আমার জীবনের সবচে পুরনো স্মৃতি হল রোদ চিকচিকে ঘোলাজলের একটি নদী। পরে মায়ের মুখে সব জেনেছি। নদীটির নাম পদ্মা। আমার মা বিশাল একটি ফেরির রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে। কোলে কাঁথায়-মোড়ানো ছোট্ট একটি শিশু। নীচে মধ্যাহ্নের কিরণ মাখা পদ্মা। ফেরিটি সত্যিই বড়। প্রায় শ’খানেক বাস আর ট্রাক এবং প্রাইভেট কার। আরিচাঘাট থেকে রওনা হয়েছে। আর হয়তো ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ভিড়বে পাবনার নগরবাড়ি ঘাটে। তারপর বাস ছুটবে রাজশাহীর পথে। ওই শহরে হেতেম খাঁ জামে মসজিদের কাছে একটি বাড়িতে থাকেন আমার মায়ের বড় বোন । আর, সিরোলে থাকেন মায়ের এক খালা । মা ওই দু-বাড়িতেই দিন কয়েক বেড়াবেন। তারপর একদিন সকালে রাজশাহী স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠবেন। গন্তব্য নওগাঁ। নওগাঁর একটি গ্রামে আমার মায়ের নানাবাড়ি। সে বাড়িতে রয়েছে আমার মায়ের মেয়েবেলার অনেক স্মৃতি। পরিবারের যখন সবাই কলকাতা ছিল, সেই ব্রিটিশ পিরিয়ডে, আমার মা তখন নানাবাড়ি ছিল । সে সব স্মৃতির কাছে পৌঁছে যেতেই ঢাকা থেকে রওনা হয়ে ফেরি করে পদ্মাপাড় হওয়া। যে কারণে আমার শিশুবয়েসের একটি রোদ ঝলমলে নদীর স্মৃতি আজও অম্লান।
ছেলেবেলায় কতবার যে পদ্মাপাড় হয়ে রাজশাহী শহরে গিয়েছি। রাজশাহীতে আমার খালার বাড়িটি ছিল শান্ত, দোতলা আর ছিমছাম। একতলায় চারকোণা ছোট্ট একখানি সিমেন্টের উঠান। উঠান ঘিরে দোতলা বাড়ি। একতলার বৈঠকখানায় ঢুকলে মনে হবে উনিশ শতকে পৌঁছে গিয়েছিল। বৈঠকখানার দেয়াল-আলমারীতে প্রচুর শিশুতোষ বই ছিল। তার মধ্যে ‘শিশুভারতীর’ কথা মনে আছে। ওই বয়সে সে বই গোগ্রাসে গিলতাম। রাতদিন বাঁদরামী যাইই করি না কেন-অবসর মুহূর্তে বইপড়ার মতো স্থিরতা ছিল মনে।
একতলায় থাকতেন আমার বড়খালার শ্বশুর-শাশুড়ি । বড়খালার শাশুড়ি কম কথা বলা মানুষ। তবে আমাকে যে স্নেহ করতে তা ঠিকই বুঝতে পারতাম। বড়খালার শ্বশুর অবশ্য বেশ কথাটথা বলতেন। বেশ মজার মানুষ ছিলেন। রিষ্টওয়াচ খুলে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ক’টা বাজে?
আমি বলতাম, ছটা বাজে দাদা।
ছটা তো বুঝলাম। ছটা বেজে ক’ সেকেন্ড?
আমি বলতাম, ছটা বেজে পঁচিশ সেকেন্ড, ছাব্বিশ সেকেন্ড, সাতাশ সেকেন্ড, আঠাশ সেকেন্ড ...
