বিষ্ণু এসে পৌঁছেছে থাইল্যান্ড থেকে। এসে পড়েছে না বলে ঘাড়ে চেপে বসেছে- বলাই যথার্থ। বিবিধ বায়না লেগেই আছে আসার আগে থেকে । বাড়ি ঠিক করে রাখ, ব্যাঙ্ক অ্যকাউন্ট খুলে দাও। ল্যাব এর চাবি নেই তালা খুলে দাড়িয়ে থাক, রাস্তা চিনতে পারি না বাজারে নিয়ে চল, রান্না করতে পারি না রেসিপি লিখে দাও।
তা কি আর করি অ্যাডভাইসারতুত ভাই, না বলা চলে না। দুবছর কাটিয়েছি থাইল্যান্ডে; একই সাবজেক্ট একই অ্যাডভাইসার। কপাল এমন এখন আবার ঠিক একই সমন্ধ। এবার আমার বোনাস কোর্সলোড -উনি স্বয়ং। কেন যে মরতে তার একমাস আগে এখানে এসে পৌঁছেছি; অতএব বাই ডিফল্ট সিনিয়র। 'সেবাই পরম ধর্ম' প্লাকার্ড হাতে সদাপ্রস্তুত।
কদিন হল নতুন আব্দার; কাপড় কাচতে পদধূলি দেবেন আমার ভাঙ্গাকুটীরে । ওনার ওয়াশিং মেশিন নষ্ট। মাথায় হাত! আসবে বললে হল, এসেই তো আমার পিসিটা দখল করবে। সিরিয়াল ধরে 'বিষ্ণুপ্রিয়া'রা উপস্থিত ইন্টারনেটে। আহা ওর বাসায় নেট নেই তায় ব্যাচেলর মানুষ,না করা যায় না। ওদেরই ত এখন 'facebook' এ face দেখানোর সময়।
তার থেকে বড় দায় একটা আছে। কাকুতিমিনতি করে ওর বাড়িউলিকে বলেছি -ছেলে ভাল! শাওয়ার নেয়, লন্ড্রি করে (অপরাধ নেবেন না , শ্বেতপ্রভুদের বোধহ্য় এই বিষয়ে কোন ঘাটতি আছে)। অতএব ইহা বালিকার কৃতকর্মের ফল।
কাহিনীটা খুলেই বলি। বিষ্ণুর বাড়ি আদতে নেপাল, আসার আগে ওর জন্য বাসা ঠিক করতে গেছি। ল্যান্ডলেডি কঠিন জিনিস, বহুবছর ধরে ইউনিভার্সিটির কাছে, দেশবিদেশ এর ছাত্র চরিয়ে খাচ্ছেন। আমার মত আনাড়ি- অর্ধকালো- দরিদ্র- দক্ষিণ এশিয়ানকে পেয়ে তো জেরার পর জেরা। হাজারখানেক প্রশ্নের চেকলিস্ট । কোথা থেকে আসছে? 'এ্যাঁ নেপাল মানে হিমালয়'! যেন পাহাড় থেকে নেমে আসবে একটি বিরাট গরিলা। 'নিয়মিত শাওয়ার নেয়? লন্ড্রি করে?'
অতঃপর শর্ত হল বাসা কনফার্ম হবে না এখনই, যদি চেহারা দেখে পছন্দ হয় তবে বিবেচনা করা যেতে পারে। নিরুপায় হয়ে বললাম অতগুলো লাগেজ নিয়ে বিদেশী ছাত্র , কোথায় যাবে? কর্তাটি একটু সদয় ছিলেন, তবু চিঁড়ে ভিজল না। সোজাসাপটা কথা কোথায় যাবে তা জানি না , আগে দেখে পছন্দ হলে তবে বাড়িভাড়া (কথা শুনলে মনে হয় মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন )। মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। পাঠক, পাত্রপক্ষ এই অধমকে দেখতে আসলেও এত ভাবতাম না। চোখ বুজে ভাবছি, আচ্ছা বিষ্ণুটার চেহারা কেমন? আসবে তিনদিনের জার্নি করে তায় এত লটবহর। হে ধরণী! দ্বিধা হও। এয়ারপোর্ট থেকে নামার পর সোজা বললাম, আয়না চিরুণি নাও, কিছু ঘষাঘষির থাকলে কর; মুখ দেখে নাকচ করলে আর উপায় থাকবে না; পরের ফ্লাইট ধরতে হবে।
