পূর্বাহ্ন। বৈশালী নগরের অভিমুখে ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে হাঁটছেন গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধের পরনে রক্তবর্ণের গোরুয়া । মস্তক মুন্ডিত। চোখ অর্ধ-মুদিত। দূরে বৈশালী নগরের নগরপ্রাচীরটি আবছা দেখা যায়। বুদ্ধে সঙ্গে প্রিয় শিষ্য ভিক্ষু আনন্দ, ভিক্ষু সারিপুত্র এবং ভিক্ষু উপালি। মাটির পথটি সংকীর্ণ। দু’পাশে কলাগাছ আর ফসলের মাঠ। আদিগন্ত ফসলের মাঠে দূরন্ত বাতাসে দুধমনি ধানের সবুজ গাছ দুলছে। বৈশালী নগরটি মগধের উত্তরে। আজ ভোর ভোর সময়ে গঙ্গা পাড় হয়ে খানিকটা পথ গরুর গাড়িতে এসেছেন।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতক। আশ্বিন মাস। নীল বর্ণের আকাশটি মেঘমুক্ত । চরাচরে সাদা রঙের উজ্জল রোদ ছড়িয়ে আছে। বৈশালীর প্রকৃতি অত্যন্ত মনোরম। নগরময় অসংখ্য উদ্যান এবং পদ্মপুকুর। বুদ্ধ এর আগেও বেশ কয়েকবার বৈশালী নগরে এসেছেন । বোধি লাভের পঞ্চম বছরে বর্ষাকাল ওই নগরেই কাটিয়েছেন।
...আর্যাবর্তের (অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের ) ষোলটি মহাজনপদের একটি হল বজ্জি; আটটি মৈত্রীবদ্ধ গোষ্ঠী বজ্জির অর্ন্তভূক্ত। লিচ্ছবি গোষ্ঠী তাদের অন্যতম । ওই লিচ্ছবি গোষ্ঠীই শাসন করছে বৈশালী । মনোরম সৌন্দর্য ছাড়াও অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী নগর বৈশালী ...
বৈশালীর তোরণদ্বার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ভিক্ষু শুভব্রত । এই মধ্যবয়েসি ভিক্ষুটি বৈশালীর মহামায়া বিহার অধ্যক্ষ। পরনে রক্তবর্ণের গোরুয়া। মুন্ডিত মস্তক। গায়ের রং শ্যামলা। সন্ন্যাস গ্রহনের পূর্বে বৈশ্য ছিল ভিক্ষু শুভব্রত। পাটলিপুত্র নগরে ব্যবসা করত। দশ বছর আগে বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিয়েছে।
দূর থেকে বুদ্ধকে দেখে এগিয়ে গেল ভিক্ষু শুভব্রত।
বুদ্ধকে প্রণাম করে ভিক্ষু শুভব্রত বলল, তথাগত, আপনাকে আতিথ্য দিতে বৈশালীর মহামায়াবিহার প্রস্তুত।
বুদ্ধ মৃদু হাসলেন। তারপর ভিক্ষু আনন্দের দিকে তাকালেন।
ভিক্ষু আনন্দ বললেন, তথাগতর পক্ষে এক্ষুনি মহামায়া বিহারের নিমন্ত্রণ গ্রহন সম্ভব না।
ভিক্ষু শুভব্রতর মুখে বিস্ময়চিহ্ন ফুটে উঠল।
ভিক্ষু সারিপুত্র বললেন, আম্রপালী পূর্বেই তথাগতকে নিমন্ত্রন করেছে। আমরা এখন আম্রপালীর ভবনে যাচ্ছি।
ভিক্ষু শুভব্রতর চোখেমুখে বিস্ময়ের চিহ্নটি গভীর হয়ে উঠল যেন । আম্রপালী বৈশালী নগরের সুন্দরী ‘রূপাজীবা’ (royal courtesan); তার আতিথ্য বরণ করবেন তথাগত বুদ্ধ? বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে ভিক্ষু শুভব্রত বলল, তথাগত! আপনি বৌদ্ধবিহারে না-গিয়ে সামান্য একজন নগরনটীর আতিথ্য গ্রহন করবেন?
