গতবছর যশোরের একটি পুরনো জমিদার বাড়িতে আমার বিচিত্র এবং রহস্যময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সত্যি বলতে কী-আজও আমি সেই রহস্যময় অভিজ্ঞতার কোনও যথাযথ ব্যাখ্যা পাইনি। ঘটনাটি এই রকম ....আমি দীর্ঘকাল আগে পুরাতত্ত্ব বিষয়ে অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছি । বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পুরনো সব দর-দালানে যেমন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াই, তেমনি পুরাতত্ত্বর ওপর বই কিংবা নথিপত্রও সংগ্রহ করি। পুরাতত্ত্বর ওপর বই কিংবা নথিপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে ওই রহস্যময় ঘটনার সূত্রপাত। খুলে বলি। ... হিরন্ময় রায় নামে একজন সৌখিন প্রতœতত্ত্ববিদের লেখা প্রায়ই পত্রিকায় চোখে পড়ে। সৌখীন বললাম এই কারণে যে পেশাগত জীবনে হিরন্ময় রায় সোনালী ব্যাঙ্কের চাকরি করেন। তবে পুরাতত্ত্ব সংক্রান্ত ভদ্রলোকের প্রতিটি লেখাই অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ ।
গতবছর মাঝামাঝি পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম হিরন্ময় রায় মারা গিয়েছেন। এক প্রজ্ঞাবান লেখককে হারিয়ে গভীর শোক উপলব্দি করলাম। কখনও আমাদের দেখা না- হলেও আমারা ছিলাম অভিন্ন গোত্রের লোক। পত্রিকা পড়ে আরও জানতে পারলাম যে হিরন্ময় রায়-এর পরিবার জমিজমা বিক্রি করে বিলেত পাড়ি দেবেন (পরে জেনেছি হিরন্ময় রায়-এর পরিবারের একটি শাখা লন্ডন শহরে বাস করে) লোকমুখে জানতে পারলাম জমিজমা ছাড়াও হিরন্ময় রায়ের পরিবার হিরন্ময় রায়ের ব্যক্তিগত বইপত্রও বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খোঁজখবর করে কাল বিলম্ব না-করে রায়ের বাজারে একটি প্রকান্ড পুরনো বাড়িতে হাজির হলাম। এবং পুরাতত্ত্বের বইয়ে ঠাসা ছ’টি আলমারী তারা যে দাম চাইলেন সেই দামেই কিনে ফেললাম।
হাতে যেন সাতরাজার ধন পেলাম । আমার শরীর কাঁপছিল। হিরন্ময় রায়-এর সংগ্রহে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব সংক্রান্ত বাংলা-ইংরেজি অনেক দূর্লভ গ্রন্থ, নথিপত্র, দলিলপত্রাদির অনুলিপিও ছিল। ১৯০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড কার্জন মালদহ পরিদর্শ করতে গিয়েছিলেন। সে সময় বিখ্যাত ‘মেমোরিজ অভ গৌড় অ্যান্ড পান্ডুয়া’ বইটির লেখক খান সাহেব আবিদ আলী খান লর্ড কার্জন তাঁর বইটি টাইপ করে একটি কপি দিয়েছিলেন। সেটির একটি অনুলিপি রয়েছে। রয়েছে মির্জ নাথান- এর বাহরীস্থান- ই- গায়বী; এবং মুন্সী রহমান আলী তায়েশ- এর ‘তাওয়ারিখে ঢাকা'-র প্রথম ফারসি সংস্করণ। আরও রয়েছে ১৯১২ সালে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত বি.সি অ্যালান এর ‘ইস্টার্ণ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারর্স, ঢাকা’-র প্রথম সংস্করণ।
অনেকটা আকস্মিক ভাবেই বইপত্রের ভিতরে একটি পুরাতন ডায়েরি পেয়ে যাই। লেখক অবনী রায়চৌধুরী; ইনি হিরন্ময় রায়-এর এক উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ। (বুঝতে পারলাম কোনও এক অজ্ঞাত কারণে হিরন্ময় রায় তার মূল পারিবারিক উপাধি থেকে ‘চৌধুরী’ শব্দটি ছাঁটাই করে ফেলেছেন।) ডায়েরির কয়েক পাতা পড়ে আমার মনে হল অবনী রায়চৌধুরী একজন বিদ্যানুরাগী ও স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। ডায়েরির কাগজ হলদে হয়ে গেছে। সবুজ কালিতে বাঁকানো অক্ষরে লেখা। তবে ডায়েরিটি মূল লেখার প্রতিলিপি কিনা তা বোঝা গেল না। মাঝে মাঝে কয়েকটি