somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিরবিদ্রোহী অলি আহাদ--আ ব দু ল হা ই শি ক দা র

২২ শে অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সংগ্রামশীল বাংলাদেশের অন্তরগত চেতনার প্রবল অবলম্বন, অন্যায়, অসত্য,
শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে আজীবন আপসহীন, সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়নিষ্ঠ, আদর্শবাদী জননায়ক চিরবিদ্রোহী অলি আহাদ আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। এই লেখাটি গত শুক্রবার রাতে
(১৯ অক্টোবর) যখন লিখি, তখনও প্রত্যাশা ছিল তিনি আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন আমাদের মধ্যে। কিন্তু গতকাল শনিবার ২০ অক্টোবর এলো সেই দুঃসংবাদ।
এখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জানাজা শেষে ফিরে লিখছি এই নোট।

বিষ্যুদবার ১৮ অক্টোবর। পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালের সামনে যখন দাঁড়ালাম তখন ৯টা ৩০ মিনিট। বাইরে ঝলমল করছে আলো। কিন্তু আমার ভেতরে উদ্বেগ আর উত্কণ্ঠার মেঘ। এই হাসপাতালের পাঁচতলায় আইসিইউ’র ছয় নম্বর বেডে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে চির বিদ্রোহী জননায়ক অলি আহাদের শেষ প্রস্থান ঠেকাতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন ডা. এবিএম হারুন ও ডা. নিম্মির নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক। আর জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে পেণ্ডুলামের মতো দুলছে তার থাকা-না থাকা।
খবরটা মিডিয়ার কল্যাণে আগের রাতেই জেনে নিয়েছিলাম। ছ্যাত্ করে উঠেছিল বুক। পঁচাশি বছর বয়সের বয়োবৃদ্ধ জননেতাকে সকালে গিয়ে জীবিত পাব তো? সারা দেশের প্রতিটি কোনায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিংস্র হাঙর-কুমির।
সেসব অন্যায় ও জুলুমের প্রতিবিধান না করে গোটা জাতিকে কূলহারা নোনা পানিতে ভাসিয়ে তিনি চলে যেতে পারেন না। এ ধরনের প্রস্থান তো তার দর্শন ও স্বভাববিরুদ্ধ! আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম তার আরোগ্যের জন্য।
সকালে আমার স্ত্রী কানের কাছে গুঁজে দিল রেডিও। বললো, বিবিসি-তে রুমিনের সাক্ষাত্কার প্রচার করছে, শোনো। রুমিনের পুরো নাম রুমিন ফারহানা। অলি আহাদ ভাইয়ের একমাত্র সন্তান। এই ব্যারিস্টার মেয়েটি পিতার চোখের মণি। অতি আদরের।
বিবিসি জানতে চাইলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে জননেতা অলি আহাদের কোনো খোঁজখবর নেয়া হয়েছে কি?
রুমিন বললো, এখন পর্যন্ত কেউ কোনো খবর নেয়নি।
বিবিসি বললো, দেশের বাইরে উন্নততর চিকিত্সা নেয়ার ব্যাপারে কি কিছু ভাবছেন আপনারা?
রুমিনের সংক্ষিপ্ত উত্তর—আমাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই।
দু’পক্ষের মাঝখানে জায়গা নেয় নীরবতা। বিব্রতকর নীরবতা। সেই নীরবতা ভেঙে বিবিসির প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করে—আপনি কি প্রত্যাশা করেন না, ওনার মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত একজন ব্যক্তির চিকিত্সাভার রাষ্ট্রীয়ভাবেই নেয়া উচিত?
