এবারের প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় যখন বাকখালি নদীতে ঐতিহ্যবাহী জাহাজ ভাসল না... তখন আমার সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ে গেল ...
ছেলেটির বাড়ি বিক্রমপুর, বসবাস ঢাকা শহরে, চাকরি একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে। শ্যামল, বলিষ্ট গড়নের মিশুক, আলাপি, হাসিখুশি একটি ছেলে। এ ধরণের মানুষ দেখলে আমি অর্ন্তগত চিন্তাস্রোত ছিন্ন করে খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসি, বই মুড়িয়ে রেখে দীর্ঘ আলোচনায় প্রস্তুত হই। ছেলেটি একটানা কথা বলতে ভালোবাসত। ( ভালোবাসত বললাম এই কারণে যে ছেলেটি আমাদের বহুতল থেকে বছর তিনেক হতে চলল চলে গেছে; যা হয়, এখন আর ওর সঙ্গে আমার এমন কী টেলিফোনেও যোগাযোগ নেই।)
নানা বিষয়ে উৎসাহ ছিল ছেলেটির । বিশেষ করে ধর্মেকর্মে এবং ভ্রমনে। নামাজ পাঁচ ওয়াক্তই পড়ত। তবে ধর্ম নিয়ে মনের মধ্যে বিন্দুমাত্র গোঁড়ামি ছিল না। এর এক কারণ হয়তো ছেলেটির জ্ঞানতৃষ্ণা। তিন আলমারি ভর্তি নাকি বই ছিল,‘নাকি’ বললাম এই কারণে যে আমরা একই বিল্ডিংয়ে পাশাপাশি বসবাস করলেও বইয়ের ছেলেটির আলমারি আমার কখনও স্বচক্ষে দেখা হয়নি। তবে যা বুঝেছিলাম আলমারির বেশির ভাগ বইই রোমেনা আফাজ -এর ‘দস্যু বনহুর’ বা পশ্চিম বাংলার নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস। তার মানে মাসুদ রানা পড়ার জন্য মনের যে আধুনিক গড়ন দরকার হয়,তা যে কারণেই হোক ছেলেটির মধ্যে তৈরি হয়নি। কাজেই ছেলেটিকে আমি ভারি পছন্দ করতাম। তবে এই নয় যে ছেলেটি ছিল নিতান্তই অনাধুনিক। আমার কম্পিউটারের সামনে বসে ফরেন বায়ারদের ঝটপট ইংরেজিতে মেইলে উত্তর দিয়েছে, আপলোড করে কাপড়ের স্যাম্পল পাঠিয়েছে এবং আমাকে বায়িং হাউজের নানান মারপ্যাঁচ সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞান দিয়েছে -এমন কী ব্যক্তিগত মানসিক যন্ত্রণার কথাও খুলে বলেছে।
ছেলেটির প্রথম যন্ত্রণা ... কাজের চাপে বউ-বাচ্চাকে সময় দিতে না পারা। বায়িং হাউজ থেকে ফিরতে- ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা বেজে যেত, আর অফিসে রওনা হতে হত সকাল সাতটা মধ্যেই, তখন বাচ্চাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখত; রাতে ফেরার পরও ওই একই অবস্থা। ছেলেটির দ্বিতীয় যন্ত্রণা ছিল অনেকটা পরাধীনতার গ্লানির। ছেলেটি থাকত বড় ভাইয়ের সঙ্গে। প্রথম বাচ্চা হওয়ার পর একসঙ্গে থাকার ব্যাপারটা ছেলেটির বউয়ের যথারীতি না-পছন্দ। কাজেই, বউ আলাদা হতে ক্রমশ চাপ দিচ্ছিল। ছেলেটির বউ আবার ধনী শ্বশুরের একমাত্র মেয়ে! সুতরাং, বউয়ের কথার জোর আছে। অথচ, যা বেতন তাতে আলাদা হওয়া সম্ভব হলেও বহুতলে থাকার স্বাচ্ছন্দ্য থাকে না। ইত্যাদি ... ইত্যাদি।
কাজেই অভিমানী বউকে মাঝেমাঝেই শ্বশুরালয়ে রেখে আসতে হত ...
শ্বশুরালয়টি দক্ষিণাঞ্চলের এক বন্দরনগরীতে। ছেলেটি ভ্রমনপ্রিয় বলেই বাসযাত্রা উপভোগ করত। পরে একা ঢাকায় ফিরে এসে দুঃখী ছেলেটি আমাকে সেসব কথা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে বলত।
অর্ন্তগত দহনের কথা যতটা না তার চেয়ে বেশি তুচ্ছ বাস ভ্রমনের অভিজ্ঞতা!
তো, এমন ছেলে ছাত্রজীবনে কক্সবাজার- বান্দরবান- রাঙামাটি ইত্যাদি প্রকৃতির সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকা ঘুরে বেড়াবে না তা কি হয়?
তো, ছেলেটি একবার রামু গিয়েছিল।
(রামু শব্দটি এখন আমাদের মনে যে রকম সচেতনা সৃষ্টি করে ২/৩ বছর আগে তেমন করত না) ... ঘুরতে ঘুরতে বিকেলের দিকে একটি বৌদ্ধবিহারে গিয়ে উপস্থিত হয়ে ছেলেটি ঘুরে ঘুরে বিহার দেখল।
তারপর বৌদ্ধবিহারে বসেই বিহারের অধ্যক্ষের সঙ্গে অনেক ক্ষণ ধর্মালোচনা হল ছেলেটির।
কথায় কথায় সময় গড়াল।
মাগরিবের আজানের সময় হল।
ছেলেটি বলল, আমি অজু করব, আমাকে পানি দেন।
ছেলেটির ভাষ্য অনুযায়ী বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ অত্যন্ত খুশি হয়েই পানির ব্যবস্থা করলেন।
ছেলেটি অজু করল।
তারপর বৌদ্ধবিহারের মধ্যেই মাগরিবের নামাজ পড়তে শুরু করে দিল ...