পিতার মৃত্যুর পর সকলেই ভাঙিয়া পড়িলেও নজরুলের ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম রহিল না। বিধবা মা, ছোট পাঁচ ভাই আর একমাত্র বোনের বিমর্ষ মুখ পানে চাহিয়া নীরবে অশ্রু সংবরণ করিল। লেখাপড়া করিয়া কী হইবে যদি ছোট ছোট ভাই বোন আর মা অন্ন কষ্টে ভুগিয়া মারা যায়। অগত্যা কাঁধ হইতে বিদ্যালয়ের প্রিয় ব্যাগখানা স্বযতনে নামাইয়ায় রাখিয়া সংসারের জোয়ালখানা কাঁধে তুলিয়া লইয়াছিল। বোধ করি ইহাও আজ হইতে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর পূর্বে হইবে। সকল ভাই বোনের সোলতেতে আগুন জ্বালাইয়া, কুপির নিচের অন্ধকার হইয়া থাকিয়াও মনঃকষ্ট ছিল না তাহার। হাড় ভাঙা পরিশ্রম করিয়া ভাই বোনদিগকের শিক্ষার আলো জ্বালাইয়া, তাহাতেই নিজেকে আলোকিত মনে করিয়া বরং গর্ববোধ করিত।
ভাই বোন সকলেই যখন চাকুরীতে যোগদান করিল, তখন নিজের অজান্তেই কিঞ্চিৎ স্বপ্ন দেখিতে শুরু করিয়াছিল নজরুল। সকলে বোধ হয় এইবার সংসারের জোয়ালখানা তাহার কাঁধ হইতে নামাইয়া লইবে। দেখিতে দেখিতে সকলেই জোয়াল কাঁধে তুলিয়া লইল ঠিকই কিন্তু তাহার জোয়াল তাহার কাঁধেই পড়িয়া রহিল। ব্যতিক্রম হইয়া রহিল কেবল ছোট ভাই বদরুল। স্বদেশে যখন চাকুরী করিত, তৎকালে বড় ভাই নজরুলের জোয়ালখানা পুরোপুরি বহন করিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না বিধায় ভাগাভাগি করিয়াই কাঁধে লইয়াছিল। বিদেশ বিভূঁইয়ে আসিবার পর বড় ভাইকে নির্ভার করিলেও সৃষ্টিকর্তা কি হেতু যেন মানিয়া লইতে পারিল না। সঙ্গোপনে ক্যান্সার ব্যধির ভারখানা নতুন করিয়া ঠিকই বড় ভাইয়ের শরীরে চরাইয়া দিয়া ভার শতগুণ বাড়াইয়া দিল আরও।
নিজে খাইয়া না খাইয়া থাকিলেও বিদেশ বিভূঁইয়ের উপার্জিত সমস্ত অর্থ কড়ি বদরুল বড় ভাইয়ের চিকিৎসা বাবদ মাস পার হইবা মাত্রই স্বদেশে পাঠাইয়া দিত। তাহাতেও যখন চিকিৎসার ব্যয় ঠিকমতো মিটিতেছিল না বরং ব্যাঘাত ঘটিতেছিল, তখন প্রবাসী বন্ধুদিগকের কাছে লাজ শরম ভুলিয়া ধর্না দিতে বাধ্য হইয়াছিল। উহাতে সংসারের জোয়ালের ভারের সহিত ঋণের ভার যোগ হইয়া তাহা যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িত লাগিল। কিন্তু অতিরিক্ত ভারে ন্যুইয়া পড়িলেও তাহাতে ভ্রূক্ষেপ করিবার ফুরসৎ ছিল না।
পিতৃতুল্য বড় ভাইয়ের আয়ু যে ক্রমেই কমিয়া আসিতেছিল তাহা অনুধাবন করিবার মতো মনোবল মনোযোগ কোনটাই ছিল না তাহার। অশ্রু মুছিবার ঢের বস্তু জগৎ সংসারে খুঁজিয়া পাওয়া গেলেও বাবার আদরের হাতখানা কী আর কখনো মাথায় পাওয়া যাইবে যদি বড় ভাই চলিয়া যায়? এই ভাবনায় ডুবিয়া দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করিতেও গায়ে বাধিত না।
বিধাতা বুঝি বদরুলের প্রতি সদয় হইয়াছিল। ঋণের বোঝা যাহাতে আর বাড়িয়া না যায়, সেই ব্যবস্থা নিজ হাতে করিয়া দিলেন পাঁচ মাস অতিক্রম হইবার পর। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কিছু ঋণ এখনো রহিয়া গিয়াছে যাহা বাড়িলে কষ্ট ভোগের পরিবর্তে মানুষ সুখ ভোগ করিয়া থাকে। এই সুখখানাও বদরুলের কপালে সহিল না।
ঋণের ভারে না অশ্রুর ভারে তাহা এখনো আমার জানা হইয়া উঠে নাই, তবে অনেকেই জানি বদরুল স্বদেশে না যাইয়া প্রায়ই টেমসের ধারে উদাসীন হইয়া বসিয়া থাকে কিন্তু টেমসের জল ফোটা ফোটা করিয়া বাড়িতে দেখা গিয়াছে। তাহাতে জোয়ারের পানি বাড়িল না কমিল কেহ খবর লইবার প্রয়োজন বোধ করিল না।