নৌকা উজানীর ঘাটে ঠেকেছে। একতারা হাতে ধীরেসুস্থে নৌকা থেকে নামতে যাবেন- গড়াই নদীর প্রবল বাতাসে নৌকা টলে উঠতেই লালনের ৮৪ বছরের শীর্ণ শরীরটি একবার টাল খেল। একটি খালি গা ধুতি পরা কালো রঙের লিকলিকে বালক বৃদ্ধ বাউলকে জাপটে ধরে। ... লালন অধরা মানুষের পরম স্পর্শ পেলেন। আজকাল এসব ঘটনায় বৃদ্ধ বাউলটির চোখে জল এসে যায়।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ। আশ্বিন মাস। এখন এই পূর্বাহ্নের নীলাভ আকাশ থেকে ধবল আলোর ঢল নেমে আসছিল গড়াই নদীর বুকে ... উজানীর চরে। গড়াই নদীর এই চরে আজই প্রথম এলেন লালন। আজ এই চরে আসবার পিছনে তেমন কোনও উদ্দেশ্য নেই। মাঝে-মাঝেই চুপিসারে আখড়া থেকে বেরিয়ে যান লালন। আশেপাশের অপরিচিত পাড়াগাঁয়ে ঘুরে বেড়ান। একা একা ...
গতমাসে গিয়েছিলেন হরিণাকুন্ড। যায়গাটা কুষ্টিয়া সদরের দক্ষিণে। এক ছায়াঢাকা পুরাতন খালের পারে রাধা বৈষ্ণবীর ভিটা। সত্তরের মতো বয়েস রাধা বৈষ্ণবীর। অপূর্ব দেবদত্ত কন্ঠস্বর। রাধা বৈষ্ণবীর কন্ঠে গোষ্ঠলীলার গীত শুনে লালন অশ্রু সম্বরণ করতে পারেননি:
গোঠে আমি যাব মাগো গোঠে আমি যাব।
শ্রীদাম সুদাম সঙ্গে বাছুরি চরাব।
চূড়া বান্ধি দে গো মা মুরলী দে মোর হাতে
আমার লাগিয়া শ্রীদাম দাঁড়ায়্যা রাজপথে।
লালনও গভীর আবেগের বশে চড়া গলায় গান ধরেছিলেন:
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখ না রে মন চেয়ে।
দেশ-দেশান্তর দৌড়ে এবার
মরিস কেন হাঁপিয়ে।
গানখানা যেন্ রাধা বৈষ্ণবী রে অবশ কইরে দিয়েছেল। চোখের জল ফেলতি-ফেলতি আমার পদধুলি নিল বৈষ্ণবী।
আজ ভোর ভোর সময়ে আখড়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গড়াই নদীর ঘাটে বসেছিলেন লালন। একা। মনের ভাব খানিকটা উদাস এবং বিষন্নই ছিল। কদিন ধরে চারটে পদ মাথায় ঘুরছিল। আমি একা রইলাম ঘাটে / ভানু সে বসিল পাটে / তোমা বিনে ঘোর সঙ্কটে/ না দেখি উপায় ...কিন্তু এভাবে তো গান শুরু করা যায় না। গানের শুরুর জন্য একখান যুৎসই গৌড়চন্দ্রিকা দরকার। সেটাই তৈরি করতে পারছিলেন না। লালন আপনমনে হাসলেন। ভাবলেন: বঙ্গের মানুষ ... তুমরা আমার গান শুনবা। কিন্তু আমার গান লয়ে আমার বিস্তর পেরেশানির খবর কি তুমরা লবা?
ঘাটে একটা নৌকায় যাত্রীরা উঠছিল। হঠাৎ কী মনে করে উঠে দাঁড়ালেন লালন। তারপর নৌকায় উঠে বসলেন। মুচকি মুচকি হাসছিলেন।
ভাবখানা এমন ... দেখি কোন্ ঘাটে ঠেকে নৌকা। তারপর সে নৌকা এখন ঠেকল এসে উজানীর চরের ঘাটে। বেলা হলি পর শিষ্যরা খুঁজবে। খুঁজুক। মাঝে মাঝে শিষ্যদের ফাঁকি দিয়ে হারিয়ে যান লালন। এই ৮৪ বছর বয়েসেও ...
