এক
বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালো মামুন।
একগাল ধোঁয়া ছেড়ে গায়ের চাদরটা দিয়ে কান-মাথা ভালো করে ঢেকে নেয়।
আশপাশে কোনো রিক্সা চোখে পড়ছে না।
রাত এমন কিছু বেশি হয়নি, সাড়ে দশটা। তবে মফস্বল শহরে শীতকালে সাড়ে দশটাই গভীর রাত। এদিক-সেদিক তাকিয়ে হলের উদ্দেশ্যে পা বাঁড়ায়। দূরত্ব এমন কিছু নয়, হেঁটেই যাওয়া যায়। তবে এই শীতের মধ্যে এটুকু কষ্ট করতেও ইচ্ছে হচ্ছিলো না। কিন্তু কি আর করা!
চারদিক ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। এবছর শীতটাও বড্ড জাঁকিয়ে পড়েছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাম্পাসের বড় বড় গাছগুলো দেখে কেমন যেন গা ছম ছম করে উঠে।
নিজের মনেই হেসে উঠে মামুন। কতো সহজেই না মানুষ ভয় পায়!
কিছু দূর এগুতেই পেছন থেকে ভেসে আসা টুন..টুন শব্দ যেন কানে মধু বর্ষণ করলো। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে কুয়াশার চাঁদর ছিঁড়ে একটি রিক্সা এগিয়ে আসছে। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে মামুন।
না, রিক্সাটা খালি।
কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে ত্রিচক্রযান।
ও যেমন রিক্সা খুঁজছিলো, রিক্সাওয়ালাটিও মনে হয় সওয়ারির সন্ধানে ছিল। এতো রাতে একজন রেডিমেড যাত্রী পেয়ে নিশ্চই সেও আনন্দিত। উঠে বসতেই প্যাডেল চালায় রিক্সাওয়ালা। কোথায় যাবে সেটিও জিজ্ঞেস করেনি। আয়েশ করে বসে আরেকটি সিগারেট ঠোটে ঝুলায় মামুন। কিন্তু বার বার চেষ্টার পরও লাইটারটি সাড়া দেয় না। তোমার কাছে ম্যাচ আছে?'
রিক্সাওয়ালাকে প্রশ্ন করে মামুন। জবাব না দিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন প্যাডেল চালিয়ে যায় রিক্সাওয়ালা। গলাটা একটু চড়িয়ে আবারও একই প্রশ্ন করে মামুন। এবারও কোনো উত্তর নেই।
কালা নাকি!
সিগারেটটা প্যাকেটে ভরতে ভরতে চিন্তা করে, একটু পর রুমে গিয়ে গরম কফির সঙ্গে সিগারেট-আহ, এই শীতের রাতে আর কী চাই! বড্ড চায়ের তেষ্টা পেয়েছে।
আজকে সুমনের রুমে দারুন আড্ডা জমে উঠেছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে মেজাজ খারাপ করেই উঠে আসতে হয়েছে মামুনকে। তাই আড্ডার চরম লোভনীয় অংশটি, অর্থাৎ চা না খেয়েই সুমনের হল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে মামুন। আন্যান্য দিনের মতো আজও প্রেম-রোমান্স, রাজনীতি, ক্রিকেট-এসব নিয়ে উদ্দেশ্যহীন আলোচনা হচ্ছিলো। নানা বিষয় ঘুরে কিভাবে কিভাবে যেন জমজমাট আড্ডাটা ভুতের গল্পে গিয়ে ঠেকলো। এর পর দেখা গেল সেখানে উপস্থিত সবারই নিজের, নাহয় ঘনিষ্ট কারো প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ ভুতের অভিজ্ঞতা আছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই একুশ শতকের তরুণরাও বিনা দ্বিধায় ভুতের অস্বিত্ব স্বীকার করছে। শুধু তাই নয়, নিজেরাও ভুত দেখেছে বলে দাবি করছে!
এর পর মামুনের পক্ষে আর ধৈর্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানের এই যুগে এ ধরণের অবৈজ্ঞানিক গাজাখুড়ি বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রবৃত্তি হয়নি তার। সে জন্যই আড্ডার মাঝ পথে প্রস্থান।
বেমক্কা এক ঝাঁকুনিতে চিন্তার সুতাটা ছিঁড়ে যায়। একটা গর্তে রিক্সার চাকা পড়ে এই বিপত্তি।
কিন্তু এ কোথায় নিয়ে এসেছে রিক্সাওয়ালা! এটাতো মামুনের হলের একোবারে উল্টো পথ! ইউনিভার্সিটি লাগোয়া গোরস্থান এলাকা।
চরম বিরক্তি নিয়ে রিক্সা ওয়ালার দিকে তাকায় মামুন। কিন্তু ব্যাটা এমনভাবে চাদরে মাথা ঢেকে রেখেছে, চেহারা দেখে কার সাধ্যি!
‘আমি যাবো মুসলিম হলে, আর তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে আসলা?’
