
মা কে নিয়ে আমার প্রথম সুখময় স্মৃতির কথা চিন্তা করলে, নাটকের দৃশ্যের মত প্রথম যেই দৃশ্যটা আমার চোখে ভেসে উঠে, তা হল, একটা সরকারী কোয়ার্টারের দু-তলা একটা ফ্ল্যাট। ২টা শোবার ঘরের প্রথমটায় জানালা ঘেসে পাতিয়ে রাখা একটা পড়ার টেবিলে টিয়া রঙের একটা ফ্রক পড়ে আমি পা ঝুলিয়ে বসে আছি, মায়ের হাতে বানানো সেই জামার কুচিগুলোতে আমাকে একটা সবুজ ফুলপরীর মত লাগছিলো। মায়ের পড়নে কি রঙের শাড়ি ছিলো আমার মনে পড়ে না, তবে খুব মনে পড়ে, আমি রাজ্যের সব মুগ্ধতা নিয়ে, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মা খাটের উপড়ে বসে আমারকে টেবিলে বসিয়ে রেখে, জানালা দিয়ে দূরের স্পষ্ট ভেসে থাকা মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, আমাকে একটা গান শিখাচ্ছিল। তখনো আমি বাক্য লিখতে শিখিনি, সব শব্দ বুঝতে শিখিনি, অনেকগুলো লাইন কিভাবে একসাথে করে মনের ভাষা প্রকাশ করতে হয় তা শিখিনি। কিন্তু সেই ছোট্ট আমি বেশ দ্রুত এর সব-ই শিখে ফেলার চেষ্টা করছি, এবং মায়ের আগ্রহ আমার আগ্রহ মিলে সেই অদ্ভুত কাজটা খুব অল্প সময়েই সম্ভব-ও হয়ে যাচ্ছে !
মা কেমন জানি রেডিওর মত কথাগুলো বলছে, আর আমি তার সেই কথা গুলো পাখীর মত বলার চেষ্টা করছি। সেই কথাগুলো ছিলো---
" আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে;
ও মা আমার প্রাণে বাজায় বাশিঁ!"
যখন স্কুলে পড়তাম, সাদা জামা, সাদা জুতো পড়ে সবুজ ঘাসে দাড়িয়েঁ লাইন ধরে প্রায় একশত ছাত্রীর মাঝে আমি এই গান গেয়েছি, তখন প্রথম শুনেছি, এইটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিখা !
তার আগে মনে হতো, এইটা সরকারের গান, সরকারী স্কুলে গাইতে হয়, অনুষ্ঠানের শুরুতে বাজাতে হয়, গাওয়ার সময় বা বাজানোর সময় সবাইকে দাড়াতেঁ হয়!
আমার মাকে আমি প্রায়-ই আহ্লাদ করে জাপটে ধরতাম। এখনো ধরি, তারপর রাজ্যের সব প্রশ্ন ছুড়েঁ দেই, মা উত্তর দেয়। মায়ের পৃথিবীর সব কোনা থেকে মা আমার জন্য উত্তর খুজেঁ আনে, কুড়িয়ে আনে। এখনো যখন কোনো প্রশ্নের উত্তর পাই না, মা-কে ফোন দেই, মা ধরে, জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে, তখন কেদেঁ ফেলি, কারন আমার প্রশ্নটাই আমি আর খুজেঁ পাই না। আমার কান্না শুনে অথবা চুপ করে থাকা দেখে মা -ও কাদেঁ! কারন মায়ের কাছে প্রশ্ন না দিলে মা তো উত্তর-ও খুজেঁ আনতে পারে না !!
মা কে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা মা, স্কুলে প্রতিদিন সকালে এই গানটা কেনো গাইতে হয়? কেনো এই গানটা গাইলে সবাই উঠে দাঁড়ায়?
মা বলেছিলো, পতাকার জন্য !
আমি বলেছিলাম, পতাকা তো পতাকা ! এর জন্য কেনো গান গাইতে হবে? কেনো উঠে দাড়াতেঁ হবে? সব্বাইকে ?
মা বলেছিলো অই সবুজ রঙের জন্য আর মাঝখানের টক টকে লাল বৃত্তটার জন্য ! আমি দৌড়ে গেলাম আমার শিক্ষক বাবার কাছে, বললাম, বাবা পতাকার জন্য কেনো গান গাইতে হবে? লাল-সবুজ রঙের জন্য কেনো সব্বাইকে প্রতিদিন গাইতে হবে?