থামো, থামো।
বড়খালার তিন ছেলে এক মেয়ে। নাম রেখেছেন ফুলের নামে। টুলিপ, টগর, শাপলা এবং বাবলা। শেষটি অবশ্য ফুল নয়,গাছ। কাঁটাওয়ালা গাছ। আমার বড়খালার এই ছোট ছেলেটি সত্যিই কাঁটাযুক্ত ছিল এবং সে কারণেই হয়তো রাজশাহী শহরের আমার প্রধান আকর্ষন ছিল । বাবলা আমারই প্রায় সমান বয়েসী। শ্যামবর্ণ। ঈষৎ থলথলে। দূরন্ত স্বভাবের বাবলা কথা বলত রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায়। যা আমার কানে মধুবর্ষণ করে। আজও। যে ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছি ও বয়েসেই। প্রচলিত শব্দের মজার-মজার প্রতিশব্দ তৈরি করা। যেমন: মিথ্যে বলছিস কেন? এই কথাটা বাবলা আমাকে বলত: ‘ঢপ’ দিচ্ছিস ক্যান? কিংবা কেউ বকা দিল। বাবলা বলল, ‘ধাবড়ি’ দিল। রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষাটি সিধে স্ট্রেট না। বাক্যে অনেক মধুর বাঁক রয়েছে। যা আমার কানে মধুবর্ষণ করে। আজও।
বাবলা ছিল ভীষন চঞ্চল। কোথাও চুপ করে একদন্ড বসে থাকছে না। এই সাইকেল নিয়ে বেরুচ্ছে তো এই রাস্তার মোড়ে ঘোলওয়ালাকে ‘ধাবড়ি’ দিচ্ছে। সব সময় মাথায় নিত্যনতুন আইডিয়া খেলছে। একে- ওকে চ্যালেঞ্জ করছে। চ্যালেঞ্জ করে দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়া কিংবা অ্যাকুয়ারিয়ামের পানি খাওয়া ওর কাছে কোনও ব্যাপারই না। তার ওপর মারপিটে ভীষন ওস্তাদ ছিল বাবলা । ওর যন্ত্রণায় পাড়ার ছেলেদের যেমন শান্তি ছিল না তেমনি ওর লক্ষ্যভেদ থেকে চামচিকা আর টিকটিকিরও রেহাই ছিল না । হেতেম খাঁয় আমরার বড় খালার বাড়িতে ছিল একটা এয়ার গান । আমরা সাহেববাজার থেকে গুলি কিনতাম। তো ওই বয়েসে পয়সার বড় ক্রাইসিস ছিল আমাদের । গুলি শেষ হয়ে গেলে গুলি কিনতে পারতাম না। গুলি শেষ তো কি-বাবলা কয়লা ঘঁষে ঘঁষে সাইজ মতো গুলি তৈরি করে নিত। তারপর, এয়ারগানটা তুলে টিকটিকির ল্যাজ কি চামচিকার ডানা লক্ষ করে এইম করে ফায়ার করত!
বড়খালার বাড়ি থেকে পদ্মা কাছে। ভোরবেলা এয়ারগান হাতে আমরা পদ্মাপাড়ে চলে যেতাম । আমরা হেতেম খাঁ মোড় পাড় হয়ে যাদুঘর ছাড়িয়ে দরগাপাড়ার ভিতর দিয়ে নদীর পাড়ে পৌঁছতাম। নদীর খাত অনেক নীচে। পানি অনেক দূরে। কেবলই ধূ ধূ বালিয়াড়ি। ওপারে মুর্শিদাবাদ। তখন কি বুঝতাম যে কি এক ঐতিহাসিক জায়গায় ভোরবেলা এয়ারগান হাতে নিয়ে ঘুরছি? আমি আর বাবলা যেখানে ঘুরছি, হয়তো সে জায়গায় সম্রাট হুমায়ূন এসেছিলেন। সম্রাট হুমায়ূন পলাতক জীবনে পদ্মাপাড় হন নি? কে বলল? সব কথা কি বইতে লেখা থাকে?