বিরক্তি নিয়েই কথাগুলো বলে মামুন। কিন্তু রিক্সাওয়ালার এতে কোনো ভাবান্তর নেই। আচমকা তাকে চমকে দিয়ে অ™ভুত ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠে
‘রিক্সা আর যাইবোনা স্যার, সামনের চাক্কা বইয়া গেছে।’
‘বাহ্, এতো একেবারে সোনায় সোহাগা। উল্টা রাস্তায় এনে এখন বলছো রিক্সা যাবে না। মানে পুরা ডাবল রাস্তা হাঁটতে হবে আমাকে।’
রাগের চোটে গলা চড়িয়ে কথাগুলো বলে মামুন।
কিন্তু এতেও রিক্সাওয়ালার কোনো ভাবান্তর নেই। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে উল্টোমুখো হাঁটা শুরু করে মামুন।
’স্যার ভাড়াটা দ্যাবেন না।’
রিক্সাওয়ালার অস্বস্তিকর ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে পায়, পকেট হাতড়ে খুচরা টাকা বের করে।
কিন্তু একি!
ভুসভুসে কালো চাঁদরের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে একটি একটি অপার্থিব হাত। সাদা সাদা অস্বাভাবিক বড় আঙ্গুলের ডগায় কালচে বাঁকানো বড় বড় নখ। আর হাতের তালুতে এক গুচ্ছ লোম। মাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে রিক্সাওয়ালার অস্বাভাবিক হাতটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না।
কোনো কথা না বলে কোনো রকমে মাথা ঠান্ডা রেখে ভুতুড়ে হাতে টাকা তুলে দিয়ে জোরে পা চালায় মামুন। যতো দ্রুত সম্ভব এ এলাকাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার একটি তীব্র তাগিদ অনুভব করে। এই বিভিষীকাময় স্মৃতি থেকে যতো দূরে সরে যাওয়া যায় ততোই মঙ্গল।
হাঁটতে হাঁটতেই নিজের মনে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির ব্যখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে মামুন। তার যুক্তিবাদি মন কিছুতেই অলৌকিক কিংবা ভুতুড়ে কোনো কিছুর অস্বিত্ব মেনে নিতে রাজি নয়। অথচ মনের আরেকটি অংশ এখনও একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার আকষ্মিকতা এবং আস্বাভাবিকতায় আচ্ছন্ন।
নিজের মনে একে একে যুক্তি সাজাতে থাকে মামুন। প্রথমত, সে রিক্সা ওয়ালাকে বলেনি কোথায় যাবে তাই রিক্সা ওয়ালা তাকে ক্যাম্পাসের শেষ প্রান্তে গোরস্থানের কাছে এই নির্জন স্থানে নিয়ে এসেছে। অন্যমনষ্ক ছিলো বলে মামুন আগে থেকে বিষয়টি লক্ষ্য করেনি। আর রিক্সাওয়ালাটি নিশ্চই শ্বেতি এবং হরমোনের জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত। তাই তার হাতটি এমন অস্বাভাবিক ফ্যাকাসে, সাদা। এই রোগের প্রভাবেই হাতের তালুতে অস্বাভাবিকভাবে লোম গজিয়েছে, নখগুলো হয়ে গেছে একেবারে কালচে।
নিজের মতো করে ব্যখ্যা দাঁড় করিয়ে কিছুটা স্বস্তি পায় মামুন।
আচমকা বাঁশির শব্দ। একজন টহল পুলিশ পথ আটকায়। কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসে দুটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ধুন্দুমার মারামারির পর ক্যাম্পাসে টহল জোরদার করা হয়েছে। বাইরের সন্ত্রাসীদের আনাগোনা ঠেকাতে রাতের বেলা সন্দেহজনক কাউকে দেখা গেলেই পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া হয়, কখনো কখনো কিছুটা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
'আইডি কার্ড।'
মামুনের সামনে হাত বাড়ায় টহল পুলিশ।
একটু আগে দেখা রিক্সা ওয়ালার ভুতুড়ে হাতটিই আবার সামনে হাজির হয়। এবার হাতের মালিক টহল পুলিশ।
এরপর আর নিজেকে ধরে রাখা সম্ভভ হয়না মামুনের পক্ষে। অমানুষিক আতঙ্কে ছুটতে থাকে। অনেকদিন এভাবে দৌড়ানো হয়নি। কিছুদূর যাওয়ার পরই বুকের ভেতর কেমন করতে থাকে, তলপেচে খিঁচ ধরে যায়, বাতাসের অভাবে ফুসফুসটি যেন যেন ফেটে যাবে। এসব অগ্রাহ্য করে প্রাণভয়ে ছুটতে থাকে মামুন। এক সময় দম বন্ধ হয়ে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। এ অবস্থায়ও কিছুটা স্বস্তিবোধ করে সে, কারণ ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসের নির্জন এলাকাটি ছেড়ে একটি হলের সামনে এসে পড়েছে।
এভাবে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখে তাড়াহুড়ো করে সোলেমান হলের গার্ড আকরাম আলী এগিয়ে আসে। হলের সিড়িতে মামুনকে বসিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্ত হয় মামুন। সংক্ষেপে আকরামকে জানায় একটু আগের অভিজ্ঞতার কথা।
তার কথা হেসেই উড়িয়ে দেয় আকরাম।
'কি যে কন, এমুন হাত মাইনসের হয়! আপনে নিশ্চই ভুল দেখছেন। ভালা কইরা চাইয়া দেখেন তো আমার হাতটা কেমুন!'