শব্দ অস্পস্ট, কয়েকটি পাতা ছেঁড়া। ভাষার ধরন দেখে মনে হল ডায়েরিটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা। হ্যাঁ, তাই। পিছনে ছোট্ট করে লেখা রয়েছে: বাংলা ১২৬২সন । হিসেব করে দেখলাম ১৮৫৫ সনে লেখা। এ রকম আবিস্কারে বিপুল পুলক বোধ করলাম। ডায়েরিতে অবনী রায়চৌধুরী তাঁর বাল্যস্মৃতি ও যৌবনের ইতিবৃত্ত লিখলেও ঐতিহাসিক উপাদান আছে। ভাষাও ঝরঝরে ভাষা। ১৮৩৫ সালের কলকাতা শহর দেখার অভিজ্ঞতার কথা রয়েছে। রয়েছে আত্মচিন্তা। অবনী রায়চৌধুরী ছিলেন উপনিষদের দর্শনে আচ্ছন্ন। শেষ জীবনে অবনী রায়চৌধুরী তাঁর দিদিমা রাসসুন্দরী দাসীর চিকিৎসা উদ্দেশে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গে আর ফিরে আসেন নি। সে যাই হোক। ডায়েরির এক জায়গায় আমার চোখ আটকে গেল। অবনী রায়চৌধুরী লিখেছেন ... রায়চৌধুরীদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষের নাম হইল রামনারায়ণ রায়চৌধুরী; ইনি অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে যশোহরের রামনগর পরগনায় জমিদারী তালুক লাভ করিয়া রায়তদের কাছ হইতে কর আদায় করত এক ভাগ নিজে রাখিয়া এবং নয় ভাগ ইংরাজদিগকে রাজস্ব প্রদান করিতেন। এইরূপে রামনারায়ণ রায়চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংরাজদিগের আস্থাভাজন হইয়া ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব অর্জন করিয়া লইলেন। কালক্রমে তাহার প্রভূত ধন হস্তগত হইল।ইহার কারণ এই যে রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর স্বভাব ছিল কঞ্জুস প্রকৃতির। প্রত্যহ উপাসনালয়ে দানধ্যান করিলেও তাহার চরিত্রে জামদারীসুলভ বিলাস-ব্যসনের কোনরূও লক্ষণই ছিল না। ধন লইয়া রামনারায়ণ রায়চৌধুরী যথেচ্ছ করিতেন না। অবশ্য রামনারায়ণ রায়চৌধুরী নীলকন্ঠী পাখি অতিশয় পছন্দ করিতেন। তিনি নীলকন্ঠী পাখি পুষিতেন। রামনগরস্থ জমিদারবাড়ির আঙিনায় অলিন্দে কিংবা ছাদে নীলকন্ঠী পাখি ডাকাডাকি করিত। আমার দিদিমা রাসসুন্দরী দাসীর কাছে শুনিয়াছি রামনারায়ণ রায়চৌধুরী নীলকন্ঠী এবং তাহার ধন যক্ষের ন্যয় আগলাইয়া রাখিতে অত্যন্ত বিচলিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। অনন্তর বিভূতি দেখাইয়া নাগবসু নামক প্রাগজ্যোতিষপুরের এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর আস্থা ভাজন হইয়া উঠিয়াছিল। নাগবসু রামনারায়ণ রায়চৌধুরী রায়চৌধুরী কে এই বলিয়া আশ্বাস দিয়াছিল যে যুগ যুগ ধরিয়া তাহার ধন জমিদারবাটিতে গোপন কুঠিরে লুক্কায়িত থাকিবে। সে ধন কেহই হরণ করিতে পারিবে না। ধন তাহার মন্ত্রসিদ্ধ নীলকন্ঠী পক্ষীগণ পাহারা দিবে। আমার দিদিমা রাসসুন্দরী দাসীর বিশ্বাস এরূপ- আজও সে ধন রামনগরের রায়চৌধুরীর ভিটায় লুকাইয়া আছে। রায়চৌধুরীদের ধন অক্ষুন্নই রহিয়াছে এবং তাহা নীলকন্ঠী যক্ষীপাখি আগলাইয়া রাখিয়াছে। তবে আজ আমি এক গুপ্তকথা প্রকাশ করিব। আমরা কেহ কেহ সাত রাজার ধন অনুসন্ধানে ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিলাম। অবশেষে হেমন্তের একদিন অপরাহ্নবেলায় একতলার একটি নিভৃত কক্ষের একটি তামার কলসী ...এরপর ডায়েরির পৃষ্ঠা ছেঁড়া ...আশ্চর্য! পৃষ্ঠা কে ছিঁড়ল? অবাক কান্ড তো। কার হাতে পড়ল পরের পৃষ্ঠাগুলি? এসব প্রশ্নে আচ্ছন্ন হয়ে উঠলাম। কিন্তু মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ জেগে রইল। রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর সাত রাজার ধন কি সত্যিই আছে? নাকি শ্রেফ মিথ? কল্প-কাহিনী?
আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। অবনী রায়চৌধুরী সুলেখক। জমিদার বাড়ির চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। অবনী রায়চৌধুরী দীর্ঘজীবি ছিলেন। ১৯০৯ সালের কথাও লিখেছেন। কুড়ি শতকের গোড়ায় রায়চৌধুরী পরিবারটি কলকাতায় চলে যায়। পরিবারের আরেকটি শাখা ইংল্যান্ড স্থায়ী হয়। ভাবলাম এত বিশাল বাড়ি যখন তখন নিজের চোখে একবার দেখা দরকার। তাছাড়া জমিদার বাড়িটি প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। রক্ষণাবেক্ষণ করাও তো দরকার।
পুরাতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুমতি নিলাম। সরেজমিনে জরিপ করে অধিদপ্তরে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেব। (এ ধরনের কাজ আমি এর আগেও স্ব-উদ্যেগে করেছি ) ... আর রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর গুপ্তধনের খোঁজও নেব।
অবনী রায়চৌধুরীর লেখায় রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর জমিদারবাড়িটি যশোহর জেলার রামনগর-এ বলে উল্লেখ করেছেন। জায়গাটা এখন যশোর সদর উপজেলার দক্ষিণে। যশোর থেকে সরাসরি রামনগর যাওয়ার উপায় আছে। আবার যশোর থেকে পুব দিকে রেলপথে রূপদিয়া হয়েও যাওয়া যায়।
ভোর বেলা রূপদিয়া রেলস্টেশনে নামলাম। তারপর লোকাল বাসে চেপে সকাল নটার মধ্যেই রামনগর পৌঁছলাম। বাস স্টেশন লাগোয়া বাজার। বাজারে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তারা রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর জমিদার বাড়ির নাম জানে বটে তবে বাড়িটি পরিত্যক্ত হওয়ায় ওদিকে বড় একটা ঘেঁষে না। তারা বলল জমিদারবাড়ির অবস্থান গাউস দীঘির দক্ষিণের একটি গভীর জঙ্গলের ভিতরে। আমার যদ্দূর মনে পড়ে পারস্যের সুফিসাধক গাজী গাউস বলখী ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার শাহবাজ খানের আমলে বঙ্গে এসেছিলেন। গাউস দীঘি তাঁরই নামে বলে মনে হল। যদিও আমি নিশ্চিত নই। কেননা, ওই একই নামে একটি পুরনো দরগা রয়েছে দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায়।
যা হোক। গাউস দীঘি অবধি যাওয়ার জন্য একজন স্থানীয় লোক পাওয়া গেল। লোকটার নাম নূর আলী। মধ্যবয়েসি । রিকশা চালায়। তবে কোত্থেকে একটা ভ্যান জোগাড় করে আনল।
আমি পা ঝুলিয়ে ভ্যানে বসলাম। ভাঙাচোরা সরু পিচের রাস্তা। দুপাশে খেঁজুর,হিজল আর বাবলা গাছ। একপাশে খাল। তারপর দিগন্ত অবধি পাকা ধানের ক্ষেত।
প্যাডেল মারতে মারতে নূর আলী বলল, আরও কারা যেন জমিদারবাড়ির খোঁজ করছিল। লোকগুলো দেখতে উঁচা লম্বা। দুইজন ফরসা। আর একজন কাইলা। তাদের শরীরে বিদেশি সুগন্ধ। কথাটার মানে ঠিক বুঝলাম না। রামনগরে এসে কে জমিদার বাড়ির খোঁজ করতে পারে? ভেবে পেলাম না। বেলা দশটার মধ্যেই গাউস দীঘির দক্ষিণ পাড়ে পৌঁছে গেলাম । ঘন গাছগাছালি ছাওয়া টলটলে কালো জলের নির্জন দীঘি দেখে মুগ্ধ হলাম। নূর আলীকে দুশো টাকা দিয়ে বিদায় করলাম।
চারপাশে দেখতে দেখতে হাঁটছি । হাতে ছোট্ট ব্যাগ। ব্যাগের ভিতর ল্যাপটপ আর কিছু জামাকাপড়। অবনী রায়চৌধুরীর ডায়েরির একটা ফটোকপি। চারিদিকে অশোক, অর্জুন আর কাটবাদাম গাছের জঙ্গল । ফিকে বেগুনি রঙের বিছুটি ফুল ফুটে রয়েছে। সুন্দর ফুল, তবে বিছুটি গাছের গায়ে এক ধরণের শুঁয়ো পোকা থাকে। শরীরে লাগলে চুলকাবে। ঝিঁঝি ডাকছি। একটি নাগেশ্বর গাছের ডালে লেজ ঝুলিয়ে বসে একটা বাঁদর। নূর আলী আমাকে জমিদার বাড়ির সঠিক অবস্থান জানায়নি বা জানাতে পারেনি। স্থানীয় লোকজন কাছে পুরনো জমিদার বাড়ির অবস্থান গাউস দীঘির দক্ষিণের গভীর জঙ্গলের ভিতর। যা হোক। হাঁটছি। বাঁ পাশে কৈতা বাঁশের ঘন ঝাড়। তার ভিতরে একটা টিস্যু পেপারের বক্স পড়ে থাকতে দেখলাম। ব্র্যান্ডের নাম লেখা: লোটাস। তার মানে বক্সটা বিদেশি। এখানে কে বিদেশি ব্র্যান্ডের টিস্যু পেপারের বক্স। টের পেলাম রহস্য একটা ঘনীভূত হয়ে উঠছে।
