ত্রয়োদশ শতকের ইতালির মানচিত্র
ত্রয়োদশ শতকের ইতালি ছিল ছোট ছোট নগরে বিভক্ত। এই নগরগুলি ছিল স্বাধীন এবং স্বায়ত্বশাসিত। অবশ্য রোমকেন্দ্রিক পোপের প্রতি আনুগত্য ছিল। নগর শাসন করত অভিজাত কোনও পরিবার । ছোট ছোট নগরগুলি প্রায়ই একে অন্যের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত। ত্রয়োদশ শতকের ইতালির তেমনি দুটি ছোট নগর ছিল রাভেন্না এবং রিমিনি । রাভেন্নার শাসক ছিলেন গুইদো দ্য পলেনটা এবং রিমিনির শাসক মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিও।
ইতালির মানচিত্রে রাভেন্নার অবস্থান ।
রাভেন্নার শাসক গুইদো দ্য পলেনটা রিমিনির শাসক মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিও-র সঙ্গে এক দীর্ঘকালীন সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ওইকালে দুটি পরিবারের মধ্যে পারিবারিক বিরোধ স্বাভাবিক ছিল। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকেও আমারা তাই দেখি। যা হোক। মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে অবশেষে রাভেন্না এবং রিমিনি নগরের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হল।
ইতালির মানচিত্রে রিমিনির অবস্থান।
রিমিনির মালাটেসটা পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের এই নতুন সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে চাইলেন রাভেন্নার শাসক গুইদো দ্য পলেনটা । তার কন্যা ফ্রানসেসকা। সুন্দরী। তরুণী। মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিওর বড় ছেলে গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তো মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিওর উত্তরাধিকারী । তারই সঙ্গেই ফ্রানসেসকার বিয়ের কথা ভাবলেন গুইদো দ্য পলেনটা । গুইদো দ্য পলেনটা বন্ধুরা বলল, গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তো দেখতে কুৎসিত। ফ্রানসেসকা তাকে দেখলে বিয়েতে রাজি হবে না।
তাহলে কি করা যায়?
গুইদো দ্য পলেনটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন।
বন্ধুদের একজন বলল, মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিওর ছোট ছেলেটি কিন্তু বেশ দেখতে।
কার কথা বলছ?
পাওলো মালাটেসটা।
ওহ্ । পাওলো তো সুদর্শন বটে।
সঙ্গে ফ্রানসেসকার বিয়ে দাও না কেন।
সে কি করে সম্ভব! পাওলো তো মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিওর উত্তাধিকারী নয়। আমি রাভেন্নার শাসনকর্তা।
আহা আমি তো পাওলোর সঙ্গে তো বিয়ে দিতে বলছি না।
তাহলে?
কাগজে কলমে ফ্রানসেসকা বিয়ে হবে গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তোর সঙ্গেই । বিয়ের আসরে তোমার মেয়ে দেখবে পাওলোকে।
ওহো। কি বুদ্ধি! এবার বুঝতে পেরেছি।
ক’জন পুরুষ মিলে এরকম প্রতারণার আশ্রয় নিল বটে কিন্তু তারা একবারও ফ্রানসেসকা কথা ভাবল না। কবি দান্তেও বিষয়টি উপলব্দি করতে পারেন নি। তিনি পরকীয়ার অভিযোগে ফ্রানসেসকা এবং পাওলোকে ঠিকই খ্রিষ্টীয় নরকে ঠাঁই দিয়েছেন।
যা হোক। বরের বেশে রিমিনি থেকে পাওলো রাভেন্না এল ।
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। তারপর বরযাত্রীরা ফ্রানসেসকা কে রিমিনি নিয়ে গেল ...
