হল্যান্ডের মানচিত্রে লিউওয়াডেন -এর অবস্থান ।
মাতাহারির পারিবারিক নাম মার্গারিটা গ্রিটুইডা জেল্যে। ১৮৭৬ সালের ৭ অগস্ট হল্যান্ডের লিউওয়াডেন- এ মার্গারিটার জন্ম। মা ছিল জাভানিজ (মানে জাভা দ্বীপের অধিবাসী । ওই সময়ে ইন্দোনেশিয়া হল্যান্ডের কলোনি ছিল বলেই এরকম বিবাহ সম্ভব হয়েছিল ।) ...মা জাভানিজ বলেই মার্গারিটার মুখে এক ধরণের ভিন্ন সৌন্দর্য ছিল-যা ইউরোপে আদৃত হয়েছিল। মার্গারিটার বাবা টুপির ব্যবসা করতেন। অবস্থা বেশ সচ্ছলই ছিল। বালিকা মার্গারিটা ভালো স্কুলে পড়ত। বালিকার মনটি ছিল শিল্পপ্রবণ। নাচগান ভালো লাগত। গাইতে পারত, নাচতেও পারত। হয়তো একা একা নাচত।
বালিকা মার্গারিটার শৈল্পিক মনের প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীকালে মাতাহারির নৃত্যজীবনে
মার্গারিটার যখন তেরো বছর বয়স তখন সংসারে বিপর্যয় নেমে এল। বাবা দেউলিয়া হয়ে গেল। তারপর মা-বাবার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটল। তবে মার্গারিটার একজন অভিভাবক ছিল। তারই সহযোগিতায় স্কুলের পড়াশোনা চালিয়ে যায় মার্গারিটা। কিন্তু স্কুলের হেডমাস্টার কিশোরী মার্গারিটার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। তারপর আর মার্গারিটার পড়া হয়নি। ...
ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। ওই সময়ে,অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষে ইন্দোনেশিয়া ছিল হল্যান্ডের কলোনি ।
মার্গারিটার বয়স তখন ১৮ ... পুরুষেরা সব শরীর ঘিরে ঘুরঘুর করে । মার্গারিটা একে সুন্দরী, তার ওপর হাঁটাচলায় নৃত্যের ছন্দ। ১৮ বছরের এক কিশোরী পুরুষশাসিত পৃথিবীতে একা। (হয়তো সেই অভিভাবকটিও লোলুপ হয়ে উঠছিল।) ... একজন শক্ত সমর্থ পুরুষের নিরাপত্তা বলয় অনুভব করছিল মার্গারিটা। এক বিজ্ঞাপনে বিয়ের আহবানে সাড়া দিল। ডাচ আর্মির সামরিক অফিসার কর্নেল ক্যাম্পবেল ম্যাকলয়েড। তিনি বিয়ে করতে চান। কর্নেলের বয়স মার্গারিটার চেয়ে ২০ বছরের বেশি। কিন্তু কিছু করার নেই। ১৮৯৫ সালের ১১ জুলাই বিয়ে হল ।
জাভা। জাভা থাকতেই প্রাচ্যনাচ শিখেছিল। মাতাহারি নামটি তখনই নিয়েছিল। জাভানিজ ভাষায় শব্দটির অর্থ ‘সূর্যর চোখ’।
বিয়ের চার মাস পর স্বামীর সঙ্গে জাভা এল মার্গারিটা । একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হয়। তবে একটি বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে। শিশুদের নার্সের প্রেমিক শিশু দুটিকে কী কারণে বিষ খাওয়ায়। কারণটি ঠিক জানা যায়নি। যাই হোক। মেয়েটি বেঁচে গেলেও ছেলেটি মারা যায়। এরপর পারিবারিক দিক থেকে ঘনিয়ে আসে ভাঙন। ক্যাম্পবেল ম্যাকলয়েড এ্যালকোহোলিক হয়ে ওঠে। সব সময় মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকে ।
এই ওরিয়েন্টাল নৃত্যের ভঙ্গির পিছনে কষ্ট অনেকেই বোঝেনি
মার্গারিটা হল্যান্ডের রাজধানী আমসট্রাডাম চলে আসে। মদ্যপ স্বামীর সঙ্গে সংসার করা কঠিন। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে ১৯০৬ সালে । মেয়েটি অবশ্য বাবার কাছেই রয়ে গেল। ... এরপর পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াল মার্গারিটা । নাম বদলে রাখল মাতাহারি। জাভায় শেখা নাচ নিয়ে বার্লিন থেকে প্যারিস ছুটে বেড়াল। সেই সঙ্গে মাতাহারি নামটিও ইউরোপে তীব্র আলোরন তুলল। মাতাহারিকে ঘিরে কেমন এক রহস্যময়তা ছড়াল।
মাতাহারির নৃত্যের ভঙ্গিমায় ও পোশাকে প্রাচের ছিল উপাদান। যেমন, মুকুট, নেকাব। সারং।
মাতাহারির নৃত্যের পটভূমিকায় ভারতীয় নৃত্যের উপাদানও ছিল। এবং সেটি কত্থক কথাকলি কিংবা মনিপুরী নয়। ধরা যাক শিবমন্দিরের স্বল্পবসনা সেবাদাসী গাইছে নজরুলের গান ...
অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে
কিংবা রবীন্দ্রনাথের
এসো শ্যামলও সুন্দরও
নৃত্যের ভঙ্গিমায় যথেষ্ট ইরোটিক উপাদান ছিল । এটি সম্ভবত মাতাহারিরই ইনোভেশন। নৃত্যকে কি একটি পর্যায়ে উপনীত করতে চেয়েছিল শিল্পপ্রবণ নারীটি, যার তার দীর্ঘকালীন চিন্তার ফসল? যাই হোক। নাচের চেয়ে শরীর বড় হয়ে উঠল। (ভারতীয় টেনিস তারকা সানিয়া মির্জার ক্ষেত্রেও তাই দেখেছি আমরা) মাতাহারির নিটোল কোমল অর্ধ-প্রকাশিত ছন্দোবদ্ধ শরীরটির চারপাশে কামার্ত পুরুষের ভিড় বাড়ে। লাস্যময়ী নারীকে কাছে পেতে চায়। মাতাহারি জীবনভর নিরাপত্তার অভাব অনুভব করেছে। স্বামী সুখ কপালে সইল না। ছেলে মারা গেল। মেয়েকেও কাছে পেল না। সে কি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল? হয়ে উঠেছিল অতিরিক্ত লাস্যময়ী? মাহাহারির প্রেমিক পুরুষেরা অধিকাংশ ধনী ব্যবসায়ী। এরাই মাতাহারির বিলাসবহুল জীবনের ব্যয় নির্বাহ করতে লাগল। এদের মধ্যে সামরিক অফিসার থাকাও তো বিচিত্র নয় ...
প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রণাঙ্গনের ছবি। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন সারাজেভোতে অষ্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সিংহাসনের উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফার্দিনান্দের গুপ্তহত্যার মাধ্যমে প্রথম মহাযুদ্ধ সূত্রপাত হয়। ক্রমশ ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পালটে দেয়। তার অনিবার্য উত্তাপ পড়েছিল মাতাহারির জীবনেও ...
প্রথম মহাযুদ্ধে হল্যান্ড ছিল নিরপেক্ষ। মাতাহারি হল্যান্ডের নাগরিক। কাজেই যুদ্ধকালীন সময়ে মাতাহারির পক্ষে ইউরোপীয় সীমান্ত অতিক্রম করা সহজ ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নাচের দল নিয়ে জার্মান যেত মাতাহারি । ওখানে তার অনেক অনুরাগী ছিল। অনুরাগীদের মধ্যে জার্মান সামরিক অফিসার থাকাও তো বিচিত্র নয়।
একজন চিত্রকর মাতাহারির ছবি আঁকছে
মাতাহারির ঘনঘন জার্মানি যাওয়ার বিষয়টি ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগের নজরে আসে। মাতাহারি ফরাসি না-হওয়ায় তাদের সন্দেহ হয়। মাতাহারিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। যা হোক। স্পেনও প্রথম মহাযুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল। ফরাসি গোয়েন্দারা স্পেনে জার্মান নৌ ও সামরিক স্থাপনার খবরাখবর জানার জন্য মাতাহারিকে নির্দেশ দেয়। এ লেখার শুরুতে বলছিলাম যে মাতাহারি জীবন বিশ্লেষন করলে মনে হয় মাতাহারি আসলে একজন প্রকৃত শিল্পী, যার জীবন পুরুষতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে বিসর্জন দিতে হয়েছিল। পরে আবার ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগ মাতাহারিকে ডবল এজেন্ট ভাবে।একজন লেখকের ভাষায়: It appears (the details are vague) that British intelligence picked up details of Mata Hari's arrangements with the German consul and passed these to their French counterparts... মাতাহারি বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছিল গুপত্তবৃত্তির ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? মাতাহারিকে ঝুঁকিপূর্ন জীবনে ঠেলে দিয়েছিল ফরাসি গুপ্তচর বিভাগ।
১৯৩১ সালে মাতাহারি ছবির পোস্টার। মাতাহারির চরিত্রে অভিনয় করেছেন গ্রেটা গার্বো।
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাতাহারি ফ্রান্সে ফিরে এলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাতাহারি জার্মান গুপ্তচর-এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। বিচার চলাকালীন সময়ে মাতাহারি অবশ্য কিছু প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি। মাতাহারির মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। রায়ে বলা হল ওই বছরই, অর্থাৎ, ১৯১৭ সালের ১৫ অক্টোবর একটি ফরাসি সামরিক ঘাঁটির ফায়ারিং স্কোয়াডে কার্যকর করা হবে।
সূর্যের চোখ।
মাতাহারির জীবনের শেষ দিনটিতে ব্রিটিশ সাংবাদিক হেনরি ওয়ালেস উপস্থিত ছিলেন। আমি তারই বয়ানে মাতাহারির শেষ দিনটির কথা উপস্থাপন করছি। ‘... বিচার শেষে মাতাহারিকে রাখা হয়েছিল প্যারিসের সেন্ট লাজা কারাগারে। যখন আমরা ভোরে সেলে ঢুকলাম তখন মাতাহারি ঘুমাচ্ছিল। শান্ত সুখের ঘুম। আমার সঙ্গে ছিল ফাদার আরাবু, দুজন নান, ক্যাপ্টেইন বাওচাদোও এবং একজন আইনজীবি।
একজন নান তাকে ডেকে তুলল। বলল, সময় হয়েছে।
সুন্দরী রমনীকে আমার লৌহ মানবী বলে মনে হল। বিন্দুমাত্র টলেনি। শুধু বলল, আমি কি দুটি চিঠি লিখতে পারি?