হোপা (এক ধরণের ফার্ন) আর বুনো কুশা ঘাস মারিয়ে আরও কিছুক্ষণ বুনোপথে হাঁটার পর কুরচি লতায় ঢাকা মূল ফটকটি দেখতে পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলাম।আমার গলায় ঝুলছে ১০.১ মেগাপিক্সেলের একটি স্যামসং এন ভি টেন ডিজিটাল ক্যামেরা। ঝটপট প্রবেশদ্বারের বেশ ক’টা ছবি তুলে নিলাম। খিলান দেওয়া মূল ফটকটি বেশ উঁচু এবং চওড়া। এখানে ওখানে অবশ্য ইটে খসে পড়েছে, গজিয়েছে বটের ঝুড়ি। মূল ফটকটির ওপাশে ইটের তৈরি বিশাল একটি গলিপথ। তারপর একটি দেউড়ি। দেউড়ি পেরিয়ে রোদ ঝলমলে খোলা চত্ত্বরে চলে এলাম। ইটবিছানো বেশ বড় চত্ত্বর। এখানে ওখানে ফাটল। ঘাস জন্মেছে। একপাশে একটি কুয়া।
চত্ত্বর ঘিরে দোতলা দালান। তবে দোতালার বারান্দায় অর্ধচন্দ্রাকৃতির খিলান দেখে অবাক হলাম। দূর্গটি মুসলিম আমলে নির্মিত মনে হল। রামনারায়ণ রায়চৌধুরী মনে হয় দূর্গ করে নিয়েছেন; তারপর Renovate করেছেন? সুফি গাজী গাউস বলখীর চিল্লাখানা গাউস দীঘির আশেপাশে কোথাও হবে। বাংলায় সুলতানী অনেক সুফিসাধক সুলতানদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হিন্দু ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন । এখানে একটি দূর্গ গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক। সিঁড়ি বেয়ে দোতলার উঠে এলাম। দোতলায় টানা বারান্দায় পূর্বাহ্নের রোদ। জাফরিকাটা রেলিং। দোতলার বারান্দা ধরে হাঁটছি। এক পাশে অনেকগুলি কক্ষ। সবকটাই তালাবন্ধ। তালায় জং ধরে গেছে। প্রতিটি কক্ষে ঢোকার সময় পাব কিনা জানি না। বারান্দায় অজস্র পাখির খাঁচা দেখে অবাক হলাম। বাঁশের তৈরি খাঁচা। পুরনো বলে মনে হল না। তবে পাখি নেই। দরজা খোলা। হঠাৎ খাক! কাক! কাক! শব্দে চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি রেলিংয়ের ওপর একটি নীলকন্ঠ পাখি বসে। ওই পাখিটাই ডাকছে খাক কাক কাক শব্দে । পাখিটার বাদামী পিঠ গাঢ় নীল আর আকাশী রঙের ডানা। পাখিটা নীলকন্ঠী নামেও পরিচিত। ইংরেজি- ইন্ডিয়ান রোলার। জমিদারবাড়িতে পৌঁছেই একটা নীলকন্ঠ পাখি দেখে অবাক হলাম। মনে পড়ে গেল ডায়েরিতে অবনী রায়চৌধুরী লিখেছেন: ... অবশ্য রামনারায়ণ রায়চৌধুরী নীলকন্ঠী পাখি অতিশয় পছন্দ করিতেন। তিনি নীলকন্ঠী পাখি পুষিতেন। রামনগরস্থ জমিদারবাড়ির আঙিনায় অলিন্দে কিংবা ছাদে নীলকন্ঠী পাখি ডাকাডাকি করিত। ... নীলকন্ঠী উড়াল দিল। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার শেষ মাথায় এলাম। রোদ ঝলমলে গাউস দীঘির টলটলে পানি চোখে পড়ল । এ পাশটায় পুরনো শান-বাঁধানো ঘাট। সিঁড়ি নেমে গেছে দীঘির । সিঁড়ির শেষ ধাপে পানির কাছে হাতে ছিপ কে যেন বসে আছে। গায়ের রং শ্যামলা। শীর্ণ দেহ। পরনে ধূতি, খালি গা, গায়ে অবশ্য ঘিয়ে রঙের একটা উড়নি রয়েছে। মাঝবয়েসি লোকটা । কে লোকটা। রামনগরের ওরা বলেছিল জমিদার বাড়ি বিরান ভিটা। মানে পরিত্যক্ত। তাহলে কে মাছ ধরছে?
এ দিককার ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নীচে নেমে এলাম। এদিকটায় ঘন গাছের জঙ্গল। ডান দিকে একটা বিশাল পেয়ারা গাছ। গাছে অনেক পাকা পেয়ারা ধরে আছে। তবে একি পেয়ারাও অক্ষত নেই। পাখিতে ঠুকরে খেয়েছে। তবে আশেপাশে কোনও পাখি দেখতে পেলাম না। কাকও নেই। মনে পড়ল গাউস দীঘির কাছে ভ্যান থেকে নামার পর থেকে একটাও কাক চোখে পড়েনি। পরিচিত চড়ুই-শালিখও না। পা চালিয়ে কদম, কড়ুই আর জলপাই গাছের ঘন আচ্ছাদন পেরিয়ে দীঘির ঘাটে পৌঁছলাম।
পায়ের শব্দে লোকটা ফিরে তাকাল। বিশেষত্বহীন শ্যামলা লম্বাটে মুখ, চোয়াল ভাঙা গালে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি। চোখে সহজ সরল দৃষ্টি। লোকটা ছিপ ফেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাতজোড় করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, পেন্নাম হই গো বাবু মশাই।
কে আপনি ...মানে তুমি?
