গণমাধ্যমে প্রায়ই মজার মজার কিছু সত্যি ঘটনা ঘটে। এ সব কখনো কখনো প্রচলিত হাস্য কৌতুককে হার মানিয়ে দেয়। আবার এসব প্রেস জোকসের নেপথ্যে থাকে কষ্টকর সাংবাদিকতা পেশাটির অনেক অব্যক্ত কথা। এমনই কিছু বাস্তব ঘটনা নিয়ে এই 'প্রেস জোকস' পর্ব।
ট্যাক্স ফ্রি
--------
বিখ্যাত ফটো সাংবাদিক মোহাম্মাদ আলম (কিছুদিন আগে প্রয়াত) ভাইয়ের ঘটনা। ১৯৭২-৭৩ সালে আলম ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত আলোকচিত্রী। পানপ্রিয় আলম ভাই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সাথে মস্কো সফর শেষে দেশে ফেরার সময় সাথে নিয়ে এসেছেন এক বোতল রাশান ভোদকা। তো তেজগাঁ বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তারা কিছুতেই তাকে ছাড়বেন না। তারা ভোদকার জন্য ট্যাক্স দাবি করে বসলেন। এদিকে আলম ভাই কর্পদশুন্য।
তিনি যতই মুক্তিযোদ্ধা ফটোসাংবাদিক হন বা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ফটোসাংবাদিক হন, কাস্টমস কর্মকর্তারা নাছোড় বান্দা। আলম ভাই কিছুতেই তার কোনো ক্ষমতা ফলাতে না পেরে শেষে সবার সামনে বিমানবন্দরের লাউঞ্জেই ভোদকার বোতলে মুখ দিয়ে একটানে বোতল খালি করে ফেললেন। তারপর ঢেঁকুর তুলে ঢাকাইয়া উচ্চারণে বললেন, এইবার কী যাইতে পারমু? পেটের ভিতর ভুদকা থাকলে তো আর ট্যাক্স দেওন লাগবো না, না কী?
চট্টগ্রামে কেজি অচল
----------------
এরশাদ আমলের কথা। দৈনিক সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার জাফর ওয়াজেদ ভাইকে সম্পাদক কেজি মুস্তফা ঢাকা থেকে হঠাৎ করেই বদলী করলেন চট্টগ্রাম অফিসে।
জাফর ভাই তো মহা বিরক্ত। তিনি এটিকে পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে মনে করলেন। একে তার সব নিউজ-সোর্স ঢাকায়; তার ওপর তিনি চট্টগ্রাম শহরটিকে ভালো করে চেনেন না, চাটগাঁইয়া ভাষাও বোঝেন না। যা-ই হোক, তিনি খবর নিয়ে জানলেন, কেজি ভাই রোববারে সাপ্তাহিক ছুটি কাটান। আর ওইদিনই তিনি চট্টগ্রাম থেকে একটি বিশেষ রিপোর্ট পাঠালেন, শিরোনাম 'চট্টগ্রামে কেজি অচল'।
ঘটনা হচ্ছে, মন-সের মাপের পরিবর্তে এরশাদ সরকার তখন সারাদেশে মেট্রিক পদ্ধতির কেজি-লিটার ইত্যাদি চালু করলেও চট্টগ্রামের হাট-বাজারে তখনো প্রাচীন পরিমাপ পদ্ধতি চলছে। এই নিয়ে ছিলো সেই খবর।
বার্তা সম্পাদক সেটি সরল মনে প্রথম পাতায় ছেপে দিলেন। পরদিন সকালে সম্পাদক কেজি ভাই কাগজ দেখে অফিসে এসে হাজির। গম্ভীর ভাবে এখানে-সেখানে পায়চারী করছেন। রাগে-দু:খে কিছু বলতেও পারছেন না। পরে বার্তা সম্পাদকের টেবিলে এসে ওই খবরটি আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করে বললেন, এহ! এটা কোনো খবর হলো? এটি প্রথম পাতায় না দিলেও তো চলতো!
