গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংক ও তাকে ঘিরে ২৯ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
নোবেলবিজয়ী এই অর্থনীতিবিদের ব্যক্তিগত কার্যালয় ‘ইউনূস সেন্টার’ থেকে এ বিবৃতি পাঠানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ কোম্পানি ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে বিভিন্ন মহলে এবং মিডিয়ায় নানা বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে। হয়তো তথ্য না-জানার কারণে অনেকে কাল্পনিক তথ্য তৈরি করে তীব্র ভাষায় সমালোচনায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। এতে দেশের মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। দেশের মানুষের জ্ঞাতার্থে, সমালোচকদের আলোচনার সুবিধার্থে গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ কোম্পানি ও প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন সম্প্রতি উত্থাপিত হয়েছে তার প্রকৃত তথ্য আমরা সংকলিত করে দিলাম।”
বিবৃতিতে জানানো হয়, “যে তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রকাশনায় আছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলির কাছেও আছে। সেখান থেকে আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা যায়। প্রয়োজনে ইউনূস সেন্টারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাবে।”
০১. প্রশ্ন: সরকার গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত করতে চাইলে তাতে এত বাধা বা সমালোচনা হচ্ছে কেন? নোবেল লরিয়েট বলে তিনি কি তদন্তের উর্ধ্বে?
উত্তর: সাধারণতঃ কোনো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তদন্ত করা হয় যখন সেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। গ্রামীণ ব্যাংক একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান বলেই সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নিবিড়ভাবে গ্রামীণ ব্যাংক পরিদর্শন করেছে। প্রতি বছর দু’টি আন্তর্জাতিকমান সম্পন্ন অডিট ফার্মও গ্রামীণ ব্যাংক অডিট করে এসেছে। কোনো অডিট টিম কোনো অনিয়ম নিয়ে কোনোদিন প্রশ্ন তোলেনি। তাছাড়া সরকার প্রধান সংসদে, সংসদের বাইরে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন যা বিদ্বেষমূলক বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। অন্যদিকে সরকার প্রধানের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগা কি স্বাভাবিক নয়? এই তদন্ত কি তার মন্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হবে না? শুধু এই কারণেই বিভিন্ন সুধীজন এই তদন্ত সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। অন্য কোনো কারণে নয়।
নোবেল বিজয়ী বলে তিনি তদন্তের উর্ধ্বে নন। যারা আপত্তি তুলেছেন তারা এই তদন্ত বিদ্বেষমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে এই ধারণা নিয়েই আপত্তি তুলেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীগণ এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেন যে, “আমি সংবিধানের সংরক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব, এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব”। আচরণ নিয়েই সমস্যা, তদন্ত নিয়ে নয়। বাস্তবে এই আচরণ থেকে বিচ্যুত হতে দেখলে তার প্রতিবাদ করা কি সব নাগরিকের কর্তব্য নয়?
০২. প্রশ্ন: গ্রামীণ ব্যাংক তো একটি সরকারি ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রফেসর ইউনূস একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারী হিসেবে সরকারি নিয়মকানুন মেনে চলেননি কেন?
উত্তর: বর্তমান সরকারের আমলে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগের কোনো সরকার, এমনকি আগের আওয়ামী লীগ সরকারও কোনোদিন এরকম দাবি করেনি। গ্রামীণ ব্যাংক ৯০ সালের পর থেকে বেসরকারি ব্যাংক হিসেবেই কাজ করে এসেছে। এখন এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে আগের ধারণাকে পাল্টে দেয়া হয়েছে। বর্তমান দাবির মূল কারণটি হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি আইনে প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারি বিধিবদ্ধ সংস্থা।
১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের সংশোধনীর মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারি নিয়ন্ত্রনমুক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে এর ভিত্তিতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, এবং গ্রামীণ ব্যাংক তার কার্যক্রম পরিচালনা করে এসেছে। এতে কেউ আপত্তি করেনি। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এক্সটারনাল অডিটর বা অন্য কারো কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন আসেনি।
আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকানাই শুধু বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি (বর্তমানে ৯৭%), ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার সমস্ত দায়-দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি লক্ষণ হলো যে, তার রুলস এবং রেগুলেশান তৈরি করার সময় সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। ১৯৯০ সালের সংশোধনীর পর গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে এই বিধান আর রাখা হয়নি।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকার সময় সময় বিভিন্ন নির্দেশ দিতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে এমন বিধান রাখা হয়নি।
ফলে গ্রামীণ ব্যাংক মূলতঃ বেসরকারি মালিকানায় এর বোর্ড কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত ও প্রণীত প্রবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে। এই ব্যাংকের কর্মচারীরা ব্যাংকের নিজস্ব নিয়মে (বোর্ড কর্তৃক প্রণীত প্রবিধান অনুযায়ী) চাকরি করে। বেতনের স্কেলসহ চাকরির সব সুযোগ-সুবিধা বোর্ড ঠিক করে দেয়। যা অর্ধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা দশ বছর পূর্তির পর যেকোনো সময় গ্র্যাচুইটি ও পেনশনসহ অবসর নিতে পারে যা সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সময়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এই প্রতিষ্ঠানে বোর্ডই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সরকার নিজেই সরকারের কাছে কোনো ক্ষমতা রাখেনি। এ কারণেই গ্রামীণ ব্যাংক তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পেরেছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বোর্ড নিয়োগ দেয়। বোর্ডকে সে ক্ষমতা আইনে দেয়া আছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ ও দায়িত্ব সম্পর্কিত বিধান গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে সন্নিবেশিত আছে। আইনানুযায়ী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্ষদ কর্তৃক দেয়া শর্তাধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তার নিয়োগের জন্য কোনো বয়সসীমা নির্ধারিত নেই।
গ্রামীণ ব্যাংকের মতো পৃথক আইনে সৃষ্ট আরেকটি প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দেয়া যায়। সেটি হলো এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন (এ.ইউ.ডব্লিউ)। গ্রামীণ ব্যাংক যেরূপ একটি বিশেষ আইন বলে সৃষ্টি হয়েছে সেরূপ চট্টগ্রামে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ও একটা বিশেষ আইনে সৃষ্টি হয়েছে। এ.ইউ.ডব্লিউ সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। এর কর্মচারীরা সরকারি কর্মচারী নন। এর ভাইস-চ্যান্সেলরও সরকারি কর্মচারী নন। তাকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলো মেনে চলতে হয় না।
গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি না বেসরকারি এটা নিয়ে একাডেমিক আলোচনা হতে পারে। মূখ্য বিষয় হচ্ছে ২০১১ সাল পর্যন্ত এটা বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে চলেছে। এটা নিয়ে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক কারো মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না বলেই গ্রামীণ ব্যাংক তার কার্যক্রমে সাফল্য অর্জন করতে পেয়েছে। এখন যদি এটাকে সরকারি পরিচয় ধারণ করে তার চরিত্র সংশোধন করে চলতে বলা হয় তাহলে এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। এটাই হলো মূল কথা।
যদি আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, বর্তমানে যে আইন আছে তাতে এটা বেসরকারিভাবে চলার কোনো উপায় নেই, এতদিন ভুল করে বেসরকারিভাবে চলেছিল, তাহলে আইন সংশোধন করে এটাকে সম্পূর্ণ বেসরকারি করে ফেলতে হবে। এর আর কোনো গত্যন্তর নেই।
এরকম আইন করে দিলে গ্রামীণ ব্যাংক মজবুত, স্থায়ী ব্যাংক হিসেবে চলতে পারবে। জাতীয় প্রয়োজনে তাই করতে হবে। সরকারি ব্যাংক হিসেবে চলতে গেলে এটা মুখ খুবড়ে পড়ে যাবে।
০৩. প্রশ্ন: গ্রামীণ ব্যাংক তো সরকারের অর্থে চলে। তাছাড়া বিদেশ থেকেও গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য শত শত কোটি টাকা আসে। এই টাকা কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা দেখা কি সরকারের কর্তব্য নয়?
