পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি কিশোর-কিশোরীদের অমানুষিক নির্যাতন করে পৈচাশিক আনন্দ পান পাকিস্তানি আর্মির মেজর পারভেজ রশীদ। যেন তিনি মানুষ নন; মেজর নন, তিনি কেবলি পিশাচ ... একটু আগে যে আঠারো জন ‘মুক্তি’ কে স্কুলের মাঠে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করার নির্দেশ তিনি দিলেন, তাদের মধ্যে একজন অল্পবয়েসি কিশোরও আছে। তাকে আলাদা ‘ট্রিট’ করার কথা ভাবছেন মেজর পারভেজ রশীদ তবে হাতে সময় কম। যা করার দ্রুত করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা যে কোনও মুহূর্তে স্কুলে অ্যাটাক করবে । স্থানীয় রাজাকার মোসলেমউদ্দীন এরকমই খবর এনেছে।
‘চল সালে।’ বলে গর্জে উঠে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বন্দিদের স্কুলমাঠে নিয়ে যায় পাক সৈন্যরা। প্রত্যেকের চেহারাই ভাঙাচোরা । এই মুক্তিরা রেললাইন উপড়ে ফেলার প্ল্যান করছিল। আজ ভোরে ধরা পড়েছে। স্থানীয় রাজাকার মোসলেমউদ্দীনই পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
বন্দি কিশোরটির ছিপছিপে শ্যামলা চেহারা। পরনে কাদা মাখা ছেঁড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি। মুখে যুদ্ধকালীন বাস্তবতার কঠোরতা লেপ্টে আছে। কিশোরের দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি অত্যন্ত দৃঢ় এবং ভয়শূন্য। কিশোরের মুখে এই নির্ভীক দৃঢ়তা সহ্য হচ্ছিল না মেজর পারভেজ রশীদ-এর। হঠাৎ তিনি প্রচন্ড জোরে কিশোরের মুখে চড় কষলেন । হেলাল ছিটকে পড়ে। প্রচন্ড জোরে দেয়ালে মাথা ঠুকে যায় তার। তার নাক দিকে রক্ত বেরিয়ে আসে। চোখে অন্ধকার দেখে । মৃত্যু অতি নিকটে বলেই এতক্ষণ আল্লাহর মুখ স্মরণ করার চেষ্টা করছিল হেলাল । নিরাকার আল্লাহর মুখের বদলে মায়ের মমতাভরা মুখখানিই বারবার ভেসে উঠছিল। ... মা ঝিরঝির বৃষ্টির ভিতর অন্ধকার উঠানে দাঁড়ায় কানতেছিল। হেলাল যখন বলল, মা আমি যুদ্ধে যাইতেছি। তুমি কাইন্দো না। তারপরও মায়ে কান্দন থামে না। কানতে কানতে হেলালের হাত ধরে সাফিয়া খাতুন অন্ধকারে খালপাড় পর্যন্ত আসেন। কচুরিপানার তীব্র গন্ধের ভিতরে নৌকায় উঠে হেলাল। সাফিয়া খাতুন নৌকার গলুই পাড়ের দিকে টেনে ধরে থাকেন। যাইতে দিমুরা তরে, ওরে সোনা আমার ... অথচ সাফিয়া খাতুন-এর ইচ্ছা ছেলে খানসেনা হত্যা করে দেশ স্বাধীন করুক ... মেজর পারভেজ রশীদ হেলালের বুকে বুটের দিয়ে প্রচন্ড জোরে লাথি মারেন। মায়ের মুখখানা ভাসছিল বলে হেলাল যন্ত্রণা অনুভব করে না। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সৈন্যর হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নেন মেজর পারভেজ রশীদ । তারপর পৈচাশিক ভাবে হেলালের তলপেটে বেয়োনেট চার্জ করেন। কিশোরের মাথর ভিতরে অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে ...
বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আসরের নামাজ পড়েন হেলালউদ্দীন। তারপর পিছনের বারান্দায় এসে বসেন । পত্রিকা পড়েন। মুড়ি-চা খান। শেষ বিকেলে কেমন ঘন ছায়া ঘনিয়ে ওঠে চারপাশে। পরম শান্তি পান হেলালউদ্দীন । বারান্দার ওধারে ছোট একটা উঠান। শ্যাওলা ধরা ভাঙাচোরা দেওয়াল ঘেঁষে আতা, কাঁঠাল আর পেঁপেগাছ। দেওয়ালে আর গাছগুলোয় শেষবেলার ম্লান রোদ থমকে থাকে । তখন খাঁচায় ময়না পাখিটি ডেকে ওঠে। হেলালউদ্দীন-এর মেয়ে সেতু বড় পাখি ভালোবাসে। হেলালউদ্দীন নিজেও পাখি ভালোবাসেন। পাখি মানেই শৈশব। হেলালউদ্দীন ময়নাকে দানাপানি খাওয়ান।
পত্রিকা পড়তে পড়তে হেলালউদ্দীন খুক খুক করে কাশছিলেন। সেতু বারান্দায় আসে। বলে, আব্বা তুমি তখন থেইকা খালি কাশতেছ। এক কাপ আদা চা খাইবা? খাইলে কও, বানায়া দেই।
হ মা, খামু, দে বানায়া দে।
সেতুর মা আসমা ঘরে নেই । পাশের বাড়ির লতিফা বানুর সঙ্গে দরগায় গেছেন । বিধবা লতিফা বানু নানারকম গঞ্ছনা সহ্য করে মেয়েজামাইয়ের সংসারে কোনওমতে টিকে আছেন। রূপালী নদীর পাড়ে কালাচাঁদের পীরের দরগায় যেয়ে শান্তি পান লতিফা বানু । আজকাল শেষরাতে মন্দ খোয়াব দেখছেন আসমা। পাড়ার সিকদারের পুকুরের সেতুর বাবা ডুব দিয়েছেন। আর উঠছেন না ...লতিফা বানুর সঙ্গে আসমার কালাচাঁদের পীরের দরগায় যাওয়ার এই কারণ। শেষরাতে মন্দ খোয়াব দেখা ছাড়াও আসমার অন্য এক টেনশনও আছে। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে টেনশন। সেতু সুন্দরী। কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছে। কলেজে যাওয়া-আসার পথে মাইঝা পাড়ার মিঠুন সেতুকে বিরক্ত করে। আজেবাজে কথা বলে। শুনে শরীরে রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল হেলালউদ্দীনের। ছিঃ! এমন ফুলের মতো পবিত্র মেয়েকে কেউ মন্দ কথা বলতে পারে। মাইঝা পাড়ার মিঠুন আলতাফ মাস্টারের ছোট ছেলে। আলতাফ মাস্টারের কাঁধে কাঁধ রেখে চল্লিশ বছর আগে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন হেলালউদ্দীন। ...মিঠুন ফার্নিচারের ব্যবসা করে। আলতাফ মাস্টার গতবছর মারা গেলেন। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। ছেলেটাকে একদিন বোঝাতে হবে। সেতু হেলালউদ্দীনের প্রাণপাখি। তার কোনও ধরণের অবমানরা সহ্য হবে না। ... সেতু অবিকল হেলালউদ্দীনের মায়ের মুখের আদল পেয়েছে। (হেলালউদ্দীনের মা সাফিয়া খাতুন দেখতে ফরসা ছিলেন।)... যুদ্ধের পর গ্রামে ফিরে পোড়া বাড়িতে মাকে আর পাননি হেলালউদ্দীন। অনেক খুঁজেছেন। পাননি। চিৎকার করে পথে পথে ঘুরে কেঁদেছেন। মনের দুঃখে গ্রাম ছেড়ে জেলা শহরে চলে এসেছেন। আলতাফ মাস্টার তখন আশ্রয় দিয়েছিলেন। আজ তারই ছেলে কিনা ...সেতুর মধ্যে সেই হারানো মাকে খুঁজে পেয়েছেন হেলালউদ্দীন। মা অত্যন্ত সুরেলা কন্ঠে কোরাণ পাঠ করতেন। সেতুর গানের গলাও চমৎকার।
সেতু চা নিয়ে আসে। ফিরোজা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। মুখে ক্রিম মেখে বেশ করে সেজেছে। চোখে কাজল। হেলালউদ্দীন জিগ্যেস করলেন, কই যাও গো মা?
সেতু বলে, দীপালী গো বাড়ি যাই আব্বা। শিবাণীদি শ্বশুরবাড়ি থেইকে বাচ্চা নিয়া আসছে। শিবাণীদি বাচ্চারে এখনও দেখি নাই। তারে দেখতে যাই।
যাও। সন্ধার আগে ফিরবা।
আইচ্ছা। আমি আইসা ভাত বসামু।
সরকার বাড়ির দিলীপ সরকারের বড় মেয়ে শিবাণীর কাছে গান শিখত সেতু । শিবাণী মেয়েটা বড় ভালো। নজরুল গীতি গাইত। যদিও সেভাবে নামধাম করতে পারেনি। বিয়ের আগে এ বাড়ি নিয়মিত আসত। তখন হেলালউদ্দীন আবদার করতেন, অহন গান শোনাও তো মা।
শিবাণী হারমোনিয়াম টেনে গাইতে থাকে -
আমার যাবার সময় হল/ দাও বিদায় ...