ক্লাস সেভেন- এইটেই আমাদের দুজনের হৃদয়েই প্রেমের উদ্ভাস হয়েছিল। আমার ওই বয়েসেই ঈভ টিজিংয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল। বাবলা আবিস্কার করে যে একটি রূপসী মেয়ে সাহেব বাজারে কোচিং করে। আমাকে বলল, চ। (এই চ মানে চল।) বাবলা সাইকেল চালাচ্ছে। আমি রডে বসে আছি। রাস্তায় ঝলমলে রোদ। রূপসী মেয়েটি কোচিং থেকে বেরিয়ে রিকশায় চেপেছে। রিকশার পিছু পিছু সরু গলির ভিতর দিয়ে চলছে সাইকেল । তারপর গলির শেষে সাইকেল যেখানে পৌঁছল, সেটিই নির্মীয়মান উপশহর। হঠাৎ বৃষ্টি এল। বৃষ্টি এল ঠিকই, কিন্তু রোদ ঠিক মুছল না। এমন সব মুহূর্তে গান গাইতে হয়। সেই সত্তর আর আশির দশকে ভারতীয় অন্ধ সংগীতশিল্পী রবীন্দ্র জৈনের গান খুব বাজত। সাইকেলের প্যাডেল মারতে-মারতে বাবলা রবীন্দ্র জৈনের একটা গান ধরত-
চলতে পথে হঠাৎ এল বৃষ্টি
বিজলী থমকে গেলাম চমকে
ঝাপসা হল দৃষ্টি ...
রিকশার বালিকাটি যে ফোঁস করেনি তা নয়। করেছে। কিন্তু সে ফোঁসফোঁসানিও ছিল বড় মধুর। আজ ভাবি ... তখনকার দিনে ঈভটিজিং কতই না মধুর ছিল, রৌম্যানন্টিক ছিল । আর এখন? প্রকৃতিলগ্ন ছিলাম বলেই কি আমাদের জৈবধর্ম কখনও কদর্য রূপ পায়নি? আর এখনকার প্রজন্মের অনেকেই প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন টেকনির্ভর বলেই কি উগ্র? কদর্য? বিভৎস?
আমার বড় খালা কে মনে আছে। চশমাপরা, কিছুটা গম্ভীর, আত্মমগ্ন। রাজশাহী মহিলা কলেজের বাংলা পড়াতেন বড়খালা । গভীর সাহিত্যনুরাগী ছিলেন বলেই হয়তো ছিলেন ভীষন রবীন্দ্রভক্ত। বছর পাঁচেক আগে, প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়েসে ‘দারুচিনি নয়’ নামে একখানি কবিতার বই ছেপে বার করেছেন । আমাকেও এককপি উপহার দিলেন মনে করে । পৃষ্ঠা উলটে দেখি কবিতার ছত্রে ছত্রে রবীন্দ্রনাথ। ‘দারুচিনি নয়’ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি:
পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে
যে আজ নিয়েছে নিঃশ্বাস
উদার, উন্মুক্ত আকাশের বুকে
তোমার দূর্লভ জন্ম ...
করেছে ধন্য তোমাকে, আমাকে ...(শুভ জন্মদিন)
আমার একনিষ্ট ধর্মপরায়ণ মাতামহও রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন। সেকথা আমি এর আগের একটি পোস্টে উল্লেখ করেছি। সম্ভবত সে ঐতিহ্য অনুসারেই আমার রবীন্দ্রভক্ত বড়খালাও ছিলেন একনিষ্ট ধর্মপরায়ণ । ফজরের ওয়াক্তে নামাজ সেরে বড়খালাকে ওয়াজিফা পাঠ করতে দেখেছি। আমি আর বাবলা তখন পদ্মাপাড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ওয়াজিফা সেরে বড়খালা ঢুকতেন রান্নাঘরে । রুটি নিজের হাতেই বানাতেন। আমি আর বাবলা পদ্মাপাড় থেকে ঘুরে এসে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পড়তাম। থালায় রুটি তুলে নিয়েছি, বড় খালা কাঠের বড় চামচে করে থালায় নিরামিষ তুলে দিতেন । অমৃত! অমৃত!
আমার বৃদ্ধা মাতামহী এবং বড়খালা
আমি রাজশাহী থেকে ঢাকা ফেরার আগে স্নেহপ্রবন এই নারী আমাকে দর্জির কাছে পাঠিয়ে শার্ট বানিয়ে দিতেন। কিংবা প্যান্টের কাপড় কিনে উপহার দিতাম। সে শার্টপ্যান্ট পরে আমি ঢাকা শহরে টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম । কেউই আমার নতুন জামাকাপড়ে স্নেহের চিহ্ন দেখতে পেত কিনা- তা নিয়ে আমি হয়তো ভাবতাম না ...
