মৃত্যু যে আসন্ন- সেটা অংচাপ্রু মারমা এরই মধ্যে টের পেয়ে গেছে। অথচ সে জন্মের মায়া-জড়ানো এই শ্যামল নির্জন বন-পাহাড় আর সাঙ্গু নদী ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে পারবে না, এই বন পাহাড়েই তাকে মরতে হবে । আর সীমান্তের স্মাগলারদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচাও তো সহজ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্ত-ঘেঁষা ঘোর অরণ্য পাহাড়ে সম্প্রতি চোরাকারবারিদের তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। ও সব দূর্গম পথে সীমান্তের ওপার থেকে মারাত্মক সব নেশাদ্রব্য ঢুকছে বাংলাদেশে । চোরাচালানিদের দাপটে এখন অংচাপ্রু মারমার জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
মৃত্যুর আগে একবার বৌদ্ধবিহারে গিয়ে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করবে অংচাপ্রু মারমা । বৌদ্ধবিহারটি থানচিতে । মাঘের এক ভোরে তিন্দু বাজার থেকে রওনা হয়ে সাঙ্গু নদীর তীর ধরে কুয়াশা মোড়ানো পথে হাঁটতে থাকে সে । ভট ভট শব্দে খুব নীচু দিয়ে একটা আর্মির হেলিকপ্টার উড়ে যায় থানচির দিকে ।তার শরীরের গড়নটি ছোটোখাটো, গায়ের রং ফরসা । তার পরনে চেক লুঙ্গি । গায়ে খয়েরি রঙের একটা সোয়েটার, সে সোয়েটারের নীচে সাদা শার্টের হাতা আর কলার দৃশ্যমান। সাধারণত স্থানীয় লোকজন এ পথটুকু আসা-যাওয়া করে নৌকায়। বুদ্ধের কাছে সহজে যেতে চায় না সে । পাথরের আঘাতে পায়ে রক্ত ঝরিয়ে তবেই সে থানচির বৌদ্ধবিহারে পৌঁছতে চায়।
অংচাপ্রু মারমার বাড়ি তিন্দু। জায়গাটা সাঙ্গু নদীর পাড়ে। তিন্দু বাজারের পিছনে একটা ছোট টিলার ওপর অংচাপ্রু মারমার গ্রাম । তিন্দুর পরই রেমাক্রিবাজার।ওই রেমাক্রিবাজার থেকেই বিখ্যাত নাফাখুম ঝরনা ঘন্টা তিনেকের হাঁটাপথ। বছর কয়েক হল এসব নির্জন বন- পাহাড়ে শহর থেকে পর্যটকরা সব আসছে; তাদের অধিকাংশই তরুণ, তবে পর্যটকদের মধ্যে তরুণিও রয়েছে । অংচাপ্রু মারমার শৈশবে জায়গাটা নির্জনই ছিল। হঠাৎই করেই যেন নির্জন পাহাড়ি পরিবেশ গেল বদলে । বান্দরবান থেকে থানচি হয়ে শহুরে তরুণ-তরুণিরা এসে তিন্দু-রেমাক্রিবাজার- নাফাকুম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাতে অংচাপ্রু মারমার ভাগ্য গেল বদলে। এর আগে সে এক রকম বেকারই ছিল; থানচি থেকে মিনারেল ওয়াটার কিংবা চিপস-এর প্যাকেট এনে তিন্দু বাজারে বিক্রি করত। এবার গাইড-এর কাজ পেয়ে গেল সে। তরুণ পর্যটকদের সে রেমাক্রিবাজার থেকে নাফাখুম ঝরনা দেখিয়ে আনে। বাংলা ভালোই বলে অংচাপ্রু মারমা । পাহাড় এবং পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের প্রতি শহুরে তরুণরা আজকাল গভীর আকর্ষন এবং কৌতূহল বোধ করে। তরুণ পর্যটকদের সঙ্গে তার মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে । বাঙালি তরুণদের ভালোই লাগে তার। মেয়েদেরও ভালো লাগে। মেয়েরা তাকে বলে, আচ্ছা, আপনারা নাকি খরগোশ ভর্তা খান? আমাদের খাওয়াতে পারবেন?