বুদ্ধ নীরব রইলেন। মনে মনে হয়তো বললেন, সমাজের রূপাজীবারাও তো তোমার মতোই মানুষ হে ভিক্ষু শুভব্রত!
ভিক্ষু উপালী বিরক্ত দৃষ্টিতে ভিক্ষু শুভব্রতর দিকে তাকালেন। এরা সব বৌদ্ধমঠের অধ্যক্ষ, দীক্ষাও নিয়েছে ভগবান বুদ্ধের কাছে। অহোরাত্র বুদ্ধের অহিংস মন্ত্র জপ করে। তথাপি এরা মানবিক হৃদয়ের অধিকারী হতে পারেনি।
বুদ্ধের নীরবতায় হতাশ বোধ করে ভিক্ষু শুভব্রত । সে কিছুতেই নটী আম্রপালীর গৃহে পা দেবে না। নারীটি অপবিত্রা। বহুভোগ্যা।
বুদ্ধ বললেন, আমরা আম্রপালীর ভবনে যাচ্ছি। তোমার ইচ্ছে হলে আমাদের সঙ্গে যেতে পার । তবে আমি তোমাকে জোর করব না।
এই বলে বুদ্ধ হাঁটতে শুরু করেন ।
বুদ্ধকে অনুসরণ না-করে মঠে ফিরে গেলে নানা প্রশ্ন উঠবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভিক্ষু শুভব্রত বুদ্ধের পিছন পিছন হাঁটতে লাগল। সন্ন্যাস জীবন বড় পবিত্র । আজ সন্ন্যাসজীবনের পবিত্রতা নষ্ট হতে চলেছে ...
বৈশালী নগরের সুন্দরী রূপাজীবা আম্রপালীর প্রমোদ ভবনটি নগরের দক্ষিণে । মর্মর পাথরের দ্বিতল ভবন। চারিদিকে আমবন । প্রাঙ্গনটি পরিচ্ছন্ন । এই মুহূর্তে সেই রৌদ্রমূখর প্রাঙ্গনে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি মায়াহরিণ, একটি নিঃসঙ্গ ময়ূর এবং একটি রূপবান শ্বেতবর্ণের রাজহাঁস । প্রাঙ্গনে একটি শূন্য রাজকীয় রথ থেমে আছে। রথটি আম্রপালীর প্রিয় বাহন। একতলার লাল পাথরের তৈরি অলিন্দটি বেশ প্রশস্ত । অলিন্দের চারিদিকে পাথরে স্তম্ভ। সে স্তম্ভে নগ্ন নারীমূর্তি খোদিত।
ভবনের পিছনে একটি সুপরিসর পদ্মপুকুর। পুকুরের জল কৃষ্ণবর্ণের । শরতের নীলাভ আকাশের ছায়া পড়েছে পদ্মপুকুরে । পদ্মপুকুরের পাড়ে আমগাছ। পুকুরজুড়ে মনোরম পদ্ম ফুল ফুটে রয়েছে। পদ্মের উপর উড়ছিল ভ্রমর এবং ফরিঙের দল।
এদিকটা কেমন নির্জন হয়ে রয়েছে ...
স্নান সেরে পদ্মপুকুরের মর্মর পাথরের ঘাটের ওপর চুল এলো করে বসেছিল আম্রপালী। আম্রপালীর পালক-মা বিধবা হরিবালা আম্রপালীর দীঘল চুলে জবাকুসুম তেল মাখিয়ে দিচ্ছিল। সে তেলের গন্ধ ঘাটে ছড়িয়েছে।আম্রপালী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। পানপাতার মতো মুখের গড়ন । যুগল ভ্রু। আয়ত চোখ। বত্রিশ বছরের লাবণ্যপূর্ণ কোমল শরীর। সে শরীরে লিচ্ছবি গোষ্ঠীর রাজপুরুষগনের লালসার অদৃশ্য চিহ্ন । পদ্মপুকুরের জলে ধুয়ে পবিত্র হয় আম্রপালী। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের ফুটফুটে কিশোর "গৌতম বুদ্ধ এসেছেন", "গৌতম বুদ্ধ এসেছেন"- বলে চিৎকার করতে করতে পুকুর ঘাটে ছুটে এল।
আম্রপালী বুকের আঁচল ঠিক করতে করতে ছেলেকে বলল, কি বলছিস তুই বিমল! তথাগত বুদ্ধ এসেছে?