বড়খালু ছিলেন আদ্যান্ত নাগরিক ঋষি। কম কথা বলা ধ্যানী মানুষ । কথা অবশ্য টুকটাক আমার সঙ্গে হত আমার পরম সৌভাগ্যবশত।জ্বল এলেও জীবনে কখনো নাকি প্যারাসিটামল খাননি! দেখেছি জ্যৈষ্ঠের গরমেও ফ্যান চালান না, চা মানে চিনিছাড়া লিকার।
বড়খালু।১৯৯১ সালে; আমার বড়বোনের বিয়ের সময় । পেশায় চিকিৎসক ওই আত্মনিমগ্ন মানুষটি ছিলেন প্রকৃতি ও গাছগাছালির একান্ত অনুরাগী।
একবার। বড় খালু ঢাকায় এসেছেন। রিকশা করে আমরা পিজি হাসপাতালে যাচ্ছি। ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সিটিটিউটের সামনে রিকশা চলে এসেছে। রাস্তার ধারে পামগাছ দেখে বড়খালু রিকশা থামাতে বললেন। রিকশা থামলে রিকশা থেকে নেমে ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে অনেক ক্ষণ ধরে পাম গাছটি পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর আবার রিকশায় উঠে উদ্ভিদবিদ্যার ক্লাস নিতে শুরু করলেন । আমি মুগ্ধ শ্রোতা।
রাজশাহীর বাড়িতে আঙুরলতা পুঁতেছিলেন বড়খালু। আঙুর ধরেছিলও। আমি খেয়ে দেখেছি। ভীষণ টক।
দিব্য। টুলিপভাইয়ের ছেলে। এরই দাদার কথা লিখছি। দিব্য ঢাকায় কোডায় (কলেজ অভ ডেভোলাপমেন্ট অল্টারনেটিভ) পড়ছে। রাজশাহীর Mesmorize Epselon নামে একটি ব্যান্ডের লিড ভোকাল। এসব তথ্য ও ছবিতে দুটি প্রজন্মের জীবনধারার মধ্যে স্পষ্টত ব্যবধানটি প্রকট হয়ে ওঠে।
বড়খালু যে একনিষ্ট ধর্মপরায়ণ ছিলেন সে কথা কি লিখে জানাতে হবে? আর সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে নিষ্টাবান ধার্মিক হলেও বড়খালুর যুক্তিহীন ধর্মান্ধতা বা অন্ধ গোঁড়ামি ছিল না। তখন শাপলা আপা কলেজে পড়ছেন। সন্ধ্যের পর একতলায় বৈঠকখানায় কলেজের ছেলেবন্ধুদের নিয়ে তুমুল গল্প-আড্ডা-তর্ক চলত। সে আড্ডায় আমিও উপস্থিত থাকতাম। আমাদের আড্ডা নিয়ে বড়খালু কখনও বিরক্তি প্রকাশ করেননি। বা মেয়েকে ডেকে শাসন করেন নি। দেখেছি এশার আজানের পর বড়খালু দোতলা থেকে নেমে বৈঠকখানার মাঝখান দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। আড্ডা মুহূর্তে নিরব হয়ে যেত। বড়খালু চলে যেতেই আবার আড্ডা সরব হয়ে উঠত । নামাজ শেষে বড়খালু আবার বৈঠকখানায় এলে আড্ডা আবার কিছুক্ষণের জন্য স্তব্দ হয়ে যেত । তিনি দোতলায় উঠে গেলে আড্ডা আবার সরব হয়ে উঠত।
শাপলা আপা (শাড়ি পরা)। ১৯৯১ সালে ঢাকায় আমার বড়বোনের বিয়ের সময়।
তো, আমার সেই ঋষিসম বড়খালু এ বছর একটি শিশুতোষ গল্পের বই লিখেছেন। বয়স যখন প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। বইয়ের নাম রঙিন ছবিতে দাদুর মুখে মজার গল্প এই শিশুতোষ বই লেখার বিষয়টিই হয়তো তাঁর মনের উদারতার ব্যাপারটি অনেকখানিই ব্যাখ্যা করে ...
