কিছু কিছু টিনের চালের ঢেউয়ের শেষ অংশ গুলোতে জং ধরেছে । টিনগুলো কতকাল রোদ বৃষ্টিকে আগলে রেখেছে কে তার খবর রেখেছে । ঘেরা দেয়া কাঠের বেড়া গুলোর দু একটি খুলে পড়ে গেছে । চৌকাঠের নীচের ইটের গাথুনীতে গুলোতে মসৃন গর্ত হয়েছে । নড়বড়ে দুটো দরজা কোনরকমে আটকে আছে । এক সময়ের ব্যস্ত ঘরটা এখন পতিত ঘর হয়েছে । লম্বালম্বি ঘরটার একদিকে এক খানা চকি বিছানো । ঘরটির সামনে বড় উঠান বা খুলি। অগ্রহায়ন মাসে ধানের কাটামারি শুরু হয় । কাটামারীর ধানের আটি গুলোকে পুন্জ আকারে গোল গোল করে বিশাল উঠানে রাখা হয় । মিয়ার বাড়ীর ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চারা এই পুন্জের উপর চড়ে দিনে রাতে লাফ ঝাফ করে ।কাটামারির সময় কামলা কিষানরা এই ঘরে বসে জিড়ায়, বিড়ি টানে, দুপুরের খাবার খায় । হঠাৎ বৃষ্টি এলে ছাগল ভেড়া মুরগী ঘরটাতে উঠে সামান্য স্বস্তি খোজে । ভাদ্র মাসের রাতের গরমে বাড়ীর কিষানরা মাঝে মাঝে ওই বিছানো চকিতে বিছানা পাতে ।
এক সময়ের ঘরটি যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে । ঘরটিকে সবাই বলে খানকা ঘর। বাড়ীতে অজানা অচেনা আগুন্তুক এলে তাকে এই খানকা ঘরে থাকতে দেয়া হত । শেষ কবে আগুন্তুক এসেছিল তা বোধহয় আর কারও মনে হয় । পাতিলের ভাতে যখন টান পড়েছে, এক ঘর ভেংগে পাচ ঘর হয়েছে তখন আগুন্তুক আসাও কমে গেছে । আগুন্তুকের জন্য ভাগ হওয়া পাচ ঘরের কোন রাধুনী গরম ভাত তরকারী রান্না করে খাওয়াবে । পাতিল আলাদা, জীবন আলাদা ।
এই খানকা ঘরেই বিচার বসেছে । বাশটাতে বহুদিনের মাকড়ষাড় জাল ছিল সাথে জমে থাকা কতকালের ধুলোবালি ময়লা, দড়ি বাধতে গিয়ে বাশ খানিকটা পরিস্কার হয়েছে । বাশে হাত উচু করে হাত বাধা সাইদার । শাড়ীর আচল যেন খশে না পড়ে, তাই একজন বৃদ্ধা মহিলা আচল টাকে ঘুরিয়ে সা্ইদার কোমরে ঢুকিয়ে দিয়েছে । বিচারের জন্য গ্রামের গন্যমান্যরা উপস্থিত । বেশির ভাগ ছোট ছোট বাচ্চাদের কে থাকতে দেয়া হচ্ছেনা এই বিচারে । সদরুল এক চিপায় ঢুকে বসে পড়ল । সেই চিপা দিয়ে মাথা বের করে হা করে তাকিয়ে থাকল । ধলাবাবুর কথা মনে হতেই সদরুল ইতি উতি তাকিয়ে ধলাবাবুকে খুজছিল । কেননা ধলা বাবুই বলেছিল খানকাত বিচার বসছে হাট দেখিয়া আসি ।
সদরুলের এবারে চোখ পড়ল সাইদার উপরে । সাইদার হাত উচু করে বাধা । নিশ্বাসের সাথে বুক উঠা নামা করছে । অনন্তকাল ধরে সাইদা যেন মাটির দিকে তাকিয়ে আছে । সাইদা কে সদরুল বুবু বলে ডাকে । সাইদার ভাই জাবেদ আলী সদুরুলের খেলার সাথী । সদরুল কারও কাছে জানার ইচ্ছা কেন তাকে বাধা হয়েছে কিন্তু বলতে সাহস হচ্ছে না । যদি কেউ আবার বলে এই ছল যাও এটে থাকিয়া । তুই কি বুঝিস ইগলা বিচারের । সাইদা এবার ঘাড় কাত করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে শুরু করল । সদরুলের বড় মেয়েদের কান্না দেখতে ভাল লাগে । কেন ভাল লাগে সদরুল জানেনা । শরীরে শিড় শিড়ানী অনুভুত হয় ।
