গতকাল রাতে একটি পোস্ট হয়েছে মাদ্রাসার ছাত্রদের কী হবে ? শিরোনামে, জনাব আরিফ জেবতিক লিখেছেন। সেখানে আমি মন্তব্য করতে গিয়ে ভাবলাম মন্তব্য অনেক বড় হবে তাই এই পোস্টের অবতারণা।
শিরোনাম দেখে বুঝা যায় লেখক সাধারণ ভাবে সকল মাদ্রাসাকেই নির্দেশ করেছেন। কিন্তু বিষয়বস্তু ছিল শুধু কওমী মাদ্রাসা কেন্দ্রীক। অথচ যারা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানে না তারা সে লেখা পড়ে সব ধরনের মাদ্রাসা সম্বন্ধে একই রকম ধারণা পোষণ করতে পারে এবং কারো কারো মন্তব্যে সে বিষয়টি ফুটেও উঠেছে।
মূল কথার আগে বলে রাখি, মাদ্রাসা শিক্ষা মূলত দুই ধরনের- আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমী মাদ্রাসা। আলিয়া মাদ্রাসার ফরম্যাট অনেকটা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মতোই। মাধ্যমিক পর্যায়কে এখানে বলা হয় দাখিল, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়কে বলা হয় আলিম, ডিগ্রি পর্যায়কে বলা হয় ফাযিল আর মাস্টার্সকে বলা হয় কামিল। আর কওমী মাদ্রাসা অবশ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ফসল হিসেবে কিন্তু সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সিলেবাস আপডেট না করায় তারা বলা যায় জনগণের মূল স্রোত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। তাদের অনেক প্রকার বিধি নিষেধও রয়েছে যা অযৌক্তিক।
এবার আসা যাক জনাব আরিফের বক্তব্যে। তিনি লিখেছেন, "আমার ছোটবেলায় ৩ ইউনিয়নের মাঝে মাদ্রাসা ছিল ১টি ( হাজীগঞ্জ মাদ্রাসা ) আর স্কুল ছিল ৩টি । এখন স্কুল হয়েছে ৪টি , কিন্তু মাদ্রাসা হয়েছে ১৬/১৭টি ।"
এটা হয়তো তার এলাকায় হতে পারে। কিন্তু পুরো বাংলাদেশেই যে এটা ঘটছে তা কিন্তু নয়। বেনবেইস কিন্তু সে কথাই বলে। 'বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুক্যাশনাল ইনফরমেশন এন্ড স্ট্যাটিস্টিকস' (বেনবেইস) এর জরিপে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পুরো বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতটি সে হিসাব পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে তুলে ধরছি।
দাখিল- ৬৬৮৫, মাধ্যমিক- ১৮৫০০
আলিম- ১৩১৫, উচ্চমাধ্যমিক- ১৮০৯ (স্কুল এন্ড কলেজ-৬৩৪ ও উচ্চমাধ্যমিক কলেজ- ১১৭৫)
ফাজিল- ১০৩৯, ডিগ্রি পাস কোর্স ও অনার্স- ১২০৮ (এগুলোর ভেতর উচ্চমাধ্যমিক অন্তর্ভুক্ত)
কামিল- ১৭৫, মাস্টার্স- ৮৯
সর্বমোট = মাদ্রাসা- ৯২১৪, স্কুল ও কলেজ- ২১৬৫০।
তাছাড়া ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা মাদ্রাসা বনাম সাধারণ শিক্ষায় অনেক পার্থক্য। মাদ্রাসার স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রী অনেক বেশি।
সংশ্লিষ্ট তথ্য দেখতে এখানে ক্লিক করুন
সংশ্লিষ্ট আরো তথ্য দেখতে এখানে ক্লিক করুন
আরো দেখতে এখানে ক্লিক করুন
জনাব আরিফের পোস্টের ৯নং মন্তব্যটি লক্ষ্য করুন। মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেছেন, "মাদ্রাসা ছাত্রদের বুদ্ধিশুদ্ধি এতো কম হয় না ।"
তিনি তার পোস্টে মাদ্রাসা ছাত্রদের ব্যাপারে যে বর্ণনা দিলেন তাতে মনে হয় যে মাদ্রাসা ছাত্ররা ব্লগিং তো দূরে থাকুক কম্পিউটার ব্যবহারই করতে পারে না। আসলেও তাই, তবে সেটা কওমী মাদ্রাসার ক্ষেত্রে। আমার আপত্তিটা সেখানেই। তিনি মাদ্রাসা ছাত্র বলতে আলিয়া ও কওমী সবাইকে বুঝিয়েছেন।