রুমিনের কণ্ঠে যেন দৃঢ়চেতা, আপসহীন, সব রকমের স্বার্থমুক্ত তার পিতার পরিচ্ছন্ন উপস্থিতি, দেখুন এই রাষ্ট্রের কাছে, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। যে দেশে গুণীর সম্মান হয় না, সেই দেশে গুণীর জন্মও হয় না। বাংলাদেশের ভাগ্যে অলি আহাদের মতো রাজনীতিবিদ নেই। বাংলাদেশ যা উবংবত্াব করে তেমন রাজনীতিবিদরাই এখন রাজনীতি করে। এখন রাজার নীতি হলো রাজনীতি।
রুমিনের বেদনা ও কষ্ট আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। যে দেশে ক্ষমতাসীনদের লালসার লালায় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে গেছে দেশ, শেয়ারবাজারকে গোরস্তান বানিয়ে পাচার করা হয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা, ব্যাংকগুলো থেকে তছরুুপ হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা, মন্ত্রীদের বাড়িতে যায় টাকার বস্তা, পদ্মা সেতুর টাকা আসার আগেই ভাগ-বাটোয়ারা করে খাওয়া-দাওয়া শেষ। চুরি, দুর্নীতি, ঘুষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, গুম, খুন, ধর্ষণ নৈমিত্তিক ব্যাপার বানিয়েছে শাসকরা। আধিপত্যবাদের পায়ের কাছে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে লাখ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ—সেই দেশে নীতিনিষ্ঠ অলি আহাদের উন্নততর চিকিত্সা দেয়ার সাধ্য নেই তার পরিবারের। বাংলাদেশের চোর, দুর্নীতিবাজ, মতলববাজ, মুনাফেক, প্রতারক, জালিয়াত, দেশদ্রোহী, জাতিদ্রোহী. মিথ্যাবাদী, আত্মসর্বস্ব রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দেখে দেখে যাদের চোখ ও মন দুটোই ভাগাড়ের বিষ্ঠায় পরিণত হয়েছে; তাদের কাছে এই বিষয়টা বেমানান লাগতে পারে। লাগারই কথা। কারণ অলি আহাদকে পরিমাপ করতে হলে যে ন্যায়, নীতি, সততা, সাহস, দৃঢ়তা, আপসহীনতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম থাকতে হয়—তা এরা কোথায় পাবে? ফলে এরা এদের নিজ নিজ বাটখারা দিয়ে হিমালয় পর্বতকে দেখতে গিয়ে, নিজেদের আবর্জনাকেই গলাধঃকরণ করে দিয়ে আসে। অলি আহাদের জন্য উন্নততর চিকিত্সার ব্যবস্থা এরা করে কীভাবে? এদের সবকিছুর মধ্যেই তো জঘন্য পাপ।
আমি শমরিতা হাসপাতালের আইসিইউ’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
দুই.
অলি আহাদ। আশ্চর্য এক নাম। আমাদের রাজনৈতিক গগনের উজ্জ্বলতম বাতিঘর। আমাদের রাজনীতির শেষ সত্যনিষ্ঠ নক্ষত্র। আমাদের অভিভাবক। আমাদের বিবেক। সত্যি তো, অলি আহাদ এখন আর কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। অলি আহাদ একটি অসাধারণ দ্যোতনাময় বিশেষণ। একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের চিরকালের আপসহীন বিদ্রোহের আগুন। এজন্যই তিনি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নন, তিনি সর্বজনীন। তার নাম উচ্চারণ মাত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে এমন একটি প্রতিকৃতি যিনি আজীবন ব্যক্তির ঊর্ধ্বে, দলের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন জাতীয় স্বার্থকে। কে কী ভাবলো, কে কী বলবে, এ নিয়ে সামান্যতম মাথাব্যথাও তার কোনোকালে ছিল না। যা তিনি বোঝেন, যা তার বক্তব্য, তা তিনি অকপটে, সরবে, সহজ-সরলভাবে উচ্চারণ করেছেন অকম্পিত কণ্ঠে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা তিনি। শুধু ভাষাসৈনিকই নন, তিনি ভাষা-নেতা, ভাষানায়ক। তিনি