বইয়ের নামঃ নেপাল টু সংযুক্ত আরব আমিরাত
লেখকঃ সুফিয়া বেগম
বইয়ের ধরণঃ ভ্রমণ কাহিনী
প্রকাশকঃ টুম্পা প্রকাশনী
প্রচ্ছদঃ অনন্ত আকাশ
মূল্যঃ ১৭০ টাকা মাত্র
ISBN: 984-70269-0013-3
যারা ভ্রমণবিলাসী তাদের বেশী দিন ঘরে আবদ্ধ রাখা যায় না। সময় সুযোগ পেলেই তারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন আর ছুটে বেড়ান স্বদেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আমাদের সহব্লগার এবং লেখক সুফিয়া বেগমও একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। বিশ্বকে দেখার তাড়নায় তিনি ইতিমধ্যেই জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারত ঘুরে এসেছেন। তারপর আবার একসময় তাঁর মধ্যে লোভ জেগে উঠে হিমালয় ও মরুর ফুল ‘বুর্জ আল খলিফা’ দেখার। সময় এবং সুযোগ পেয়ে বেরিয়েও পড়েছিলেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মনুষ্য তৈরি সৌন্দর্যকে অবলোকন করার জন্য।
২০১৩ এর জুলাই মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পেশাগত সফরে গিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয় ‘বুর্জ আল খলিফা’। তারপর আবার একই বছরের নভেম্বর মাসে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সফরে নেপালে ঘুরে দেখে আসেন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পর্বতমালা হিমালয়। এই সফরে লেখক বেশ দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ সফরসঙ্গী হিসাবে কাউকে না পেয়ে একাই বেরিয়ে পড়েছিলেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত আর নেপাল ভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতাকে তিনি পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করেছেন তাঁর নূতন এবং তৃতীয় ভ্রমণ কাহিনীর বই ‘নেপাল টু সংযুক্ত আরব আমিরাত’ এ, যা এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। ভ্রমণ কাহিনীর সবটুকু স্বাদ ও সৌন্দর্য লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা রীতিমতো কঠিন কাজ। মনের ভাব ও অনুভূতি প্রকাশে অনেক সময় উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। তবে বইটি পড়লে বুঝা যায় লেখক তাঁর চেষ্টায় কোন ধরণের ত্রুটি রাখেন নাই। লেখার ভাঁজে ভাঁজে যত্নের ছাপ স্পষ্ট অনুভূত হয়।
‘একটি ভ্রমণ কাহিনী তৈরি করার জন্য লেখার পারঙ্গমতা যতটা দরকার, ঠিক ততটাই দরকার ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে নিজের ভেতর ধারণ করা। নিজের ভেতর ধারণকৃত ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে ভাষার প্রাঞ্জলতার মাধ্যমে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলে একটি ভ্রমণ কাহিনী সত্যিকার সাহিত্যিক মূল্য দাবি করতে পারে বলে আমি মনে করি। ভ্রমণতো আমরা অনেকেই করে থাকি, সে দেশে হোক কিংবা বিদেশে হোক। ভ্রমণ করতে গিয়ে আমরা কত বিচিত্র ঘটনা ও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই তা বলে শেষ করা করা যাবে না। এসব অভিজ্ঞতাকে নিজের লেখনীর মাধ্যমে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারলে কার না ভাল লাগে?’...১
ভালো লাগার সেই আবেগ ঘন মুহূর্তগুলোকে মলাটবন্দী করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করাকে লেখক তাঁর নৈতিক দায়িত্ব হিসাবে ধরে নিয়েই রচনা করেছেন তাঁর ‘নেপাল টু সংযুক্ত আরব আমিরাত’ বইটি।
হিমালয় কন্যা নেপাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক আধার। মূলত হিমালয়কে ঘিরেই নেপাল সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে, যা ভ্রমণবিলাসী মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত নেপালের পোকারা শহরটির মনোরম নৈসর্গিক সৌন্দর্য পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে হিমালয়ের অন্নপূর্ণা, ধুলাগিরি ও মাকাউ শৃঙ্গের সূর্যোদয়ের অভূতপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। পোকারার সারাংগেটে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থান নিয়ে সূর্যোদয় দেখে লেখক যেন অন্য জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন। লেখকের অভিব্যক্তিতে তাই সহজেই ধরা দেয়-
‘সত্যি এ সৌন্দর্যের তুলনা মেলেনা পৃথিবীর কোথাও! কোন ভাষার কোন সমৃদ্ধ অভিধানেও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না এই সৌন্দর্যকে উপযুক্তরূপে বর্ণনা করার মতো কোন শব্দ। পৃথিবী বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের কল্পনা বিলাসও বোধহয় এখানে এসে হার মানতে বাধ্য হবে। আমি শুধু ভাবছি মানুষের মনকে মোহিত করার জন্য বিধাতার সে কি অপরূপ সৃষ্টি! প্রকৃতিকে সাজিয়ে রেখেছে সৌন্দর্যের সবটুকু নির্যাস দিয়ে। একমাত্র চোখে দেখে হৃদয়ে ধারণ করা ছাড়া কার সাধ্য আছে ভাষার ফ্রেমে এই সুন্দরের এই আবাহনকে প্রকাশ করতে পারে?’
