এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অলি আহাদ এক সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চেতনার নাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী, ক্ষুদে নেতা থেকে শুরু করে মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তার গোটা জীবনটাই কেটেছে সক্রিয় রাজনৈতিক তত্পরতার মধ্য দিয়ে। জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি শাসকশ্রেণীর অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করেছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৭ বার কারাভোগ করেছেন। আত্মগোপনে ছিলেন ২ বার। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে রাজনৈতিক কারণে তিনি প্রায় ৭ বছর আত্মগোপনে ছিলেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে তিনি ৬ বার গ্রেফতার হন এবং ৩৫৭ দিন কারাভোগ করেন।
দীর্ঘ ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতা বা ক্ষমতার মোহ তাকে কোনো দিনই আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তাই তিনি এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন অনন্য সত্ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সমানভাবে পরিচিত। নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাত, কর্মচাঞ্চল্য, বর্ণাঢ্য এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ তার রাজনৈতিক জীবন। অত্যন্ত সমৃদ্ধ তার অভিজ্ঞতা, জাতীয় রাজনীতিতে হাজারো ঘটনা ঘটেছে তার চোখের সামনে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তিনি এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কৈশোরেই তিনি রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তদানীন্তন ভারতীয় মুসলিম সমাজে যে অভূতপূর্ব জাগরণ দেখা দেয় তা তার তরুণ মনে ভীষণভাবে রেখাপাত করে। তার বাবা দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, মাসিক মোহাম্মদী ও মাসিক সওগাতের নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। এসব পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র খেলার খবর—বিশেষভাবে ফূটবল খেলার মাঠে ৩৪ সাল থেকে কলকাতা মোহামেডানের ধারাবাহিক বিজয়ের সংবাদ তার কিশোর মনে তথা আবাল বৃদ্ধ বনিতা মুসলমানদের মনে এক লুপ্তপ্রায় সত্তার পুনর্জাগরণের আহ্বান ও আবেদন জানায়। এর সঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনা, গীত, গজল, আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠ আত্মজ্ঞানহারা ম্রিয়মান ও পশ্চাত্পদ মুসলমান সমাজকে আত্মসচেতন ও আত্মবলে বলীয়ান করতে বিশেষ অবদান রাখে। ফলে ভারতের বুকে মুসলমানদের স্বীয় ও সতন্ত্র বাসভূমির দাবি তার হৃদয়কে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তাই স্কুল জীবনের অপরিণত বয়সে প্রস্তাবিত মুসলিম বাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে সক্রিয় হন।
অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর গ্রামে। বাবা মরহুম আবদুল ওহাব ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। ১৯৪৪ সালে হোমনা হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এ সময় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার কারণে তিনি ১৯৪৬ সালে আইএসসি পরীক্ষা দেননি। ১৯৪৭ সালে তিনি আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কম. ক্লাসে ভর্তি হন। আইএসসিতে ভালো রেজাল্ট করার জন্য তিনি হাজী মোহাম্মদ মহসীন ট্রাস্টের মাসিক ২০ টাকা হারে বৃত্তি লাভের জন্য নির্বাচিত হন। তবে এটি গরিব ছাত্রদের হক মনে করে এই টাকা তিনি গ্রহণ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ভাষা দিবসে তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। সেই থেকে শুরু হয় তার কারা জীবনের ইতিহাস।
১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত মূলনীতি রিপোর্টে পূর্ববাংলার আঞ্চলিক অঙ্গীকার উপেক্ষিত হলে এর বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয় অলি আহাদ তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হওয়া সত্ত্বেও এ সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক না করার প্রতিবাদে তিনি সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন। পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অলি আহাদের নেতৃত্বে এই যুবলীগ এদেশে প্রগতিশীল আন্দোলনের সূচনা করে এবং ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসে এ সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ভাষা সংগ্রাম কমিটিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে তার তেজোদীপ্ত সমর্থনের মধ্যে দিয়ে এদেশের যুবসমাজের বিপ্লবী মনোভঙ্গি প্রতিধ্বনিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে সূচিত সংগ্রামসহ ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা নগরীর উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ ইত্যাদি ঘটনার অন্যতম প্রধান নায়ক অলি আহাদ।
১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রথমে প্রচার সম্পাদক এবং পরে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। কাগমারী সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে ১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে তিনিও আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। অলি আহাদ ন্যাপের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠিত হলে তিনি এ দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম ২৫ সালা দাসত্ব চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন এবং আজাদ বাংলার ডাক দেন। এ জন্য তার পরম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। ৪২৭ দিন কারাভোগের পর ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট তিনি মুক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোস্তাক আহমদ ডেমোক্র্যাটিক লীগ গঠন করলে তিনি এ দলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলে অলি আহাদ প্রথম থেকেই এর প্রতিবাদ করেন। এ সময় অলি আহাদের নেতৃত্বে ৬ দল, বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ৯০-এ গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতন হলে বিএনপি সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের গঠনমূলক সমালোচনা করেন। ৯৬-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এলে ৯৮ সালে ১২ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল গঠন করা হয়। অলি আহাদ এই ৭ দলের অন্যতম নেতা হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের পরিপকস্ফ অভিজ্ঞতার আলোকে অতীত এবং বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক জীবনধারা ও ঘটনাবলি অত্যন্ত স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্নভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের মাধ্যমে রচনা করেছেন ‘জাতীয় রাজনীতি ৪৫ থেকে ৭৫’ শীর্ষক গ্রন্থ। যা এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য দলিল।(সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৪:৩৪