একটি অভিনব পদত্যাগ
------------------
গণমাধ্যম কর্মী মাত্রই জানেন, কর্মস্থল বদল করলে আগের অফিস বকেয়া বেতন-ভাতা দিতে চায় না। এমন কী বকেয়া টাকা আদায়ে মামলা করে বছরের পর বছর ঘুরেও পাওনা টাকা আদায় করা যায় না।
তো ১৯৯৯-২০০০ সালের ঘটনা। দৈনিক সংবাদের একেবারে পড়তি অবস্থা। ইত্তেফাক, জনকন্ঠ, ভোরের কাগজ, প্রথম আলোর তখন বাজার ভালো। আর সংবাদে চার-পাঁচ মাস করে সাংবাদিকদের বেতন বকেয়া পড়েছে; ওভার টাইমসহ অন্যান্য বিল তো আছেই।
এই সময় দৈনিক যুগান্তর প্রকাশ হবে। সংবাদের চট্টগ্রামের সাংবাদিক জসিম চৌধুরী সবুজ ভাই যুগান্তরে ভালো বেতনে কাজ পেয়েছেন (এখন তিনি যুগান্তরের চট্টগ্রাম অফিসের বুরো চিফ ও বিশেষ সংবাদদাতা)। তো তিনি জানতেন, সংবাদ থেকে পদত্যাগ করলে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ চার-পাঁচ লাখ টাকা তার লোকসান হবে। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কী করা যায়?
সবুজ ভাই পরামর্শ করার জন্য ফোন করলেন ওনার সেকশন চিফ, মফস্বল সম্পদক কার্তীক চক্রবর্তীকে। কার্তীকদা তাকে বললেন, সবুজ, তুমি নতুন কাগজে ভাল বেতনে কাজ পেয়েছো, এটি তো খুবই খুশীর খবর। তোমাকে আন্তরিক অভিনন্দন। কিন্তু হুট করে চাকরি ছাড়লে তো তুমি সংবাদ থেকে বকেয়া টাকা-পয়সা কিছুই পাবে না। তাই আমি যেভাবে বলি, সেভাবে পদত্যাগপত্র জমা দাও।
সবুজ ভাই কার্তীকদার পরামর্শে একটি অভিনব পদত্যাগ পত্র ঢাকার অফিসে এক কপি ফ্যাক্সে পাঠালেন; আরেক কপি দিলেন কুরিয়ারে।
তিনি যা লিখেছিলেন, তা অনেকটা এ রকম:
বরাবর, সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ, ঢাকা। বিষয়: পদত্যাগ পত্র। জনাব, বিনীত নিবেদন এই যে, ব্যক্তিগত কারণে আমি সংবাদ থেকে পদত্যাগ করছি। যেদিন থেকে আমার যাবতীয় পাওনা-দেওনা মিটিয়ে দেয়া হবে, সেদিন থেকে আমার পদত্যাগ পত্র কার্যকর হবে। নিবেদক...ইত্যাদি।
এরপর তিনি সংবাদে চট্টগ্রাম থেকে নিউজ পাঠানো বন্ধ রাখলেন। একের পর এক সংবাদে চট্টগ্রামের নিউজ মিস হতে থাকলো। বার্তা সম্পাদক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ভাই (এখন এটিএন বাংলায়) উপায় না দেখে ঢাকা থেকে টেলিফোনে ধরলেন সবুজ ভাইকে, কী সবুজ, চট্টগ্রাম থেকে নিউজ পাঠাচ্ছো না কেনো?