১৫ নং মন্তব্যে আহা! বলেছেন, "আমাকে ইংরেজি শিখতে হলে ইংলিশ মিডিয়ামে পরতে হবে কেন? আর ধর্মপ্রান বাংলাদেশের বাসিন্দা হিসেবে আমি স্কুলে পড়ি বলে কেন পরিপূর্ণ ধর্মশিক্ষা পাবো না? ইংরেজি ভাষা বা ইসলাম ধর্ম কোনোটাই কোনো বিশেষ গোষ্ঠির সম্পত্তি না।"
তার এ বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত।
৩৪ নং মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেছেন, "আমি জেনারালাইজড করছি কারন কর্মক্ষেত্রে আলাদা করে কওমী আর আলীয়া মাদ্রাসার কোন অবস্থান তৈরী হয়নি তেমনভাবে । চিন্তা করে দেখুন , আপনি নিজেই কওমী মাদ্রাসা আর আলীয়া মাদ্রাসার তফাৎ জানেন না , অথচ দুইটি বেশ দূরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা ।"
কথাটা কিন্তু বিপরীতমূখী। দুটি যদি বেশ দূরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা হয় তাহলে কর্মক্ষেত্রে কওমী আর আলিয়া মাদ্রাসার আলাদা কোন অবস্থান তৈরী হয় নি এ কথা কি বাস্তবসম্মত?
ঐ পোস্টে আবদুর রাজ্জাক শিপন বলেছেন: "এমনও দেখেছি , কওমি মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করে বেরিয়েও দু'লাইন শুদ্ধ বাংলা লিখতে পারেনা ।"
হাসি পেলো। কওমী মাদ্রাসায় ফাজিল পাশ! তবে হ্যা কওমীতে যারা পড়ে তারা বাংলায় খুবই দুর্বল।
মাদ্রাসায় কিন্তু ২০১০-২০১১ সেশন থেকে বাণিজ্য বিভাগ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগতো আগে থেকেই আছে।
এ ব্যাপারে শেষ কথা, জনাব আরিফের পোস্টটি হয়তো তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে করেছেন। কিন্তু এতে মুদ্রার একটি পিঠ ফুটে উঠেছে অন্য দিকটি কিন্তু অন্ধাকারেই রয়ে গেছে।
এবার অন্য প্রসঙ্গে, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের ভর্তির ব্যাপারে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাদেরকে ঢাবির সাতটি বিভাগে (গতকাল লোকপ্রশাসন তাদের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে) ভর্তি করা হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিজেই বলেছেন, মাদ্রাসার ছাত্রদের মেধা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় স্মর্তব্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটই হচ্ছে তৎকালীন বাংলার মুসলমানদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নীতকরণ। তখন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেক বিশিষ্টজনই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তাই বলে তো কোনো হিন্দু ছাত্রের ভর্তি নিয়ে এখানে জটিলতা হয় না।
মাদ্রাসা ছাত্রদের ভর্তির ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন ইংরেজীর কথা। মাদ্রাসার ছাত্ররা নাকি ইংরেজীতে ১০০ মার্ক পড়ে আসার কারণে ইংরেজীতে দুর্বল। তাই যদি হয় তাহলে ভর্তি পরীক্ষায়ই তো মাদ্রাসার ছাত্ররা অকৃতকার্য হবে। ভর্তি পরীক্ষায় যদি তারা কৃতকার্য হয় তাহলে তাদের ভর্তি করতে সমস্যা কোথায়? যারা কোটা পদ্ধতিতে ভর্তি হচ্ছে তাদের চেয়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের যোগ্যতা কোন দিক থেকে কম?
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:১২