রাজশাহী শহরে আমার আর এক অন্যতম আকর্ষনের জায়গা ছিল সিরোল। জায়গাটার আরেক উচ্চারণ সম্ভবত- সিরোইল। সেই সিরোলে আমার মায়ের এক খালার বাড়ি। সাদা রং করা দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে পিছনে নাড়কেল গাছ আমগাছ,জামগাছ। বাড়ির পিছনে ছোট্ট পুকুর। সে পুকুরে হয় তেলাপিয়র চাষ। পুকুরের ওপাশে ঘন ঝোপঝাড়। তারপর পাঁচিল। পাঁচিলের ওপাশে রেললাইন। বাড়ির ঠিক লাগোয়া রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সেরিকালচার কারখানা। সেরিকালচার-এর মাঠে বাবুমামার সঙ্গে ফুটবল খেলতাম।
আমার মায়ের সেই আছিয়া খালা ছিলেন চুপচাপ । কিন্তু, মুখে একখানা মিষ্টি হাসি যেন লেগেই থাকত। আমাকে ডাকতেন ‘ইমুন’ বলে। কিন্তু, আমার মায়ের খালুটি ছিলেন বেশ কথা বলিয়ে মানুষ। ওনাকে আমরা ‘সিরোল নানা’ বলে ডাকতাম। সিরোল নানার বাড়ি ছিল নওগাঁ; সরকারি চাকরি করতেন। রাজশাহীতে জমি কিনে বাড়ি তুলেছিলেন। অত্যন্ত হাসিখুশি আর মজার মানুষ ছিলেন সিরোল নানা । তানপুরা বাজিয়ে ওস্তাদী গান গাইতেন । প্রচন্ড সিগারেট খেতেন, চেইন স্মোকার যাকে বলে। সিগারেট ছাড়াও হুক্কা টানতেন সিরোল নানা । জীবনের প্রথম আমি হুক্কার স্বাদ পেয়েছিলাম ওই ‘সিরোল নানা’র হুক্কায়, যেমন আমার ঈভ টিজিংয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল বাবলার কাছে ...
সিরোল নানা আর আছিয়া নানীর ছিল অনেকগুলি ছেলেমেয়ে । বুলবুল মামা, দুলদুল মামা, টুলটুল মামা, বাবুমামা, ছোটন মামা নার্গিস খালা, নিহার খালা, নিগার খালা, কাকলী খালা এবং ইলোরা খালা। আর ছিল ঢাকা-রাজশাহী এবং নওগাঁ থেকে আসা মেহমানদের ভিড়। সুতরাং সিরোলের দোতলা বাড়িটি সারাক্ষণই গমগম করত।
সে যাই হোক। আমার সিরোলের খাল-মামারা প্রায় প্রত্যেকেই কমবেশি গান জানতেন। টুলটুল মামার স্বভাব ছিল খানিকটা আছিয়া নানীর মতো। বেশ গম্ভীর। বাবার কাছে ওস্তাদি গানের তালিম নিয়েছিলেন। দরদ দিয়ে গাইতেন:
সাখি এরি আলি পিয়া বিনা ...
আমি বিভোর হয়ে শুনতাম। পরে জেনেছিলাম ওটা ইমন রাগের সুর। রাগসংগীতের প্রতি যে আমার আকষর্ণ শৈশবেই প্রোথিত হয়েছিল, তার পিছনে ছিল রাজশাহীর সিরোলের একটি বাড়ি।
সিরোলে আমার আরেকটি আকর্ষনের জায়গা ছিল। সেটি একটি পুকুর। সেই পুকুরের নাম ছিল- কফিলের পুকুর। কফিলের পুকুরটা ছিল সিরোলের বাড়ির সামনের রাস্তার উলটো দিকে সামান্য ঝোপঝাড় পেরিয়ে। ছোট পুকুর। তেমন বিশেষত্ব ছিল না। তবে ওই বয়েসে সাঁতার কাটার আনন্দই আলাদা। সবাই মিলে পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করতাম। বাবলা, আমি, ছোটনমামা, বাবুমামা, শাপলা আপা, টগরভাই, ইলোরা খালা, কাকলী খালা ... এরকম কথাও শুনতাম যে কফিলের পুকুরে ‘শিকল’ আছে। সেই শিকল নাকি পা টেনে ধরে পকুরের গভীরে টেনে নিয়ে যায়। শুনে গা যে শিরশির করত করত। কিন্তু কফিলের পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি বন্ধ হয়নি। একবার কী মনে করে কফিলের পুকুরে গিয়েছিলাম। একা। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। কেন গিয়েছিলাম বলতে পারি না। গা শিরশির করেছিল হয়তো ...