আমার নাম বাসু গো বাবুমশায়।
বাসু? কোথায় থাক? এখানেই? বলে ঘাটের দিকে তাকালাম। সিঁড়ির ওপর একটা ছেঁড়া গামছা ঢাকা পিতলের কড়াই। গামছাটা ছেঁড়া বলেই আশ্বিনের ঝলমলে রোদে কয়েকটা ছটফটে সরপুঁটির রুপালি ঝিলিক চোখে পড়ল।
বাসু হাত তুলে জমিদারবাড়ি দেখিয়ে বলল, এখানেই থাকি গো বাবুমশায়।
এই শীর্ণ হাড় ঝিরঝিরে লোক কিছুতেই রামনারায়ণ রায়চৌধুরী বংশধর হওয়ার কথা নয়। তাই ভাবলাম উটকো লোক হবে। বললাম, কবে এসেছে এখানে?
আমার জন্ম এখানেই বাবুমশায়। আমার পূর্বপুরুষ রায়বাহাদুরদের ঠাকুর ছেলেন।
রায়বাহাদুর মানে রামনারায়ণ রায়চৌধুরী?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ঠাকুর মানে বাবুর্চি তো?
ওই হল।
রামনগরের লোকজন আমায় বলল জমিদার বাড়িতে কেউ থাকে না
মাকিলপক্ষের কেউ থাকেন না বটে। তবে আমাদের মতন ছোটনোকের হিসেব গণায় ধরেনি কো।
অ। তা তুমি এ বাড়িতে একাই থাকো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনকূলে আমার ভগবান ছাড়া কেউই নেই গো বাবুমশাই।
অ। আচ্ছ শোন, বাসু । তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হল। আমি সরকারি লোক। এ বাড়িতে ক’দিন থেকে জরিপ করব। রক্ষণাবেক্ষণ কি করা যায় সেসব সরকারকে বলব।
বুঝেছি গো বাবুমশায়।
তুমি আমার থাকার ব্যবস্থা আর দুটি ভাত রেঁধে দিতে পার?
পারব গো বাবুমশায়।
নিশ্চিন্ত হলাম। বাসু দোতলায় একটি কক্ষ পরিস্কার করে দিল। কক্ষে বেশ বড় একটি পালঙ্ক; তার ওপর নতুন চাদর বিছিয়ে দিল বাসু। কোত্থেকে দুটি বালিশ এনেও দিল। বড় একটি দেরাজ ছাড়াও কক্ষে একটা আবলুশ কাঠের কালচে টেবিল আর একটি আরাম কেদারাও রয়েছে।
একতলার একটি ঘরে খাওয়া-দাওয়া সারলাম ভাত, নিরামিষ আর সরপুঁটি মাছের ঝোল দিয়ে। বাসু বোধহয় ডাল-টাল খায় না। তবে কোত্থেকে জলপাইরে আচার যোগাড় করে দিল। তবে বাসুর রান্নার হাত ভালো।
খেতে খেতে বললাম, এতবড় বাড়ি বিরান হয়ে গেল। ভাবতেই কেমন লাগে, তাই না?
বিরেন হবি না কেন বাবুমশায়-বলি লোইকজনের উপর কম অত্যাচার করিছেন রায়বাহাদুর মশায়? মেইয়েছেলেক ঘর থেকে টানি আনি উঠোনে ছেলের সামনে উদোম করে অপমান করিছেন, দুধের শিশুকে মায়ের কোল থেইকে টেইনে ফেলে দিয়েছেন কুয়োত।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এসব নির্মম ইতিবৃত্ত আমার জানা আছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর আসল ধকল গেছে বাংলার কৃষকের বুকের ওপর দিয়ে।
বাসু বলল, বাপ-দাদার মুখত শুনিচি, রায়বাহাদুর মশায়ের অর্থের খুব লোভ ছেল। শোনা যায় সেই পাপের ধন বংশধরক খাতি দেন নিকো। সে পাপের ধন তিনি কুতায় নুকিয়ে রেইখেছেন।
আমার ভুঁরু কুঁচকে ওঠে। এ ধরনের মিথ বাংলাদেশে পুরাতন জমিদারবাড়ি প্রসঙ্গে শোনা যায়। তবে এর সত্যতা কতদূর কে জানে।
খাওয়া সারতে সারতে প্রায় দেড়টা বাজল। আর দেরি করলাম না । কাজ শুরু করলাম একতলার ঘরগুলি থেকে। বাসুর কাছে চাবি ছিল। সেই তালা খুলে দিল। একটি ঘর বেছে নিয়ে ছবি তুলে, মাপজোখ করে কাজ শুরু করলাম। ডেসক্রিপশন লিখলাম। মার্জিনে নিজস্ব মন্তব্য লিখলাম। বাসুকে আর দেখতে পেলাম না। দক্ষিণ দিকে একটা কক্ষে ঢুকে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। বেশ বড় কক্ষ। দেয়ালে টেরাকোটার নকশা । মুগলযুগে বাংলায় টেরাকোটা তেমন হয়নি। এটি প্রধানত