ফলে তিনি এখন দেশের সেরা ধনীদের একজন। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীকে ঘিরে যেসব দলীয় নেতাকর্মী ও আত্মীয়-স্বজন ত পাঁচ বছর বিচরণ করেছেন তারাও এখন কোটিপতি!
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন যতগুলো বিভাগ ও দফতর আছে তার মধ্যে অন্যতম হল সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। বিএনপির পাঁচ বছর সওজে এমন কোন অপকর্ম নেই যা হয়নি। সাবেক মন্ত্রীর এক ভাই এসব অপকর্মে নেতৃত্ব দেন। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সওজ-এ শুরু হয় বদলি বাণিজ্য। পাঁচ বছর তা অব্যাহতভাবে চলে।
বদলি বাণিজ্য করতে গিয়ে ক্ষমতাধররা বিশেষ করে প্রকৌশলীদের জন্য রেট নির্ধারণ করে দেন। যেমন একজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে তার পছন্দের স্থানে বদলি হতে লাগত ৫০-৭০ লাখ টাকা, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ২০-৪০ লাখ টাকা, সহকারী প্রকৌশলী ১০-১৫ লাখ টাকা ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী ৫-১০ লাখ টাকা। প্রকৌশলীদের বদলির এই রেট সওজে ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছিল। তখন জনশ্র“তি ছিল, বদলি বাণিজ্যের সিংহভাগই গেছে সাবেক মন্ত্রীর ভাই কামরুল হুদার পকেটে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক মেরামতের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় সওজের কুমিলা জোন ২০০৫ সালের ১৫ মে পাঁচটি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করে। এগুলোর মধ্যে ইএফডিআরপি/সিজেড/এমভিবি/আর-০১ নম্বর প্যাকেজে জাহানারা এন্টারপ্রাইজ ৬ কোটি ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ৫৮৮ টাকা হেঁকে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। কিন্তু চূড়ান্ত অনুমোদনের বেলায় সামান্য ভুলের সূত্র ধরে প্যাকেজের কাজটি শামীম এন্টারপ্রাইজ নামে অপর একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ৩২ লাখ টাকা বেশিতে দিয়ে দেয়া হয়। এ নিয়ে জাহানারা এন্টারপ্রাইজ উচ্চ আদালতে মামলা করে এবং কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে তৎকালীন মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও প্রধান প্রকৌশলী একেএম ফয়জুর রহমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
গফরগাঁও-বর্মী সড়কের ১৬ থেকে ২১তম কিলোমিটার অংশে ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের সঙ্গে ডেন্স বিটুমিনাস কার্পেটিং ওয়ারিং কোর্সের জন্য ২০০৫ সালের ২৭ অক্টোবর ময়মনসিংহ সড়ক বিভাগ দরপত্র আহ্বান করলে নয়টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। সওজের করিৎকর্মা নির্বাহী প্রকৌশলী মাত্র তিন ঘণ্টায় সব প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দুটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করেন। নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান দুটি ছিল শামীম এন্টারপ্রাইজ (প্রাঃ) লিমিটেড ও আরসি-পিটিএসএল জয়েন্ট ভেঞ্চার।
শামীম এন্টারপ্রাইজ ১ কোটি ৬১ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৭ টাকা হেঁকে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা এবং আরসি-পিটিএসএল ২ কোটি ৩৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৫ টাকা হেঁকে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা গণ্য হয়।
কিন্তু ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী টেন্ডারের মূল কাগজপত্রে মনগড়া পরিবর্তন আনেন বলে আরসি-পিটিএসএল’র পক্ষে আবদুর রাজ্জাক লিখিত অভিযোগে দাবি করেন। তিনি বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠানের দর অস্বাভাবিক বাড়িয়ে ১৩শ’ ৬৯ কোটি ৫৯ লাখ ৩০৪ টাকা এবং শামীম এন্টারপ্রাইজের উদ্ধৃত দর ২ কোটি ৯৭ লাখ ২ হাজার ৩৩৩ টাকা দেখানো হয়। এভাবে আরসি-পিটিএসএলের দর অস্বাভাবিক বাড়িয়ে তাদের দরপত্র বাতিল এবং ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে শামীম এন্টারপ্রাইজকে কাজ দেয়ার সুপারিশ করা হয়।
