somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মনে বাবলা পাতার কষ লেগেছে ... বাংলার একটি মরমি লোকগানে শুদ্ধতার জন্য আর্তনাদ

৩১ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে ? এই লুটেরা সময়ে দুনিয়া যখন রসাতলে যাচ্ছে মানুষের লোভের তান্ডবে তখন ... তখন বাংলার মরমি লোকগানে হার্দিক শুদ্ধতার জন্য এই আর্তনাদ আমাদের বিস্মিত করে বৈ কী । এই আমরা যারা মেনে নিয়েছি যাবতীয় অনিয়ম, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, আসন্ন মহাপ্লাবন -সেই নতজানু আমাদের বিস্মিত করে। ব্যথিতও করে।
কিন্তু, এমনটা মনে হওয়ার কারণ কি?
দেশের সমকালীন পরিস্থিতি বিশ্লেষন করার পর অবশ বিমূঢ় মনের ওপর সম্প্রতি এক লোকগানের আকস্মিক অভিঘাত। সহসা শুনি যে কিরনচন্দ্র রায় গাইছেন:

মনে বাবলা পাতার কষ লেগেছে
উঠবে কী আর সাবানে
গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে ?


শিষ্য তার গুরুর কাছে জানতে চাইছে গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে? এই লুটেরা সময়ে এমন প্রশ্ন তো কেউ করে না। তবে এটুকু জানি যে এমন ধারার প্রশ্ন আজও বাংলার শুদ্ধচারী মরমি বাউলেরা করে থাকেন। তাই মনোযোগী হলাম। পাপ কিংবা পাপচিন্তা এই গানে বাবলা পাতার কষ হিসেবে এসেছে। হয়তো, বাবলা পাতার কষ প্রতীক। হয়তো-বা আরও গূঢ় প্রতীক। কেননা, বাংলার লোকগান সহজিয়া বৌদ্ধদের চর্যাপদ -এর উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। চর্যার কবিরাই তো এককালে লিখেছিলেন:

ঘরহি ম থক্কু ম জাহি বণে জহি তহি মন পরিআণ।

ঘরে থেকো না। বনেও যেও না। যেখানেই থেকো। মনকে ভালো করে জেনো।

(সূত্র: আজহার ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। ( প্রাচীন ও মধ্যযুগ) পৃষ্ঠা: ৮)


চর্যাপদের দার্শনিক জঠরে জন্ম বলেই বাংলার লোকগানে অনেক শব্দই আজও গূঢ়ার্থে ব্যবহৃত হয়।

ও স্বভাব যায় না রে ধুলে
খাইসলত যায় না রে মলে ।
ছুঁচোর গায়ের গন্ধ যায় কী
বাবা গো গোলাপ জল দিলে


শিষ্য অনেকটা স্বতগসংলাপের মতো করে এই কথাগুলি বলছে। বলছে যে: মানুষের স্বভাব সহজে বদলায় না। মানুষ মরলেও তার চরিত্র বদলায় না। সে বড় পাপপ্রবণ। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তার ঝোঁক। এই তার স্বভাব। এসব করে করে মানুষের দুনিয়া রসাতলে যায়। এ জন্যেই ছুঁচোর গায়ের গন্ধ গোলাপ জল দিলে যায় না। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। বাংলার মরমি লোকগান সমন্বয়পন্থি। অর্থাৎ বাংলার মরমি লোকগানের কাঠামোয় আর্যবৈদিক এবং বৌদ্ধ ধারার পাশাপাশি মরমি ইসলামি ধারাও বিদ্যমান। বাংলায় মারেফত বলতে আলীপন্থি মারেফতকেই বোঝায় । কাজেই "বাবা" বলতে এই আত্মশুদ্ধির মরমি গানে হযরত আলী (রা) কে বোঝানো হতে পারে। উল্লেখ্য, গোলাপ জলও ইসলামি উপচার।

ও আমার মনপাখিটা* বেজায় খেপা
মন রে ধর্মকথা কই শোনে।
গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে ?


*কিরনচন্দ্র রায় অবশ্য মনপাজি উচ্চারণ করেছেন। তবে এরকম উচ্চারণ ভেদ আমরা বাংলার মরমি লোকগানে প্রায়শই দেখতে পাই ...

শিষ্য এবার অবজেক্টটিভ থেকে সাবজেক্টটিভ হচ্ছেন। অর্থাৎ এবার নিজের সর্ম্পকে বলছেন। বললেন, ও আমার মনপাখিটা বেজায় খেপা। অর্থাৎ শিষ্যের মন ভীষণ চঞ্চল। ধর্মকর্মে তার মন বসে না। তাই এই আর্তনাদ-গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে ?