উত্তর: না, গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের অর্থে চলে না। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই চেষ্টা হচ্ছিল যেন ব্যাংকটি কেবলমাত্র সদস্যদের মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার এটাতে রাজি হয়নি। জন্মকালে (১৯৮৩ সালে) গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৬০% ছিল। প্রফেসর ইউনূস ৬০% সরকারি মালিকানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় মোটেও রাজি ছিলেন না। তাকে বুঝানো হলো যে, ব্যাংক চালু হয়ে গেলে এটা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হবে। ১৯৮৬ সালে সেটা করা হয়েছিল। ৭৫% শেয়ার বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল অধ্যাদেশ সংশোধন করে। প্রফেসর ইউনূস সরকারের শেয়ারের অংশ টোকেন অংশীদারিত্ব হিসেবে পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। যার ফলে সরকার ২০০৮ সালে ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে সরকারের শেয়ার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনে এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ বোর্ডের হাতে ন্যস্ত করে। পরে বর্তমান সরকার তা সংসদে পেশ করে আইনে পরিণত না করায় সরকারের শেয়ার পূর্বের মতো ২৫ শতাংশে ফিরে গেছে। চেয়ারম্যানের নিয়োগ সরকারের কাছে থেকে গেছে।
সরকার ব্যাংকের জন্মকালে এক কোটি ২০ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছিল। এখনো সরকারের মোট শেয়ারের পরিমাণ এক কোটি ২০ লাখ টাকা। সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাক প্রত্যেকে ৩০ লক্ষ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছে। ফলে সরকারের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছিল এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। জন্মের পর থেকে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে এক কোটি ৮০ লক্ষ টাকার বেশি আর কোনো টাকা দেয়নি। সরকার তার মূলধনের পরিমাণ না বাড়ানোতে কার্যতঃ সরকারের মালিকানা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
সরকারের অনুরোধে বিভিন্ন সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক বিদেশী ঋণ ও অনুদান নিয়েছে। বিদেশী ঋণ ও অনুদান নেবার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের উপর সময় সময় চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেসব তথ্য বিভিন্ন প্রকাশনায় লিপিবদ্ধ করা আছে। যেসব বিদেশী ঋণ নেয়া হয়েছিল তা চুক্তি মোতাবেক শোধ করে দেয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধে গ্রামীণ ব্যাংক কোন সময় এক দিনের জন্যও বিলম্ব করেনি।
১৯৯৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আর বিদেশী ঋণ বা অনুদান নেবে না। চালু ঋণ/অনুদানগুলি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চালু থাকে। এরপর থেকে গ্রামীণ ব্যাংক আজ পর্যন্ত কোনো বিদেশী ঋণ বা অনুদান নেয়নি। সরকারি অনুদান গ্রামীণ ব্যাংক কোনকালেও নেয়নি।
গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধনের প্রধান উৎস সদস্যদের শেয়ার কেনা বাবদ অর্থ। প্রতি শেয়ারের মূল্য ১০০ টাকা। সরকার কর্তৃক বেঁধে দেয়া মূলধনের সর্বোচ্চ সীমা ২০০৮ সালের পূর্বে কম ছিল বলে, গ্রামীণ ব্যাংক কোনো সদস্যকে একটির বেশী শেয়ার দিতে পারেনি। যদিও সদস্যদের ইচ্ছা তারা বেশি করে শেয়ার কিনবেন, কারণ গ্রামীণ ব্যাংক শেয়ার প্রতি ২০% থেকে ৩০% মুনাফা দিয়ে থাকে।
০৪. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লক্ষ সদস্য কি ব্যাংকের প্রকৃত শেয়ার হোল্ডার? নাকি সব ভূঁয়া?
উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের অধিকাংশ সদস্য ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার। শেয়ার কিনেছেন এমন সদস্যের সংখ্যা ৫৫ লক্ষ। মোট সদস্য ৮৪ লক্ষ। যারা শেয়ার এখনো কিনেননি তাঁরা ক্রমান্বয়ে কিনবেন। এজন্য কোন তাড়া দেয়া হয় না। সম্মিলিতভাবে সদস্যরা ৯৭% শেয়ারের মালিক। আরো সদস্য শেয়ার কিনতে থাকলে সদস্যদের মালিকানা ৯৭%-এর উপরে চলে যেতে থাকবে।
প্রতি শেয়ারের মূল্য ১০০ টাকা। সদস্যের সঞ্চয়ী হিসেবে ১০০ টাকা জমলে তা দিয়ে তিনি ১০০ টাকা দামের একটি শেয়ার ক্রয় করেন। তিনি শেয়ার কেনা বাবদ ১০০ টাকা ব্যাংকের শেয়ার খাতে জমা দিয়েছেন এমর্মে সেটা সদস্যের পাস বইতে লিখে দেয়া হয়। এর ফলে শেয়ার হোল্ডার রেজিস্টারে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এই রেজিস্টার থেকে পরিচালক নির্বাচনের সময় ব্যাংকের ভোটার তালিকায় তার নাম তোলা হয়।
০৫. প্রশ্নঃ যদি শেয়ারহোল্ডার থেকে থাকে, তবে কোনদিন তাদেরকে ডিভিডেন্ড দেয়া হলো না কেন? মুনাফার টাকা কি প্রফেসর ইউনূস এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তাহলে হজম করে ফেলেছেন?
উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংক বরাবর শেয়ারহোল্ডারের ডিভিডেন্ড দিয়ে এসেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রত্যেক সদস্য যেকোন সময় ১০০ টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শেয়ার কিনতে পারেন। ৮৪ লক্ষ ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ৫৫ লক্ষ ঋণ গ্রহীতা এ পর্যন্ত শেয়ার কিনেছেন। এর মাধ্যমে তারা ৫৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনে ৯৭ শতাংশ মূলধনের মালিক হয়েছেন। সরকার ও সরকারি ব্যাংক ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার শেয়ার কিনে ৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
এপর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক সরকারকে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার শেয়ারের বিনিময়ে ২ কোটি ৫২ লক্ষ টাকা, সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংককে প্রত্যেকে ৩০ লক্ষ টাকার শেয়ারের বিনিময়ে ৬৩ লক্ষ টাকা লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে।
সদস্যরা ৫৫ কোটি টাকার শেয়ারের বিনিময়ে ৭৭ কোটি টাকা লভ্যাংশ পেয়েছেন (সদস্যরা তুলনামূলকভাবে কম পেয়েছেন, যেহেতু ২০০৬ সালের পরবর্তী সময়ে যারা শেয়ার কিনেছেন তারা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মেয়াদে লভ্যাংশ পেয়েছেন)। প্রত্যেক সদস্যকে প্রতি বছর লভ্যাংশ তার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে বাৎসরিক হিসাব অনুমোদন করার সময় বছরের অর্জিত মুনাফা কীভাবে বন্টন করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুনাফার কী পরিমাণ অংশ ডিভিডেন্ড হিসেবে শেয়ার মালিকদের কাছে বন্টন করা হবে সে বিষয়ে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ লভ্যাংশ দেয়ার মত পর্যাপ্ত না থাকায় ডিভিডেন্ড প্রদান করা হয়নি। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারের দেয়া শর্ত পূরণের জন্য ডিভিডেন্ড প্রদান সম্ভব হয় নি। ডিভিডেন্ড প্রদান না করে সকল মুনাফা পুনর্বাসন তহবিলে প্রদানের শর্তে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে আয়কর অব্যাহতি প্রদান করে এজন্য বোর্ড ডিভিডেন্ড প্রদান করতে পারেনি। ২০০৬ সাল থেকে সরকারের এই শর্ত রহিত হওয়ার পর বোর্ড ২০০৬ সালে ১০০%, ২০০৭ সালে ২০% এবং ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রতিবছর ৩০% হারে লভ্যাংশ প্রদান করেছে। মুনাফার পরিমাণ কম হলে গ্রামীণ ব্যাংক যাতে একই হারে মুনাফা বন্টন করে যেতে পারে সেজন্য “মুনাফা সমতা আনয়ন তহবিল গঠন করেছে। ২০১০ পর্যন্ত এই তহবিলে ৬৯ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা জমা আছে।
গ্রামীণ ব্যাংক যেহেতু প্রফেসর ইউনূস বা তার সহকর্মীদের কোন শেয়ার নাই তাঁরা গ্রামীণ থেকে কোন লভ্যাংশ নিতে পারেন না। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে তার শুধু বেতন ভাতা পান। শুধু সেটুকুই তারা নিয়েছেন।
০৬. প্রশ্নঃ সরকারের আইন অনুসারে ৬০ বছর বয়সের পরও প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থেকেছেন। এটা কি বেআইনী কাজ হয়নি? এই অতিরিক্ত সময়ে বেতন-ভাতা গ্রহণও কি বেআইনী নয়?