নৌকার যাত্রীরা ঘাটে নেমে যে-যার গন্তব্যে চলে গেছে। শূন্য নৌকা আবার নতুন যাত্রীতে ভরে উঠেছে । মাঝি নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। নৌকা আবার কখন আসে কে জানে!
এখন ঘাটে নেমে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন লালন। দেখলেই বোঝা যায় উজানীর চরটি বেশ পুরনো । শক্ত দোআঁশ মাটি কেটে কয়েক ধাপ ঘাট তৈরি করা হয়েছে । ঘাটের দু’পারে বিস্তারিত কাশবন। বাতাসে সাদা সাদা কাশফুলেরা দুলছিল। দেবী মায়ের আসার সময় হল। কাল্পনিক ঢাকের আনন্দিত বোলও যেন শুনলেন বৃদ্ধ বাউলটি।
ঘাট ছেড়ে উঠে এলেই একটা মস্ত নিম গাছ। তারই তলায় একখানা খড়ের চালাঘর। চালাঘরটি বেশ বড়োসরো। চারপাশে দেয়াল-টেয়াল নেই। মাটির ভিতখানি বেশ উঁচু। তাতে কয়েকটি বাঁশের বেঞ্চি পাতা। চালাঘরে যাত্রীরা বসে জিরিয়ে নেয়।
লালন ধীরেসুস্থে বেঞ্চে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখের সামনে ঘোলা জলের গড়াই নদীটি শ্রাবণের ঝকঝকে রোদে স্পষ্ট। নদী উপরে নীল রঙের একখানি বিস্তারিত আকাশ। পাগলা বাতাস উড়িয়ে নিচ্ছিল শুভ্র মেঘ। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্ষণিকের জন্য আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন লালন। কি আছে আকাশের ওই পারে? অধরা মানুষ? কিন্তু অধরা মানুষ তো বাস করে এই দেহে ...
অধরা মানুষ যে মানবদেহে বাস করে-এই কথাটা আলমপুরের তারক নস্কর বিশ্বাস করে না। তারক নস্কর বয়েসে লালনের দু-এক বছরের বড়ই হবে । লালনের তরুণ বয়েসের সঙ্গী তারক নস্কর। জাতে বৈদ্যি। তরুণ বয়েসে গড়াইপাড়ের জঙ্গলে একসঙ্গে কত কত দিন ভেষজ লতাপাতার সন্ধানে কেটেছে।
লালন তারক নস্কর কে শুধান , অধরা মানুষ মানবদেহে বাস করে না?