বাবুমামা। এই মানুষটি আমার ছেলেবেলার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বাবুমামা এমনই উদার মানুষ যে মিশতে বয়েসের ব্যবধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। যে কারণে বাবুমামার সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বেশ আমুদে দিলখোলা মানুষ ছিলেন। এখনও ...
বাবুমামা আর আমি সন্ধেবেলায় রিকশায় চেপে সাহেব বাজারে যেতাম। খাশির চাপ খেতে। একটা রকের সামনে আড্ডা হত। বাবুমামার ইয়ারদোস্তরা সব আসতেন আড্ডায় । গানবাজনা হত। গানবাজনায় বাবুমামার বেশ উৎসাহ ছিল। তবে তিনি টুলটুলমামার মতো উচ্চাঙ্গ সংগীতের দিকে যাননি। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গভীর দরদ দিয়ে বাংলা ছায়াছবির গানই গাইতেন:
আমি তো বন্ধু মাতাল নই
মানুষ যদি মোরে নাই বল
বেঈমান বল বেঈমান ...
আমি স্কুলে পড়ার সময়ই টুকটাক গিটার বাজাতে পারতাম। বাবুমামা সেটাই তাঁর বন্ধুমহলে ফলাও করে তুলে ধরতেন। হয়তো আমি আজম খানের 'আসি আসি বলে তুমি আর এলে না' গানটা বাজালাম, অমনি আড্ডায় সে কি হুল্লোড় পড়ে যেত। সে সব কথা মনে করে এখন আমার হাসি পায়।
সাহেববাজারের সন্ধ্যার আড্ডায় একবার এক মজার কান্ড হয়েছিল। কি নিয়ে কথা কাটাকাটির পর জটলার মধ্যে একটা ছেলে আরেকটি ছেলের কলার চেপে ধরেছে। যার কলার চেপে ধরা হয়েছে, সে বলল, ‘পিঁয়াজির ব্যাটা, কাকে লাড়তে কাকে লাড়ছিস?’ পরে শুনেছি ছেলেটি ছিল উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সে কারনেই অমন সরস উক্তি।
সিরোল থেকে অনেকটা হেঁটে দেয়াল-টেয়াল ডিঙিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। বাবলার সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। বাবুমামার সঙ্গেও যেতাম। একবার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। যখন হাঁটতে শুরু করি, তখনও ঝরঝরে রোদ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর ঘোরাঘুরির সময়ও রোদ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বাবুমামার ইয়ারদোস্ত ছিল। হলে পৌঁছতেই চারপাশ মেঘলা হয়ে এল । হলের একটা রুমে তাশ পেটানো হল। দুপুরে ক্যান্টিনে খাওয়া হল। মেঘলা বিকেলে ফিরে এলাম। এটা সম্ভবত উনিশ শো চুরাশি সালের কথা। শেষবার যখন রাজশাহী গিয়েছিলাম।
বাবুমামা কখনও সিনেমা দেখতেও নিয়ে যেতেন। হলের নাম মনে নেই। সিনেমার নাম সম্ভবত রাজ্জাক অভিনীত ‘পাগলারাজা’। আজকাল যে ‘বাংলা ছিনেমার’ নাম শুনেই নাক কুঁচকাই ছেলেবেলায় আগ্রহ সহকারে তাই দেখতাম। সেসময় রাজশাহী-নওগাঁর ট্রেনের নাম ছিল ‘জনতা এক্সপ্রেস’। এই নামে একটি ছবিও হয়েছিল। ঢাকার একটি হলে ছবিটা দেখেছিলাম মুকুলমামার সঙ্গে। (হয়তো তখন ক্লাস এইটে পড়ি।) মুকুলমামা আমার মায়ের মামাতো ভাই। মুকুলমামা নওগাঁ থাকেন। মুকুলমামা নিজের চোখে শান্তাহার স্টেশনে ছবির সুটিং দেখেছিলেন। তাই ভীষণ উত্তেজিত ছিলেন।