উত্তরঃ ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংকের মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন হয়ে সরকারের মালিকানা ৬০% থেকে কমে ২৫% এবং ব্যাংকের সদস্যদের মালিকানা ৪০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫% এ উন্নীত হয় এবং মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন হয়ে সরকারের মালিকানা হ্রাস পাওয়ায় অধ্যাদেশ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের উপর ন্যস্ত করা হয়। সংশোধিত অধ্যাদেশে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়ার পূর্বানুমতিদানের অনুরোধ জানিয়ে ১৪-০৮-১৯৯০ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৫-০৮-১৯৯০ তারিখে চিঠি দিলে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের বিষয়ে পূর্বানুমোদন দেয়। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক তার অনুমোদন পত্রে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের বেলায় কোন বয়সসীমা উল্লেখ করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন পত্রের ধারাবাহিকতায় কোন বয়সসীমা উল্লেখ না করে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত অবস্থায় জুলাই ২০, ১৯৯৯ তারিখে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালকমণ্ডলীর ৫২তম সভায় স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তার অবসর গ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে বোর্ডকে অবহিত করেন। পরিচালকমণ্ডলী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যতদিন পর্যন্ত পরিচালকমণ্ডলী অন্য কোনো সিদ্ধান্ত না নেবে ততদিন পর্যন্ত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বহাল থাকবেন।
উল্লিখিত পর্ষদ সভায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে একটি রেগুলেশন তৈরির সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। উক্ত রেগুলেশনেও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের জন্য কোন বয়স সীমা আরোপ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গ্রামীণ ব্যাংকের উপর ৩১-১২-৯৯ তারিখের স্থিতি ভিত্তিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি মর্মে আপত্তি উত্থাপন করে। গ্রামীণ ব্যাংকের উপর ব্যাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ১৯৯৯ সালের স্থিতি ভিত্তিক বিষদ পরিদর্শন প্রতিবেদনের অনিস্পত্তিকৃত কিছু বিষয়ের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩ জন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ৩ জন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ১৫-০১-২০০১ তারিখে একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। যৌথ সভায় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনের কতিপয় অনুচ্ছেদ নিস্পত্তি হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কতিপয় অনুচ্ছেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, গ্রামীণ ব্যাংক যাচিত ডকুমেন্টসসমূহের কপি সরবরাহ করলে আপত্তিসমূহ নিস্পত্তি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে। সে প্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংক ১৬-০১-২০০২ তারিখে যাচিত ডকুমেন্টসহ পুনঃপরিপালন প্রতিবেদন প্রেরণ করে। পুনঃপরিপালন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে আপত্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে। এ সময় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এর বয়স ছিল ৬১ বছর ৬ মাস। অর্থাৎ তার বয়স এ সময় ৬০ বছর অতিক্রান্ত হলেও এ বিষয়ে ঘটনাত্তোর অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা বলেননি। এর ফলে নিস্পত্তি হয়ে যাওয়া এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরবর্তী কোন বিষদ পরিদর্শন প্রতিবেদনেই এ প্রসংগটি আর কখনোই আসেনি।
উল্লেখ্য যে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই প্রফেসর ইউনূসের বয়স ষাট বছর উর্ত্তীণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সরকার তার বয়স নিয়ে কোন আপত্তি তোলেনি।
মোট ১১ বছরে এটা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আর কোন প্রশ্ন তোলেনি। ২০১১ সালে প্রশ্ন তোলা হলো। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আদালতে গেলেন। আদালত তার আবেদন গ্রহণ করলো না এই বিবেচনায় যে তার প্রতিকার চাওয়ার ‘লুকাস স্টান্ডি’ নেই, অর্থাৎ আবেদন করার যোগ্যতা নাই। তিনি আপিল বিভাগে গেলেন। সেখানেও তার আবেদন একই যুক্তিতে অগ্রাহ্য হলো। তিনি এরপর পদত্যাগ করলেন।
তিনি যে ১১ বছর দায়িত্ব পালন করলেন এটা কি তার অপরাধ, নাকি যাঁরা তাঁকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তাদের অপরাধ, নাকি যে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি দিয়ে এই নিয়োগকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছেন তাদের অপরাধ, এটা স্থির করতে হবে।
০৭. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে কতজন নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি রয়েছেন? ওরা কারা? কীভাবে তারা বোর্ডে আসেন?
উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের আইন অনুসারে বোর্ডে নয়জন নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাচন পদ্ধতি গ্রামীণ ব্যাংক নির্বাচন বিধিমালা তৈরির মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের নয়টি নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হয়। প্রতি নির্বাচনী এলাকায় তিন স্তরে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়। নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন পরিচালনা করেন। নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। যারা শেয়ার কিনেছেন শুধু তাঁরাই ভোটার তালিকায় স্থান পান।
প্রত্যেক স্তর থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। প্রথম স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মিলে দ্বিতীয় স্তরের নির্বাচনে ভোটার হন। দ্বিতীয় স্তর থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় স্তরের প্রতিনিধিরা মিলে তৃতীয় স্তরের প্রতিনিধি পরিষদ গঠন করেন। এই পরিষদ যাকে নির্বাচিত করেন তিনিই ওই নির্বাচনী এলাকার বোর্ড সদস্য হিসেবে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হন। যিনি শেষ পর্যন্ত বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হলেন তাঁকে তিন স্তরের প্রতিটি স্তর থেকে নির্বাচিত হয়ে সর্বশেষ স্তর পর্যন্ত নির্বাচিত হতে হয়। খুবই কঠিন একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়ে তাঁকে বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হতে হয়। বিভিন্ন গুণাবলী যাচাই করে প্রতি স্তরের ভোটাররা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে পরিচিত তার একটি প্রমাণ হলোঃ গ্রামীণ ব্যাংকের ১৩ জন সদস্য গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৪০২২ জন সদস্য ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে ৯৮ জন সদস্য মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, একজন সদস্য উম্মুক্ত আসনে পুরুষ প্রতিদ্বন্ধির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। একজন পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ১৮৪ জন পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।
তাছাড়া সদস্যদের স্বামী ও ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৪৭ জন উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ২৪৮ জন্য পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এসংখ্যা হলো যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সংখ্যা। যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন কিন্তু নির্বাচিত হতে পারেননি তাদের সংখ্যা এর চাইতে অনেক বেশি।
গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নেতৃত্বদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। তাদের সবাইকে যত অবলা নারী চিন্তা করে কথাবার্তা হচেছ, তারা মোটেই তা নন।
০৮. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে নির্বাচিত মহিলা পরিচালকরা কি প্রফেসর ইউনূসের হাতের পুতুল নয়? বোর্ড সভায় তাঁরা কি কোনো ভূমিকা পালন করেন?
উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে সিদ্ধান্তের জন্যে খুব রুটিন বিষয় আসে। বোর্ড সভায় কোন ঋণ প্রস্তাব পাশ করার প্রয়োজন হয়না। ঋণ প্রস্তাব সাধারণতঃ শাখা এবং এরিয়া পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। বোর্ডে শুধু নীতি বিষয়ক প্রস্তাব আনা হয়, বাজেট আনা হয়, পরিকল্পনা আনা হয়। বোর্ড সদস্যরা বোর্ড সভায় অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে সকল বিষয়ে তাদের মনোভাব, প্রশ্ন ও অভিমত প্রকাশ করেন। নির্বাচিত বোর্ড সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে বোর্ড সভায় গ্রামীণ ব্যাংকের বহু নীতির পরিবর্তন হয়েছে এবং বহু নতুন নীতি প্রণীত হয়েছে।
নির্বাচিত সদস্যরাই পরিচালনা পর্ষদের মূল প্রাণশক্তি। চেয়ারম্যান ও সরকারি সদস্যরা তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্যেই সম্মিলিতভাবে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন।
বোর্ডের মোট ১৩ জন সদস্যের মধ্যে চেয়ারম্যান ও সরকারের দু’জন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বোর্ড মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। আজ পর্যন্ত কোন দিন ভোটাভুটি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতে পৌঁছেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
শুরু থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দেশের বিজ্ঞ ও খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রণীত বিধান অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা বোর্ড নির্বাচন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার সদস্যগণের মধ্য থেকে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের নয় জন নির্বাচিত পরিচালকের উপস্থিতিটাই ব্যাংক পরিচালনায় আলোচনার ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাদের সঙ্গে ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় ও যাচাই করা যায়। এই জ্ঞান তাদের কাছে ব্যতীত পৃথিবীর আর কারো কাছে নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের তারা সরাসরি মালিক। গ্রামীণ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের ফল তাদের উপর বর্তায়। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের জীবন সরাসরি জড়িত। তারা উপস্থিত থাকেন বলে আলোচনা জীবন-ভিত্তিক হতে বাধ্য হয়।
শুরু থেকেই চেয়ারম্যানসহ সরকার মনোনীত পরিচালকগণ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গৃহীতা শেয়ারহোল্ডার সদস্যগণের মধ্য থেকে নির্বাচিত পরিচালকগণ গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন। স্মরণ রাখতে হবে যে, তাদের সুযোগ্য পরিচালনার ফলেই গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে নোবেল প্রাপ্তি সম্ভব হয়েছে। তারা যখন বোর্ডে প্রস্তাব পাশ করে নীতি নির্ধারণ করে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যান- তাদের প্রণীত নীতি যদি সদস্যদের পছন্দ না হয় তা হলে নিজ গ্রামের সদস্যসহ আশেপাশের দশ গ্রামের সদস্যরা তাদের উপর চড়াও হবে সেটা তাদের জানা থাকে। সেখানে তখন তিনি সবার সামনে একা। ওদের সঙ্গেই তাকে বসবাস করতে হয়, সাপ্তাহিক মিটিং করতে হয়। তাদের চটাতে তিনি কোনো অবস্থাতেই চান না।
০৯. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংক কি অত্যন্ত উচ্চ সুদের হারে মহাজনী কায়দায় গরিব মানুষকে শোষন করে আসছে না?