বাবা আমার বড় ভাইয়ের একটা বই খুলে আমাকে টেবিলে বুঝানোর চেষ্টা করলো, চার কোনা পতাকার মাঝের লাল বৃত্ত মানে লাল সূর্য, স্বাধীনতার প্রতীক আর সবুজ মানে সবুজ বাংলাদেশ। যুদ্ধ করে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিলো একসময়, তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীক এই পতাকা।
আমি দৌড়ে গেলাম আবার মায়ের কাছে, মা-- যুদ্ধ কী ? মা কী কী সব বললো আজ আমার মনে নেই, শুধু মনে আছে, আমি যেই ঘরে বসে মায়ের সাথে কথা বলছি, তার ছাদে ছিলো ক্যাম্প, ইট, বালির বস্তা, তাবু আর ডাল-পালা, শুকনো পাতা দিয়ে, ঘরের মত বানিয়ে সেইখানে থাকতো পুলিশ, কারা যেনো আমাদের মেরে ফেলতে চাইত, তাই সবাই এই কলোনী ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলো, যেতে যেতে পথে অনেক মানুষের লাশ, রক্ত, কুকুরের মানুষের মাংশ নিয়ে টানা টানি, লঞ্চে যাওয়ার সময়, পানিতে ভেসে থাকা ফুলে থাকা লাশ, চোখ বাধাঁ-হাত বাধাঁ মানুষ !
শুধু প্রাণটা নিয়ে আর ছোট্ট একটা ব্যাগে দামী কিছু জিনিস নিয়ে সবাই হাটছেঁ, দৌড়াচ্ছে, গন্তব্য অজানা। আয়ু শুণ্য, মন শূণ্য দেহ শুধু দৌড়েছে জীবনের সন্ধানে !! ছেলে, বুড়ো, নারী-শিশু কেউ বাদ যায় নি !!
আমার মায়ের গর্ভে তখন বড় ভাইয়া, আমার বড় আপা তখন সবে কথা বলা শুরু করেছে! বাবা মায়ের নতুন সংসার !! কই যাবে? কোথায় লুকিয়ে রাখবে নিজের স্ত্রী কে, মেয়ে কে ? শিক্ষিত যুবা পুরুষ দেখলেই ধরে নিয়ে যায় কারা যেনো, আর আসে না কোনো দিন !! মায়ের চিন্তাভরা মুখে সেই গল্প শুনে, আমার চোখ বেড়িয়ে গেলো কোটর থেকে !! গাল বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরতে লাগলো !!
মা কে বললাম, মা, আমরা আবার এই বাসায় থাকছি, তোমার ভয় লাগে না ?
ওরা যদি আবার আসে ?
মা বললো, আর আসবে না। এই জন্য-ই এই পতাকা !!
তারপর থেকে, পতাকা দেখলেই থমকে দাড়াঁই ! এই পতাকা থাকলে কেউ আমাদের মারতে আসবে না ! এই পতাকা আমাদের জীবন রক্ষা করবে ! হাত তুলে স্যালুট করি, এক মিনিটের জন্য ছোট্ট সেই ফ্রক পড়া শিশুটি হয়ে যাই, এই জীবনের চলার পথে, দেশে -বিদেশে, গ্রামে গঞ্জে, শহীদ মিনারে, স্মৃতি সৌধে, স্কুলে কলেজে যেইখানেই পতাকা দেখি, খোলা আকাশে দু-চোখ ভরে দৃষ্টি ফেলি, প্রান জুড়িয়ে দেখি সেই প্রহরী ! আমার রক্ষাকর্তা সেই লাল-সবুজ পতাকা !! নিজের অজান্তেই, জুতো খুলে ফেলি, সবুজ ঘাস স্পর্শ করে খালি পা আর ডান হাত কপালের ডান পাশে !!
আজো মনের কোনে নানা প্রশ্ন, আমার মা কে করা হয় না, অবহেলে!
আজো মুক্তিযোদ্ধা সেই দাড়োয়ান
, আমাকে অফিসের মেইন গেইট খুলে দেয়, রিক্সা না পেলে পাশে এসে দাড়ায়ঁ, হেসে কথা বলে, রিক্সা ডেকে দেয়, আজো মুক্তি যোদ্ধারা ভুয়া সার্টিফিকেটের বেড়াজালে নিজেদের জড়ায় না বলে, ভাতাহীন, অন্নহীন, বস্ত্র কষ্টে দিন পাত করে, আজো কেউ বুক ভরা অভিমান নিয়ে রিক্সা চালায়, অসুখে ভুগে মরে চিকিৎসার অভাবে ! মেয়ের বিয়ের টাকা রোজগারের জন্য পথে নামে নীরবে! আজো অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে, কাফনের কাপড় কিনার জন্য, মৃত সন্তান কে কবর দেয়ার জন্য মাত্র ২০০ টাকার জন্য আমাদের মত হাজার মানুষের কাছে হাত পাতে!
আজো কেউ বুকের গভীরে মাটি চাপা দেয়, সেই দিনের বীরগাথাঁ, সাহসী পদক্ষেপ, জীবন বাজির গৌরব !! আজো কেউ বুকভরা অভিমান আর কষ্ট নিয়ে, মুখে হাসি টেনে নির্মলভাবে বলে উঠেন, দেশ বইলা কি কিছু আছে বাজান ? তহন মানুষের লাইগ্যা হাতে অস্ত্র নিছিলাম, এহন নিজের লাইগ্যা পথে নামছি !!
আমরা কী তার সব শুনতে পাই ? সব কী দেখি ?? দেখেছি ??
যেমন প্রতিদিন ঐ লাল-সবুজ পতাকাটি কে দেখি, ?? আমার মায়ের মুখের মতো??
সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিট
৪ঠা ডিসেম্বর, ২০১১।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ৯:১৯