সেসব দিনে রাজশাহী থেকে নওগাঁ যেতাম । আমার মা যেতেন মেয়েবেলার স্মৃতির টানে। ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজের সঙ্গে আমরা। রাজশাহী স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতাম। সে আনন্দের কি তুলনা হয়? আবদুল্লাপুর জংশনে ইঞ্জিন বদলানো হত। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হত। সে অপেক্ষায় আনন্দ ছিল; বিরক্তি ছিল না। মোটের ওপর ট্রেন জার্নি ছিল অত্যন্ত আনন্দময়। মনে আছে একবার। দুলদুলমামার বিয়ে। আমরা বরযাত্রীরা ট্রেনের একটি কামড়ায় হইহই করতে করতে নওগাঁ যাচ্ছি। আমি আমার প্রিয় জায়গায়। দরজার ধারে। হাতল ধরে ঝুঁকে ছুটন্ত দেখার মজাই মজা। দরজার কাছে দুলদুল মামা এলেন। হালকা-পাতলা শরীর। ছাপা শার্ট পরেছেন। বরের পোশাক পরবেন নওগাঁয় পৌঁছে, আামাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। দুলদুল মামা মাথায় টেস্ট ক্রিকেটারদের সাদা ক্যাপ। জিনিসটা কোথায় পেয়েছিলেন কে জানে, দুলদুল মামা সে ক্যাপ খুলে, আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, পরমানন্দে বাতাসে উড়িয়ে দিলেন।
নওগাঁ শহরের রেলস্টেশনটির নাম শান্তাহার। স্টেশনটি মূল শহরের খানিকটা দূরে। ধামকুড়ি গ্রামটি নওগাঁ শহর এবং শান্তাহার স্টেশনের মাঝামাঝি। ধামকুড়ি আমার মায়ের নানাবাড়ি। আমরা নওগাঁ শহরের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থাকলেও ওই ধামকুড়ি গ্রামটিই ছিল আমাদের মূল ঠিকানা। উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলি যেমন হয়- ছাড়া ছাড়া তালগাছ, মহিষ, ঘোড়া, ঈষৎ লালচে মাটির উদাসী-ধূসর। ধামকুড়ি গ্রামটি ছিল ঠিক তেমনই । ধামকুড়ির আমার মায়ের নানাবাড়িটি পাকা। পুরাতন ইটের গাঁথুনি দেখে ছোটখাটো জমিদার বাড়িই মনে হয় । দেয়ালে কুলঙ্গি ছিল, কাঁচও নাকি বসানো ছিল। বাড়ির সামনের পুকুরঘাটটি পুরনো ইটের নির্মিত । ১৯৭১ সালে বাড়িটিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা আগুন দিয়েছিল। আমি স্বচক্ষে পোড়াটে চিহ্ন সেই বাড়ির সর্বত্রই দেখেছি। মায়ের মুখে শুনেছি, এ বাড়ির আঠারো-উনিশ জন পুরুষকে উঠানে লাইন করে দাঁড় করানো হয়েছিল। তারপর নির্মম ব্রাশফায়ার। একজনই মাত্র বেঁচেছিলেন। রিন্টুমামা। আমার মায়ের মামাতো ভাই। রিন্টুমামার হাতে এখনও গুলির দগদগে দাগ একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বতার স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে।
দলবেঁধে ধামকুড়ি গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম। লালমাটির পথ, বোপঝাড়, পগার পুকুর, তালগাছ, মহিষ, ঘোড়া, খড়ের স্তূপ। ছনের বাড়ির মেঝেটি মাটির। অনেক ঘরের মাটি আবার উঁচু করে লেপা, তার ওপর কাঁথাবালিশ। সম্ভবত খাট-পালঙ্ক কেনার খরচ বাঁচাতে! আমার বাবার বাড়ি চাঁদপুর। সেখানকার মানুষ এত বুদ্ধিমান না!
ধামকুড়ির গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই চোখে পড়ার কথা ... এত আনন্দ পৃথিবীর কোথায় আছে? এমন অমলিন দৃশ্যই তো অমর করে রেখেছে প্রাচুর্যময়ী বাংলাকে । এই ছবিটি নিয়েছি দিব্যর ফেসবুকের ছবির অ্যালবাম থেকে ...