সাদা সাদা বড় আঙ্গুল, কলচে বাঁকানো বড় বড় নখ আর তালুতে অস্বাভাবিক এক গোছা কালো লোমসহ হাতটি মামুনের সামনে বাড়িয়ে ধরে আকরাম।
হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটি নীচে পড়ে ভেঙ্গে যায়, তার আগেই অবশ্য জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে ঢলে পড়ে মামুন।
দুই
আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে রাজীব, রবীন, কোয়েলসহ আরো কয়েকজন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় রিক্সাওয়ালার ছদ্মবেশধারী সুমন এবং টহল পুলিশ আমজাদ।
হতবুদ্ধি আকরাম তখন মামুনকে তুলে বসানোর চেষ্টা করছে।
'আমার কিন্তুক কুনু দোষ নাই। কুয়েল বাই যেমনে কইছে আমি সেমতেই কাম করছি। এখন দেখি মামুন ভাই মাতা ঘুরাইয়া পইড়া গেছে।'
'একটু পানির ছিটা দিলেই জ্ঞান ফিরে আসবে। তবে যাই বলিস কোয়েল, এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। এতো বড় শকটা এখন বেচারা সামলে উঠতে পারলেই হয়!'
'দেখ রবীন জ্ঞান দিবিনা। আমরা সবাই মিলেই মামুনকে ভয় দেখানোর প্ল্যান করেছি। সুমনের রুমে বসে শালা কতো বড় বড় বুলি ছাড়লো তোদের মনে নেই! আর আমরা ভুতে বিশ্বাস করি বলে কুসংস্কারের ডিপো, খ্যাত, অশিক্ষিত, মুর্খ, কতো কিছু বলেই না গালাগাল করলো। এখন বাবাজী ভুতের ভয়ে একেবারে খাবি খাচ্ছেন।
আর রাজীবের মামার পাঠানো উদ্ভট গ্লাভস জোড়া ব্যবহারের বুদ্ধিওতো তুই দিয়েছিলি। খুবতো বলেছিলি, একজোড়া গ্লাভস দিয়েই তিনজন ভয় দেখাতে পারবে। মামুনতো আর ভুতের দুই হাত দেখতে চাইবে না। প্রথমে রিক্সাওয়ালা উরফে সুমন বাঁ হাতের গ্লাভসটি পড়বে, এরপর আমজাদভাই পড়বে ডান হাতেরটা। আর ততোক্ষণে সুমন তার গ্লাভসটি দিয়ে দেবে আকরামকে। এভাবে তিনজন মিলে দুটি গ্লাভস দিয়ে ভয় দেখানোর প্ল্যানটাওতো তোর মাথা থেকেই বেড়িয়েছিলো, নাকি!'
'আহ্ তোরা থামবি।' মামুনের দিকে এগিয়ে আসে সুমন। 'আমার মনে হয় একে দ্রুত ইউনিভার্সিটি হেলথ সেন্টারে নেওয়া দরকার। পরে ভালো-মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে সবাই বিপদে পড়বো।'
সবাই ধরাধরি করে মামুনকে রিক্সা তোলার চেষ্টা করে।
এমন সময় হো হো হো..হা হা হা.. করে বিকট শব্দে হেসে উঠে মামুন। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে এই হাসিকে কেমন যেন অপার্থীব শোনায়।
সবাই দারুন চমকে উঠে। তবে কী সত্যিই মামুনের উপর ভুতের আছর হলো? গা ছম ছম করে উঠে সবার।
ধীরে সুস্থে উঠে বসে মামুন।
পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সবার দিকে।
'তোরা ভেবেছিলি এতো সহজে আমাকে বোকা বানাবি।
কী করে তোরা ভাবলি এতো পুরাতন থীমের একটা নাটক দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখাবি। ছি ছি, তোদের কল্পনা শক্তিকে করুণা হচ্ছে। সেই রিক্সা ওয়ালার ভুতুড়ে হাত বাড়িয়ে দেওয়া, এর পর পুলিশ, এর পর আর কেউ- এই গল্প কে না জানে। ছোটকাল থেকেই এ ধরণের ভুতের গল্পগুলো শুনে আসছি। এর চেয়ে ভালো কিছু ভাবতে পারলি না!
তার উপর সুমনের কাঁচা অভিনয়। গলাটা যতোই বিকৃত করো বাপু, তোমার সেই বরিশাইল্লা একসেন্ট কোথায় লুকাবে? 'ভাড়া দ্যাবেন না!' ভুতের মুখে বরিশালের টান। হা..হা..হা..'
ভয় দেখানোর পরিকল্পনাকারীদের চোয়াল ঝুলে পড়ে।