অন্য কালি সে তো ধুলে যায়
আর মনের কালি বিষম কালি
গুরু গো সে তো ধুবার নয়।
ও আমার কালো রং কী গৌড় হবে
কাঁচা হলুদ গায় মাখিলে?


মনের কালি কি পাপবোধ কিংবা পাপচিন্তা? তাইই। শিষ্য স্বীকার করছেন যে- মন থেকে পাপচিন্তা সহজে মোছা যায় না। তারপরও সে হাল ছাড়ে না । শিষ্য গুরুকে জিজ্ঞেস করছে-ও আমার কালো রং কী গৌড় হবে? কাঁচা হলুদ গায় মাখিলে? গৌড় বলতে ফরসা বোঝায়। তবে গানটি যখন বাংলার মরমি লোকগান তখন এই গৌড় শব্দটিকে শ্রীচৈতন্যদেব মনে করাই শ্রেয়। যিনি ষোড়শ শতকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গৌড়-বাংলা আলোকিত করেছিলেন; যিনি প্রেমের আধাররূপে বাংলার সাধুসমাজে শ্রদ্ধেয়। ‘কাঁচা হলুদ’ সম্ভবত সহজিয়া বৌদ্ধদের " শূন্যতার তত্ত্ব"। সেই শূন্যতার তত্ত্ব বোঝার জন্য একটু পিছনে যেতে হবে। মধ্যযুগে পাল আমলে বুদ্ধের শূন্যতার ধারণার ওপরই গড়ে উঠেছিল সহজিয়া বৌদ্ধদের তান্ত্রিক বজ্রযানী দর্শন। যে দর্শনের মূলকথা হল ‘সৃষ্টির আদি ও অকৃত্রিম উৎপত্তিস্থল একমাত্র শূন্য।এই শূন্য মহাসুখ এবং আনন্দস্বরূপ। এই শূন্য ঘনীভূত হয়ে প্রথমে শব্দরূপে দেখা দেন পরে শব্দ হতে পুনরায় ঘনীভূত হয়ে দেবতা রূপ গ্রহন করেন।’
মধ্যযুগের বাংলার বজ্রযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধ দের অন্যতম তাত্ত্বিক ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর। তিনি বলেছিলেন:The greatest medicine is the emptiness of everything. সে যা হোক। শূন্যকে বজ্রযান দর্শনে ‘বজ্র’ বলা হয়েছে। কিন্তু, কেন? কারণ শূন্য বজ্রের মতোই (ক) অবিনাশী, (গ) অভেদ্য ও (গ) দৃঢ়। কাজেই ‘শূন্য’-র অপর নাম ‘বজ্র’। এবং যে মার্গে (বা যে পথ অবলম্বন করলে ) শূন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়া যায় তাকেই শূন্যযান বা বজ্রযান বলে।
শূন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়া কেন?
শূন্যের সঙ্গে মিলিত হতে পারলে পাপপূন্যের আর নাই বালাই। তখন শূন্য নিরঞ্জনের র্স্পশে কেবলই মহাসুখ।

ও আমার কালো রং কী গৌড় হবে
কাঁচা হলুদ গায় মাখিলে?


সুতরাং, শিষ্য পাপ ও পূন্যের উর্ধ্বে ওঠার জন্য শূন্যের সঙ্গে মিলিত হতে চাচ্ছেন বলেই গানে কাঁচা হলুদ শূন্যতার তত্ত্বের প্রতীক হিসেবে এসেছে। কিন্তু, গানে ‘গৌড়’ শব্দের উল্লেখ কেন- যে গৌড়কে আমরা শ্রীচৈতন্যদেব- এর সঙ্গে অভিন্ন মনে করছি? সেই কারণটি বোঝার জন্য আবারও আমাদের একটু পিছনে যেতে হবে। শ্রীচৈতন্যদেব ষোড়শ শতকের বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সময় বাংলার সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধরা ছিল কোণঠাসা, অন্ত্যজ এবং অচ্ছুত। শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর প্রতিষ্ঠিত মঠে বাংলার সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। গানে ‘গৌড়’ শব্দের উল্লেখের এই কারণ। এই গানের গুরুও তিনি।

গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে ?

পাপবোধহীন এই সময়ে দুনিয়া যখন রসাতলে যাচ্ছে তখন বাংলার মরমি একটি লোকগানে হার্দিক শুদ্ধতার জন্য এই আর্তনাদ আমাদের বিস্মিত করে বৈ কী।

মনে বাবলা পাতার কষ লেগেছে গানটির এমপি থ্রি ডাউনলোড লিঙ্ক

http://www.mediafire.com/?d9ab8n854dk247p

মনে বাবলা পাতার কষ লেগেছে গানটির সূত্র:

http://www.music.com.bd/
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৯:০২
১৩টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×