প্রথম র্পব এখানে: Click This Link
রিমি
একটা দু:স্বপ্ন দখে ঘুম ভেঙ্গে যায় রিমির। বুকটা ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
বালিশের পাশ থেকে মোবাইল ফোনটা খুঁজে নিয়ে বোতাম টিপে সময় দেখে।
ভোর ৪টা ২২ মিনিট।
ঠিক এসময় চারদিক থেকে ভেসে আসে ফজরের আজানের ধ্বনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে একের পর এক মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজান শুনতে শুনতে একটু আগে দেখা স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করে রিমি।
কিন্তু কী আশ্চর্য! কিছুই মনে পড়ছে না।
অথচ, সেই দু:স্বপ্নের রেশ এখনও আছে। গায়ের সবগুলো লোম খাড়া হয়ে আছে। বুকের ভেতর এখনও উলট পালট হচ্ছে।
দাদী বলতেন, ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। কথাটি মনে পড়ে আবারও নতুন করে আতঙ্ক জাগে রিমির ভেতর। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কাঁপতে থাকে।
বান্ধবীদের কাছে শুনেছে বিয়ের আগে নাকি মেয়েদের মনে অনেক রকম অজানা ভয়-আতঙ্ক তৈরি হয়। হয়তো নতুন পরিবেশে, নতুন একজন মানুষের সঙ্গে জীবন যাপনের অনিশ্চয়তা থেকেই এই আতঙ্কের সৃষ্টি। কিন্তু যার সঙ্গে রিমির বিয়ে হচ্ছে সে তো তার কাছে নতুন কেউ নয়। সেই কৈশরে যখন নিজের ভেতর রহস্যময় পরিবর্তনগুলো টের পাচ্ছিলো, তখন থেকেই এই মানুষটিকে মনে প্রাণে চাইছে সে। প্রথমে এই ভালোলাগাটি ছিল নিছক মুগ্ধতা মাখানো বিষ্ময়। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই মানুষটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তার নিয়তি। তাকে ছাড়া এক মুহুর্তও জীবন যাপন সম্ভব নয়। অনেক চড়াই উতরাই পেড়িয়ে যখন তাকে কাছে পাওয়ার মুহুর্তটি একেবারে এগিয়ে এসেছে, তখন এই সদ্য দেখা অথচ বিস্মৃত ভয়ঙ্কর স্বপ্নটি বুকের ভেতর একটা অজানা আশঙ্কা তৈরি করছে।
মশারির ভেতর থেকেই জানালার পরদা সরিয়ে বাইরে তাকায় রিমি।
চারদিক এখনও আবছা অন্ধকারে ঢাকা।
ঘুম যখন ভেঙ্গেছেই তখন আর শুয়ে থেকে কী লাভ!
বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র বোটকা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠে। পেট চেপে মেঝেতে বসে হড়হড় করে বমি করে দেয় রিমি। অশুভ এক আতঙ্কে সারা শরীর কাঁপতে থাকে। মনে হয় পৃথিবীর কোথাও চরম কোনো অঘটন ঘটছে। অদ্ভুত এক অজানা ভয়ে রীমির পুরো শরীর বরফের মতো জমে যায়। এই মুহুর্তেই বাথরুমের দরজা খুলে দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার একটা তীব্র তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু মেঝের সঙ্গে কেউ যেন তার পা আটকে রেখেছে।
দীর্ঘ কয়েক মুহুর্ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছিটকিনি খুলে বের হয়। ততোক্ষণে ঘেমে গোসল হয়ে গেছে। গয়ের নাইটিটা ভিজে সপ্সপ্ করছে। যেন কেউ একবালতি পানি ঢেলে দিয়েছে গায়ে।
রুমে ঢুকেও সেই অস্বস্তিকর বাজে গন্ধটার অস্তিত্ব টের পায় রিমি। এখানে বরং দুর্গন্ধটির তীব্রতা আরো বেশি।
বিছানার ভেতর আলো জ্বেলে নি:শব্দে বাজতে থাকে মুঠোফোন। নিরবিচ্ছন্ন ঘুম নিশ্চিত করতে রাতে রিংগার অফ করে বিছানায় যায় রিমি।
এক ধরণের বোবা আতঙ্ক নিয়ে মোবাইল ফোনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, এই ফোন কলটি অন্য কোনো জগতের এক অশুভ বার্তা নিয়ে এসেছে। বাজতে বাজতে একসময় থেমে যায়। আবারও রিং আসে।
কাঁপা হাতে ফোনটি তুলে নেয় রিমি। স্ক্রিনে তন্ময়ের নাম দেখে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। নিজের বোকামিতে নিজে নিজেই হেসে উঠে। যার একটি কলের জন্য সকাল-সন্ধ্যা প্রতি মুহুর্ত অপেক্ষায় থাকে, তার ফোন পেয়েই এতো ভয়। কিন্তু এতো সকালে সে কী করছে। অন্য সময়তো ছুটির দিনে বাবুর ঘুম ভাঙ্গে ভোর দশটায়।
সবুজ বোতাম টিপে হ্যালো বলে রিমি।
অপর প্রান্ত থেকে কেমন যেন ফ্যাস ফ্যাসে কণ্ঠ ভেসে আসে
- কী করছিলে রিমি?