রিমিনির গ্রাদারা দূর্গ নগর। তৎকালে ইতালিতে প্রতিটি নগরে এরকম দূর্গ থাকত। মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিও পরিবারপরিজন নিয়ে রিমিনির গ্রাদারা দূর্গে থাকতেন।
রিমিনি এসে ফ্রানসেসকা জানতে পারল আসল ঘটনা। কুৎসিত গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তো কে দেখে আতকে উঠল। এর চে বাবা যদি আমাকে কেটে সাগরে ভাসিয়ে দিতেন। যে স্বামী প্রতারণার আশ্রয় নেয় সেই স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকার কথা নয়।
যা হোক। প্রায়ই গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তো কে ব্যবসা বানিজ্যের কাজে রিমিনি নগরের বাইরে যেতে হত । পাওলো বিবাহিত হলেও সে ফ্রানসেসকার রূপে মুগ্ধ হয়েছিল। সে ফ্রানসেসকার প্রতি ঝুঁকে পড়ল । তারা এক সঙ্গে ল্যানসেলট ও গুইনিভেরের প্রেমের কাহিনী পড়ত। ছাদে ঘুরে বেড়াত।
দান্তে মনে করতেন পাওলো এবং ফ্রানসেসকা এক সঙ্গে ল্যানসেলট ও গুইনিভেরের প্রণয় উপাখ্যান পড়ার ফলেই অবৈধ প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিল।
পাওলো আর ফ্রানসেসকার ঘনিষ্টতা জিয়ানসিওত্তো এক ভৃত্য দেখে ফেলে। কারও কারও এসব বিষয়ে উৎসাহ থাকে বেশি। ভৃত্যটিও সে প্রকারের। ভৃত্যটি জিয়ানসিওত্তোর কাছে গিয়ে সব খুলে বলে। সব শুনে জিয়ানসিওত্তো ভয়ানক ক্ষেপে উঠে এবং রিমিনি ফিরে আসে। রিমিনি পৌঁছে লুকিয়ে গ্রাদারা দূর্গে ফ্রানসেসকার কক্ষে আসে জিয়ানসিওত্তো। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। চিৎকার করে স্ত্রীকে ডাকল জিয়ানসিওত্তো । ফ্রানসেসকা এবং পাওলো দুজনই জিয়ানসিওত্তোর কন্ঠস্বর চিনতে পারল। টেনশনে ফ্রানসেসকার ফরসা মুখটি কেমন নীলবর্ণের হয়ে যায়। ও চারিপাশে তাকায়। কক্ষটির মেঝের ওপর একটি গোপন পাটাতন ( ট্র্যাপডোর) ছিল। পাটাতন তুলে নীচের একটি কক্ষে যাওয়া যায়। ফ্রানসেসকা চোখের ইঙ্গিত করলে লুকোনোর জন্য পাওলো দ্রুত সেদিকে যায়। পাটাতন সরিয়ে নীচে লাফ দিল, পাওলোর জামা পেরেকে আটকে যায়। পাওলো শূন্যে ঝুলতে থাকে।
ইউরোপীয় চিত্রকরের আঁকা ফ্রানসেসকার কক্ষে জিয়ানসিওত্তো
ফ্রানসেসকা দরজা খুলেছে।
জিয়ানসিওত্তো জিগ্যেস করে, ঘরে কে?
কই, কেউ নাই তো।
সত্যি করে বল!
মিথ্যবাদীকে কি সত্যি বলব! ফ্রানসেসকা ফুঁসে উঠে বলল।
মানে? জিয়ানসিওত্তো কে কেমন হতভম্ব দেখাল।
আমাকে ধাপ্পা দিয়ে বিয়ে কর নাই তুমি! ফ্রানসেসকা চেঁচিয়ে উঠল।
থাপ্পড় মারার জন্য হাত তুলবে জিয়ানসিওত্তো, ঠিক তখনই পাটাতনের দিকে চোখ গেল । দ্রুত কাছে গিয়ে নীচে উঁকি মেরে পাওলোকে ঝুলতে দেখল জিয়ানসিওত্তো । ততক্ষণে জিয়ানসিওত্তোর হাতে বেরিয়ে এসেছে তরবারি।
ফ্রানসেসকা দ্রুত ওদের মাঝখানে চলে আসে।
তরবারির পরা ফ্রানসেসকার বুকে বিদ্ধ হয় । ক্রোধে উন্মক্ত জিয়ানসিওত্তো
এক টানে তরবারি খুলে এবার পাওলোকে বিদ্ধ করে। তারপর কক্ষে
দুটি মৃত দেহ রেখে বেড়িয়ে যায়।
পরের দিন সকালে, ... দান্তের ডিভাইন কমেডির ভাষ্যকার চার্লস সিংলেটন লিখেছেন,amidst much weeping, the two lovers were buried in the same tomb.
রাভেন্না শহর। এককালে এ নগরে বেঁচে ছিল ফ্রানসেসকা।
তারপর কি হয়েছিল?
এ প্রসঙ্গে একজন লেখক লিখেছেন: ...Forty years later, around 1323, Paolo's son, Ramberto, claimed to have avenged his father's death by murdering Gianciotto's son and successor, Uberto, Count of Giaggolo at a banquet in his home.
চিত্রকরের তুলিতে ফ্রানসেসকা এবং পাওলো
ছবি: ইন্টারনেট
তথ্যসূত্র:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
http://scottteitsworth.tripod.com/id38.html
Click This Link
Click This Link