জাবেদ আলীর বাড়ী পাশেই । জাবেদ আলীর বাড়িতে বহুবার গেছে সদরুল । দুটো বেড়ার ঘর । একটাতে রান্না হয় । আর একটাতে গরু ছাগল জাবেদ আলী ওর মা বোন সবাই থাকে । জাবেদ আলীর আম্মা সদরুলের নানীদের ফাই ফরমায়েশ খাটে সাথে সাইদাও থাকে । কাটামারির সময় সারাদিন কাজ করে । সে্ই জাবেদ আলীর বোনকে এভাবে কেন বাশের সাথে টাংগিয়ে রাখা হবে সদরুলের মাথায় ঢুকল না । এরমাঝে একজন মুরুব্বি উঠে দাড়িয়ে বল্ল তাহালে এই নটি মাগির কি করবেন আপনারা ? এক কি গ্রাম ছাড়া করবেন ? এই তো গ্রাম নষ্ট করবে । গ্রামের সগ যুবক ছেলে পেলেক নষ্ট করবে ।
কোথা থেকে জাবেদ আলীর মা এসে সেই দাড়ানো মুরুব্বির পা ধরল । এবারের মত ওক এলা মাফ করে দেও । দাড়ানো মুরুব্বি এই পাও ছাড় পাও ছাড় বলে চিৎকার দিলে জাবেদ আলীর আম্মা পা ছেড়ে দিল । ছেড়ে দিয়ে বলল -
মুই দায়িত্ব নিতিচো । সাইদা আর খারাপ কাম করবা নয় । এরপরে করলে তোমরা যেই শাস্তি দিবা সেটাই হবি সেটাই মানি নেম ।
দাড়ানো মুরুব্বি বসে থাকা মুরুব্বিদের বললেন তাহলে আপনারা কি কন ?
বসে থাকা মুরুব্বিরা একজন বলল ওর পাছাত আগে শপাত শপাত করে হাকাও ।
বলা মাত্র একজন সাইদার পাছায় ডাল দিয়ে শপাং শপাং করে মারতে লাগল ।
সাইদা ও মা রে ও বাবারে বলে চিৎকার করতে লাগল । সাথে তার পশ্চাদদেশ এদিক সেদিক ঘোরাতে লাগল ।
বসে থাকা মুরুব্বীদের একজন হাতের ইশারা দিয়ে মার থামাতে বলে উপরের সাইদা হাতের দড়ি খুলে দিতে বল্ল । তারপর বল্ল তুই মাটিতে ছ্যাপ ফেলা তারপর সেই ছ্যাপ চাট । সাথে নাক ছ্যাছরা দে । সাইদার হাত খূলে দেয়া মাত্র সাইদা হাত দিয়ে তার পশ্চাদদেশে নাড়তে লাগল । তারপর মাটিতে থু থু ফেলে আবার সেটা নিজেই চেটে খেল । তারপর মাটিতে সিজদা দেবার মত করে নাক নাক ছ্যাছরা দিল । বসে থাকা মুরুব্বিদের একজন বল্ল আবার যদি শুনি তোর এই আকাম কুকাম তাহলে তোর চামড়া ছিলে লবন লাগাবো সাথে গ্রাম ছাড়া করবো হারামজাদী । সাইদাকে নিয়ে সাইদার আম্মা চলে গেল । আস্তে আস্তে মুরুব্বিরা চলে গেল সাথে বিচার শেষ হল ।
সদরুলের মনে হল জাবেদ আলীর সাথে দেখা করা দরকার বিষয়টা বোঝার জন্য । জাবেদ আলীর বোন সাইদা কি খারাপ কাজ করছে এটা জানার জন্য । এরিমাঝে কোথা থেকে ধলাবাবু এসে খবর দিল ইটের ভাটাত হাট ওটে বলে মরা ছল বাড়াছে । সদরুল ধলাবাবু মিলে ইটের ভাটার দিকে দৌড় । দৌড় শুরু করতেই এল ঝম ঝম বৃষ্টি ।
ইটের ভাটাতে সদরুল ধলাবাবুর আগেই আরও সবাই এসেছে । কেউ কেউ কাচা কন্চি দিয়ে মৃত নবজাতকের উপরের মাটি সরাচ্ছে । সদরুল একটা লাঠী দিয়ে পুরো মাটি সরাতেই বৃষ্টির তোড়ে মৃত নবজাতকের মুখের মাটি সরে গেল । বড় রাস্তার পাশে পতিত ইটের ভাটাতে কেউ কেন নবজাতক মৃত শিশুকে ফেলে যাবে কে জানে ?
পুরো গ্রাম চাউর হল মৃত নবজাতকের খবর । আরও বিভিন্ন মানুষজন চলে এল ।
কেউ কেউ বলতে লাগল মানষের বেবেক নাইও মানষের সীমারের কলজা । মানষের পাপের ভয় না্ই । একজন মুরুব্বী সদরুল, ধলাবাবু, হাছিুনর, হান্নান, চ্যাংটু, সহ সবার দিকে তাকিয়ে বল্ল এ ছলেরা তোরা নদীত যায়া সাবান দিয়া গাও পাও ধুয়া বাড়ীত ঢোকেন ।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২১ সকাল ৯:৫৯