চট্টগ্রামে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু নির্মাণের জন্য ২০০৬ এর ১৫ জানুয়ারি চারটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে।এগুলোর মধ্যে চায়না হারবার, চায়না মেজর ব্রিজ ও হুন্দাই নামের তিন প্রতিষ্ঠান কারিগরি প্রস্তাব দিয়ে মনোনীত হয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যাতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয় সেজন্য অর্থদাতা কুয়েত ফান্ড সেতু নির্মাণ প্রকল্পে একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞকে উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়। উপদেষ্টা চায়না মেজর ব্রিজ ও হুন্দাইয়ের ডিজাইনকে অসম্পূর্ণ বলে মন্তব্য করেন এবং এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে প্রকল্প কর্মকর্তাদের আর অগ্রসর না হওয়ার পরামর্শ দেন। উপদেষ্টা চায়না হারবারকে যোগ্য বিবেচিত করলেও দরের ব্যাপারে কিছু ব্যাখ্যা জানতে চান। অভিযোগ উঠেছে, ব্রিটিশ উপদেষ্টার এ সুপারিশ উপেক্ষা করে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল ফাউন্ডেশনের ডিজাইন দাখিলকারী চায়না মেজর ব্রিজকে কাজ পাইয়ে দেয়ার পাঁয়তারা শুরু করেন। অভিযোগ ওঠে, মোটা কমিশন দিয়ে মন্ত্রীকে তখন ম্যানেজ করা হয়েছিল।
জোট সরকারের শেষ সময়ে বড় ধরনের লুটপাটের আয়োজন করা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি নিয়ে। জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুক্তি সরণি থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত- ২৪ কিলোমিটার সড়ককে চারলেনে উন্নীত করা হয়েছে।
এরপর দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত- ২০০ কিলোমিটার অংশকে চারলেনে উন্নীতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায়ও ঠিকাদার নিয়ে জালিয়াতি হয়। অভিযোগ উঠেছে, মুক্তি সরণি-দাউদকান্দি অংশের সড়ককে চারলেনে উন্নীত করতে প্রতি কিলোমিটারে যে টাকা ব্যয় হয়েছে, দাউদকান্দি-চট্টগ্রাম অংশে একই কাজ করতে কিলোমিটার প্রতি ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। এভাবে প্রকল্পটি থেকে দুর্নীতিবাজরা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার আয়োজন করে।
জোট সরকারের আমলে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল প্রিয়ডিক মেইনটেন্যান্স প্রোগ্রাম (পিএমপি) নামের একটি প্রকল্প। তখন বলা হতো, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার এটা লুটপাটের অন্যতম হাতিয়ার। জানা গেছে, লুটপাট হালাল করার জন্য সওজ কর্তৃপক্ষ কোনরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রাকযোগ্যতাসম্পন্ন ২০০ ঠিকাদারকে নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে। এ তালিকার সিংহভাগ ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার আত্মীয়-স্বজন ও তার নির্বাচনী এলাকা দোহারের ক্যাডার। এদের জন্য ২০০৫ সালের ৫ ডিসেম্বর ১১২টি গ্র“পে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার কাজের দরপত্র গ্রহণ করা হয়। সাধারণ কোন ঠিকাদার এই টেন্ডারে অংশ নিতে পারেননি। তাদের পরিবর্তে সাবেক মন্ত্রীর ক্যাডাররা সব কাজ ভাগাভাগি করে নেয়। পরদিন এ নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
ফলে মন্ত্রণালয় সে টেন্ডার বাতিল করে দিয়ে গত বছর ১৩ ফেব্র“য়ারি দ্বিতীয় দফায় দরপত্র গ্রহণ করে। কিন্তু একই কায়দায় ক্যাডাররা সব কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। অভিযোগ ওঠে, পিএমপির কাজ পেতে প্রতি গ্রুপের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয়ে ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। আরও ১০ শতাংশ কমিশন নিয়েছে সাবেক মন্ত্রীর এক ভাই ও সওজ-এর দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা।
জোটের পাঁচ বছর সওজে কাজ নিতে যেমন কমিশন দিতে হয়েছে, তেমনি বিল পেতেও ঠিকাদারদের কমিশন দিতে হয়েছে।
সওজের ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন। ২০০৬ এর ২৮ জুন সড়ক ভবনে ঠিকাদাররা বকেয়া বিল পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে গিয়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কমিশন নেয়ার কথা ফাঁস করে দেন।