- এই মাত্র ঘুম ভাঙ্গলো, বাথরুমে ছিলাম।
- ফোন ধরতে এতো দেরি হলো কেন? ভয় পেয়েছিলে?
এ প্রশ্নে চমকে উঠে রিমি। ভয়ের প্রশ্ন আসছে কেন? সে যে ভয় পেয়েছে তন্ময়ের তো সেটা জানার কথা নয়! যাই হোক, এসব নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে রিমি
- তুমি এতো সকালে কী করছো? আর তোমার কথা এমন শোনাচ্ছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো?
খল খল করে অচেনা শব্দে হেসে উঠে তন্ময়। যার ভরাট গলার হাসি শুনে এখনও মুগ্ধ হয়ে যায় রিমি, তার হাসির শব্দেই আজ গা শিউরে উঠে।
- না, আমার কিছু হয়নি, আমি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। রাতে অনেক কাজ ছিল। এখন ঘুমুতে যাচ্ছি।
এ কথা বলে কোনো রকম বিদায় না জানিয়েই আচমকা লাইন কেটে দেয় তন্ময়। ছোট্ট ফোনটি হাতে নিয়ে স্থানুর মতো বসে থাকে রিমি। বাইরে তখন একটু একটু করে আলো ফুটছে। চারদিকে পাখির কিচির মিচির ডাকে কান পাতা দায়।
চারদিক আলো করে সূর্য উঠেছে আজ। ছুটির দিন। বাইরের ঘরে বসে রং মিস্ত্রিদের নির্দেশ দিচ্ছেন রিমির বাবা মোর্শেদ আলম। দুদিন পর মেয়ের বিয়ে। বাড়িতে একটু রং না করালে চলে না।
চায়ের পেয়ালা হাতে বাবার কাছে এসে দাঁড়ায় রিমি। চারদিকে কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব। তার জন্যই এতো আয়োজন। ভাবতে গিয়ে একটু লজ্জা হয়, ভালো লাগে তার চেয়েও অনেক বেশি।
ছোটভাই বাবু তার কতোগুলো চ্যাংড়া বন্ধুবান্ধব নিয়ে দোতলার রুমে জটলা করছে। দফায় দফায় চা যাচ্ছে সেখানে। তার বন্ধুরাই নাকি হলুদের স্টেজ, আলপনা এসব কিছু করবে। মা ব্যস্ত রান্নাঘরে। একজন বাঁধা কাজের মানুষ আর ছুটা বুয়াকে নিয়ে রান্নাঘরে গলদঘর্ম হচ্ছেন। ধানমন্ডি থেকে ছোট খালা আসবেন আসবেন। বিকেলে সবাই মিলে মার্কেটে যাবে বিয়ের কেনাকাটা করতে।
বাড়িতে সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। শুধু কাজ নেই রিমির হাতে। পুরো বাড়িটায় একটা চক্কর দিয়ে নিজের ঘরে এসে বসে। রাতের ঘটনাটি ভেবে এখন নিজেরই হাসি পাচ্ছে। আশপাশে কোথাও হয়তো কিছু পঁচেছে, সেই গন্ধেই আতঙ্ক অস্থির হয়ে পড়েছিল সে। আর বমিতো হয়েছে অ্যাসিডিটি থেকে। এই সমস্যাটিতো নতুন কিছু নয়। একটা এন্টাসিড প্লাস খেয়েই হাতে হাতে ফল পেয়েছে।
তন্ময়কে নিয়ে একটু চিন্তিত রিমি। ফোনে কেমন উল্টাপাল্টা কথা বলছিলো। কাল রাতেও নিশ্চই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ছাইপাশ গিলেছে। অকেশনালি একটু আধটু ড্রিংক করলে ঠিক আছে। সে ক্ষেত্রে কিছু মনে করবে না রিমি। এতোটা পিউরিটান নয় সে। কিন্তু এটা অভ্যাসে পরিণত হলেই তার আপত্তি। দাঁড়াও বিয়ের পর সব ঠিকঠাক করে দেবো। তখন দেখা যাবে কার কতো মুরোদ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মোবাইল ফোনের বোতাম টেপে। টানা সাতটি রিং হওয়ার পর তন্ময়ের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ শোনা যায়।
- হ্যালো, এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠো। বাথরুমে গিয়ে কিটন হয়ে এসে দশ মিনিটের মধ্যে আমাকো ফোন করো।
একটানা নির্দেশের সুরে কথাগুলো বলে ফোন রেখে দেয় রিমি। একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে। যানে, ঠিক দশ মিনিটের মাথায় কলব্যাক করবে তন্ময়। সারাটা জীবন এভাবেই মানুষটিকে আদরে-শাসনে বেঁধে রাখবে রিমি। হে পরম করুনাময়, আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আনন্দ-ভালোবাসায় পূর্ণ করে দাও। চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। চমকে উঠে চোখ মোছে রিমি।