ধান ভানতে শিবের গীত। তার বাড়িউলিকে গুণকীর্তন করেছি অতএব এখন লন্ড্রি করাও। সক্কাল বেলা ল্যাব এ দেখি পর্বতপ্রমাণ একটা ট্রাভেলকিট। মালিকানা পরমকরুণাময় বিষ্ণুর। উৎসুক হয়ে বিষয় কি জানতে গিয়ে শুনি উহারাই আমার রজকালয়ে আজ দর্শন দেবেন। ও হরি! এযে এক বস্তা, তিনবারেও লোড হবে না। শুধু কি তাই হাসিমুখে গদগদ হয়ে জানালেন আজ তাড়াহুড়ায় লাঞ্চ আনতে পারেননি , অধমের বাড়িতে ব্রাহ্মণভোজনে সেটা পুষিয়ে নেবেন । এত গুলো কাপড় ধুতে ধুতে রান্না দিব্যি হয়ে যাবে। গা জ্বলে গেল। ওকে শুদ্ধু ওয়াশিং মেশিনে লোড করলে কেমন হয়। বেটা ভেজিটরিয়ান! খাওয়াবটা কি? আমার রান্নাঘর তো ভরা মাছের গন্ধে ('স্যামনের মুড়োটা' তো ভুলে যাননি) । গজগজ করে বললাম ঐ আশায় থাকো। সময়কালে টের পাবে।
ঘন্টাখানেক আগেই কেটে পড়ার মতলবে আছি ল্যাব থেকে, গুরুদেব ফোন দিলেন আজ একটা সারপ্রাইজ আছে-সকলেই যেন ল্যাবে থাকি। বেজার মুখ করে সারপ্রাইজের জন্য বসে আছি, অবশেষে এলেন। হাতে একটা নতুন খাদ্য; বললেন 'এগনক' - এ অঞ্চলে খুবই পপুলার, খেতে হয় রামযোগে ককটেল রূপে। বলা বাহুল্য আমাদের প্রফেসরটি কিঞ্চিত অদ্ভুতপ্রকৃতি, সবর্দাই চিন্তাতরঙ্গে নতুন নতুন আইডিয়া গজাচ্ছে, এবং তার প্রথম গিনিপিগ হিসাবে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা- ল্যাব এর কতগুলো অবলা জীব। আসুন এইবেলা ওনাকে একটা নামকরণ করি (গুরুনাম যত কম নেওয়া যায় ততই নিরাপদ)। ধরুন ওনার নাম ঝাঁঝাঁ। তো রামের নামে আমাদের পিডিএফটির (পোস্ট ডক্টরাল ফেলো) চোখ চকচক করে উঠল, যদিও ড. ঝাঁঝাঁর সীমানায় রাম শ্যাম যদু মধু কোনোটাই চলে না। অতএব ডিমময় এই বিস্বাদ পানীয়টা রামহীন গিলতে হল। ঝাঁঝাঁ পরম উৎসাহে মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এবার মন্তব্যের পালা। পাঠক এই প্রসঙ্গে একটা রাশিয়ান কৌতুক মনে পড়ে গেল। এক বস প্রায়ই জুনিয়রদের অনেক কৌতুক বলেন এবং জুনিয়ররা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। একদিন একজন কৌতুক শুনে হাসছে না। সহকর্মীরা বিস্ময়ে জানতে চাইল, কি ব্যাপার হাসি পাচ্ছে না তোমার? এবার সেই লোক ততোধিক বিস্ময়ে বলল, 'আশ্চর্য আমি অলরেডি নোটিশ দিয়ে ফেলেছি, নেক্সট মান্থে জয়েন করব নতুন কোম্পানিতে। এখনও আমাকে হাসতে হবে?'