না। নস্কর বিশ্বাস মাথা নেড়ে কন।
তাহলে গান করে কিডা? লালন হেসে শুধান।
আরে বেটা গান করস তুই! বলে তারক নস্কর লালনের কাঁধে থাবড়া মারেন। তারপর ফোকলা দাঁতে হাসেন।
তাইলে এই আমিডা কিডা? লালন কয়।
তারক নস্কর ঠিক এই জায়গায় এসে খাবি খায়। তার খেল খতম হয়ে যায়। তার পুঁজিপাট্টা শেষ হয়ে যায়। বয়স তো অনেক হল। কে আমি? এই প্রশ্নের উত্তর তো আইজও জানা হৈল না ।
চালাঘরে বসে থেকে অনেকটা সময় কাটল।
মধ্যাহ্নে একটা লোক এসে ঢুকল চালাঘরে। তারপর বেঞ্চির ওপর বসল। লোকটি মাঝবয়েসি । খালি গায় ধুতিপরা লোকটা বেশ থলথলে শরীর। ফর্সা। । এক মুখ কাঁচাপাকা দাড়ি । হাতে হুঁকো। বেঞ্চের উপর পা তুলে বসে গুড়গুড় করে হুঁকো টানতে লাগল লোকটা। বেশ অবস্থা সম্পন্ন বলে মনে হয়। পা তুলে বসার ভঙ্গিতে কেমন নিশ্চিন্ত ভাব। তবে লালনকে চেনার কোনও লক্ষণই নেই।
লালনকে যে এ অঞ্চলের সবাই চেনে এমন না। হয়তো অনেকেই লালনের গান শুনেছে।কিন্তু স্বচক্ষে দেখেনি। তার ওপর উজানীর চরটি কুষ্টিয়া সদর থেকে অনেকটা দক্ষিণে। অনেকটা বিচ্ছিন্ন। চরবাসী সামান্য আহার-সংস্থানের জন্য নিত্য সংগ্রামে রত । এদের গানের বাণী ও সুরের দিকে মুখ তুলে তাকানোর ফুরসৎ কই ! লালন অভিজ্ঞতায় জানেন, সমাজের সামান্য অংশই গানের জন্য উতলা বোধ করে। তার বাইরে অধিকাংশের জীবন একেবারেই অন্যরকম।
মশায়ের নাম? লোকটি গলা খাঁকারি দিয়ে জিগ্যেস করল। ধোঁয়ায় ঢেকে আছে লোকটা মুখ।
আজ্ঞে, আমার নাম লালন। লোকে আমারে কয় লালন ফকির ...
লোকটা হুঁকো মুখে তুলতে যাবে, হুঁকোসুদ্ধো হাতটা থমকে গেল। হেসে বলল, ওহো। আপনেই লালন ফকির?
আজ্ঞে, হ্যাঁ।
লোকের মুকে আমি আপনার নাম শুনেছি শাঁইজী। তবে গান কখনও শুনিনি ।
লালন হাসলেন। লোকটা আমার গান শুনেনি বলল। তারপরও লোকটা গান শুনতে চাইল না। বরং হুঁকো টানতে লাগল। সংসারের বেশির ভাগ মানুষই এমন ধারার । অজ্ঞান। বেহুঁশ। তারা সৌন্দর্যের তত্ত্বতালাশ করে না। এই লোকটাও তেমনি। এই জনমে এর জ্ঞান ফিরবি নে। লালন গান গেয়ে লোকেদের হুঁশ ফেরান । বলেন, দেখ, জগতে দুঃখ থাকলেও জগৎ কত সুন্দর ...
লোকটা বলল, শাঁইজী। আমার নাম নিবারণ চাকী। জাতে কায়স্থ।
হুমম। ছোট্ট শ্বাস ফেললেন লালন। মনে মনে বললেন, তোমার জাতের পরিচয় কে জানতে চেয়েছে?
নিবারণ চাকী বলে, আমরা দু-পুরুষর ধইরে এই উজানীর চরে বাস করে আসছি। পূর্বে আমাদিগের ভিটেমাটি ছেল মজমপুর পরগনার ধলা-শুরেশ্বর মৌজায়। বাপদাদার মুখে শুনিছি, তাদের মজমপুরের দিনগুলি নাকি সুখেই যাচ্ছিল। তারপর নয়নপুরের আশু ঘোষ মামলা ঠুকে দেলেন। আমার ঠাকুরর্দা মুকুন্দ চাকী সে মোকদ্দমায় হেইরে ছাওয়াল-পাওয়াল লয়ে এই উজানীর চরে আসি ঠাঁই নিলেন। সেই থেকে আমরা এই চরেই আছি। ভগবান সুখে রেখেছেন। তৃতীয় পুরুষ বসে বসে খাচ্ছে।
লালন মন দিয়ে শুনছিলেন। মানুষের মনের কথা তিনি মন দিয়েই শোনেন। যদি সেই মনের কথার ভিতরে অধরা মানুষের কোনও সূত্র পাওয়া যায়। জনমভর অধরা মানুষের সন্ধান করে গেলেন লালন। সেই অধরা মানুষের খোঁজ মিলল না আজও ...