তখন ক্লাস সেভেনে পড়ত সেতু। ধারকর্য করে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন মেয়েকে। হেলালউদ্দীন সামান্য স্কুল শিক্ষক। বাজেটের বাইরে গেলে নাভিশ্বাস ওঠে। আক্ষেপ এই- শিবাণীর বিয়ের পর সেতুর আর গান শেখা হয়নি। তবে সেতুর প্রতিভা জন্মগত। দু-একবার শুনলেই যে কোনও গান তুলতে পারে। ...
সরকার বাড়ি কাছেই । সিকদারের পুকুরের উলটো দিকের গলিতে, রামকৃষ্ণ মিশনের পাশে । তারপরও টেনশন হয় হেলালউদ্দীনের। আজকাল এই মফঃস্বর শহরের পাড়ায় পাড়ায় বখাটে ছেলেদের উৎপাত ভীষণ বেড়ে গেছে ।
মাগরিবের নামাজ সেরে জায়নামাজে বসে ছিলেন হেলালউদ্দীন।
খিদে টের পেলেন। মশার কয়েল জ্বালিয়ে মুড়ি-টুড়ির খোঁজে রান্নাঘরে যাবেন- কে যেন কড়া নাড়ছে। সেতু? দরজা খুলে দেখলেন আসমা। কালো বোরখা পরা। দ্রুত ঘরে ঢুকে বলেন, পাখি এখনও ফিরে নাই?
(সেতুকে 'পাখি' ডাকেন আসমা)
না গো।
আচ্ছা, আমি ভাত বসায় দেই। বলে দ্রুত বোরখা খুলে খাটের ওপর ছুড়ে দ্রুত পায়ে বাথরুম চলে যান আসমা ।
দাও। বলে কাশতে লাগলেন হেলালউদ্দীন । কাশিট বড় জ্বালাচ্ছে। হেলালউদ্দীন টুকটাক বনৌষধি জানেন। বাসকের রস কাশিতে ভারি উপকারি। কাল স্কুল থেকে ফেরার পথে বাসকপাতা নিয়ে আসবেন।
রান্নাঘর থেকে ফিরে আসেন আসমা। হাতে একটা ঠোঙা। স্বামীর দিকে ঠোঙা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নাও বাতাসা খাও। খাদেম মমিনউল্লা দিসে। খাইলে তুমার কাশি কমব।
হেলালউদ্দীন ঠোঙা নেন। হায় আল্লা, বাতাসা খাইলে নাকি কাশি কমব। হাসি পায় হেলালউদ্দীন । তবে গোলযোগ এড়ানোর জন্যই সুকৌশলে হাসির বেগ দমন করলেন।
সেতু এল। বলল, তোমার কাশি হইছে শুইনা শিবাণীদি দেবদারু গাছের ছাল দিল।
হেলালউদ্দীন-এর মুখটি প্রসন্ন হয়ে ওঠে। দেবদারু চূর্ন মধু দিয়ে খেলে উপকার ।
পরের দিন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে নায়েব আলীর ‘স’ মিলের সামনে মিঠুনকে কে দেখে থমকে দাঁড়ালেন হেলালউদ্দীন । মিঠুন একটা নীল মোটর সাইকেল ওপর বসে ছিল। মাথায় লাল হেলমেট। পরনে জিন্স। হলুদ গেঞ্জি। চোখে সান গ্লাস। মিঠুনের পাশে চেক লুঙ্গি আর মেরুন রঙের ফতুয়া পরা একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। । কালো ছেলেটির ন্যাড়া মাথা। কানে রিং।
হেলালউদ্দীন হাত তুলে ডাক দিলেন- এই, এদিকে আস তো বাবা।
মিঠুন মোটরসাইকেল থেকে নেমে আসে। হেলমেট আর সানগ্লাস খুলে কালো ছেলেটির হাতে দেয়। তারপর হেলালউদ্দীন এর কাছে এসে সালাম দেয়। শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই ছোট মফঃস্বল শহরে সুনাম আছে হেলালউদ্দীন- এর। এর পিছনে মিঠুনের বাবা আলতাফ মাষ্টার অবদান কম না। আলতাফ মাষ্টার প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক পাকিস্তানি মেজর হেলালউদ্দীন- এর পেটে বেয়োনেট চার্জ করছিল। তখন আলতাফ ভাইরা স্কুল অ্যাটাক করে হেলালউদ্দীন কে সীমান্তের ওই পাড়ে নিয়ে গেলেন। দেরি হলে বাঁচত না কিশোর হেলাল। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পর আলতাফ মাষ্টারই এই শহরে হেলালউদ্দীন-এর
মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছিলেন। মমিনুন্নেছা স্কুলের চাকরি তিনিই দিয়েছিলেন।
হেলালউদ্দীন পারফিউমের গন্ধ পান। জিগ্যেস করেন, কেমন আছ বাবা?
