somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফ্রানসেসকা এবং পাওলোর রক্তাক্ত প্রণয় উপাখ্যান

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
ফ্রানসেসকা এবং পাওলো। এরা দু’জনই ছিল ইতালিয় কবি দান্তের (১২৬৫-১৩২১খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক। এদের ‘পরকীয়া’ প্রেম সম্বন্ধে দান্তে তাঁর বিখ্যাত ‘ডিভাইন কমেডি’তে উল্লেখ করেছেন। আমরা জানি, কবি ভার্জিল কে নিয়ে দান্তের মৃত্যুর পর খ্রিষ্টীয় পরলোক ভ্রমনই ডিভাইন কমেডির মূল বিষয় । ডিভাইন কমেডির ইনফার্নো পর্বে (৫.১০০.৭ ক্যান্টো) আমরা ফ্রানসেসকা এবং পাওলোকে নরকে দেখতে পাই। তাদের এই নরকবাস তাদের পরকীয়া প্রেমের জন্য। তবে একুশ শতকে ফ্রানসেসকা এবং পাওলোর মর্মান্তিক প্রণয়কাহিনীর অন্য রকম ব্যাখ্যা সম্ভব ...






ত্রয়োদশ শতকের ইতালির মানচিত্র

ত্রয়োদশ শতকের ইতালি ছিল ছোট ছোট নগরে বিভক্ত। এই নগরগুলি ছিল স্বাধীন এবং স্বায়ত্বশাসিত। অবশ্য রোমকেন্দ্রিক পোপের প্রতি আনুগত্য ছিল। নগর শাসন করত অভিজাত কোনও পরিবার । ছোট ছোট নগরগুলি প্রায়ই একে অন্যের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত। ত্রয়োদশ শতকের ইতালির তেমনি দুটি ছোট নগর ছিল রাভেন্না এবং রিমিনি । রাভেন্নার শাসক ছিলেন গুইদো দ্য পলেনটা এবং রিমিনির শাসক মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিও।



ইতালির মানচিত্রে রাভেন্নার অবস্থান ।

রাভেন্নার শাসক গুইদো দ্য পলেনটা রিমিনির শাসক মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিও-র সঙ্গে এক দীর্ঘকালীন সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ওইকালে দুটি পরিবারের মধ্যে পারিবারিক বিরোধ স্বাভাবিক ছিল। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকেও আমারা তাই দেখি। যা হোক। মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে অবশেষে রাভেন্না এবং রিমিনি নগরের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হল।



ইতালির মানচিত্রে রিমিনির অবস্থান।

রিমিনির মালাটেসটা পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের এই নতুন সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে চাইলেন রাভেন্নার শাসক গুইদো দ্য পলেনটা । তার কন্যা ফ্রানসেসকা। সুন্দরী। তরুণী। মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিওর বড় ছেলে গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তো মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিওর উত্তরাধিকারী । তারই সঙ্গেই ফ্রানসেসকার বিয়ের কথা ভাবলেন গুইদো দ্য পলেনটা । গুইদো দ্য পলেনটা বন্ধুরা বলল, গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তো দেখতে কুৎসিত। ফ্রানসেসকা তাকে দেখলে বিয়েতে রাজি হবে না।
তাহলে কি করা যায়?
গুইদো দ্য পলেনটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন।
বন্ধুদের একজন বলল, মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিওর ছোট ছেলেটি কিন্তু বেশ দেখতে।
কার কথা বলছ?
পাওলো মালাটেসটা।
ওহ্ । পাওলো তো সুদর্শন বটে।
সঙ্গে ফ্রানসেসকার বিয়ে দাও না কেন।
সে কি করে সম্ভব! পাওলো তো মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিওর উত্তাধিকারী নয়। আমি রাভেন্নার শাসনকর্তা।
আহা আমি তো পাওলোর সঙ্গে তো বিয়ে দিতে বলছি না।
তাহলে?
কাগজে কলমে ফ্রানসেসকা বিয়ে হবে গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তোর সঙ্গেই । বিয়ের আসরে তোমার মেয়ে দেখবে পাওলোকে।
ওহো। কি বুদ্ধি! এবার বুঝতে পেরেছি।
ক’জন পুরুষ মিলে এরকম প্রতারণার আশ্রয় নিল বটে কিন্তু তারা একবারও ফ্রানসেসকা কথা ভাবল না। কবি দান্তেও বিষয়টি উপলব্দি করতে পারেন নি। তিনি পরকীয়ার অভিযোগে ফ্রানসেসকা এবং পাওলোকে ঠিকই খ্রিষ্টীয় নরকে ঠাঁই দিয়েছেন।
যা হোক। বরের বেশে রিমিনি থেকে পাওলো রাভেন্না এল ।
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। তারপর বরযাত্রীরা ফ্রানসেসকা কে রিমিনি নিয়ে গেল ...