চালাঘরের বাইরে রোদ ঝকমক করছিল। এক বৃদ্ধাকে ঘাটের দিকে যেতে দেখা গেল। ছোটখাটো গড়ন বৃদ্ধার। গায়ের রংখানি ঘঁসা পিতলের মতন। মাথার পাকা চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। পরনে সাদা থানের শাড়ি। বিধবা বলেই মনে হল। হাঁটার ধরণটি ঠিক স্বাভাবিক নয়। কেমন টাল খেতে খেতে চলেছে। শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই।
নিবারণ চাকী গলা তুলে বলল, ওহে বিধু পিসি, শম্ভুর মাথা ঠান্ডা হইল? আর কত পথে পথে ঘুরবা? যাও. এইবার ঘরে ফিরা যাও।
বৃদ্ধা উত্তর না দিয়ে হাঁটতে থাকে। কথাটা শোনেনি মনে হল। একবার এদিকে তাকালোও না। কিন্তু কে শম্ভু? বৃদ্ধার বেশ হাঁটার ধরণ কেন ওরকম ?
লালন নিবারণ চাকীর দিকে তাকালেন।
নিবারণ চাকী এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ওই বুড়ি হইল বিধুবালা দাসী। সম্পর্কে আমার দূর সম্পর্কের পিসিমা। বিধুপিসি বছর পাঁচেক হইল বিধবা হইয়েছেন। ছেলের সংসারেই থাকত। ছেলে শম্ভু আর তার বউ উঠতে বসতে বিধুপিসিরে গাইলমন্দ করত। শম্ভুর কাপড়ে ব্যবসা। এদানীং মোকাম করছে পাবনায়। পোলাডার নতুন পয়সা হইয়েছে। তো দিন কতক হইল বউয়ের পরামর্শে মায়েরে ঘর থেইকে তাড়িয়ে দিছে শম্ভু।
লালন শরীরে শীতলস্রোত টের পেলেন। জীবের এই দুঃখ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লালন।
নিবারণ চাকী হুঁকো টানে। তারপর বলে, বিধুপিসি এখন পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও আশ্রয় জুটছে না।
কেউ আশ্রয় দিল না?
কে আশ্রয় দিব শাঁইজী? বিরাণ চরে বলদের খাওয়াও জোটে না। বলে হুঁকো টানতে থাকে নিবারণ চাকী।
লালন অনেক ক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন। গড়াই নদী থেকে লোনা হাওয়ারা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃদ্ধ বাউলের উপর। সে হাওয়ায় তামাকের গন্ধ ঘুরপাক খায়। সহসা লালন টের পেলেন ... পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে। চারটি পদ যেন সুরের রূপ ধরে মাথায়-
বিধাতা সংসারের রাজা
আমায় করে রাখলেন প্রজা।
কর না দিলে দেয় গো সাজা
কারও দোহাই মানে না।
বেলা পড়ে আইসে। আমি এখন যাই গো শাঁইজী। আমার ছোটমেয়েটির জ্বর। তামুক খাইতেই বাইর হইছিলাম। বলতে বলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল নিবারণ চাকী।
তারপর চলে যায় থলথলে লোকটা ।
লালন আরও কিছুক্ষণ বসে থাকেন। গুম হয়ে আছেন। হেঁটে হেঁটে উজানীর চরটা ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে ছিল। সেই ইচ্ছেটা মরে গেছে। বৃদ্ধ বাউল দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আকাশের দিকে তাকান। ধীরে ধীরে আকাশে রং বদলে যাচ্ছে। আখড়াবাড়ির সকলে চিন্তা করছে । আজ বিকেলের দিকে ঝাউদিয়া থেকে রহিম বাউলের আসবার কথা। গতকাল বিকেলে জাগতি হাটে রহিম বাউলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল দুদ্দুর। সেই কাল রাতে বলল, রহিম বাউল কি নাকি পদ বেঁধেছে। আপনারে শোনাতে চায় শাঁইজী।
লালন উঠে দাঁড়ালেন।
তারপর ঘাটের দিকে ধীয় পায়ে হাঁটতে লাগলেন।
বুকের ভিতরে অথই শূন্যতা। এই মুহূর্তে তিনি প্রাণপন কিছু একটা বিশ্বাস করতে চাইছেন। পারছেন না। মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। জগতে জীবের এই কষ্ট!