উত্তরঃ বাংলাদেশে সরকারি ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাসহ যাবতীয় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার সর্বনিম্ন। গ্রামীণ ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদের হার ২০%। এটা সরল সুদ। ক্রম হ্রাসমান পদ্ধতিতে সুদের হার ঠিক করা হয়। যা ফ্লাট পদ্ধতিতে ১০% এ দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি (এমআরএ) দেশের সকল ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে সর্বোচ্চ সুদের হার নির্ধারণ করেছে ২৭%। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার এই হারের চাইতে ৭% কম।
গ্রামীণ ব্যাংকের গৃহনির্মাণ ঋণের বার্ষিক সুদের হার ৮%। উচ্চশিক্ষা ঋণের সুদের হার, শিক্ষা জীবনে ০% (অর্থাৎ সুদ নেই) এবং শিক্ষা সমাপ্তির পর ৫%। ভিক্ষুক সদস্যদের জন্যে প্রদত্ত ঋণের সুদের হার ০% (অর্থাৎ সুদ নেই)। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলির মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণের উপর সর্বনিু সুদ নেয়, এবং সঞ্চয়ের উপর সর্বোচ্চ (৮.৫% থেকে ১২%) সুদ দেয়।
এসব তথ্য দীর্ঘদিন যাবত গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন নীতিমালা প্রকাশনা ও ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছেও এই তথ্য রয়েছে। তবু অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে কল্পিত বিভিন্ন উচ্চতর সুদের হার গণমাধ্যমে উল্লেখ করে থাকেন, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
উল্লেখযোগ্য যে, ২০১১ সালে প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরও এই সুদের হার এবং আদায় পদ্ধতি সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রয়েছে।
১০. প্রশ্নঃ বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের ওপর কি নিপীড়ন করা হচ্ছে না?
উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম লগ্ন থেকে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের নীতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে এটার পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। স্বতঃস্ফুর্তভাবে যেহেতু সদস্যরা নিজেরাই সঞ্চয়ের ব্যাপারে অভ্যস্থ ও আগ্রহী হয়ে গেছেন সে কারণে পরবর্তীতে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের নিয়ম রহিত করা হয়। সে থেকে সকল সঞ্চয় সম্পূর্ণরূপে ঐচ্ছিক। এখন গ্রামীণ ব্যাংকে কোন বাধ্যতামূলক সঞ্চয় নেই। গ্রামীণ ব্যাংক গোড়া থেকেই সঞ্চয়ের উপর ৮.৫% থেকে ১২% চক্রবৃদ্ধিহারে পর্যন্ত সুদ দেয়। (মাইক্রোফিনান্স রেগুলেটরি অথরিটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলির জন্য সঞ্চয়ের সর্বনিম্ন সুদের হার নির্ধারণ করে দিয়েছে ৬%)। সদস্যরা এর ফলে উৎসাহী হয়ে বেশি টাকা সঞ্চয়ে জমা করেন। যেমন পেনশন ফান্ডে জমা করার ব্যাপারে তাদের খুবই উৎসাহ। কারণ এ টাকায় ১২% সুদ পওয়া যায়। তাদের জমা টাকা তাড়াতাড়ি বড় হয়। অনেকে এককালীন দীর্ঘ মেয়াদী সঞ্চয়ে টাকা জমা রাখেন। সঞ্চয়ের টাকা যখন ইচ্ছা তখন তোলা যায়, জমা দেয়ার পরদিনই তোলা যায়। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের মোট সঞ্চয়ের ব্যালেন্স ৭ হাজার কোটি টাকা। যেখানে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের কোন ব্যাপার নেই সেখানে নিপীড়নের মাধ্যমে সঞ্চয় নেবার কথা উঠে কী করে?
১১. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের কিস্তি দিতে না পেরে অনেক মহিলা কি আÍহত্যা করেনি? অনেক মহিলাকে কি ভিটে-বাড়ি ছাড়তে হয়নি? অনেক মহিলা কি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে না?
উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকের একজন সদস্য আত্মহত্যা করতে পারেন, পালিয়ে বেড়াতে পারেন, আয়ার কাজও করতে পারেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে তাকে এটা করতে হয়েছে এরকম ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। একজন সদস্য গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে পালিয়ে বেড়াবে কেন? গ্রামীণ ব্যাংক কি তার উপর অত্যাচার করে? গ্রামীণ ব্যাংক কি তাকে পুলিশে সোপর্দ করে? তার বিরুদ্ধে কি মামলা করে? গ্রামীণ ব্যাংকের ৩৫ বছরের ইতিহাসে কেউ কি কোনদিন শুনেছে গ্রামীণ ব্যাংক কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেছে? অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট কেইস করার ক্ষমতা সরকারই গ্রামীণ ব্যাংককে দিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক এক দিনের জন্যেও এই আইন কারো উপর প্রয়োগ করেনি।
গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাংকারদের অভিযোগ হলো গ্রামীণ ব্যাংক একটুতেই ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়- যাতে ঋণগ্রহীতাকে “ঋণখেলাপী” বলতে না-হয়। এটা সত্য কথা। ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংক কার্পণ্য করে না। কারণ এটা গ্রামীণের মূল দর্শনের সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। গ্রামীণ ব্যাংক মানুষের মর্যাদায় বিশ্বাসী, বিশেষ করে গরিব মানুষের। গ্রামীণ ব্যাংকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে গরিব মানুষ যতটা না স্বেচ্ছায় খেলাপী হয়, তার চেয়ে অনেক বেশী খেলাপী হয় পারিপার্শিক কারণে। ব্যাংক তাদের পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে তাদের পুরনো ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করে; নতুন করে পুঁজি পূনরুদ্ধার ঋণ প্রদান করে। তবে প্রতিবার ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর সময় সঙ্গে সঙ্গে বকেয়া ঋণের ৫০% এর সমপরিমাণ প্রভিশন করা হয়, অর্থাৎ সেটা খরচের অন্তর্ভূক্ত করে ফেলা হয়। ফলে সদস্যদের সাথে যে আয়োজনই থাকুক না কেন ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী থাকে স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিকমানের।
ঋণখেলাপীই যদি না-হলো তাহলে পালিয়ে বেড়াবেন কেন?
আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে। সদস্য কেবল ঋণগ্রহীতাই নন, তিনি একজন নিয়মিত সঞ্চয় আমানতকারী। কিস্তি দেবার মত টাকা তার সঞ্চয়ী তহবিলেই থাকে। তিনি কেন কিস্তির ভয়ে পালিয়ে বেড়াবেন?
গরিব মহিলার জীবনে সমস্যা অনেক। নারীদের প্রতি সহিংসতার দৌরাত্ম্যে যে সমস্ত দেশ পৃথিবীতে শীর্ষ স্থানে আছে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। অনেক কারণে তিনি আত্মহত্যা করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে আত্মহত্যার কোন সুযোগই নেই। কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার কারণে গত ৩৫ বছরে এর জন্য সদস্যদের থানায় সোর্পাদ করা হয়নি কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি। তাছাড়া আত্মহত্যার পর সদস্যের সঞ্চয়ী আমানতে টাকার পরিমাণ দেখলেই এটা পরিস্কার বুঝা যায়। সাধারণতঃ তিনি যত ঋণ অনাদায়ী রেখে মারা গেছেন তার চাইতে অনেক বেশী টাকা তার সঞ্চয়ী আমানতে জমা পাওয়া যায়। এটা কি গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না-করার কারণে আত্মহত্যার লক্ষণ হতে পারে?
১২. প্রশ্নঃ প্রফেসর ইউনূস কি গ্রামীণ ব্যাংককে নানা কৌশলে আয়কর থেকে মুক্ত রাখেননি; এবং সেজন্য ধিকৃত হননি?
উত্তরঃ সরকারের সহযোগিতায় প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব মহিলাদের স্বার্থে ব্যাংককে ২০১০ সাল পর্যন্ত আয়কর থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। অথচ ২০১০-১১ সালে তার এই কাজের জন্য অনেকে তার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। সরকার ২০১০ এর পরে আর ট্যাক্স অবকাশের সুবিধা রাখতে সম্মত হয়নি। ২০১১ সালের মে মাসে গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদন অগ্রাহ্য করে সরকার দশ কোটি টাকা অগ্রিম আয়কর আদায় করে। প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে যাবার পর সরকার নতুন করে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে কর অবকাশ দিয়েছে। অথচ এই নিয়ে সমালোচনার আর কোন ঝড় দেখা যাচ্ছে না।
১৩. প্রশ্নঃ প্রফেসর ইউনূসের অবর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক কি আগের চেয়েও ভালোভাবে চলছে না? তার অনুপস্থিতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ও ঋণ গ্রহীতাদের ওপর নির্যাতনও কি কমে যায়নি?