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে সূর্যোদয় দেখার তৃপ্তি নিয়ে লেখক ছুটে গিয়েছেন নগরকোটে। কাঠমুন্ডু থেকে বত্রিশ কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত নগরকোট শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১৭৫ মিটার উঁচুতে। এখান থেকে হিমালয়ের মায়াবী রূপ বিশেষ করে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের পরিপূর্ণরূপে উপভোগ করা যায়।
‘একদিকে হিমালয়কে নিজের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্য তাঁর আপন গরিমায় উদ্ভাসিত। অন্যদিকে নিজের দুগ্ধ-ধবল বরফাচ্ছাদিত শান্ত-সৌম্য রূপের সাথে সূর্যের রক্তাক্ত আভাকে ধারণ করে আপন মহিমায় উজ্জ্বল হিমালয়। মাঝখানে প্রকৃতির বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা সবুজ পাহাড়রাশি যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা পটভূমি।‘...২
হিমালয়ের সৌন্দর্যে লেখক এতোটাই মুগ্ধ যে, তাঁর মনে হয়েছে এই যে বছরের পর বছর ধরে মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে হিমালয়ের চূড়ায় আরোহণের জন্য মানুষের অদম্য চেষ্টা তা কেবল অভিযাত্রী হিসাবে ইতিহাসে নাম লেখাবার জন্যই নয় বরং হিমালয়ের মায়াবী সৌন্দর্য অন্যতম কারণ।
হিমালয় দেখতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেন মিউজিয়াম দেখবে না, তা কী হয়। সেখানেও গ্যালারী ঘুরে দেখেছেন অনেক কিছু, যা বইতে উঠে এসেছে। নেপালের আরও একটি অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান ‘ডেভিস জলপ্রপাত’, যার ইতিকথার সাথে এক নাম না জানা লেক এর কথাও আমাদের জন্য বইটিতে স্থান পেয়েছে। শান্ত সমাহিত নীরব অভিমানে মুখর লেকটি লেখককে এক অদৃশ্য বন্ধনে যেন জড়িয়ে নিয়েছিল। বইয়ে স্থান পাওয়া স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন ‘বখতপুর দরবার স্কয়ার’ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও পাঠকের জন্য একটা বিরাট পাওয়া। সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজা জিতামিত্রা মল্লা কর্তৃক নির্মিত এই রাজপ্রাসাদটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর তালিকাভুক্ত করেছে।
নেপালের সৌন্দর্য যেখানে প্রকৃতি প্রদত্ত, সেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সৌন্দর্যের বেশীর ভাগই মনুষ্য সৃষ্টি অপরূপ নির্মাণশৈলী কারণে। টাকা থাকলে নাকি বাঘের চোখও মেলে। সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্বন্ধে যারা জানেন তারা সেটা সহজেই মেনে নেবেন বলে আমার বিশ্বাস। আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের সর্বাধিক ব্যবহার চোখে পড়ে আমিরাতের আনাচে কানাচে। বিজ্ঞান আর মনুষ্য মস্তিষ্কের অনন্য সমন্বয় ঘটিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দৃষ্টি নন্দন পাঁচ তারকা হোটেল ‘বুর্জ আল খলিফা’। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাদশা খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ‘বুর্জ দুবাই’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘বুর্জ আল খলিফা’ রাখা হয়। বিশ্বের ধনকুবেরদের পদচারণে মুখরিত এই ‘বুর্জ আল খলিফা’ এখন পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ‘বুর্জ আল খলিফা’র মতোই সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরও একটি অনন্য আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন ‘কিং জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ’, যা আমিরাতে ইসলামের মাহাত্ম্য ও গর্বের প্রতীক। দুবাইয়ের এক সময়ের অন্যতম গর্বের প্রতীক ‘বুর্জ আল আরব’ দেখার অভিজ্ঞতাও লেখক আমাদের জন্য পরম যত্ন নিয়ে বইটিতে এঁকে দিয়েছেন।