সবুজ ভাইয়ের সরল উত্তর, বুলবুল ভাই, আমি তো পদত্যাগ করেছি; তাই এখন নিউজ দিচ্ছি না। এখন আমার পদত্যাগপত্র আপনারা কী ভাবে কার্যকর করবেন, সেটি আপনাদের বিষয়।
বুলবুল ভাই সবুজ ভাইয়ের পদত্যাগপত্র নিয়ে সম্পাদক-প্রকাশকের টেবিলে দৌড়ালেন। এর পর প্রকাশক আহমেদুল কবির ভাই (প্রয়াত বিশিষ্ট সাংবাদিক) ফোন করলেন সবুজ ভাইকে, বাবা, তুমি আজ রাতের ট্রেনেই ঢাকায় এসো। তোমার গাড়ি ভাড়া আমরা দেবো। তোমার সঙ্গে সামনা-সামনি কথা আছে।
বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ-সাংবাদিকের কথায় সবুজ ভাই ঢাকা এলে, কবির ভাই তাকে বুঝিয়ে বললেন, বাবা, এভাবে পদত্যাগ করলে তো আমাদের বিপদ; তুমি এটি ফিরিয়ে নিয়ে একটি সাধারণ পদত্যাগ পত্র জমা দাও। আমরা তোমার টাকা একবারে না হোক, কয়েক দফায় পরিশোধ করবো।
সবুজ ভাই, তা-ই করলে সংবাদ কর্তপক্ষ আস্তে আস্তে তার সমস্ত বকেয়া পরিশোধ করে।
রাজু ভাই বৃত্তান্ত
--------------
মহিদুল ইসলাম রাজু ভাই (এখন এটিএন বাংলায়) তখন সংবাদের স্টার রিপের্টার। একই সঙ্গে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি। তার মাথা একটু গরম হলেও তিনি লোক ভালো, আর সাংবাদিক হিসেবে তুখোড় তো বটেই।
রাজু ভাইয়ের একটি বদ অভ্যাস হলো, যেখানে-সেখানে মুখের মধ্যে গুল নেয়া (আমরা বলি, গুল মারা)। একদিন আমরা তখনকার ক্ষুদে সাংবাদিক কয়েকজন রাজু ভাইকে ধরলাম; তাকে বুঝিয়ে বললাম, রাজু ভাই, আপনি এখন সাংবাদিক নেতা। পাঁচতাঁরা হোটেল বা মন্ত্রীর এয়ারকুলার লাগানো ঝাঁ চকচকে অফিসে বসে আপনার গুল মারা এখন বেমানান। আপনাকে এই রিকশা-ওয়ালাদের নেশা ছাড়তে হবে।
রাজু ভাই পড়লেন বিপদে। বললেন, কী করি তোরা বলতো? অনেক বছরের পুরনো নেশা।...
আমি বুদ্ধি দিলাম, আপনি বেনসন সিগারেট খাওয়া ধরুন। দুটাই তো তামাক, আপনার নিকোটিনের চাহিদাও মিটবে, আবার স্মার্ট-নেসও থাকবে।
রাজু ভাই চা খাওয়ার পর সিগারেট খাওয়া অভ্যাস করলেন।
অনেকদিন পর রিপোর্টার্স ইউনিটির অফিসে গিয়ে দেখি রাজু ভাই, চা খেয়ে একটা পান মুখে দিলেন। এরপর আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরালেন। আমি তো অবাক, রাজু ভাই, আপনি পান খাওয়া ধরলেন কবে?
আর বলিস না, সিগারেট ধরার পর দেখলাম চা খেয়ে একটা পান মুখে দিয়ে সিগারেট ধরালে দারুন লাগে। সেই থেকে পান খাওয়াটাও শুরু করলাম।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আর আপনার গুল মারা?
রাজু ভাই মাথা চুলকে বললেন, হেঁ হেঁ....সেটাও ছাড়তে পারিনি রে।
অর্থাৎ রাজু ভাই তখন গুল মারা, চা, পান ও সিগারেট--এই চারটি নেশাই সমান তালে চালাচ্ছেন!...
(চলবে)
১৮.০৫.০৯