২ বছর আগে কালের কন্ঠে এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়। ভাল লাগবে আপনাদের
রাঙ্গুনিয়ার কবির আহমদকে 'বাবা' বলে ডাকতেন জিয়া
সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁকে 'বাবা' বলে ডাকতেন। খালেদা জিয়া এখনও তাঁকে বাবা বলেই সম্বোধন করেন। সেই সূত্রে তারেক, আরাফাতের কাছে তিনি দাদা। রাঙ্গুনিয়ার ৯১ বছরের বৃদ্ধ কবির আহমদের সাথে এমনই সম্পর্ক জিয়া পরিবারের। কপালের ফেরে অজ্ঞাত লাশ হিসেবে তাঁর হাত দিয়েই ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রথম কবর দেওয়া হয়েছিল জিয়াকে। তাও তাঁর বাড়ি সংলগ্ন নিজের জমিতে। তখন থেকেই জিয়ানগরের তত্ত্বাবধান করছেন কবির আহমদ। এই কবির আহমদের সাক্ষাৎকার নিতে আমরা যখন রাঙ্গুনিয়া জিয়া কমপ্লেঙ্ সংলগ্ন কবির ম্যানশনে পেঁৗছাই তখন ২৭ মে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা। কিন্তু তখনই বাড়ির মালিক তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জনক কবির আহমদ প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরের রাউজানের নোয়াপাড়া জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে বের হয়ে যাচ্ছেন। কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তাঁর হাতে নেই। কিন্তু এর মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে তাঁর সম্পর্ক, নিহত হওয়ার পরের ঘটনাবলি বলে চললেন কালের কণ্ঠের কাছে।
কবির আহমদের জবানীতে, '৭১' স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর পর পরই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তৎকালীন মেজর জিয়া কালুরঘাট ব্রিজ অতিক্রম করে ১৫ জন মুক্তি সেনানীসহ রাউজানের পাহাড়তলী এলাকার আমার বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ সময় এলাকায় পাক সেনাদের আগমন ঘটলে রাঙ্গুনিয়াস্থ শান্তিরহাট হয়ে বেতবুনিয়ার দিকে পথ প্রদর্শন করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করি। এ সময় পাক হানাদাররা আমার বাড়ি আক্রমণ করে গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত করে এবং বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে হত্যা করে।'
দেশ স্বাধীনের পরও জিয়ার সাথে আমার যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। তিনি চট্টগ্রামে এলেই আমাকে ডাকতেন। এমনকি মৃত্যুর ২২দিন আগে আমার বাড়িতে এসে ভাতও খেয়েছেন। খাওয়া শেষে প্রায় ৮ একরের বিশাল বাড়ির চারপাশটা ঘুরে ঘুরে যখন দেখছিলেন, এই সময় জিয়া বর্তমান কবরের জায়গাটা দেখিয়ে বলেন, 'বাবা এই জায়গাটা কার?' আমি জবাব দিলাম, 'এটা আমার।' তিনি বললেন, 'আমাকে এখানে একটু জায়গা দেবেন?' আমি সাথে সাথে বললাম, 'এটা কি চাওয়া লাগে?' ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস মাত্র ২২ দিন পরেই ব্যবধানে সেখানেই তিনি এলেন কিন্তু অজ্ঞাতনামা লাশ হয়ে। আবেগাপ্লুত হয়ে কবির আহমদ বলে যান, 'আল্লাহ ভাগ্যে এখানেই তাঁর কবর লিখে রেখেছিলেন। তাও আবার আমার হাতে তার কবর।'
প্রথম কবর দেওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কবির আহমদ বলেন, 'যেদিন চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করা হলো সেদিন সকাল ৮টায় তিনটি মিলিটারি গাড়ি এসে রাঙ্গুনিয়ার আমার বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়। একজন মিলিটারি অফিসার বাড়িতে ঢুকে আমার ছেলে মোহাম্মদ নূরুল আবছারকে নিয়ে আমাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় খুঁজে পায়। এ সময় তাঁরা ৮জন শ্রমিক নিয়ে আমাকে বাড়ির পাশে কবর খুঁড়তে বাধ্য