অবশ্যই। বলে ঘন ঘন মাথা নাড়ে অংচাপ্রু মারমা । হাসে।
রেমাক্রিবাজারের কাছেই তার এক বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুর নাম জ্যোতি মারমা । তার বাড়িতে তরুণ পর্যটকদের নিয়ে যায় সে । তারপর শহরে পর্যটকেরা বনমুরগির ঝোল আর খরগোশ ভর্তা খেয়ে আনন্দে আটখানা । যেন পৃথিবীতেই স্বর্গ পেয়ে গেছে। অংচাপ্রু মারমা লক্ষ করেছে যে, বাঙালিরা অতি অল্পতেই খুশি হয়। তারা বিদেশি পোশাক আর বিদেশি যন্ত্রপাতি (ক্যামেরা, মোবাইল ইত্যাদি) ব্যবহার করলেও বেশ সহজ ও সরল। অনেকে আবার ভীষণ মিশুক।
সে যাই হোক। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমাসমাজটি পিতৃতান্ত্রিক। অংচাপ্রু মারমার বাবা উশি মারমার বয়স পঞ্চাশের মতো, তিন্দুর একটা সরকারি গেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার সে। অংচাপ্রু মারমার মা অবশ্য বেঁচে নেই, কেবল মায়ের স্মৃতি আছে ওই মারমা তরুণটির হৃদয়ের গহীনে। অংচাপ্রু মারমার একটাই বোন; কালাবি মারমা। তো কালাবির বিয়ে হয়ে গেছে। ওর স্বামী উম্রাচিং মারমার থানচি বাজারে একটা ভাতের হোটেল আছে ।
অংচাপ্রু মারমা থাকে রেমাক্রিবাজারেই একটা ঝুপসি ঘরে । মাস গেলে আয় মন্দ না তার। টাকা বাবাকে দেয়, থানচি গিয়ে ছোট বোনকেও দিয়ে আসে। হ্যাঁ, কিছু দেওয়ার জন্য তার জীবনে আরও একজন আছে; সে তার প্রেম। মেয়েটির নাম- অনিমা মারমা । অনিমা মারমার বাড়ি তিন্দু বাজারের কাছেই । ষোড়শী অনিমা মারমা দারুণ সুন্দরী, গানের গলাও চমৎকার। আর চমৎকার নাচেও। সাংরাই এর উৎসবে ঐতিহ্যবাহী ময়ূরনৃত্য, ছাতানৃত্য,পাখানৃত্য এবং থালানৃত্য পরিবেশনে অনিমা মারমার তুলনা নেই। অনিমা মারমা যখন উপহার পাওয়া নতুন থামি আর টপস পরে তার সামনে এসে দাঁড়ায় তখন সে মুগ্ধ চোখে সুন্দরী ষোড়শীর দিকে চেয়ে থাকে। ওরা দুজন ঘর বাঁধবে। সাঙ্গু নদীর পাড়ে বসে সে রকমই কথা হয়। অংচাপ্রু মারমারও গানের গলা চমৎকার। অনিমা মারমা তার গান শুনতে চায়। সে গায়-
নুখ্যাং নিংচ ইখিংমা/হ্নাকসে প্যাইংরে অগংখামা/খ্যাসু গা যামা হিরেলে।
একলা বসে থাকি যখন তোমায় মনে পড়ে তখন
গান শুনে অনিমা মারমা ভারি খুশি হয় ...