রিমিনির গ্রাদারা দূর্গ নগর। তৎকালে ইতালিতে প্রতিটি নগরে এরকম দূর্গ থাকত। মালাটেসটা দ্য ভেরুচ্চিও পরিবারপরিজন নিয়ে রিমিনির গ্রাদারা দূর্গে থাকতেন।

রিমিনি এসে ফ্রানসেসকা জানতে পারল আসল ঘটনা। কুৎসিত গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তো কে দেখে আতকে উঠল। এর চে বাবা যদি আমাকে কেটে সাগরে ভাসিয়ে দিতেন। যে স্বামী প্রতারণার আশ্রয় নেয় সেই স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকার কথা নয়।
যা হোক। প্রায়ই গিয়োভান্নি জিয়ানসিওত্তো কে ব্যবসা বানিজ্যের কাজে রিমিনি নগরের বাইরে যেতে হত । পাওলো বিবাহিত হলেও সে ফ্রানসেসকার রূপে মুগ্ধ হয়েছিল। সে ফ্রানসেসকার প্রতি ঝুঁকে পড়ল । তারা এক সঙ্গে ল্যানসেলট ও গুইনিভেরের প্রেমের কাহিনী পড়ত। ছাদে ঘুরে বেড়াত।



দান্তে মনে করতেন পাওলো এবং ফ্রানসেসকা এক সঙ্গে ল্যানসেলট ও গুইনিভেরের প্রণয় উপাখ্যান পড়ার ফলেই অবৈধ প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিল।

পাওলো আর ফ্রানসেসকার ঘনিষ্টতা জিয়ানসিওত্তো এক ভৃত্য দেখে ফেলে। কারও কারও এসব বিষয়ে উৎসাহ থাকে বেশি। ভৃত্যটিও সে প্রকারের। ভৃত্যটি জিয়ানসিওত্তোর কাছে গিয়ে সব খুলে বলে। সব শুনে জিয়ানসিওত্তো ভয়ানক ক্ষেপে উঠে এবং রিমিনি ফিরে আসে। রিমিনি পৌঁছে লুকিয়ে গ্রাদারা দূর্গে ফ্রানসেসকার কক্ষে আসে জিয়ানসিওত্তো। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। চিৎকার করে স্ত্রীকে ডাকল জিয়ানসিওত্তো । ফ্রানসেসকা এবং পাওলো দুজনই জিয়ানসিওত্তোর কন্ঠস্বর চিনতে পারল। টেনশনে ফ্রানসেসকার ফরসা মুখটি কেমন নীলবর্ণের হয়ে যায়। ও চারিপাশে তাকায়। কক্ষটির মেঝের ওপর একটি গোপন পাটাতন ( ট্র্যাপডোর) ছিল। পাটাতন তুলে নীচের একটি কক্ষে যাওয়া যায়। ফ্রানসেসকা চোখের ইঙ্গিত করলে লুকোনোর জন্য পাওলো দ্রুত সেদিকে যায়। পাটাতন সরিয়ে নীচে লাফ দিল, পাওলোর জামা পেরেকে আটকে যায়। পাওলো শূন্যে ঝুলতে থাকে।



ইউরোপীয় চিত্রকরের আঁকা ফ্রানসেসকার কক্ষে জিয়ানসিওত্তো

ফ্রানসেসকা দরজা খুলেছে।
জিয়ানসিওত্তো জিগ্যেস করে, ঘরে কে?
কই, কেউ নাই তো।
সত্যি করে বল!
মিথ্যবাদীকে কি সত্যি বলব! ফ্রানসেসকা ফুঁসে উঠে বলল।
মানে? জিয়ানসিওত্তো কে কেমন হতভম্ব দেখাল।
আমাকে ধাপ্পা দিয়ে বিয়ে কর নাই তুমি! ফ্রানসেসকা চেঁচিয়ে উঠল।
থাপ্পড় মারার জন্য হাত তুলবে জিয়ানসিওত্তো, ঠিক তখনই পাটাতনের দিকে চোখ গেল । দ্রুত কাছে গিয়ে নীচে উঁকি মেরে পাওলোকে ঝুলতে দেখল জিয়ানসিওত্তো । ততক্ষণে জিয়ানসিওত্তোর হাতে বেরিয়ে এসেছে তরবারি।
ফ্রানসেসকা দ্রুত ওদের মাঝখানে চলে আসে।
তরবারির পরা ফ্রানসেসকার বুকে বিদ্ধ হয় । ক্রোধে উন্মক্ত জিয়ানসিওত্তো
এক টানে তরবারি খুলে এবার পাওলোকে বিদ্ধ করে। তারপর কক্ষে
দুটি মৃত দেহ রেখে বেড়িয়ে যায়।
পরের দিন সকালে, ... দান্তের ডিভাইন কমেডির ভাষ্যকার চার্লস সিংলেটন লিখেছেন,amidst much weeping, the two lovers were buried in the same tomb.



রাভেন্না শহর। এককালে এ নগরে বেঁচে ছিল ফ্রানসেসকা।

তারপর কি হয়েছিল?
এ প্রসঙ্গে একজন লেখক লিখেছেন: ...Forty years later, around 1323, Paolo's son, Ramberto, claimed to have avenged his father's death by murdering Gianciotto's son and successor, Uberto, Count of Giaggolo at a banquet in his home.






চিত্রকরের তুলিতে ফ্রানসেসকা এবং পাওলো

ছবি: ইন্টারনেট

তথ্যসূত্র:

Click This Link
Click This Link
Click This Link
http://scottteitsworth.tripod.com/id38.html
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ৮:০০
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×