তারা বলেন, আগে বিল পরিশোধ করতেন প্রধান প্রকৌশলী। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিল পরিশোধের আগে মন্ত্রীর সুপারিশ নেয়ার অলিখিত নিয়ম চালু করা হয়। কোন ঠিকাদার মন্ত্রীর সুপারিশের জন্য মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখানে নিযুক্ত দালাল চক্র মোট বিলের ১০ শতাংশ কমিশন অগ্রিম রেখে দিত। এই কমিশন দেয়ার পরও বহু ঠিকাদার বিল পাচ্ছিলেন না। এ কারণে ২০০৬ এর জুন মাসে তারা প্রধান প্রকৌশলীর দফতরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনেন। ২০০৬ এর ঈদুল ফিতরের আগেও সড়ক ভবনে একই দৃশ্যের অবতারণা হয়।
সিএনজিচালিত বেবিট্যাক্সির রেজিস্ট্রেশন কুক্ষিগত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া সংক্রাš- গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে। জাতীয় সংসদে তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করে তারই দলীয় এক সাংসদ। এর ফলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত- স্থায়ী কমিটি বিষয়টি তদন্তের জন্য সাব-কমিটি গঠন করে।
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সহযোগিতা না করায় এ কমিটি সুবিধা করতে পারেনি।
জানা গেছে, জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র কয়েকদিন আগে সওজ-এর উন্নয়ন কাজের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় প্রায় ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা অবৈধ ক্ষমতা খাটিয়ে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বরাদ্দকৃত টাকার অর্ধেকই নিজ এলাকা সওজ’র মুন্সীগঞ্জ ডিভিশনে নিয়ে যান। এ নিয়েও গত অক্টোবরে সড়ক ভবনে ঠিকাদাররা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নাজমুল হুদার ওই অন্যায় আবদার বাতিল করা হয়।
পাঁচ বছর প্রকাশ্যে লুটপাট ও দুর্নীতি করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে এক সময় যারা ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে অফিসে আসতেন, পাঁচ বছর লুটপাট করে তারা বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে চলাচল করছেন।
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এখন দেশের সেরা ধনীদের একজন। তার ফুলে-ফেঁপে ওঠা সম্পদের সামান্য একটা নমুনা দেখা যায় ঢাকা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে দোহার থানার পদ্মার পাড়ে সাইনপুকুরে বিলাসবহুল ভবনটিতে। দুর্নীতিবাজরা এখন প্রকাশ্যেই ঘোরাঘুরি করছে।
অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, জালিয়াতির বিষয়টিও তদন্ত- করে দেখার তাগিদ অনুভব করেনি।
জোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে দুর্নীতিতে ফার্স্ট হয়েছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা।
বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা মন্ত্রী থাকাকালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, বদলি বাণিজ্য, কমিশন গ্রহণ সবই হয়েছে প্রকাশ্যে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও সরকারের ভেতর অত্যন্ত- দাপুটে বলে খ্যাত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কিছুই হয়নি। ফলে তিনি এখন দেশের সেরা ধনীদের একজন। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীকে ঘিরে যেসব দলীয় নেতাকর্মী ও আত্মীয়-স্বজন গত পাঁচ
বছর বিচরণ করেছেন তারাও এখন কোটিপতি!
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন যতগুলো বিভাগ ও দফতর আছে তার মধ্যে অন্যতম হল সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। গত পাঁচ বছর সওজে এমন কোন অপকর্ম নেই যা হয়নি। সাবেক মন্ত্রীর এক ভাই এসব অপকর্মে নেতৃত্ব দেন। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সওজ-এ শুরু হয় বদলি বাণিজ্য। পাঁচ বছর তা অব্যাহতভাবে চলে।
------চলবে------
সূ্ত্রঃ দৈনিক পত্রিকা ২০০৭
ধারাবাহিক শেষে বিস্তারিত তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৩:৫৭