সুলতানী আমলের শিল্প। এক দেওয়ালে মুগল স্টাইলে আস্তরের ওপর ফুল, পাতা, আর জ্যামিতক নকশার কারুকার্য। পিউর মুসলিম আর্ট! অন্য দেয়ালে অবশ্য পোড়ামাটির ফলকের উপর শ্রীকৃষ্ণের কালীয় দমনের দৃশ্য অঙ্কিত । এর কি কারণ? রামনারায়ণ রায়চৌধুরী এসব অলঙ্করণ পরে করিয়েছিলেন? ছবি তুললাম। একপাশে দরজা। তবে পাল্লা ভেঙে পড়েছে। তার মানে ওদিকে আরেকটি ঘর রয়েছে। ঘরে আবছা অন্ধকার। ভিতরে বেশ কিছু আসবাবপত্র। একটি পালঙ্ক । একটি টেবিলের ওপর চিনামাটির বাটি, কাঁচের জগ, প্লেট, গ্লাস ছাড়াও বেশ দামী হাতির দাঁতের একটি চিরুনি আর একটা রূপার পানদানী দেখলাম । বাসু তাহলে বেশ বিশ্বাসী লোক। টেবিলের ওপর ঠিক মাঝখানে চার ফুট উঁচু একটি তামার কলসীর ওপর আমার চোখ আটকে গেল। কলসীতে রাধা জল আনার ছবি খোদাই করা। চকিতে মনে পড়ে গেল। অবনী রায়চৌধুরী লিখেছেন: তবে আজ আমি এক গুপ্তকথা প্রকাশ করিব। আমরা কেহ কেহ সাত রাজার ধন অনুসন্ধানে ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিলাম। অবশেষে হেমন্তের একদিন অপরাহ্নবেলায় একতলার একটি নিভৃত কক্ষের একটি তামার কলসী ... তামার কলসীটা কতক্ষণ ঠেলাঠেলি করলাম লাভ হল না। শূন্যই মনে হল। তাছাড়া তামার কলসীটা ঠিক টেবিলের ওপর। নীচে তো অমসৃণ নিরেট মেঝে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ওপাশে একটি দেরাজ। ভিতরে তৈজসপত্র। তার পাশে একটি দরজা। তার মানে ওদিকেও আরেকটি ঘর রয়েছে। ঘর অন্ধকার। টর্চ বের করে আলো ফেললাম। তারপর ঘরে ঢুকলাম। ঢোকামাত্র ধূপের গন্ধ পেলাম। এই বিষয়টি আমার অভিজ্ঞতার বাইরে। পুরনো একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ধূপের গন্ধ কেন? প্রথমে ঘরটি ফাঁকাই মনে হয়েছিল । না, ঠিক ফাঁকা নয়। অনেকগুলি পাখির খাঁচা। খাঁচাগুলি সবই অটুট। একটিও ভেঙে পড়েনি। খাঁচার ভিতরে পাখি-টাখি নেই অবশ্য। তবে সবকটা খাঁচার দরজা খোলা। অবনী রায়চৌধুরীর ডায়েরি হাতে পাওয়ার পর থেকেই বিস্ময়কর সব ঘটনা ঘটছে। কাজেই অবাক আর কী হব। টর্চ ঘুরিয়ে চারিদিকে আলো ফেললাম। সাদা চুনকাম করা দেয়ালে ফাটল। লোনাও ধরেছে। দেয়ালে পরপর তিনটে ছোট বড় কুলুঙ্গী। দুটি ছোট কুলুঙ্গীতে পিতলের প্রদীপ। আর মাঝখানে বড় কুলুঙ্গীতে ছোট্ট একটি দেবীমূর্তি। দেখেই চিনতে পারলাম। শক্তিদেবী কামাখ্যা। মনে পড়ে গেল। অবনী রায়চৌধুরী লিখেছেন, ... অনন্তর বিভূতি দেখাইয়া নাগবসু নামক প্রাগজ্যোতিষপুরের এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর আস্থা ভাজন হইয়া উঠিয়াছিল। নাগবসু যখন প্রাগজ্যোতিষপুরের তান্ত্রিক সন্ন্যাসী তখন শক্তিদেবী কামাখ্যার আরাধনা করাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এটা কি তার ঘর? কিংবা ঠাকুরঘর? তখনই মেঝের ওপর একটি ধূপধানী চোখে পড়ল। ধূপের গন্ধের উৎস পেলাম। কিন্ত, রহস্য ঘুচল না।