না হলে হয়তো একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাই ঘটতো না। ’৬৯ সালেই তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করার কাজে হাত দিয়েছিলেন। এই অগ্রগামী জননায়ক ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি যেমন ভাষা আন্দোলনের মূল নায়ক, তেমনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেরও অন্যতম স্থপতি। তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। আবার দেশ স্বাধীনের পর তিনি আমাদের প্রথম রাজনীতিবিদ যিনি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আওয়াজ তুললেন—পিন্ডির শিকল ছিঁড়েছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়। তিনি বললেন, এ স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ। তিনি শুরু করলেন তার বহুল আলোচিত ‘আজাদ বাংলা’ কায়েমের আন্দোলন। ৩০ জুন ক্ষিপ্ত শেখ মুজিব সরকার তাকে নিক্ষেপ করলো কারাগারে। ৪২৭ দিন কারা নির্যাতন ভোগের পর মুজিব সরকারের পতনের পর, ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ আবার মুক্ত বাতাসের মধ্যে তার ফিরে আসা। ১৯৫৭-এর কাগমারি সম্মেলন থেকে তাকে বাদ দিলে হারিয়ে যায় লাবণ্য। ১৯৪৮-এ প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। যুবলীগের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের জনকদেরও একজন তিনি। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে বহিষ্কৃত হন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই বহিষ্কারাদেশ ৫৪ বছর পর প্রত্যাহার করে নেয় বেগম খালেদা জিয়ার সরকার।
সত্যিই তো অলি আহাদ আমাদের অমিততেজা সংগ্রাম ও চেতনারই অন্য নাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জীবনের সূচনা, তা বিভিন্ন সময়ে হয়ে উঠেছে আমাদের অনুপ্রেরণার উত্স। স্বাধীনতার জন্য, মানবমুক্তির জন্য তিনি উত্সর্গ করে গেছেন তার পুরো জীবন। শাসক সে যত শক্তিশালীই হোক, ভ্রূক্ষেপ করেননি এই মানুষটি। অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন তিনি। জাতীয় কবির একটি কবিতা সত্য হয়েছে তার জীবনে :
‘যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামী ভাই
করবো সেথায় বিদ্রোহ,
ধামা ধরা জামা ধরা
মরণ ভীতু, চুপ রহো।’
পরিস্থিতি যাই হোক, পরিণাম যাই হোক, অলি আহাদ বজ্রনির্ঘোষ :
‘বল বীর—
বল উন্নত মম শির।
শির নেহারী আমার নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!’
অনন্যসাধারণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, নির্লোভ এই মহামানব তার সংগ্রামের জন্য জীবনে কারাবরণ করেছেন ১৭ বার। আইয়ুব দুঃশাসনের সময় তাকে আত্মগোপনে থাকতে হয় ৭ বছর। এরশাদের সামরিক শাসনামলে তার অসাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তিনি স্লোগান তোলেন—
‘অলি আহাদের এক আওয়াজ
খতম কর সেনাপতিরাজ।’
এজন্য তাকে গ্রেফতার করা হয় ৬ বার। বিচার করা হয় সামরিক ট্রাইব্যুনালে। কী লজ্জা! কারাভোগ করেন ৩৫৭ দিন। এরশাদ বন্ধ করে দেয় তার সম্পাদিত জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ। তবুও দম্ভের কাছে, ক্ষমতার মোহের কাছে তিনি কখনোই মাথা নত করেননি।