বাংলাসিনেমা দেখে অনেক ফূর্তিতে অনেক রাতে পাথারের (ফসলশূন্য ন্যাড়াক্ষেত) ওপর দিয়ে দলবল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরার স্মৃতি মনে আছে। সিনেমাহলের নাম সম্ভবত ‘মালা’। হয়তো রাজ্জাক রোজিনা অভিনীত কোনও ছবি। সিনেমাহলটি ছিল শান্তাহার স্টেশনের কাছেই। শো ভাঙত অনেকরাতে। আমরা ফিরতাম পাথারের ওপর দিয়ে। জ্যো¯œা শীত ও কুয়াশা একাকার হয়ে থাকত। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল ছবির কাহিনী। বাবুমামা সিনেমার গান ধরতেন। আমরা হি হি করে হেসে উঠতাম।
এ লেখার শুরুতে বলেছি যে ১৯৮৪ সালের পর আমার আর রাজশাহী যাওয়া হয়নি। শেষবার যখন রাজশাহী থেকে ফিরি
তখন এক ... ঘটনা ঘটেছিল। বাবুমামা আমায় বাসে তুলে দিলেন সকালের দিকে। লালরঙের জাপানি মিৎসুবিশি। মন ভারি বিষন্ন ছিল। প্রতিবারই যখন রাজশাহী ছেড়ে যাই মন কি রকম যেন বিষন্ন থাকে। ব্যাপরটা শুরু হত আগের দিন থেকেই।
বাসে পড়ছিলাম আবুল ফজলের ‘মানবতন্ত্র’ বইটি। বইটি ছিল সিরোল নানারবাড়ি। বাসে পড়ব বলে নিয়ে এসেছি। আবুল ফজলের মানবতন্ত্র বইটির বক্তব্য ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং বুদ্ধির মুক্তির পক্ষে । যা আমার বিশ্বাসেরর সঙ্গে মিলে যায়। সোজা কথা আমি ছিলাম অবিশ্বাসী! তো বাস চলছে। বইটি পড়ছি। ঝিরঝির বৃষ্টি। বই পড়ছি। বাস চলছে। পাবনায় চলে এসেছি। হঠাৎই আমি ২/৩ মিনিটের জন্য রাস্তার পাশে গিয়ে একবার দাঁড়ানোর চাপ অনুভব করলাম। অবস্থা বেগতিক। সিট ছেড়ে উঠে কন্ডাকটরকে বললাম সে কথা। সে ব্যাটা বলল: বাস থামানো যাবে না। সামনে নগরবাড়ি ঘাট। ফেরি মিস হবে। এমনিতেই আমি লাজুক কিসিমের । কিন্তু সেদিন যে কী হল -কোন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসে বাস থামিয়ে খালের ধারে দাঁড়িয়ে গেলাম। বাসে ফিরতেই যাত্রীদের আগুনচোখ। গুঞ্জন। র্ভৎসনা। ফেরি মিস হবে। সবারই তো জরুরি কাজ আছে। যেন আমার ইয়ে করাটা অত জরুরি নয়। আমি ভাবলাম আমার এরূপ হেনস্থার কারণ বাসে বসে আবুল ফজল এর ওই নাস্তিব বইটা পড়া। বাস নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছল। আমার সমস্ত উৎকন্ঠার অবসান করে বাসটা একেবারে শেষে ফেরিতে উঠল হেলেদুলে । আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলাম। বাসযাত্রীরা চুপ মেরে গেল। আমি এহেন অলৌকিক কান্ডে খানিকটা বিমূঢ়। তবে আমি সেদিনই বুঝেছিলাম মহামহিম ঈশ্বর বিশ্বাসী ও সংশয়বাদী-সংসারে এই দুপক্ষের ওপরই তাঁর অপার করুণা বর্ষন করেন।
নইলে এক অবিশ্বাসীর শৈশব-কৈশর অত বর্ণিলই- বা কেন?
উৎসর্গ: বাবলা এবং বাবুমামা। এবং এ প্রজন্মের দিব্যকে।