ঘরের উত্তর পাশে একটি দরজা। তবে দরজাটির পাল্লা ভেঙে পড়েছে। ওপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাছে গিয়ে আলো ফেললাম। ঘর নয়, নীচে সিঁড়ি নেমে গেছে। সিঁড়িতে মাকড়শার জাল। একটা মশালদানী চোখে পড়ল অবশ্য। নামব কিনা ভাবছি। সাপখোপ থাকতে পারে।তখনই কে যেন পিছন থেকে আঘাত করল। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরল বুঝতে পারলাম না। টের পেলাম ভিজে সেঁতসেঁতে মেঝের ওপর পড়ে আছি । চুনাপাথরের গন্ধ পেলাম। ঘরে আবছা অন্ধকার। মাথার অনেক ওপরে ঘুলঘুলি। ওখানে আলো। আমার হাত বাঁধা। মাথা ঝিমঝিম করছিল। ব্লিডিং হয়েছে কিনা বুঝতে পারলাম না।ঘরটা বেশ ছোট। একটাই দরজা। ওপাশ থেকে বন্ধ। তার মানে আমি বন্দি। কিন্তু কার হাতে। বাসু? মনে হয় না। দরজায় শব্দ হল। পাল্লা ঠেলে একজন দীর্ঘদেহী ঘরে ঢুকল। মুহূর্তেই পারফিউমের গন্ধে ভর ঘরে উঠল। লোকটার পরনে কালো কর্ডের প্যান্ট, লাল শার্টের ওপর ধূসর জ্যাকেট। চোখমুখ কাটা-কাটা আর গায়ের রং ভীষণ ফরসা ।মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। কানে রিং। লোকটার হাতে একটা ওয়ালথার পি টু টু পিস্তল। আমার দিকে তাক করা। তার পিছনে আরও দুজন লোক রয়েছে। একজন লালচুলের শ্বেতাঙ্গ। ব্রিটিশই মনে হল। অন্যজন শক্ত কোঁকড়ানো চুলের কৃষ্ণাঙ্গ। এটি বেশ ঢ্যাঙ্গা। পেশল বাহুতে টাট্টু করা। দু’জনের পরনেই গেঞ্জি। এদের অবশ্য পেশাদার অপরাধী বলে মনে হল না।
আপনি? আমার কন্ঠস্বর কেমন ফ্যাসফ্যাসে শোনালো।
লোকটা বলল, আমি অরিত্র ... আই মিন আমার নাম অরিত্র রায়চৌধুরী।
লোকটার বাংলা উচ্চারণ কেমন জড়ানো। বললাম, আপনি কি রায়বাহাদুর মানে রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর বংশের কেউ?
হুমম।
আপনি কি লন্ডনে থাকেন?
হ্যাঁ। এখন লন্ডনে থাকি। তবে কলকাতায় মানুষ হয়েছি। তা আপনি কে? এখানে ঘুরঘুর করছেন কেন?
আমি আমার নাম বললাম। আরও বললাম: আমি ডিপার্টমেন্ট অভ আর্কেওলজিতে চাকরি করি।
অরিত্র রায়চৌধুরী শ্লেষের সুরে হেসে বলল, ওহ্ আরকিওলজি। দেন ইউ আর ইন্ডিয়ানা জোন্স?
স্যাঙ্গাত দু’জন খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল।
অরিত্র রায়চৌধুরী কন্ঠস্বর পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর ওয়েলথ- এর খোঁজে এখানে এসেছেন?
না।
শাট আপ! আমি কচি খোকাটি নই যে এখনও নাক টিপলে দুধ পড়ে। আপনি আমাকে যা বোঝাবেন আর আমি তাই বুঝব। অরিত্র রায়চৌধুরী গর্জে উঠল।
আমি অতি কষ্টে রাগ হজম করলাম।
হ্যাচ্চো! অরিত্র রায়চৌধুরীর সর্দি হয়েছে দেখলাম। টিসু পেপারের জন্য পাশের জনের কাছে হাত পাতল। কৃষ্ণাঙ্গটি পকেট থেকে টিসু পেপার বার করে দিল। না তাকিকেও বুঝলাম নির্ঘাৎ লোটাস ব্রান্ডের। উপরে ঘুলঘুলি কীসের শব্দ হল। একটা নীলকন্ঠী পাখি এসে বসেছে। অবাক হলাম না। তবে বুঝতে পারছিলাম না এরপর কী ঘটবে। তবে অদ্ভূত কিছু ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।
অরিত্র রায়চৌধুরী বলল, আমি আমার ন্যায্য পাওয়া নিতে এসেছি। আর উনি এসেছেন ভাগ বসাসে।
না।
শাট আপ! মুমবাই ফিলম ইন্ড্রাষ্ট্রিতে ইনভেস্ট করে আমি এখন ফতুর হয়ে গেছি। ছবি ফ্লপ। এখন আমার শ্রী শ্রী শ্রীযুক্ত নমস্য রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর সাত রাজার ধন চাইই চাই।
আমি কী বলব। চুপ করে রইলাম।
পিস্তল ঘুরিয়ে নির্দেশ দিল, এই যে ইন্ডিয়ানা জোন্স সাহেব, উঠে দাঁড়ান তে।
উঠে দাঁড়ালাম। মাথা টনটন করে উঠল। অরিত্র রায়চৌধুরী নির্দেশে পাশে ঘরে এলাম। ছোটটি ঘর। একপাশের দেয়ালে টেরাকোটার নশকা। রাধকৃষ্ণের প্রণয় দৃশ্য। একপাশে বেশ বড় একটা তামার কলস। ওটা ধরে শ্বেতাঙ্গটা টান দিতেই ঘরঘর শব্দে টেরাকোটার রাধকৃষ্ণ দুভাগ হয়ে দেয়াল সরে গেল। অবাক হলাম না।