ভালো চাচা। আপনি?
আমি ভালো আছি বাবা। তা তোমার মায়ের শরীর কেমন?
ভালো না চাচা।
ক্যান কি হইছে ভাবিসাবের?
আম্মার আমবাত হইছে। রাইতে ঘুমাইতে পারে না।
অ। তাইলে তুলসী পাতার রস, কাঁচা হলুদের রস আর আখের গুড় মিশাইয়া খাইতে বইল। আরাম পাইবে।
আইচ্ছা বলব। বলে মিঠুন ঘুরে চলে যেতে থাকে।
হেলালউদ্দীন গম্ভীরকন্ঠে বললেন, শোন বাবা। তোমারে একখান কথা কই। সেতুরে কইলাম বোনের মতো দেখবা। কথাটা য্যান তোমার মনে থাকে । বলে হাঁটতে থাকেন হেলালউদ্দীন । অবশ্য তাঁর মিঠুনের মুখের দিকে একবার তাকানো উচিত ছিল। সম্ভবত কম্পিউটারে অতিরিক্ত মারদাঙা ছবি দেখার কারণেই হোক কিংবা অবদমিত যৌনবাসনার কারনেই হোক। মিঠুনের টকটকে ফর্সা মুখে তীব্র ক্রোধের যে বিশাক্ত লাল লাভা ছড়িয়ে পড়েছে, তা দেখে হেলালউদ্দীন হয়তো শিউরে উঠতেন ।
শুক্রবার সকালে দীপালী আর শিবাণী এল ।
শিবাণীর কোলে তোয়ালে মোড়ানো লাল টুকটুকে শিশু। সেতু আনন্দে লাফাচ্ছিল। বারান্দায় বসে ছিলেন হেলালউদ্দীন । তার শরীরেও আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। ঘরে অতিথি এলে তিনি আনন্দ পান। তখন জীবনে বড় সুখের মনে হয়। আল্লাহ মানুষ রে এই সুখের পরশ দিব বইলাই তো কত কষ্ট কইরা দুনিয়া বানাইছেন। ভাদ্রের ঝকঝকে রোদে বসে হেলালউদ্দীন ভাবেন- দুনিয়া বানাইতে আল্লার বড় মেহনত করছেন। তার হাতে কতগুলি নীলপদ্ম। ভোরবেলা সিকদারের পুকুর থেকে তুলে এনেছেন। সেতুর ঘাড়ে শ্বেতীর দাগ ফুটছে। নীলপদ্ম গরম ভাতে খেলে উপকার হয়।
শিবাণী এসে সালাম করে। শিবাণীর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করলেন হেলালউদ্দীন । পাঁচশো টাকা দিলেন। মেয়েরা রান্নাঘরে আসমার সঙ্গে গল্প করতে বসল। সেতু এসে বলে, আব্বা তুমি অখনই অসীম কাকুর দোকানে গিয়া মিষ্টি কিনা আন। দই আনবা কিন্তু। আগে আমাগো মিষ্টি দিয়া যাইবা। তারপরে বাজারে যাইবা। বড় রুইমাছ কিনবা কইলাম। দুপুরে শিবাণীদির জামাই সুশান্তদায়ে আসব।
শিবাণীর জামাই অখন কই?
কী কামে য্যান বেলায়াতপুরে গেছে।
হেলালউদ্দীন গেঞ্জি পরে ছিলেন। এখন পাঞ্জাবি পরে নিলেন। বাইরে তেতো রোদ। শরীরজুড়ে টলটলে আনন্দের অনুভূতি ছিল বলে ঘর থেকে টগবগিয়ে বেরিয়ে এলেন। ছাতা নিতে ভুলে গেলেন।
সিকদারের পুকুর ছাড়িয়ে অসীম ঘোষ-এর মিষ্টান্ন ভান্ডারটি কাছেই। রাস্তার দিকে পুকুরের পাড়টি সিমেন্টে বাঁধানো। চারদিকে ঘাট। উত্তরপ্রান্তে নিজামিয়া জামে মসজিদ। পুকুরের সবুজ পানি রোদে ঝলমল করছিল। পুকুর ভর্তি নীলপদ্ম আল ফিকে নীল আকাশের ছায়া। ঝাঁক ঝাঁক ফরিঙ উড়ছিল। পুকুর পাড়ে চেক লুঙ্গি আর মেরুন রঙের ফতুয়া পরা কালো রঙের ন্যাড়া মাথা কানে রিং পরা সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে। সে হেলালউদ্দীন কে দেখে মোবাইলে কাকে যেন কল করে। দৃশ্যটি হেলালউদ্দীন-এর চোখে পড়েনি।
অসীম ঘোষ দোকানে ছিল না। কাউন্টারে তার ছেলে জীবন বসেছিল। হেলালউদ্দীন কে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়। বলে, কাকু কি লাগব কন?