উত্তরঃ প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় যে উদ্ভাবনীমূলক বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ছা করে গেছেন তার ফলে ব্যাংকের দৈনন্দিন স্বল্প মেয়াদী পরিচালনায় কোন ধস নামেনি। ধস নামার কথাও নয়। কারণ এখনো গ্রামীণ ব্যাকের সুদের হার, কর্মপদ্ধতি, ঋণ প্রদান, ঋণ আদায় সংক্রান্ত প্রফেসর ইউনূস প্রবর্তিত নিয়মাবলী সবই হুবহু একইভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করা হচ্ছে। যারা বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা করছেন তাঁরা সবাই তার হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তার সময়ে সুদের হার যা ছিল বর্তমানেও তাই রয়েছে, ঋণ গৃহীতাদের উপর নির্যাতন আগেও ছিল না; এখনো নেই। তাই কমার কোনো প্রশ্নই উঠে না।
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভুল লোকের হাতে পড়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কিংবা ভুল নীতির জন্য সমস্ত ব্যবস্থাপনা ধসে পড়তে পারে।
১৪. প্রশ্নঃ ‘গ্রামীণ’ নামের কোম্পানিগুলোর মালিক কারা?
উত্তরঃ ‘গ্রামীণ’ নামের অধিকাংশ কোম্পানি কোম্পানি আইনের সেকশন ২৮ দ্বারা গঠিত। এই আইনে গঠিত কোম্পানীর কোনো মালিক থাকেনা। কেউ ব্যক্তিগতভাবে মুনাফা নিতে পারে না। এ ধরণের কোম্পানির আইনের ভাষায় “নন স্টক কোম্পানি লিমিটেড বাই গ্যারান্টি” বলা হয়। এতে পরিচালকরা কোম্পানির জন্য বক্তিগত গ্যারান্টি দেন কিন্তু কোনো মুনাফা গ্রহণ করতে পারেন না।
কয়েকটি কোম্পানি ‘ফর প্রফিট’ কোম্পানী হিসেবে নিবন্ধিত। উল্লেখিত কোনো না কোনো নন প্রফিট কোম্পানি এদের মালিক। ফলে এগুলোর মুনাফা নন প্রফিট কোম্পানিগুলোর কাছেই যায়। কোনো ব্যক্তির কাছে যেতে পারে না।
১৫. প্রশ্নঃ যে ৫৪টি ‘গ্রামীণ’ নামধারী বিভিন্ন কোম্পানিতে গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা ও সুনাম ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো কি গ্রামীণ ব্যাংকের কোম্পানি নয়?
উত্তরঃ ‘গ্রামীণ’ নামধারী ৫৪টি কোম্পানীতে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো বিনিয়োগ করা হয়নি। বিভিন্ন কোম্পানীতে বিভিন্ন সূত্র থেকে এই মূলধন এসেছে। অনেকের মূলধন এসেছে দাতা সংস্থার অনুদান থেকে। কারো এসেছে ঋণ থেকে। কারো এসেছে অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ থেকে। কোনো প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কোনো বিনিয়োগ নেয়নি।
প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থের সূত্র কী, সে টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অডিটকৃত আর্থিক প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে দেয়া আছে। সে প্রতিবেদন প্রতি বছর সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়।
‘গ্রামীণ’ নামের সুনাম এসেছে প্রফেসর ইউনূসের উদ্ভাবনীমূলক সৃষ্টির সাফল্য থেকে। গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মের আগে থেকেই তিনি ‘গ্রামীণ’ নামটি তার কাজে ব্যবহার করে এসেছেন। জোবরা গ্রামে তিনি কৃষি ব্যাংকের যে শাখা পরিচালনা করেছিলেন সেটার নাম দিয়েছিলেন ‘পরীক্ষামূলক গ্রামীণ শাখা’। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যে প্রকল্প পরিচালনা করেছিলেন তার নাম দিয়েছিলেন “গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প”। গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম। প্রফেসর ইউনূস তার নেয়া সব উদ্যোগের সঙ্গে “গ্রামীণ” নামটি জুড়ে দিয়ে এসেছেন। দেশেও করেছেন, বিদেশেও করেছেন। পৃথিবীর বহু দেশে এই বাংলা শব্দটি অনেকের কাছে খুবই পরিচিত শব্দ, এবং এটা অত্যন্ত সম্মানিত শব্দ।
১৬. প্রশ্নঃ প্রফেসর ইউনূস সৃষ্ট ৫৪ টি কোম্পানীর উত্তরাধিকারী কে? তার অবর্তমানে এসব কোম্পানির মালিক হবে কে?
উত্তরঃ কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রফেসর ইউনূসের কোন মালিকানা নেই। তিনি কোথাও একটি শেয়ারেরও মালিক নন। কাজেই তার উত্তরাধিকার নিয়ে চিন্তিত হবারও কিছু নেই। প্রফেসর ইউনূস সৃষ্ট ৫৪ টির অধিকাংশ “নট ফর প্রফিট” কোম্পানি যা কোম্পানি আইনের সেকশন ২৮ এর আওতায় নিবন্ধিত। এধরণের কোম্পানির কোনো মালিক থাকে না। সেজন্য মালিকানার কোনো উত্তরাধিকারের প্রশ্ন আসেনা। পরিচালনা পর্ষদ বা সাধারণ পর্ষদে কোনো পদ শূণ্য হলে কোম্পানির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে তা পূরণ করা হয়। এর মাধ্যমে কোম্পানী অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে।
‘গ্রামীণ’ নামের যে কয়েকটি ‘ফর প্রফিট’ কোম্পানি রয়েছে সে কয়েকটির মালিক উল্লেখিত কোনো না কোনো নন প্রফিট কোম্পানীর। যেহেতু এই ফর প্রফিট কোম্পানিগুলির মালিক যে সকল কোম্পানি তাদের অস্তিত্ব নিরবিচ্ছিন্নভাবে বজায় থাকছে সেহেতু কখনো মালিকানায় শূণ্যতা সৃষ্টির কোনো অবকাশ নেই।
যেহেতু প্রতিটি কোম্পানিই প্রচলিত আইনের আওতায় সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান তাই তাদের উপর নজরদারী করার জন্য উপযুক্ত আইনী কর্তৃপক্ষ আছে। এমনকি এগুলোর অবসায়ন করতে হলেও হাই কোর্টের মাধ্যমে করতে হবে।
১৭. প্রশ্নঃ গ্রামীণফোনের মালিক কে?
উত্তরঃ ‘গ্রামীণ ফোনের’ বড় অংশের মালিক হলো ‘টেলিনর’ নামক নরওয়ের একটি টেলিফোন কোম্পানি। আবার টেলিনরের বড় অংশের মালিক হলো নরওয়ে সরকার। গ্রামীণ ফোনের দ্বিতীয় মালিক হলো গ্রামীণ টেলিকম। এটা কোম্পানি আইনে নিবন্ধনকৃত একটি মালিকবিহীন নন প্রফিট কোম্পানি (যার ব্যাখ্যা অন্য একটি উত্তরে দেয়া হয়েছে)। তৃতীয় মালিক হলো বাংলাদেশের অসংখ্য শেয়ার হোল্ডার, যাঁরা শেয়ার বাজারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তাদের শেয়ার বেচাকেনা করেন। প্রফেসর ইউনূস প্রত্যেক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে গ্রামীণফোনের কোনো শেয়ারের মালিক ছিলেন না এবং এখনো নেই।
১৮. প্রশ্নঃ গ্রামীণফোনের শেয়ার কেনার জন্য গ্রামীণ টেলিকম এত টাকা কিভাবে সংগ্রহ করেছে?
উত্তরঃ গ্রামীণফোনে ইক্যুইটিতে বিনিয়োগের জন্য গ্রামীণ টেলিকম তিনভাবে পুঁজি সংগ্রহ করেছে। প্রফেসর ইউনূসের ব্যক্তিগত অনুরোধে প্রখ্যাত মার্কিন ধনী ব্যক্তি জর্জ সারোস তার ফাউন্ডেশান থেকে গ্রামীণ টেলিকমকে ১১ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। সে অর্থ গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণফোনে বিনিয়োগ করে। সে অর্থ গ্রামীণ টেলিকম যথাসময়ে সরোস ফাউন্ডেশানকে পরিশোধ করে দিয়েছে। গ্রামীণ টেলিকম দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে গ্রামীণফোনের ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ করেছে। এটাকাও যথাসময়ে পরিশোধ হয়ে গেছে। এছাড়া গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ কল্যাণ থেকেও ঋণ নিয়েছে। গ্রামীণ কল্যাণ কোম্পানি আইনে সৃষ্ট মালিকবিহীন একটি প্রতিষ্ঠান।
১৯. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ফোন থেকে পর্যাপ্ত গ্রামীণ টেলিকমের মুনাফা কোথায় যায়?