আজ তার হলোটা কী! অকারণ ভয়, অকারণ আবেগ- নিজের কাছেই কেমন যেন লজ্জা পায়।
আসলে পুরো ব্যপারটাই স্বপ্নের মতো লাগে।
তখন মাত্র কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে রিমি। তন্ময়ের প্রেমে তখন সারা পৃথিবী তার আচ্ছন্ন। আশপাশে আর কোনো কিছুই নজরে পড়ে না। নয়তো সে ঠিকই বুঝতে পারতো ইউনিভার্সিটির বান্ধবি শ্বেতার সঙ্গে তন্ময়ের হৃদয়ের বোঝাপড়া চলছে। বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর যখন রিমি বুঝতে পারে, ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিমি তখন ইউনিভার্সিটিতে মাত্র ভর্তি হয়েছে। টিএসসি, বই মেলা বা রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠে তাদেও দুজনকে প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যেতো। কিন্তু তন্ময়ের অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা রিমির কখনোই বিশ্বাস হয়নি। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যখন তাদেও দুজনের এনগেজমেন্টের দিন ঠিক হয়ে যায়।
সে সময় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল রিমি। ঠিক তখনই তন্ময়কে ছেড়ে আমেরিকা পাড়ি জমায় শ্বেতা। সেই দু:সময়ে তন্ময়ের পাশে এসে দাঁড়ায় রিমি। অফুরন্ত ভালোবাসা আর মায়ায় সারিয়ে তোলে তন্ময়ের হৃদয়ের ক্ষত। এতো কিছুর পর আজ সেই ক্ষণ উপস্থিত। দুদিন বাদেই বিয়ে। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছে রিমি। সকালে তন্ময়ের সঙ্গে ফোনে কথা হওয়ার পর সকল অস্বস্থি এক লহমায় উড়ে গেছে। ভোরবেলার ভয়ের কোনো স্মৃতিই এখন আর তার ভেতর নেই।
দুপুরে খাওয়ার পর জম্পেস আড্ডা আর কয়েক দফা চা খেয়ে সবাই উঠে পড়ে মার্কেটে যাওয়ার জন্য। আরামদায়ক এক ধরণের আলস্য নিয়ে বিছানায় গড়ায় রিমি। খালি বাড়িটা কেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। শীর্ষেন্দুর একটা জমজমাট উপন্যাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক সময় ঘুমে ঢলে পড়ে।
তীব্র বোটকা এক ধরণের পচা গন্ধে ঘুম ভাঙ্গে রিমির। প্রথমে বুঝতেই পারে না, এখন দিন, নাকি রাত। মুহুর্তেই সব কিছু মনে পড়ে যায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে কখন চারদিক আঁধার হয়ে এসছে। বাবা-মা এখনো মার্কেট থেকে ফিরেনি। ভোরবেলার আতঙ্কটা এবার শতগুণ বেড়ে সাড়াসির মতো চেপে ধরে রিমির পুরো অস্বিত্বকে। সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। নাড়ি উল্টে বমি আসে। বাথরুম পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হয়না এবার, ঘরের মেঝে ভাসিয়ে দিয়ে দুপুরের খাবার পুরোটাই পেট থেকে উগড়ে দেয়। আগস্ট মাসের গরেমেও ঘরের ভেতরটা কেমর অদ্ভুত শীতল হয়ে আসে। আর আশ্চর্য, এর মধ্যেও কুল কুল করে ঘামতে থাকে রিমি।
অনেক দিন আগে কোব্বালা গল্পটি লিখেছিলাম। গল্পটি পড়ে অনেকেই বলেছিলেন, এটা আরো বড় হতে পারতো। আমিও তাদের সঙ্গে একমত। কিন্তু আলসেমি করে আর লিখা হয়ে উঠেনি। গত রাতে গল্পটি শেষ করেছি। শেষ করে দেখলাম ব্লগে প্রকাশের জন্য এটা অনেক বড় হয়ে গেছে। তাই কয়েক ভাগে দেবো বলে স্থির করেছি। অবশ্য যদি ব্লগার বন্ধুদের ভালো লাগে তবেই। পড়ে জানাবেন কেমন লাগছে। ভালো না লাগলে এখানেই শেষ করে দেবো। আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকলাম। ধন্যবাদ।