ঘাটের এক পাশে বিধুবালা দাসী বসে রয়েছে। বৃদ্ধার বসে থাকার ভঙ্গিটি ভারি করুণ। ফাঁকা ঘাট। নৌকা এখনও ঘাটে এসে ভিড়েনি । যাত্রীদের ভিড় নেই। লালন, বিধুবালা দাসীর সামান্য তফাতে, বসলেন। মন বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছে। অসাড় ঠেকছে। বিধুবালা দাসী কে তার ছেলে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বৃদ্ধা এখন পথে পথে ঘুরছে। এখন এই অসহায় বৃদ্ধার জন্য কি করা যায়? তাকে কি গান গেয়ে সান্ত্বনা দেয়া যাবে?
এসব কথা ভাবতেই মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ওহে লালন, বিষয়ী মানুষের মতো তোমার এত কথা কিসের? তুমি তোমার একতারা বাজাও। আমি গান গাইব।
লালন একতারাটি উপরের দিকে তুলে ধরলেন।
টং টং করে বাজিয়ে যান তার।
তারপর কে যেন বৃদ্ধ বাউলের ভিতর থেকে গাইতে লাগল:
আমি অপার হয়ে বসে আছি
ও হে দয়াময়
পারে লয়ে যাও আমায় ...
বিধুবালা গান শুনল কি না কে জানে! এদিকে তো একবারও ফিরে তাকাল না। সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে লালন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল পাটে ।
তোমা বিনে ঘোর সঙ্কটে
না দেখি উপায় ...
নাঃ, বিধুবালা দাসীর সাড়া নেই। বৃদ্ধা একেবারে মিইয়ে গেছে। শোকের প্রতিমা যেন। গানে মজল না। আশ্চর্য! অথচ এ গান শুনলে পর হরিণাকুন্ডের রাধা বৈষ্ণবী আমার পায়ের উপর মাথা ঠেকিয়ে চোখের জল ফেলত।
লালন বিষন্ন বোধ করলেন। কতদিন পর গানটি আজ পরিপূর্ণতা পেল। তারপরও তীব্র বিষাদ টের পেলেন বৃদ্ধ বাউল।
একখানা খেয়া নৌকা এদিকেই আসছে। ঘাটে যাত্রীদের ভিড় লেগেছে। যাত্রীরা যে যার গন্ত্যবে যাবে। কিন্তু, বিধুবালা দাসী কোথায় যাবে?
দূরন্ত বাতাস উড়িয়ে নিল সে উত্তর ...
... আমায় ক্ষমা করো গো মা। আমিও বড় নিরূপায়। আমিও তোমার মতো মানবদেহ ধারণ করেছি ...আমি কেবল গান বাঁধতে জানি ... তার বেশি তো কিছু জানি নে ...
এই রকম একটি গা-শিরশিরে বিপন্ন ভাবনা মাথায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন লালন। তারপর একতারা বুকে জড়িয়ে ধরে নৌকায় উঠে এলেন। উবু হয়ে বসলেন নৌকার পাটাতনের উপর । শরীরখানি কীরকম জানি কাঠ কাঠ ঠেকছে।
মাঝি নৌকা ছাড়ল।
ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে নৌকার গলুই ।
লালন চোখ বুজলেন। পাছে ঘাটে বসে থাকা বিধুবালার স্তব্দ নির্বাক ভঙ্গিটি তাঁকে উপহাস করে ...
... লেখাটি কাল্পনিক।
উৎসর্গ: ব্লগার নাজীমউদ্দীন।