উত্তরঃ গ্রামীণফোন থেকে গ্রামীণ টেলিকমের মুনাফা টাকা দিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া গ্রামীণফোনের ইক্যুইটিতে বিনিয়োগের জন্য গৃহীত ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। মুনাফার টাকা গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ঋণ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কয়েকটি বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গ্রামীণ টেলিকম মুনাফার টাকা যাতে স্থায়ীভাবে দেশের কল্যাণে ব্যবহার করা যায় তার জন্য “গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট” নামে একটি ট্রাস্ট তৈরি করেছে। গ্রামীণ টেলিকমের মুনাফার টাকা ট্রাষ্টকে দান করা হয়। ট্রাস্ট ইতিমধ্যেই একাধিক জনকল্যাণমুখী প্রকল্প চালু করেছে। একটি “হেলথ কমপ্লেক্স” তৈরি করার জন্য সাভারে জমি ক্রয় করেছে। সেখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের মেডিকেল কলেজ, একটি নার্সিং কলেজ, একটি মেডিকেল সার্পোট সার্ভিস কলেজ, জেনারেল হাসপাতাল, কার্ডিয়াক হাসপাতাল এবং ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে।
এছাড়া বৃহৎ পরিসরে মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা দেশের জনগণের নাগালের মধ্যে আনার জন্য একটি “হেল্থ সিটি” স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে ঢাকার মাওনাতে জমি ক্রয় অব্যাহত রয়েছে, যেখানে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মানের সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ বৃহৎ হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যা সমাধানকল্পে স্থাপিত সামাজিক ব্যবসায় ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
গ্রামীণ টেলিকম থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ও কর্মচারীদের কল্যাণে গ্রামীণ কল্যাণ আর্থিক সহায়তা ও দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে আসছে। গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণকে এ পর্যন্ত ৮ শত ৮০ কোটি টাকা প্রদান করেছে।
গ্রামীণ টেলিকমের টাকা এবং গ্রামীণ টেলিকম ট্রাষ্টের টাকা ব্যক্তিগতভাবে কারো পাবার কোন উপায় নেই। গ্রামীণফোনের মুনাফার টাকা মালিকবিহীন প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমের কাছে আছে এবং সে টাকার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য তা গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের হাতে ন্যস্ত করা হয়। গ্রামীণ টেলিকম ট্রাষ্ট দেশের বিশেষ করে গরিবের মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন খাতে এ টাকা বিনিয়োগ করে।
হয়তো সবার স্মরণ আছে যে, গ্রামীণ টেলিকমের সহায়তায় গ্রামীণফোন গ্রামের গরিব মহিলাদের কাছে মোবাইল পৌঁছে দিয়ে সারা পৃথিবীতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। গ্রামের মহিলারা ভর্তুকী মূল্যে এয়ার- টাইম ক্রয় করে বাজার মূল্যে বিক্রি করে বড় অংকের টাকা রোজগার করে যাচ্ছেন। এক সময় ৪ লক্ষ টেলিফোন একাজে নিয়োজিত হয়ে তাদের জীবনে বড় রকম আর্থিক পরিবর্তন এনেছেন। এজন্য গ্রামীণ ফোন থেকে যে সার্ভিস চার্জ গ্রামীণ টেলিকম পেয়ে থাকে তার ৮০% গ্রামীণ ব্যাংককে প্রদান করা হয়। শুরু থেকে জুন ২০১২ পর্যন্ত সর্বমোট ২ শত ৮৭ কোটি টাকা এ বাবদ গ্রামীণ ব্যাংককে প্রদান করা হয়েছে।
২০. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ফোনের লাভের টাকা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা পায়না কেন?
উত্তরঃ প্রথম পর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ ফোনের কোনো শেয়ারের মালিক ছিল না। কয়েক বছর আগে গ্রামীণ ফোন যখন তার শেয়ার বাজারে ছাড়ে তখন গ্রামীণ ফোনের কিছু শেয়ার গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের কল্যাণে গঠিত এৎধসববহ ইধহশ ইড়ৎৎড়বিৎং ওহাবংঃসবহঃ ঞৎঁংঃ এর জন্য কেনা হয়। সে শেয়ারের মুনাফা এৎধসববহ ইধহশ ইড়ৎৎড়বিৎং ওহাবংঃসবহঃ ঞৎঁংঃ নিয়মিত পেয়ে আসছে।
২১. প্রশ্নঃ ‘গ্রামীণ’ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে আদৌ কোনো ট্যাক্স, ভ্যাট দেয়?
উত্তরঃ প্রফেসর ইউনূস প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ট্যাক্স, ভ্যাট দেয়। বাৎসরিক অডিট হয়। অন্যান্য ব্যবসায়িক কোম্পানীর মতো এগুলি সকল প্রকার রেগুলেটরি এজেন্সির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। যেসকল কোম্পানির জন্য বোর্ড অব ইনভেষ্টমেন্ট থেকে অনুমোদন প্রয়োজন যেসব কোম্পানী বোর্ড অব ইনভেষ্টমেন্ট থেকে অনুমোদন নিয়েছে। যে সমস্ত রিটার্ন রেজিট্রারার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিকে দেয়ার কথা সেগুলো নিয়মিত দিয়ে আসছে। যে সমস্ত কোম্পানির এন.জি.ও ব্যুরো থেকে অনুমোদন দরকার তারা সেখান থেকে অনুমোদন নিয়েছে। সরকারের নজরদারীর বাইরে কোন কোম্পানি কাজ করে না।
২২. প্রশ্নঃ প্রফেসর ইউনূস কি গ্রামীণ ব্যাংক ভবনের একটি ফ্লোর (এগারো হাজার বর্গফুট) বিনা ভাড়ায় “ইউনূস সেণ্টারের” অফিস স্থাপন করে গ্রামীণ ব্যাংককে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেননি?
উত্তরঃ সরকার বিশেষ ব্যক্তিকে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনার জন্য, বা বিজয়ী খেলোয়াড় দলকে দেশের সম্মান বৃদ্ধির জন্য যেমন বিশেষভাবে পুরস্কৃত করে, তেমনি গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ দেশের নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে জন্য সম্মান বয়ে আনার জন্য এবং গ্রামীণ ব্যাংককে একটা জাতীয় গৌরবের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য প্রফেসর ইউনূসকে স্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য একটি ফ্লোর দান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রফেসর ইউনূসের চিন্তা ও কর্মসূচি সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে “নোবেল লরিয়েট ট্রাস্ট” নামে একটা ট্রাস্ট গঠন করে তার নিকট একটি ফ্লোর (১৬ তম তলা) দান করে দেয়া হয়। এর পর নোবেল লরিয়েট ট্রাস্ট এই ফ্লোরটি ইউনূস সেণ্টারকে ব্যবহারের জন্য ২৪ বছরের জন্য নামমাত্র ভাড়ায় ইজারা দেয়।
ইউনূস সেণ্টারের মূল লক্ষ্য হলো নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের দর্শন ও কার্যাবলী দেশে ও বিদেশে বিস্তৃত করা, তার অতীতের কার্যাবলীকে আরো জোরদার করা, মানব কল্যাণে তার সৃজনশীল ও উদ্ভাবনীমূলক কর্মকাণ্ডকে অব্যাহত গতিতে অগ্রসর করতে সহায়তা করা, নতুন প্রজন্মকে নতুন পৃথিবী গড়তে উদ্বুদ্ধ করা।
২৩. প্রশ্নঃ প্রফেসর ইউনূস বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে ওয়েজ আর্নার স্কীমের আয় দেখিয়ে কি কর ফাঁকি দেননি?
