
চললেন। ধরো, তোমার মা বাজারে যাবার
সময় পার্সটা বাড়িতে ফেলে গেলেন।
কী সাংঘাতিক ব্যাপার! তা হলে বাজার হবে
কী করে? দেখো সামান্য ভুলের জন্য
কেমন একটা বড় কাজ ভেস্তে গেল।
ঠিক সে রকম একটা জানা অঙ্ক তুমি শেষ
পর্যন্ত ঠিক করে এলে। লাস্ট স্টেপে
ক্যালকুলেশনে ভুল করে ফেললে।
উত্তর মিলল না। পুরো মার্কস কাটা গেল।
অথচ দেখো অঙ্কটা কিন্তু তোমার
সম্পূর্ণ জানা। ডাবলির মা রান্নাঘর থেকে
চিৎকার করে জবাব দিলেন, মার্কেটিংয়ে
যাবার সময় পার্স নিতে আমার কোনও দিনই
ভুল হয়নি। তুমিই বরং টুম্পার বিয়েতে যাবার
সময় গিফ্টটা নিতে ভুলে গিয়েছিলে।
কী লজ্জার ব্যাপার! শেষ পর্যন্ত আমি
আবার পরের দিন সেই গিফ্ট দিয়ে আসি।
যদিও এটা সিলি মিসটেক নয়। এটা হল গ্রস
মিসটেক। ডাবলির দিকে ফিরে তিনি
বললেন, বড় ধরনের দুর্ঘটনাও কিন্তু সিলি
মিসটেক থেকে হতে পারে।
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে
দেখে মিস্টার মজুমদার বললেন, বেশ
বেশ ঠিক আছে। আমারই ভুল, আর ভুল
মানুষ মাত্রই করে থাকে। থতমত খেয়ে
সে যাত্রা চুপ করে গেলেন ডাবলির মা।
আবার মেয়ে বাবার আলোচনা জমে
উঠল। বাবা মেয়েকে বললেন, আচ্ছা
ধরো, অফিসে যাবার সময় তাড়াহুড়োর
মধ্যে আমি চশমাটা নিয়ে ভুলে গেলাম।
সারা দিন কী রকম অসুবিধার মধ্যে
আমাকে পড়তে হবে এক বার ভেবে
দেখো। আর সইতে না পেরে ডাবলির মা
রান্নাঘর থেকে সটান সেখানে চলে
এসে বললেন, আজ্ঞে না। এটাও সিলি
মিসটেক নয়। এটা ইচ্ছাকৃত ভুল। যেটা তুমি
প্রায়ই করে থাকো। কত বার বলেছি চশমাটা
আগে থেকে ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে
রাখবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
মিস্টার মজুমদার এ বার সত্যি সত্যিই খুব
বিরক্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে এখন
বরং সিলি মিসটেেকর প্রসঙ্গ থাক। তুমি
এখন যাও। রান্নাটা শেষ করো। আমরা
ততক্ষণে কম্পিউটারে একটা ড্রইং করে
ফেলি। এখন আবার ড্রয়িং? আমার রান্না হয়ে
গেছে। রাত ক’টা হল খেয়াল আছে?
বিরক্ত হয়ে বললেন মিসেস মজুমদার।
মিস্টার মজুমদার মিষ্টি হেসে বললেন,
সবে তো দশটা। কাল রবিবার, ছুটির দিন। একটু
দেরি করে ঘুম থেকে উঠলেও
চলবে। রেগে গিয়ে মিসেস মজুমদার
বললেন, ছুটি তোমাদের। আমার কি ছুটি
আছে? ঘরে-বাইরে কাজ। সারা দিন খাটতে
খাটতে আমি আর পারছি না। তাড়াতাড়ি যদি
খেয়ে নাও তো ভাল, নইলে আমি শুয়ে
পড়ছি। সারা সন্ধেটা ‘সিলি মিসটেক, সিলি
মিসটেক’ করে কাটল। পড়াশোনার দফারফা।
রাত দশটায় মেয়ের সঙ্গে আদিখ্যেতা
একেবারে চাগিয়ে উঠল। মিস্টার মজুমদার
বললেন, কী রান্না করেছ আজ? সেই
তো কুমড়ো না হয় ঢ্যাঁড়শ। না বাবা, আজ মা
লুচি করেছে। আমি দেখেছি বলে
ফেলল ডাবলি। মিস্টার মজুমদার গম্ভীর
হয়ে বললেন, লুচির সঙ্গে কী? মুচকি
হেসে মৃদু গলায় মা ডাবলির মাথায় হাত বুলিয়ে
আদর করে বললেন, মাটন। শুনে বাপ-
মেয়ের চোখ চকচক করে উঠল। মিস্টার
মজুমদার নড়েচড়ে উঠে বসে
বললেন, কী, লুচি আর পাঁঠার মাংস? বাঃ,
আগে বলবে তো? ডাবলির মুখে যেন
আনন্দের শিহরন। লুচি ওর ভীষণ প্রিয়।
তাই দু’জনেই আর দেরি করতে রাজি নয়।
দু’জনের খাবার চরম আগ্রহে মিসেস
মজুমদারের মুখে প্রশান্তির হাসি। হাত ধুয়ে
সরাসরি খাবার টেবিলে বাপ ও মেয়ে।
কাচের বাটিতে গরম পাঁঠার মাংস আর থালায়
ফুলকো ফুলকো লুচি নিয়ে টেবিলে
রাখলেন ডাবলির মা। আর যেন তর সয় না।
টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ডাবলির লুচি
ছিঁড়ে দিতে দিতে মিসেস মজুমদার
সস্নেহে বলতে থাকলেন, সারা সন্ধে
তোমাদের দু’জনকে যেন সিলি
মিসটেেকর ভূত তাড়া করে
বেড়িয়েছে। এ বার সেই ভূত মাথা
থেকে তাড়িয়ে ভাল করে পেট ভরে
খাও তো। লোভ সামলাতে না পেরে বাপ-
মেয়ে দু’জনেই একসঙ্গে লুচির
টুকরো মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে মুখে
ঢোকাতেই, পিন ড্রপ সাইলেন্স। বাপ-
মেয়ে দু’জনে বাক্যহারা হয়ে একে
অন্যের দিকে বিস্ফারিত নেত্রে
চেয়ে রইল। উদ্বিগ্ন ডাবলির মা
জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?
তোমরা অমন করে আছ কেন? মাংসটা কি
ভাল হয়নি? মুখ থেকে লুচির টুকরোটা
বের করে ডাবলির বাবা বললেন, সিলি
মিসটেেকর ভূত বোধ হয় তোমাকেও
ধরেছে। মাংসতে তুমি নুন দিতে ভুলে
গেছ। ডাবলি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
কিন্তু মাংসটা খুব ভাল হয়েছে। বাবা এটা কি
সত্যিই সিলি মিসটেক? মিস্টার মজুমদার
গম্ভীর মুখে, ঠোঁটে হাসি চেপে
বললেন, আশাকরি এত ক্ষণে তুমি পরিষ্কার
বুঝতে পেরেছ হোয়াট ইজ সিলি
মিসটেক? ডাবলির মা শুকনো মুখে হতাশ
হয়ে রান্নাঘরে ছুটলেন নুন আনতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:২৮