অরিত্র রায়চৌধুরী শ্লেষের সুরে বলল, ওই যে যান। সাত রাজার ধন। যার ভাগ নিতে এসেছেন। নিয়ে যান - ওই যে । যান।
ঘরটায় কৃষ্ণাঙ্গটা আগে ঢুকল। তার হাতে একটা টর্চ। বেশ পাওয়ার ফুল। ঘরটা উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এই ঘরটিও ছোট। জানালাহীন কালো নিরেট দেয়াল। ঘরের মাঝখানে একটি কুয়া।
ওই যে, যান। যান কুয়ার ভিতরে উঁকি মেরে দেখুন।
আমি কয়েক পা এগিয়ে কুয়ার কাছে পৌঁছলাম। তারপর কুয়ার ওপর ঝুঁকেই চমকে উঠলাম। দেখতে পেলাম কুয়া ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা। ঝিকমিক করছে। আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার কথা । রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর সাত রাজার ধন তাহলে নিছক মিথ নয়। রামনারায়ণ রায়চৌধুরী এত ধন অর্জন করলেন কীভাবে। রামনারায়ণ রায়চৌধুরী কি কর আদায় ছাড়াও ডাকাতি করতেন? সেকালে অনেকে জমিদারই তো তা করত। চকিকে মনে পড়ে গেল, হিরন্ময় রায় তার মূল পারিবারিক উপাধি থেকে ‘চৌধুরী’ শব্দটি ছাঁটাই করে ফেলেছেন। এতদিনে কারণটা বোঝা গেল। কিন্তু, তিনি কি কিছু জেনেছিলেন?
অরিত্র রায়চৌধুরী কর্কসকন্ঠে চিৎকার করে উঠে বলল, সোনার টাকা আমরা নিয়ে যাব। আর আপনার কঙ্কাল এই ঘরে পড়ে থাকবে। বলে জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা সরু সাইলেন্সার বের করে ব্যরেলে ফিট করতে লাগল।
শান্তকন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে?
মানে সহজ খুব সহজ। বলে লোভী বদমাশটা আমার কপাল পিস্তল তাক করল। ঠিক তখনই ভয়ানক খাক কাক কাক শব্দে আমরা তিন জনই ভীষন চমকে উঠলাম। কুয়ার ভিতর থেকে হাজার হাজার নীলকন্ঠী পাখির ডাক উঠে আসছে । এবং শব্দটা ক্রমেই বাড়ছে । অরিত্র রায়চৌধুরীর টকটকে ফরসা মুখ রক্তিম হয়ে উঠর। হাত থেকে পিস্তলটা খসে পড়ল। তারপর কানচাপা দিয়ে মেঝের ওপর বসে পড়ল। শেতাঙ্গ আর কৃষ্ণঙ্গরও ওই একই দশা হল।
পিছন থেকে কে যেন বলল, আসুন গো বাবুমশায়।
আমি চমকে ফিরে দেখি দরজার কাছে বাসু দাঁড়িয়ে আছে।
দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাসু সেই তামার কলসটা টেনে দিল। ঘরঘর শব্দে দেয়াল বন্ধ হয়ে রাধাকৃষ্ণ আবার জোড়া লেগে গেল।
একটা ছুড়ি দিয়ে আমার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বাসু বলল, তারা ওখানেই থাকুক গো বাবুমশায়। আমরা ওঘরে থাকব কোন্ দুঃখে? আমরা কি শরীরে রায়বাহাদুর মশাইয়ের রক্ত বইছি? না তার ধনে লোভ করেছি বলুন?
মাড়া নেড়ে বললাম, হুমম। কথা ঠিক।
হাতে নাইলনের রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধেছে। বেশ টনটন করছে।
আমি একটু আসছি বাবুমশায়। বলে বাসু ওদিকে কোথায় চলে গেল। আমার সাধ্যি কী তাকে ডাকি। আমি ওপরে উঠে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নীচে নেমে এলাম। যশোরের রামনগরের রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর এই পুরনো জমিদার বাড়ি তার সমস্ত রহস্য নিয়ে পড়ে থাকুক। সব রহস্য জানতে নেই। দিনের অলো থাকতে থাকতে রামনগর রওনা হলাম।বাসুকে আর দেখতে পেলাম না। তবে গাউস দীঘির পাড় দিয়ে রামনগর পর্যন্ত একটা নীলকন্ঠী পাখি আকাশ-পথে উড়ে উড়ে আসছিল ...
উৎসর্গ: রেজোওয়ানা ...
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১২ রাত ৯:৫৪