অংচাপ্রু মারমার গান শুনে তরুণ বাঙালি পর্যটকরাও ভারি খুশি হয়। এই পাহাড়ি নদী দেখে, ছোটখাটো টিলা দেখে, নদীর বুকে ও নদীর পাড়ে ছোটবড় পাথর দেখে বাঙালিরা ভীষণ খুশি হয়ে ওঠে। বনপাহাড়ের প্রতি বাঙালিদের কী রকম এক গভীর মুগ্ধতা আছে । সেটি টের পেয়ে গভীর ও গোপন আনন্দ পায় অংচাপ্রু মারমা ।এই বনপাহাড়ে তারও প্রাণের সুর বাজে। সুতরাং বাঙালি পর্যটকদের প্রতি গভীর আকর্ষন বোধ করে সে।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি যে দলটি এসেছিল- ওদের কথা এখনও মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অংচাপ্রু মারমা। সেই দলে ছিল মারূফদা, মুনিয়াদি, সুমিতদা ও জয়াদি। এরা নাকি সবাই ঢাকা শহরের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওদের সঙ্গে সে বেশ ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছিল । সন্ধ্যার পর ওরা রেক্রামিবাজারের গেষ্টহাউজের পিছনের কুয়াশা-ঢাকা মাঠে আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসত । তখন শীত সন্ধ্যার নির্জন আকাশ থেকে ঝরে ঝরে পড়ত ফুটফুটে জ্যোস্না ।
জয়াদি বলত, অংচাপ্রু ভাই, আপনি এত সুন্দর জায়গায় থাকেন, আপনাকে আমার ভীষণ ঈর্ষা হচ্ছে ।
অংচাপ্রু মারমা হেসেছিল। কী বলবে সে। আসলেই তো এসব বনপাহাড় আর সাঙ্গু নদী প্রকৃতির ঐশ্বর্য নিয়ে অপরূপা হয়ে রয়েছে।
মুনিয়াদি বলল, ইস্, কী শীত রে বাবা! অংচাপ্রুদা, আপনি শুধু সোয়েটার পড়ে আছেন। নিন, এই চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিন। বলে মুনিয়াদি নিজের গায়ের চাদর খুলে দিয়েছিল। অংচাপ্রু মারমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।
সুমিতদা গিটার বাজাচ্ছিল। হঠাৎ গিটার বাজানো থামিয়ে বলল, উহঃ, বাংলাদেশটা এত সুন্দর! ওহ! এখানে না এলে জীবনে কী ভুলই না করতাম! উফঃ
অংচাপ্রু মারমা হাসে। সুমিতদা গিটারে কী কর্ড বাজাচ্ছিল। ওদের একটি গান শোনাতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল তার। সে গান করে -
সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা/ রি কেজেই কে পা মে ...
সাংরাই এর উৎসবে এসো সবাই মিলে জল খেলা খেলি।
দারুণ! দারুণ! জয়াদি আর মুনিয়াদি একসঙ্গে হাততালি দিয়ে ওঠে।
মারূফদা ওর মোবাইলে গান রেকর্ড করে নিয়েছিল। গান শেষ হতে বলল, আপনাদের গান কী সুন্দর!
মুনিয়াদি বলে, সত্যি সুন্দর। সহজ সুন্দর।
সুমিতদা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে। সত্যি অসাম। কী সহজ কর্ড প্রোগ্রেশন। জি-এ মাইনর-সি। আর পেন্টাটনিক স্কেল।
অংচাপ্রু মারমার এসব ইংরেজি শব্দের অর্থ জানার কথা না; তবে সে সব শব্দের অর্থ বুঝতে তার মোটেও অসুবিধে হচ্ছিল না ।
মুনিয়াদি বলে, অ্যাই সুমিত! তুই না এবছর অ্যালবাম বার করবি। তো, তোর অ্যালবামে অংচাপ্রু ভাইয়ের এই গানটা রাখ না। অ্যালবামে একটা-দুইটা ট্রাইবাল সং রাখলে কী হয়। এই গান তো আমাদের বাংলাদেশেরই গান।
জয়াদি হাততালি দিয়ে বলে, গ্রেট আইডিয়া।
আচ্ছা, করব। সুমিতদা বলে।
তাহলে অংচাপ্রু ভাইয়ের অনুমতি নে! অনুমতি নে। বলে মুনিয়াদি চেঁচিয়ে ওঠে।
কি বলে এরা! আমার গান রেকর্ড করবে? অংচাপ্রু মারমা ভিতরে ভিতরে ভীষণ কাঁপছিল। সে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ক্যশৈপ্রু মারমার কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্বন্ধে শুনেছে। স্বাধীনতার আগে নাকি পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালির প্রিয় রবি ঠাকুরের গান নিষিদ্ধ করেছিল। অথচ ... অথচ এরা এক মারমা তরুণের গান রেকর্ড করতে চায়, সেজন্য অনুমতিও চায়। কী আশ্চর্য! অংচাপ্রু মারমার বসবাস বাংলাদেশের মূল কেন্দ্র থেকে সুদূর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে । অথচ প্রান্তবাসী অংচাপ্রু মারমার প্রতি মূলধারার বাঙালিদের ব্যবহারে বিন্দুমাত্র অবজ্ঞা কিংবা কর্তৃত্ব নেই । কি এর কারণ? বাঙালি তরুণ-তরুণিরা অন্য রকম একটা বাংলাদেশ আবিস্কার করে ফেলেছে। তারা সেই অন্যরকম পাহাড়ি বাংলাদেশকে বুঝতে চাইছে? পাহাড়ের মানুষসহ পাহাড়ি প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতির কোলে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইছে ?