পাঠক আমারতো সবে জয়েনিং হল , এখনও না হোক তিনবছর লাগবে শেষ হতে। আমি কিভাবে খারাপ বলি এগনক। গদগদ ভাব দেখিয়ে বললাম বাকিটা বিষ্ণুই খাক, বেচারা আজ লাঞ্চ করেনি, ডিনারেও ওর কপালে কিছু নেই। ঝাঁঝাঁ বলল কেন? আহা আজ ডিনার ওর আমার ওখানে।(সাধ করে কে যায় বাঘের গুহায়?) বিষ্ণু ব্যগ্র হয়ে বলল তা কি করে হয় আজ ওর লন্ড্রিপ্রোগ্রাম আমার বাসায়। ঝাঁঝাঁর তাৎক্ষণিক সমাধান কুছ পরোয়া নেই আমি সহই ডিনার কাম লন্ড্রি হবে গুরুগৃহে। রেগে কাঁই হলাম, চোখ কটমট করে তাকাতেই ও বুঝিয়ে দিল একা একা ঝাঁঝাঁর খপ্পরে পড়তে সে কিছুতেই রাজী নয়।
কোথায় উইকএন্ড এর সন্ধ্যা। বাড়ি ফিরে আড্ডা দেব ব্লগে তা না ডিউটি দাও। খাও আর বেড়াও- অ্যাডভাইসার কে সামনে দেখলেই তো মনে হয় ল্যাবে আছি। অবশ্য ডিনার পর্ব ভালোভাবেই সমাধা হল এবার লন্ড্রিপর্ব। ঝাঁঝাঁ আজ মহামৌজে আছে। আজ লন্ড্রি উনি করবেন। নিজের বাসার ওয়াশিং মেশিন কখনও চোখেও দেখেননি , হাউসকিপিং পুরোটাই সহধর্মিণীর উপর। আজ এই দুর্নাম উনি ঘুচিয়ে দেবেন। দেখুক মিসেস ঝাঁঝাঁ উনি সবই পারেন। শুধু তাই নয়, কাজটি হবে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক উপায়ে। সাইন্টিস্টরা যেটাই ধরেন সেটাই হয় গোল্ডেন টাচ।
তা না হয় হল, বিষ্ণুর মুখতো শুকিয়ে আসছে। নিজের নামই স্মরণ করছে বোধহয় 'হে বিষ্ণু! এই বিপদ হতে রক্ষা কর'। ক' মাসের ময়লা, ঘাম জড়ানো, ব্যাক্তিগত -ইতরবিশেষ বেশবাস এখন প্রফেসরের সামনে খুলতে হবে। আমি আর সামনে নেই। কি দরকার বেচারার সঙ্কোচ বাড়িয়ে। ও ঘর থেকে ঝাঁঝাঁর অভিযানের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ঝাঁঝাঁর মেথডোলজি- প্রথমেই সমস্ত কাপড় ভাগ করা হবে সাদা ও রঙ্গীন। তারপর দুবর্ল ও সবল, তারপর ডিটারজেন্টের লেভেল ও টাইপ নিণর্য় করা হবে লিটারেচার দেখে।
প্রথম দফা লোড হতেই দুপদাপ শব্দ পেলাম সিঁড়িতে। আজ ড্রাইয়িং হবে ড্রায়ার নয়- বয়লার রুমে। ড্রায়ার এর হিটিং লোড অনুসারে বয়লার রুমে কত মিনিট রাখা দরকার ক্যালকুলেট করছে বিষ্ণু । ঝাঁঝাঁ শুণ্যে চোখ তুলে ভাবছেন, ধরতে চাইছেন একটা আইডিয়া কিন্তু মিলিয়ে যাচ্ছে। কি হতে পারে নেক্সট কনফারেন্সের টপিক -'ডোমেস্টিক হিট রিকভারি' নাকি 'এ ন্যিউ ইনোভাটিভ ওয়াশিং সাইকেল'। মাঝে মাঝে নিচে নামছেন বয়লার রুমটা কিভাবে রেনোভেশন করা যেতে পারে কাপড় শুকাতে যাতে নিয়মিত কাজে লাগান যায়।
আমি ঝিমাচ্ছি, বিষ্ণু নির্বাক। ক্যালকুলেট করে পাওয়া গেছে পুরোদিন লাগবে সব কাপড় শুকানো শেষ হতে। প্রফেসর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আইডিয়া একটা দাড়াঁবেই, নেটে খুঁজছেন, ওয়াশিং মেশিনের working principle. মাঝে মাঝেই তার মুখে একটা স্বর্গীয় হাসি খেলে যাচ্ছে। একটা experiment করে নিলে কেমন হয়? Temperature reading নেওয়া হবে প্রতি ঘন্টায়। তাহলে বিষ্ণুর ক্যলকুলেশনের সাথে একটা তুলনামূলক আলোচনা করা যাবে- থিয়োরিটিক্যাল আর এক্সপেরিমেন্টালের পার্থক্য।
ইশারা করে ডাকলাম । ব্যাপার কি ? বেজার মুখে বিষ্ণু উত্তর দিল- " now professor is flowing in ideas" ক্যালকুলেশন রিপিট করে পাওয়া গেছে পুরোটা শুকাতে দুইদিনই লাগবে বয়লার রুমে। সেক্ষেত্রে উইকএন্ডটা পুরোপুরিই কাজে লাগানো যাচ্ছে , সেদিক থেকে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান - (কোটেড বাই ঝাঁঝাঁ ) । ব্যাগ নিয়ে হাঁটা ধরলাম, যা থাকে কপালে , এর পর লাস্ট বাসও মিস করব ।
বিষ্ণুর কথা আর কি বলব, বহুকাল আগে একটা গান শুনেছিলাম " ফান্দে পড়িয়া বগা .... "।
একেই বলে বোধহয় 'ধোপার গাধা'।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০০৯ ভোর ৪:৫৫