এক কেজি করে চমচম আর গুড়ের সন্দেশ ওজন করতে বললেন হেলালউদ্দীন । সেতু অসীম ঘোষের দই খেতে ভালোবাসে। সুতরাং ২ কেজি দইও কিনলেন হেলালউদ্দীন । প্রায় পাঁচশ টাকা বেরিয়ে গেল। যাক। মাঝে-মাঝে টাকা খরচ করে এত আনন্দ!
হেলালউদ্দীন বলেন, বাবা জীবন, তোমার বইনরে মাইঝা পাড়ার মিঠুনে উত্যক্ত করে। তুমি তোমার বোনরে দেইখা রাইখ।
জীবন গম্ভীর স্বরে বলল, আপনি চিন্তা কইরেন না কাকা। আমি মিঠুইনার উপর চোখ রাখুম।
নিশ্চিন্ত হইলাম বাবা।
জীবন বলল, আপনি কাকা থানায় জিডি কইরা রাইখেন। দিনকাল ভালা না।
কথাটা শুনে চাপা উত্তেজনা অনুভব করেন হেলালউদ্দীন। দ্রুত দই-মিষ্টির প্যাকেট হাতে বেরিয়ে এলেন । জিডি করা কি ঠিক হবে? হাজার হলেও মিঠুন আলতাফ মাষ্টারের ছেলে। অবশ্য সেতুর মুখটাও বুকের ভিতর ধাক্কা দিচ্ছিল। সকাল এগারোটার মতো বাজে। চরচর করে রোদ চড়ছে। শুক্রবার বলেই নির্জন রাস্তা। টুংটাং ঘন্টা বাজিয়ে দু-একটি রিকশা যাচ্ছে। এখন আবার বাজারে যেতে হবে। এই অবেলায় বাজারে ভালো মাছ পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। রূপালী নদীর পাড়ে জেলেপাড়া। তারাই রাতভর মাছ ধরে সকাল-সকাল বাজারে নিয়ে আসে । এত বেলায় কি আর তাজা মাছ পাওয়া যাবে। শিবাণীরা আসবে সেটা আগে বলবে না সেতু! মেয়েটার এখনও কান্ডজ্ঞান হল না। মেয়ের উপর বিরক্ত হন হেলালউদ্দীন ।
মিঠুন ধীরেসুস্থে মোটরসাইকেল থেকে নামল । তারপর ঠান্ডা মাথায় মোটরসাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে খবরের কাগজে মোড়ানো ধারালো একটি দা বের করে হাতে নেয় । হেলালউদ্দীন সিকদারের পুকুরের নীলপদ্ম দেখতে দেখতে হাঁটছিলেন বলে মিঠুনকে দেখতে পান নি। মিঠুন তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর হেলালউদ্দীন এর ঘাড়ে ... বাহুতে ... মাথায় .. এলোপাথারি দা চালাতে থাকে । ... যেন কুপিয়ে সে পৈচাশিক আনন্দ পাচ্ছে। যেন সে মানুষ না। ফার্নিচার ব্যবসায়ী না। কেবলি পিশাচ সে ...
কাউন্টারে বসে থেকে উন্মক্ত মিঠুনকে দেখতে পায় জীবন । ‘কাকা’ ‘কাকা’ বলে চিৎকার করে মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে আসে সে। তার আগেই সিকদার পুকুরে রক্তমাখা দা ছুঁড়ে মোটরসাইকেলে উঠে স্টার্ট দেয় মিঠুন। লোহার দায়ের ধাক্তায় পুকুরের পানিতে কাঁপন ওঠে। ঢেউয়ের দোলায় নীলপদ্মগুলি দুলছে। ... ততক্ষণে হেলালউদ্দীনের রক্তভেজা নিথর দেহটি লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে ...
উৎসর্গ: ভারসাম্য