করে। সেখানেই বেলা ১১টায় আমি ও ইমাম হাবিবসহ জানাজা পরিয়ে তাঁকে কবর দিই। তখনও আমি জানতাম না কাকে কবর দিলাম। লাশের পরিচয় জানতে চাইলে এক সেনা অফিসার আমাকে ধমক দিয়ে বলে, 'নাম জানার দরকার নেই। সে সামরিক বাহিনীর লোক।' তারপর শ্রমিকদের ২০ টাকা করে এবং ইমাম সাহেবকে ১০০ টাকা দিয়ে কিছুক্ষণ পর তারা স্থান ত্যাগ করে। কিছুক্ষণ পর বেতার ঘোষণায় শুনি, জেনারেল জিয়া নিহত। পরদিন সোমবার ১ জুন কর্নেল মাহফুজ ও চট্টগ্রামের এসপি ও কয়েকজন সেনা অফিসার আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে কবর খুঁড়ে লাশ উত্তোলন করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ওইদিন কর্নেল মাহফুজসহ আমরা মৃতদেহ পরিষ্কার করে বেলা তিনটায় হেলিকপ্টারে করে লাশ ঢাকার বঙ্গভবনে যাই। পরদিন জানাজা শেষে ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার সাহেব শেষ ফ্লাইটে চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দেয়। সেই ১৯৮০ সাল থেকে অদ্যাবধি আমি রাঙ্গুনিয়া আমার বাড়ি সংলগ্ন জিয়ার মাজার ও জিয়া কমপ্লেঙ্ তত্ত্বাবধান করে আসছি।
'আমার হাত দিয়ে জিয়ার কবর হলো অথচ আমি জানতাম না লাশের পরিচয়'
কালের কণ্ঠ : জিয়ার সাথে আপনার পরিচয় কিভাবে?
কবির আহমদ : সে অনেক পুরনো কথা। স্বাধীনতার আগে ঘটনাচক্রে জিয়াউর রহমানের সাথে আমার পরিচয়। ওনাকে একটা বিপদ থেকে আমি উদ্ধার করেছিলাম। স্বাধীনতার পরও সে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে তিনি চট্টগ্রামে এলেই আমাকে ডেকে নিতেন। কালের কণ্ঠ : মৃত্যুর আগে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে আপনার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল কখন? কবির আহমদ : মারা যাবার আগেরদিনও চন্দনপুরা জামে মসজিদে আমরা একসাথে জুমার নামাজ পড়ে হযরত শাহ আমানত (রা.) এর মাজার জেয়ারত করি। সেখান থেকে বেলা দুইটায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ফিরে আসি। দুপুরে খাবারের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. ইউসুফ, কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ ও আব্দুল্লাহ আল নোমানের সাথে বৈঠক করেন। সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। মৃত্যুর ২২দিন আগে আমার রাঙ্গুনীয়ার বাসায় জিয়া ভাত খেয়েছিলেন। সেদিন আমাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'আপনার এখানে আমাকে একটু জায়গা দিবেন?' আমি সাথে সাথে বললাম, 'এটা কি চাওয়া লাগে?' সেখানেই ওনাকে প্রথম কবর দেয়া হয়।
কালের কণ্ঠ : যখন জিয়ার মৃত্যুর খবর শুনলেন তখন অনুভূতি কেমন ছিল?
কবির আহমদ : ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আমার হাত দিয়েই তাঁর কবর হলো। অথচ আমি জানি না লাশের পরিচয়! পরে যখন জানি এটা জিয়ার লাশ। তখন আমি ছিলাম অনেকটা অসাড়। ঢাকায় তাঁকে দ্বিতীয়বার কবর দিয়ে এসে আমি প্রায় একমাস শয্যাশায়ী ছিলাম। (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) এমন মানুষ আর আসবে না। এরশাদই সব করেছে। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি।
কালের কণ্ঠ : জিয়া পরিবারের সাথে এখনও কি যোগাযোগ হয়?
কবির আহমদ : ঢাকা গেলেই তো তাঁর (খালেদা জিয়া) সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে বাবা বলে ডাকেন। তারেক, আরাফাতও আমাকে দাদার মতো সম্মান করেন।
কালের কণ্ঠ : স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের আপনার সম্পর্ক কেমন?
কবির আহমদ : না, তারা সবাই আমাকে সম্মান করে। আমি কখনও উপকার ছাড়া কারো ক্ষতি করিনি। সে জন্য সবার সম্মান পাই।
(কালেক্টেড)