এই মহাপুরুষের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার ইসলামপুর গ্রামে। পিতা ছিলেন জেলা রেজিস্ট্রার। নিজে ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় লাভ করেছিলেন প্রথম বিভাগ। ভালো ছাত্রের জন্য পেয়েছিলেন মহসিন ফান্ডের বৃত্তি। কিন্তু সে বৃত্তি তিনি গ্রহণ করেননি। বলেছেন, এটা সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য। তারপর আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে নিজে হলেন ইতিহাস। আর তার হাত দিয়ে নির্মিত হলো আমাদের গর্বের ও গৌরবের ইতিহাস।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের যথেষ্ট প্রীতি তিনি লাভ করেছেন জীবনে। তিনি ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদকও। কিন্তু শাসক শেখ মুজিবের অত্যাচারকে তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেন। ১৯৫৬ সালে শেখ মুজিবের অনুরোধে তিনি শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন। শেখ মুজিবের এই অনুরোধ তিনি রাখলেও, ১৯৭২ সালে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন।
তার সর্বশেষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেটিক লীগ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি গঠন করেন ৬ দলীয় জোট। ১৯৯৬-এ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠন করেন ৭ দলীয় জোট। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের নির্যাস নিয়ে রচনা করেন ‘জাতীয় রাজনীতি (১৯৪৫-১৯৭৫)’, যা আমাদের জাতীয় রাজনীতির এক প্রামাণ্য জীবনীও বটে।
অলি আহাদ এবং বাংলাদেশ যেন একই সত্তার দুই দিক। আবার বলা যায়, অলি আহাদ এবং বাংলাদেশ যেন মিলেমিশে হয়ে উঠেছে একটা সত্তা। যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে তারা অলি আহাদকে ভালো না বেসে পারবেন না। যারা বাংলাদেশের শত্রু তারা অলি আহাদেরও শত্রু। আবার অলি আহাদকে যারা পছন্দ করেন না তারা আসলে বাংলাদেশকেও পছন্দ করেন না। বাংলাদেশ আজ দুর্গতিতে পতিত বলেই তার মহান সন্তান অলি আহাদের খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। যে বাংলাদেশের জন্য অলি আহাদ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে সংগ্রাম করে গেছেন, আজ সেই বাংলাদেশ থাকলে অলি আহাদ হতেন গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম। বিভিন্ন চ্যানেলে-সংবাদপত্রে ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রচারিত হতো সর্বশেষ বুলেটিন। হাসপাতালের সামনে লেগে যেত জনজট। দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই ছুটে যেতেন তার শয্যার পাশে।
মরহুম শেখ মুজিব অলি আহাদের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। তাই তো মন্ত্রিত্বের অফার দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর তো অলি আহাদ কেন, বাংলাদেশের প্রতিও কোনো কৃতজ্ঞতা নেই। সেজন্যই তিনি অলি আহাদের কাছে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। রাষ্ট্র নেয়নি তার চিকিত্সার ভার।
অলি আহাদ শমরিতায় পড়ে আছেন। অথচ দেশে কোথাও কোনো উদ্বেগ নেই। সবকিছু স্বাভাবিক। এই অবহেলা দিয়ে আমরা কাকে কী শিক্ষা দিচ্ছি? আমরা যত চেষ্টাই করি, আমাদের ক্ষুদ্রতা দিয়ে অলি আহাদের মহিমাকে মলিন করা যাবে না। তিনি ইতিহাসের স্রষ্টা, ইতিহাস তাকে নির্মাণ করেছে। এই পৃথিবীতে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলা ভাষায় যতদিন মানুষ কথা বলবে, ততদিন রয়ে যাবে অলি আহাদের নাম। এই অনশ্বরতা থেকে অলি আহাদকে সরায় সাধ্য কার?
তিন.