ফেরার পথে ওদের সঙ্গে থানচি অবধি গিয়েছিল সে। থানচিতে চান্দের গাড়িতে ওঠার আগে মুনিয়াদি কে চাদরটা ফেরৎ দিতে চাইল । তখন মুনিয়া বলল, আরে, না না। এটা ফেরত দিতে হবে না। এটা আপনার কাছেই রেখে দিন। স্মৃতি হিসেবে। তাহলে মাঝেমাঝে আমাদের মনে পড়বে। হি হি।
আবার আসবেন। অবরুদ্ধ কন্ঠে বলেছিল অংচাপ্রু মারমা ।
আসব না মানে।অবশ্যই আসব। শহরে থেকে আমরা মরে যাই ভাই। এখানে এলেই মনে হয় বেঁচে আছি। মায়ের কোলে ফিরে এসেছি।
সে যখন বৌদ্ধবিহারে পৌঁছল তখন শীতবেলার মধ্যাহ্নের আলো ঝলমল করছিল । থানচির আধ কিলোমিটার আগে বৌদ্ধবিহারটা একটা টিলার ওপর । সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে সে । সিঁড়ির ধাপে রক্তের ছোপ লাগে । পথের তীক্ষ নুড়িপাথরে তার পায়ের পাতা ছিলে গেছে। ওপরে ওপরে সিঁড়ির বাঁপাশে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। তারপর সুপরিসর চাতাল। অসংখ্য শুকনো পাতা পড়ে আছে চাতালের ওপর । ভিতরের একটি প্রকোষ্টে সোনার একটি বৌদ্ধমূর্তি।
দীর্ঘক্ষণ সেই মূর্তির সামনে অবনত হয়ে রইল সে।
ফেরার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতেই চমকে যায় সে । কালাবি সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে । কালাবির মুখটি মলিন। কোলে ছোট্ট মংপুচি । কালাবির স্বামী অসুস্থ । বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করতে এসেছে। কিন্তু, ওর সঙ্গে তো এখানে দেখা হওয়ার কথা না। কে ওকে পাঠালেন এখানে? বুদ্ধ? শেষবার অবশ্য বোনের মুখটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। বুদ্ধ সে ইচ্ছে পূরণ করলেন? কালাবির চোখ এড়িয়ে একদল ভিক্ষুদের ভিড়ে মিশে পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে সে। ঠিক তখনই ভট ভট শব্দে খুব নীচু দিয়ে একটা আর্মির হেলিকপ্টার উড়ে যায় তিন্দুর দিকে ।
বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করে নির্ভার বোধ করে সে। এবার মৃত্যুর অপেক্ষা ... সে জানে ... ওরা আসবে। আজ হোক কাল হোক। থিয়েন আঙ-এর দলের লোকজন ওকে হত্যা করতে আসবে ...
তার একবার মনে হয় অনিমা কে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যায়। বান্দরবান ।বান্দরবানের পরে কী আছে সে সর্ম্পকে তার পরিস্কার ধারণা নেই । অবশ্য সে জানে চোরাকারবারিদের হাত অনেক দূর যায়। বান্দরবান গিয়েও বাঁচা যাবে না। মিছিমিছি ওর জীবনের সঙ্গে অনিমার জীবন জড়িয়ে কী লাভ। অনিমা তো কোনও দোষ করেনি। আসলে তার কপালই মন্দ। নইলে থিয়েন আঙ-এর সঙ্গে দেখা হবে কেন?
গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কালাবিকে টাকা দিতে থানচি গিয়েছিল সে । তখন থিয়েন আঙ-এর সঙ্গে পরিচয়। কালাবির মুখ কালো হয়ে ছিল। ওর স্বামী উম্রাচিং মারমার বুকে ব্যথা। চিকিৎসার জন্য বান্দরবান নিয়ে যাওয়া দরকার। এদিকে কালাবির হাত খালি। চিকিৎসার জন্য বান্দরবান গেলে অন্তত পাঁচ-সাত হাজার টাকা খরচ হবে।
বিকেলে থানচি বাজারে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল সে । মনের ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল দুশ্চিন্তার কালো মেঘ । কালাবির স্বামীর চিকিৎসার জন্য অত টাকা যোগার করার কোনও পথ পাচ্ছিল না। চা খেতে খেতে বারবার একটা লোকের ওপর চোখ আটকে যাচ্ছিল তার। মাঝবয়েসি লোকটার পরনে বার্মিজ লুঙ্গি আর মেরুন রঙের জ্যাকেট। অংচাপ্রু মারমা জানে লোকটা স্থানীয় নয়, বার্মিজ। লোকটাও মাঝে মাঝে আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছিল। একটু পর লোকটা নিজেই তার পরিচয় দিল। নাম বলল, থিয়েন আঙ। বাড়ি বার্মার রামরিক। তা অংচাপ্রু মারমা বার্মিজ ভাষা বোঝে বটে। এককালে মারমা জাতির উদ্ভব তো সীমান্তের ওই পারেই হয়েছিল; মারমা শব্দটির উদ্ভব হয়েছে বার্মিজ ‘ম্রাইমা’ শব্দটি থেকে। আজও মারমা ভাষার লেখার বর্ণমালা বার্মিজ। সে যাই হোক। থিয়েন আঙ-এর মতিগতি ভালো ঠেকল না তার । মিয়ানমার সীমান্তের দিকে দীর্ঘদিন ধরে চোরাকারবারিদের নানা রকম অশুভ তৎপরতা চলছে। বার্মিজদের সে এড়িয়েই চলে। সে চায়ের বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়াবে -ঠিক তখনই থিয়েন আঙ নীচুস্বরে বলে, তুই একটা কাজ করতে পারবি?
কি কাজ?
একটা প্যাকেট নিয়া বান্দরবান যাবি। ঐ খানে হোটেল হিলস গ্রিন- এ প্যাকেটটা একজনকে দিবি। যাওয়ার আগে আমি তোরে লোকটার রুম নাম্বার বলে দিব। থিয়েন আঙ ফিসফিস করে বলে।
কি আছে প্যাকেটে?
অত কথায় দরকার কী তোর? থিয়েন আঙ চাপা খসখসে কন্ঠে বলে।
প্যাকেটের কি আছে না-বললে আমি বান্দরবান যাব না।
বিশ হাজার টাকা পাবি। এখন দশ হাজার আগাম পাবি।
আগে কও প্যাকেটে কি আছে।
নীলবড়ি (ইয়াবা)।
অংচাপ্রু মারমা চমকে ওঠে। তীক্ষ্মকন্ঠে বলে, আমি এই কাজ করতে পারব না। তার গায়ে মুনিয়াদির চাদর গায়ে। যে চাদর তাকে প্রতি মুহূর্তে প্রচন্ড পাহাড়ি শীতে উষ্ণতা দিচ্ছে। সে নীলবড়ি পাচার করে বাঙালি তরুণ-তরুণিদের সর্বনাশ করতে পারবে না ।
থিয়েন আঙ তারপর চোখের নিমিষে থানচি বাজারের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
পরদিন অংচাপ্রু মারমা রেমাক্রিবাজারে ফিরে আসে। একটা পর্যটক দল নিয়ে নাফাখুম যায়। পর্যটকদের ঝরনা দেখিয়ে আবার রেমাক্রিবাজারে নিয়ে আসে।
আজকাল হাতে কাজ না-থাকলে সে রেমাক্রিবাজারের কোনও চা দোকানের সামনে বেঞ্চির ওপর বসে থাকে। চা খায়। কালাবির স্বামীর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগারের উপায় চিন্তা করে। তার গায়ে মুনিয়াদির চাদর। বাইরে থেকে তাকে দেখে স্বাভাবিকই মনে হয়। অবশ্য সে জানে ... ওরা আসবে। আজ হোক কাল হোক। আসবে। থিয়েন আঙ-এর দলের লোকজন ওকে হত্যা করতে আসবেই ... তখন মুনিয়াদির চাদরে রক্তের ছিটে লাগবে ... সে জানে ...
এ গল্পে ব্যবহৃত মারমা গান দুটির রচয়িতা ও সুরকার সামং প্রু