উত্তরঃ প্রফেসর ইউনূস বিদেশ থেকে প্রতি বছর প্রচুর টাকা আয় করেন। বিদেশ থেকে যেসব খাতে তিনি আয় করেন সেগুলো হলোঃ ১) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বা সম্মেলনে বক্তৃতা, ২) তার লেখা বিভিন্ন বই যেগুলি বহু দেশে বহু ভাষায় অনুদিত হয়ে বিক্রি হচ্ছে, তার রয়ালিটি। ৩) নোবেল পুরস্কারসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার। প্রফেসর ইউনূস অত্যন্ত উচ্চ হারের ফি’র বিনিময়ে বিদেশে বিভিন্ন সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। অনেক স্থানে তার বক্তৃতা শোনার জন্য শ্রোতাদের অর্থের বিনিময়ে টিকিট কাটতে হয়। তার লেখা কয়েকটি বই বিভিন্ন দেশে পঁচিশটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তার বই নিউ ইয়র্ক টাইমসের “বেষ্ট সেলার লিষ্টে” অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। বক্তৃতা, বই ও পুরস্কার থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা তিনি বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়মিত দেশে আনেন। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিদেশে অর্জিত তার ব্যক্তিগত আয় যদি ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আনেন এবং প্রতি বছর আয়কর রির্টানে তা প্রদর্শন করেন তাহলে তা আয়কর আইনে করমুক্ত। তাই আইনগতভাবেই তার বৈদেশিক আয় করমুক্ত। তিনি এই আইনের ভিত্তিতেই আয়কর রিটার্ণ দাখিল করে এসেছেন, আয়কর বিভাগ কোনদিন আপত্তি জানায়নি। অন্যান্য তার সকল দেশী ও বিদেশী আয় তিনি আয়কর রির্টার্ণে প্রদর্শন করেন এবং আয়ের উপর তিনি আয়কর বিভাগ কর্তৃক নিরূপিত আয়কর আইন অনুযায়ী নিয়মিত দিয়ে আসছেন।
২৪. প্রশ্নঃ কোনো রকম আইনি ভিত্তি ছাড়া প্রফেসর ইউনূস কি সামাজিক ব্যবসার নামে মানুষকে ধোকা দিয়ে যাচ্ছেন না?
উত্তরঃ সামাজিক ব্যবসা ও প্রচলিত ব্যবসার মধ্যে আইনগত কোনো পার্থক্য নেই। ব্যবহারিক পার্থক্য একটাই। তা হলো, প্রচলিত ব্যবসায় মালিক ব্যবসার মুনাফা নিজে গ্রহণ করে, আর সামাজিক ব্যবসায় মালিক ব্যবসার মুনাফা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেন না। মুনাফার টাকা কোম্পানীর উন্নয়ন ও সম্প্রসারনে ব্যবহৃত হয়। এটি মালিকের সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানে আইনের কোনো ভূমিকা নেই। সামাজিক ব্যবসার জন্যে নতুন করে আইন করার কিছু নেই। প্রচলিত ব্যবসা সংক্রান্ত আইনই এর জন্য যথেষ্ট। সামাজিক ব্যবসার জন্য কোন বিশেষ সুযোগ সুবিধা সরকার দিক এটাও প্রফেসর ইউনূস চাননা।
সামাজিক ব্যবসা প্রফেসর ইউনূসের একটি আইডিয়া। যে কেউ নিজের উদ্যোগে সামাজিক ব্যবসা করতে পারেন। বাংলাদেশে ও বিদেশে অনেকেই সামাজিক ব্যবসা শুরু করেছেন। যেখানে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়াটাকে সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়েছে, সেখানে ধোঁকাবাজির প্রশ্ন উঠার সুযোগ কোথায়? বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রচলিত আইন মেনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পরিচালিত হচেছ।
২৫. প্রশ্ন ষাট বছর বয়স পার করে অতিরিক্ত এগারো বছর অবৈধভাবে চাকুরী করে মোট কত টাকা প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নিয়ে গেছেন তার হিসাব জনসমক্ষে তিনি প্রকাশ করছেন না কেন?
উত্তরঃ ষাট বছর উত্তীর্ণ হবার পর জুন ২৯, ২০০০ তারিখ থেকে মে ১২, ২০১১ তারিখ পর্যন্ত প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই ১১ বছরে তিনি মোট ৫২ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা বেতন-ভাতা ইত্যাদি বাবদ পেয়েছেন। এ টাকা থেকে বাড়ীভাড়া, এবং মুল বেতনের ৭.৫% হিসেবে মেইনটেনান্স খরচ কেটে রাখার পর, তিনি নগদ (টেক হোম পে) টাকা পেয়েছেন ৩৮ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা। তাতে তার মাসিক গড় নগদ বেতনের (টেক হোম পে) পরিমাণ দাড়ায় ২৯ হাজার ৯ শত টাকা।
২৬. প্রশ্নঃ গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড চাইলেও প্রফেসর ইউনূস নিজে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ আঁকড়ে রাখতে চান কেন? তার যে বয়স হয়ে গেছে এটাকি তিনি বুঝেন না?
উত্তরঃ প্রফেসর ইউনূস বহুবার চেষ্টা করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থেকে অবসর নেয়ার জন্য। কিন্তু বোর্ডের বাধার মুখে তিনি তাতে সফল হননি। সর্বশেষ তিনি কয়েক বছর আগে বর্তমান অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে একটা ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন। তাতে তিনি তার পদ থেকে সরে আসার ব্যাপারে তার সহযোগিতা চান। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তাতে মৌখিক সম্মতিও দেন। কিন্তু প্রস্তাবিত পথে তিনি অগ্রসর হননি। (চিঠিটি হুবহু কোনো কোনো পত্রিকায় ছাপানোও হয়েছিল)।
প্রফেসর ইউনূসের আপত্তিটা তার সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে নয়। তার আপত্তিটা ছিল যে কারণে তাঁকে সরে যাওয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছিল সেটা নিয়ে। তিনি আদালতকে জানাতে চেয়েছিলেন যে তার ষাট বছর পার হয়ে যাবার পরেও তাকে তার পদে বহাল থাকার ব্যাপারে বোর্ডের যেরকম আগ্রহ ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকেরও তাতে তেমন সম্মতি ছিল। এগুলি নথিপত্রেই আছে। তিনি আদালতের কাছে এগুলি দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহামান্য আদালত তার আবেদন শুনতে অপারগতা প্রকাশ করে। তিনি তো চলে যাবার জন্য উদগ্রীবই ছিলেন। কাজেই তার পদে বহাল থাকার জন্য লড়াই করার প্রশ্নই উঠে না। এটা ছিল প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরার একটা উদ্যোগ। যাতে এটা নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি না হয়।
২৭. প্রশ্নঃ প্রফেসর ইউনূস কি দীর্ঘ ৩৫ বছরে তার উপযুক্ত উত্তরসূরি তৈরি করে যেতে ব্যর্থ হননি? তিনি কি ইচ্ছা করেই একাজ করেননি, যাতে তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকে ধরে রাখা অপরিহার্য হয়ে পড়ে?
উত্তরঃ গ্রামীণ ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরবর্তী পদটি হলো উপ- ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। এপদে একজন বরাবরই থাকেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ শূন্য হলে তিনি এ পদের জন্য একজন উপযুক্ত প্রার্থী হবেন এটাই স্বাভাবিক। এখানে শূন্যতা সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই।
“উত্তরাধিকার” বলতে নানাজনের মনে হয়তো নানা কল্পনা আছে। এগুলি খোলাসা করে আলাপ করলে বুঝা যাবে কেউ কারো সঙ্গে একমত হচ্ছে না। যেমন, সরকার বলছেন যে তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুঁজে নিয়ে আসবেন। তাতে ধারণা করা যায় যে তারা দেশের মধ্যে একজন উপযুক্ত প্রার্থী পাবেন এ রকম আশা করছেন না। হয়তো বিদেশে অবস্থানরত কারো কারো কথা মনে রেখে এরকম উদ্যোগটি নেয়া হচ্ছে।
গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের হাতে গড়া এবং পরিচালিত একটা প্রতিষ্ঠান। একমাত্র নোবেল জয়ী প্রতিষ্ঠান যার জন্ম স্থানীয়ভাবে, যেটা কাজ করে দেশের সীমানার মধ্যে, যেখানে একজন বিদেশী লোকও কোনদিন চাকরি করেনি। কি কারণে এখন এই প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রধান নির্বাহী খুঁজতে বিদেশে বেরুতে হবে তার একটা ব্যাখ্যা কাউকে দিতে হবে। বাংলাদেশে যাঁরা বসবাস করেন তাদের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ করার কি কারণ ঘটেছে?