‘ভ্রমণকাহিনির লেখকের দায়িত্ব হচ্ছে, তিনি কী দেখলেন তা পাঠককে জানানো। এই কাজটি কোনো ভ্রমণকাহিনির লেখক করতে পারেন বলে আমি মনে করি না।
সৌন্দর্য কাগজে কলমে ব্যাখ্যা করা যায় না। সৌন্দর্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। ট্রয় নগরীর হেলেনের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে কবি হোমার অনেক পাতা খরচ করেন। কিন্তু সেই হেলেনকে পাঠক হিসেবে কি আমরা চোখের সামনে দেখতে পেয়ছি? কখনো না। যে দৃশ্য আগে কখনো দেখা হয় নি, মস্তিষ্ক সেই দৃশ্য দেখাতে পারে না। হেলেনকে আমরা কল্পনায় পরিচিত কোনো রূপবতীর আদলেই দেখব।‘...৩
হিমালয়ের হৃদয় কাড়া সৌন্দর্য, ডেভিস জলপ্রপাতের মুগ্ধ হাতছানি, বুর্জ আল খলিফা’র চোখ ধাঁধানো শৈল্পিক ছোঁয়া এবং কিং জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ এর মাহাত্ম্য সম্পূর্ণরূপে তুলে আনা তাই হয়তো কোন লেখকের পক্ষে নয়। তারপরও বলবো সহব্লগার ও লেখক সুফিয়া বেগম তাঁর চোখে দেখা অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির কথা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য। আমাদের জানার পরিধি বাড়িয়ে দেয়ার মতো যথেষ্ট তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ সৎ থেকে ভ্রমণের পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই বস্তুনিষ্ঠ করে লিপিবদ্ধ করেছেন বইটিতে। তথ্যের নির্ভুলতার ব্যাপারেও তাঁকে বেশ সজাগ মনে হয়েছে, যা তিনি ভূমিকাতে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। সাথে আছে আরও বেশ কিছু মজাদার অভিজ্ঞতা ও তথ্য। যারা ঘরে বসেও বিশ্বকে জানতে চান, বুঝতে চান, সেই সব কৌতূহলী পাঠক ‘নেপাল টু সংযুক্ত আরব আমিরাত’ বইটি নির্দ্বিধায় পড়ে ফেলতে পারেন। প্রমিত চলিত রীতিতে লেখা সাবলীল ধারা বর্ণনার কারণে বইটি বেশ সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে।
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতিঃ
****************************
নামঃ সুফিয়া বেগম
সামু ব্লগ নিকঃ সুফিয়া
জন্মঃ ৩০ সেপ্টেম্বর
জন্মস্থানঃ ময়মনসিংহ
প্রকাশিত অন্যান্য ভ্রমণ কাহিনীর বইঃ
(১) যেমন দেখেছি জাপান
(২) দেশে দেশে বৈচিত্র্যের সন্ধানে
এছাড়াও লেখকের আরও ২৩টি প্রকাশিত বই রয়েছে। যার মধ্যে আছে উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও শিশুতোষ রচনা
সাহিত্য পুরস্কারঃ
(১) আশরাফ সিদ্দিকী ও সাইদা সিদ্দিকী স্বর্ণপদক
(২) শ্যামল ছায়া সাংস্কৃতিক একাডেমী সম্মাননা
(৩) বঙ্গবীর ওসমানী স্মৃতি পুরস্কার
(৪) শেখ রাসেল স্মৃতি পুরস্কার
(৫) সত্যজিৎ রায় স্মৃতি পুরস্কার
(৬) ঈশা খাঁন স্মৃতি পুরস্কার
(৭) নেতাজী সুভাস বসু স্মৃতি পুরস্কার
(৮) অনির্বাণ সাহিত্য পুরস্কার
(৯) সানাউল্ল্যাহ নূরী পুরস্কার
তিনি ঢাকা ইউনিভারসিটি এলামনাই এসোসিয়েশন এবং কলকাতাস্থ বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের আজীবন সদস্য। পেশাগত জীবনে একজন উচ্চপদস্থ ব্যাংকার।
তথ্যঋণঃ
১. বইটির ভুমিকায় লেখকের নিজস্ব বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত
২. বইটিতে স্থান পাওয়া লেখকের অনুভূতি থেকে উদ্ধৃত
৩. হুমায়ূন আহমেদ এর ‘পায়ের তলায় খড়ম’ বই থেকে উদ্ধৃত