হ্যাঁ। ক্যাপ্টেইন বাওচাদোও মাথা নাড়লেন।
তাকে কালি কলম আর কাগজ দেওয়া হল। বিছানার কিনারে বসে খসখস করে দ্রুত চিঠি লিখল। লেখা শেষ হলে চিঠি আইনজীবিকে দিল। তারপর হাই হিল পরে নিল, আর লম্বা মোজা। তাতে বেঁধে নিল রেশমী রিবন। তারপর উঠে দাঁড়াল। পরনে রেশমী কিমোনো। তার ওপর লম্বা কালো ভেলভেটের কোট পরে নিল। যার কোণগুলি পশমে জড়ানো। কৃষ্ণ কালো চুল বেণী। বড় কালো ফেল্ট হ্যাট পরল। তারপর কালো দস্তানা পরে বলল, আমি তৈরি।
আমরা সেল থেকে বেড়িয়ে এলাম।
গাড়ি তৈরি ছিল।
নৃত্যরতা মাতাহারি।
গাড়ি ঘুমন্ত প্যারিস নগরী অতিক্রম করছে। সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে। সূর্য তখনও ওঠেনি। মনে পড়ল মাতাহারি মানে: ‘সূর্যর চোখ।’ জাভায় থাকার সময় শব্দটি মানে জেনেছিল। নাচ শিখেছিল জাভায়। অনেক ঘটনা ঘটেছিল জাভায়। ছেলেটি মারা গেল। মেয়েটি অবশ্য বেঁচে গেল। মেয়েটি এখন বাবার কাছে আছে। জীবনের অন্তিম লগ্নে পৌঁছে নিশ্চয়ই মেয়েটির কথা ভাবছে মাতাহারি।
... আমরা প্যারিসের উপকন্ঠে একটি পুরোনো দূর্গের কাছে পৌঁছে গেলাম। দূর্গের নাম: Caserne deVincennes । দূর্গের ব্যারাকের কাছে গাড়ি থামল। সবাই নেমে এলাম। মাতাহারি শেষে নামল। দেখি বারো জন সৈন্য রাইফেল হাতে লাইন করে দাঁড়িয়ে। তাদের পিছনে একজন অফিসার দাঁড়িয়ে। হাতে তরবারি। সৈন্যদের পিছনে একটি অনুচ্চ টিলা। গুলি মিস হলে ওই টিলায় বিঁধবে।
একজন সৈন্য এক প্রস্ত সাদা কাপড় নিয়ে এগিয়ে এল।
আমি চোখ বাঁধব না। মাতাহারি বলল। আর সিধে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ রাইফেল হাতে অপেক্ষমান সৈন্যদের দিকে।
তরবারি হাতে সেই অফিসারটি চিৎকার করে নির্দেশ দিল।
একসঙ্গে বারোটি রইফেল গর্জে উঠল।
নতর্কী ঢলে পড়ে যায় ...
ফায়ারিং স্কোয়াড। ১৯২০ সালের একটি ছবির দৃশ্য।
মাতাহারির প্রাক্তন স্বামী ক্যাম্পবেল ম্যাকলয়েড পরবর্তীকালে বলেছিল ...মার্গারিটার যতই দোষ থাকুক। তার এমন পরিণতি কাম্য নয়।
হ্যাঁ। মাতাহারি মদ্যপ স্বামীর চোখে দোষীই ছিল। মেয়েটিকে আইনগতভাবে নিজের কাছে রাখার জন্য অনেক চেস্টা করেছিল। পারেনি। স্কুলে যাওয়া পথে একবার অপরহন করতে চেষ্টা করেছিল । তাতেও সফল হয়নি ...
এই, মাতাহারির জীবনের গল্প।
ছবি।ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র।
http://www.firstworldwar.com/bio/matahari.htm
http://www.imdb.com/name/nm1299792/bio
http://www.mata-hari.com/mata-hari-en.html
Click This Link
Click This Link
Click This Link