প্রফেসর ইউনূস তার সহকর্মীদের অযোগ্য মনে করেননি। তিনি মনে করেছেন প্রতিষ্ঠানের ভিতরে, দেশের ভিতরে, অনেকে আছেন যাঁরা গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্বন্ধে সম্যকভাবে পরিচিত, যাঁরা মনে মেজাজে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজের সঙ্গে সহমর্মী হবেন। তাঁরা বিদেশী বেতন নিয়ে দেশে চাকুরী করে, বিশেষ করে নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হয়ে পরিচিতি ধারণ করে, পরবর্তী আন্তর্জাতিক চাকরির প্রস্তুতি নিতে এখানে আসবেন না।
সরকার তো নিজেই বরাবর দেশবাসীকে জানাচ্ছেন যে গ্রামীণ ব্যাংক আগের চাইতে অনেক ভালো চলছে। তাহলে উত্তরাধিকারের অভাব অনুভব হচ্ছে কেন? ঘরে লোক থাকতে আমরা আন্তর্জাতিক লোক খুঁজতে যাচ্ছে কেন? যাঁরা খুঁজছেন তাঁরা কি এমন লোক খুঁজছেন যাঁরা প্রার্থী সন্ধানকারীদের সমাজে স্বচ্ছন্দে উঠাবসা করতে পারবেন, তাদের ভাষায়, তাদের ভঙ্গীতে কথাবার্তা বলতে পারবেন? প্রফেসর ইউনূস তো ঠিকই উত্তরসূরি তৈরি করে গেছেন। একজনের পর একজন উপর দিক থেকে চলে যাবার পরও পরবর্তী জনেরা যোগ্যতার সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা করে চলেছেন। সরকার তাদের বাহবা-ও দিয়েছেন। তাহলে তো বলতে হবে প্রফেসর ইউনূস শুধু একজন উত্তরসূরি নয়, এক সারি উত্তরসূরি তৈরি করে গেছেন।
২৮. প্রশ্নঃ প্রফেসর ইউনূসের নাকি এত আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, বিদেশে নাকি তার খুব প্রভাব প্রতিপত্তি, কিন্তু তার কিছুই দেশের কাজে লাগাতে দেখি না। আমেরিকার বাজারে আমাদের তৈরি পোষাকের শুল্ক মুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে, পদ্মাসেতুর ব্যাপারে, সৌদী আরবে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ‘আকামা’ সমস্যার সমাধানে, তাঁকে তো কোনদিন তার প্রভাব খাটাতে দেখি না। দেশের কোন উপকার করতে তিনি এত নারাজ কেন?
উত্তরঃ একজন নাগরিকের প্রভাব থাকলে তা খাটানোর কাজে সরকারের একটা ভূমিকা দরকার হয়। সরকারের রায় থেকে সেই নাগরিককে এই দায়িত্ব অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও দিতে হয়। দু’দিকের সরকারকে বুঝতে হবে যে সেই নাগরিকের সঙ্গে কথা বললে তিনি সে কথা অন্য দিকের সরকারকে জানাতে পারবেন এবং তাঁরা সেটা বিবেচনা করবেন; নাগরিক শুধু তার প্রভাব খাটিয়ে আলোচনাকে সহজ করে দিচ্ছেন মাত্র। তখন যেকোনো আলোচনা অগ্রসর হতে পারে। প্রফেসর ইউনূসের বর্তমান পরিস্থিতি সে রকম নয়। বর্তমান যুগের শক্তিশালী মিডিয়ার কারণে সকল দেশের সরকার জেনে গেছে প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনেকটা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। তাছাড়া সেটা তাঁরা চাক্ষুস দেখেনও। প্রফেসর ইউনূসের সম্মানে যখন কোনো একটি দেশে একটি অনুষ্ঠান হয় সেখানে সে দেশের মন্ত্রীরা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা আমন্ত্রিত হন; অনেকে আগ্রহ সহকারে উপস্থিত হন। কিন্তু একশত ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপস্থিত থাকেন। সবাই জানতে চায় যে, যে দেশের একজন বিশিষ্ট মানুষের সম্মানে অনুষ্ঠান, সে দেশের রাষ্ট্রদূতের তো সেখানে গৌরবের সঙ্গে উপস্থিত থাকার কথা, অথচ তিনি অনুপস্থিত কেন? অবশ্য কারণ কারো বুঝতে কারো কষ্ট হয় না। তাদের ধারণাটি আরো বদ্ধমূল হয় যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।
প্রফেসর ইউনূস একটা সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিন বছর আগে। তার নাম গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস। প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানী করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বিভিন্ন দেশের কোম্পানী সরাসরি এর মাধ্যমে জনশক্তি আমদানীর জন্য তার কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কয়েকটি কোম্পানী অগ্রীম চাহিদাও দিয়ে রেখেছিল। সে সব দেশের সরকারও এই উদ্যোগে উৎসাহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু এপর্যন্ত আমাদের সরকারের কাছ থেকে একাজ শুরু করার অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তাই এই কোম্পানীর কার্যক্রম কোনদিন আর শুরু করা যায়নি। অটোমেকানিক, অটো-ইনঞ্জিনিয়ারিং প্রশিক্ষণ দেবার জন্য জাপানি একটা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে “প্রশিক্ষণ কেন্দ্র” খোলার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। সে কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাও সহজ হবে কিনা এখনো বলা মুশকিল। প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার জন্য জার্মানীর একটা বিখ্যাত কোম্পানী ২০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার সমস্ত প্রস্তুুতি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন- তাঁরা হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।
তিন বছর আগে সৌদী রাজ পরিবারের একজন জ্যেষ্ঠ্য সদস্য প্রিন্স তালাল বিন আবদুল আজিজ আল সাউদ বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি লেখেন যে তিনি তার প্রতিষ্ঠান ‘আরব গালফ ফান্ডের’ বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভাটি বাংলাদেশে করতে চান। তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে আরব দেশগুলির সংবাদ মাধ্যম উপস্থিত থাকবে। তিনি নিজে এবং আরব দেশেরসমূহের অন্যান্য গণ্যমান্য বক্তিবর্গ এখানে উপস্থিত থাকবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করার জন্য তিনি আমন্ত্রণ করেন এবং অনুষ্ঠানের সামগ্রিক অনুষ্ঠানসূচী বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেন। প্রিন্স তালাল প্রফেসর ইউনূসের দীর্ঘ দিনের বন্ধু। আরব গলফ ফান্ডের মাধ্যমে তিনি আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যের সাতটি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকরণে ‘মাইক্রোফাইনান্স ব্যাংক’ স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ সরকার থেকে জানানো হয় যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সানন্দে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন, তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কোন বাংলাদেশী বক্তৃতা করতে পারবেন না। এই জবাবে প্রিন্স তালাল অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি প্রফেসর ইউনূসকে জানান যে প্রফেসর ইউনূসকে সম্মান জানানোর জন্যই এই সমগ্র অনুষ্ঠানটি তিনি বাংলাদেশে করতে চেয়েছিলেন। যদি প্রফেসর ইউনূস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে না পারেন তাহলে তিনি বাংলাদেশে এই অনুষ্ঠান করবেন না। তিনি এই অনুষ্ঠান কুয়ালালামপুরে নিয়ে যান। পহেলা ডিসেম্বর, ২০০৯ তারিখে প্রিন্স তালাল এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে এ অনুষ্ঠান কয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়। মালয়শিয়ার প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সমস্ত অতিথেয় দেখিয়ে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অতিরিক্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নাজিব প্রফেসর ইউনূসকে সম্মানিত করেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিবের পরিবারের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের অনেক আগের সম্পর্ক। ১৯৯৪ সালে তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রফেসর ইউনূসকে “তুন আবদুর রাজ্জাক পুরস্কার” দেয়া হয়েছিল। তার বাবার স্মৃতিতে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে।
প্রফেসর ইউনূস নিশ্চয়ই আনন্দিত হবেন যদি তার কোন ভূমিকা দেশের কোন সমস্যা সমাধানে কাজে লাগতে পারে। কিন্তু তাঁকে কাজে লাগাতে হবে তো।
২৯. প্রশ্নঃ প্রফেসর ইউনূস তার প্রভাব খাটিয়ে পদ্মাসেতুর জন্য বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়ে কি একটা রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করেন নি?
উত্তরঃ প্রফেসর ইউনূস পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে আগেই ব্যাখ্যা করেছেন যে পদ্মাসেতু বাংলাদেশের মানুষের একটা স্বপ্ন। তিনিও বিশ্বাসী। এস্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করবেন। বিরোধিতা করার তো প্রশ্নই আসে না। প্রফেসর ইউনূস তার প্রভাব খাটিয়ে পদ্মাসেতুর টাকা বন্ধ করে দিয়েছেন এগল্প যাঁরা বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে তাদের ধারণা নেই। যাঁরা এই গল্প প্রচার করেন তাঁরা এটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বলেন যে, তিনি সরাসরি বিশ্ব ব্যাংককে চাপ না দিলেও, তার বন্ধু হিলারীকে দিয়ে চাপ দিয়েছেন। অর্থাৎ তার একটা সংশ্লিষ্টতা নিশ্চয়ই আছে।
আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তের কঠিন জগৎ দুই বন্ধুর খায়েশের উপর নির্ভর করে চলে না। প্রফেসর ইউনূস যত বড়মাপের লোকই হোন না কেন, তার সাথে যত পরাক্রমশালী ব্যক্তির সখ্যতা থাকুক না কেন, তিন বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট তার আবদারের কারণে বন্ধ হয়ে যাবে না। আসল বিষয়ের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার জন্য এরকম গল্পের আশ্রয় নেয়া হয়। আসল বিষয়টি পত্রিকায় প্রতিদিন বারবার আসছে। বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। তারা বলছে তাদের হাতে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে। বাংলাদেশকে তার তদন্ত করতে হবে।
আষাঢ়ে গল্প বানিয়ে মূল বিষয় থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানো সহজ হবে না।(সংগৃহীত)