এ দেশের যেকোন সরকারের ৫ বছরের টার্মের শেষ বছর সরকার থাকে দৌড়ের উপর, বিরোধীদল থাকে সরকারের নানান ব্যর্থতার ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের তুঙ্গে... আমরা দেখে দেখে অভ্যস্ত! তবে এবার একটু প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে রায় হচ্ছে সরকারের শেষ বছরেই। হয়তো আওয়ামী লীগ আশা করছে এতে করে তার ভোট ব্যাংক বাড়বে আগামী নির্বাচনে। আরেক নতুন সংযোজন হলো শাহবাগে তরুণদের স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চ, যেখান থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবীর পাশাপাশি জামাত নিষিদ্ধকরণের দাবীও উঠছে। বিপত্তিটা বাঁধছে এখানেই। একদিকে সাঈদীর ফাঁসীর রায় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে অনেকে, প্রায় ৭০ এর উপরে সাঈদীভক্ত তরুণ তাজাপ্রাণ গিয়েছে। ঐদিকে আওয়ামীপন্থী বা বামদের এক দফা এক দাবী, সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসী চাই! এদিকে বিএনপি ঠিক আবেগ দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে বিচার করছে ঘটনাবলী, জামাত শিবিরের উপরে পুলিশের নির্বিচার গুলির প্রতিবাদ করছে, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিতে দেখিনি, জামাত, বিএনপি দুই পক্ষের নারীনেত্রী-কর্মিরা এবার গ্রেফতার হলো, এটা আমার কাছে একাধারে হতাশার এবং আশংকার বিষয়! জানি না জামাত-শিবির তাদের করণীয় কি ঠিক করবে? তবে দল নিষিদ্ধ হলে দুটো ঘটনা ঘটতে পারে, হয় তারা সর্বহারাদের মতো সন্ত্রাসী দলে পরিণত হবে, নিজেদের নেতাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে, না হয় নতুন নাম দিয়ে কোন দল গঠন করবে। কি ভবিষ্যত এই চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জানা নেই, তবে বিএনপি -আওয়ামী লীগ, জামাত-আওয়ামী লীগ আপাতত মুখোমুখি, বিএনপি এখনো নিজেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে সরাসরি আন্দোলনে নামেনি, আমরা সাধারণ জনগণ দেখতে থাকি কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়?
দেশের সব মানুষকে সাথে নেয়া যায় এমন রাজনৈতিক দল প্রধানত দুটো আওয়ামী লীগ, বিএনপি। জাতীয় পার্টিকে হিসেবের বাইরেই রাখি আপাতত। জামাতসহ যেকোন ইসলামী দল বা বামদলগুলোর একটা বড় সীমাবদ্ধতা হলো এখানে নির্দিষ্ট এক আদর্শশ্রেণীর মানুষের ঠাঁই মেলে, সবার জায়গা সেখানে হয় না, যদিও তারা বলে যে আপামর জনসাধারণের দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের, কিন্তু নিজেদের দলের ভিতরে বা প্রশাসনিক স্তরের ভিতরে যেহেতু অন্য আদর্শের কাউকে তারা সেভাবে গুরুত্ব দিতে পারে না, তখনই একটা আস্থাহীন পরিস্থিতি তৈরী হয়। এতে করে শুরু হয় আদর্শিক দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বামেরা মাওলানা ভাসানীর মতো ধার্মিক নেতাকে মেনে নিতে পারে কারণ তিনি সাম্যের রাজনীতি করেছেন, কিন্তু জামাতে ইসলামীকে (যুদ্ধাপরাধের বিষয়ের বাইরে) মেনে নিতে পারে না বুর্জোয়া দল হিসেবে। এই একই মাপকাঠিতে তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপিকেও মেনে নেয় না। কিন্তু বামদের সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো তারা তাদের জীবনাচরণে সবার আগে ধর্মকে বাদ দিয়ে ফেলে (সবচেয়ে সহজ আদর্শিক জিহাদ), ধর্ম নাকি শ্রেণীশত্রু তৈরী করে, কিন্তু অন্যান্য জনসেবা বা বুর্জোয়াবিরোধী আন্দোলন তারা ধীরে ধীরে করে। কেউ কেউ বেশি আগ বাড়িয়ে নাস্তিকতা জোরে শোরে প্রচার করে। এটা অনেকটা ধর্মপ্রচারের মতোই মনে হয় আমার কাছে। কিন্তু এই মুসলিম মেজোরিটি দেশে যেখানে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ আরো নানা ধর্ম বিদ্যমান সেখানে এই বামতত্ত্ব তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায় না, তাই তারা ধর্মকে সরাসরি বাদ না বলে ধর্মীয় মূল আচাররীতিকে 'মৌলবাদ' আখ্যা দিয়ে এক ধরণের ঘৃণা তৈরী করার চেষ্টা করে জনমনে। তাই সাধারণ ধার্মিক সে যে ধর্মেরই হোক না কেন ধর্মীয় জ্ঞান কম থাকলে এসব প্রোপাগান্ডায় সহজে প্রভাবিত হয়। নিজেকে আধুনিক, প্রগতিশীল প্রমাণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত এসব ভুল কথার ফাঁদে পা দেয়। তো, মোদ্দাকথা হলো এই যে এসব আদর্শিক দলে আপামর জনসাধারণ ঠাঁই পায় না।