অলি আহাদের অসুস্থতার শুরু আজ থেকে নয়। ২০০৩ সালে তার ধানমণ্ডির ল্যাবরেটরি রোডের বাসায় বাথরুমে পড়ে তিনি প্রচণ্ড আঘাত পান। ভেঙে যায় একটি পা। তারপর থেকেই শয্যাশায়ী তিনি। চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। অত্যন্ত প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন অলি আহাদ অন্যদের মতো ফেরি করে বেড়াননি তার অসুস্থতা। এর সঙ্গে হয়তো প্রচ্ছন্ন হয়েছিল তার অভিমান। এই অভিমানের বিষয়টি অবশ্য আমার ধারণা। ফলে সবাই ভুলে যান তাকে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলে গণমাধ্যমের অশিক্ষিত সাংবাদিকরা ছুটে বেড়ান সহজলভ্য ‘পেশাদার ভাষাসৈনিকদের’ কাছে। এই পেশাদার ভাষাসৈনিকরাই চোয়ালবাজি করে দখল করে রাখেন মঞ্চ ও মিডিয়া। এই কদর্য কোলাহল অলি আহাদের মতো অভিজাত মানুষকে স্পর্শ করে কীভাবে? ফলে আড়ালেই চলে যান তিনি। না, এই চলে যাওয়া নিয়ে ফালতু কোনো অভিযোগ তার ছিল না। বাজে লোকদের কাছে নিজেকে ছোট করা তার কর্ম নয়।
অলি আহাদের স্ত্রী প্রফেসর রাশিদা বেগম জানালেন, এবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করি গত ৭ অক্টোবর রাত ২টায়। তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশি হচ্ছিল। তাকে ভর্তি করার পর দেখা যায়, প্রেসার অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। বাধ্য হয়ে তাকে দেয়া হতে থাকে লাইফ সাপোর্ট। এর আগে থেকেই তিনি হারিয়ে ফেলেন চৈতন্য। এখনও ফেরেনি তার জ্ঞান। বার্ধক্যজনিত সমস্যা এবং মাল্টি অরগান ফেইলুরের বিষয়টিও এখন ভাবিয়ে তুলেছে ডাক্তারদের।
রুমিনের চোখে টলমল করে পানি। আমাদের কারও কোনো সাহায্যের দরকার নেই। শমরিতার ডাক্তাররা নিজের জন্মদাতা পিতার মতো সম্মান করছেন আমার আব্বুকে। তারা সাধ্যমত করছেন। আপনারা দেশের মানুষকে বলবেন দোয়া করতে।
চার.
নজরুল বলেছিলেন—
‘যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না—
বিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেই দিন হতো শান্ত।’
কিন্তু নজরুল কথা রাখতে পারেননি। উত্পীড়নের ক্রন্দন রোল রয়ে গেল। অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ মানববিশ্বকে হারিয়ে দোজখ বানিয়ে রাখলেন। এর প্রতিবিধানের আগেই নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে নজরুলের ছায়া পাওয়া যায় কেবলমাত্র অলি আহাদের মধ্যেই। সেজন্যই তাকে আমি ১৯৯৮ সালে তার বিশাল দীর্ঘ সাক্ষাত্কার ছাপানোর শিরোনামে জুড়ে দিয়েছিলাম—‘চির বিদ্রোহী অলি আহাদ।’ আজ সবাই তাকে এভাবেই চিনছেন, সম্মানিত করছেন। নজরুলের মতোই অসম সাহসী মানুষটি রাজনীতিতে সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। কিন্তু সেই অন্যায় ও অসত্য সমাজ থেকে উত্খাতের আগেই, নজরুলের মতোই কথা না রেখে ক্লান্ত হয়ে, পরদিন সকালে, আমাদের কাউকে কিছু না বলে, নীরবে-নিঃশব্দে অনন্তের দিকে যাত্রা করলেন অলি আহাদ। আর কোনোদিন তার কণ্ঠ শুনতে পারবো না আমরা। দুঃখিনী বাংলাদেশের সবচেয়ে অমিততেজা সন্তানটি চলে গেলেন। আর এই প্রস্থানের ভেতর দিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে শেষ সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
তারপরও অলি আহাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় পঙক্তি—
‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির
ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’
চিরকাল ধ্রুব তারকার মতো আমাদের পথের দিশা দেবে। জ্বলজ্বল করবে আমাদের চেতনায়।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৪:৩২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×