হ্যাঁ, মা। কিশোর বিমল বলল।
আম্রপালীর বুক কাঁপছে। বেশ কিছুকাল আগের কথা। বুদ্ধ সে সময় পাটলিপুত্রে ছিলেন । এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিল আম্রপালী। কখনও বৈশালী নগরে এলে আমার আতিথ্য গ্রহন করবেন। আজ কি তথাগত এলেন? রূপাজীবা বলে অবহেলা করলেন না!
এবার বৃদ্ধা হরিবালা জিজ্ঞেস করল, সত্যি কইছিস তো বিমল?
হ্যাঁ। ঠাকমা। আমি সত্যি কইছি। মিথ্যে কইতে যাব কেন?
চল তো দেখি। বলে আম্রপালী অলিন্দে ছুটে এল।
দূর থেকে আমবাগানের পথে বুদ্ধকে ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে আসতে দেখল আম্রপালী । বুদ্ধের সঙ্গে শিষ্যের দল। তথাগত সত্যিই এলেন তাহলে? আম্রপালীর বুকের ভিতরে কলকল কলকল করে ছুটল এক অদৃশ্য জলধারা। চোখে জল এসে গেল তার।
বুদ্ধ অলিন্দে উঠে এলেন। সেই মুহূর্তে আম্রপালীর মুখে তির্যকভাবে আশ্বিনের বিখ্যাত রোদ এসে পড়েছে। বুদ্ধ সে অপূর্ব সুন্দর মুখের দিকে তাকালেন। যেন আম্রপালীর তীব্র সৌন্দর্যে সন্ন্যাসীও খানিকটা বিমূঢ় । যেনবা তিনি জবাকুসুম তেলের মিষ্টি সুগন্ধও পেলেন।
আম্রপালী ভাবল: কি পবিত্র দৃষ্টি। লালসার চিহ্নমাত্র নেই!
কেবল ভিক্ষ শুভব্রত আম্রপালীর হলুদাভ নিটোর শরীরটি চোখ দিয়ে লেহন করছিল।
আম্রপালী ঝুঁকে আর্যাবর্তের সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ ঋষি পুরুষটির পদধুলি গ্রহন করে। বুদ্ধ মৃদু হাসেন। তারপর ঝুঁকে আম্রপালীর মাথা স্পর্শ করেন। পলকে আম্রপালীর দেহে সঞ্চালিত হয় অদৃশ্য শীতল তরঙ্গ । যেনবা দূরবর্তী পর্বত শৃঙ্গ থেকে মানস সরোবরে শীতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আতপ্ত নারীটি। পদধুলি গ্রহন করার পর আম্রপালী উঠে দাঁড়ায়। তারপর বুদ্ধের অতল গভীর চোখে চোখ রাখে। তবে চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় আম্রপালী। টের পায় পরমের স্পর্শে কন্ঠতালু শুকিয়ে গেছে তার। কোনওমতে বলল, আসুন, তথাগত। আসন গ্রহন করেন।
বলে দ্রুতপায়ে খাবারের আয়োজন করতে ভিতরে চলে গেল আম্রপালী।
হরিবালা এসে কোন্ ফাঁকে সাদা রঙের চাদর বিছিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। বুদ্ধ ইঙ্গিতে শিষ্যদের আসন গ্রহন করার জন্য নির্দেশ দিয়ে নিজেও বসলেন। অলিন্দের স্তম্ভে নগ্ন নারীমূর্তি দেখে বুদ্ধের শিষ্যরা ঈষৎ সঙ্কোচ বোধ করে । কেবল ভিক্ষু শুভব্রতর চোখ নারীমূর্তির স্তনে আটকে থাকে। কিশোর বিমলের দিকে তাকালেন বুদ্ধ। ফুটফুটে মুখে মগধের রাজা বিম্বিসারের মুখ যেন বসানো। লোকে তাহলে ঠিকই বলে ...
লোকজন দেখে প্রাঙ্গন থেকে একটি রাজহাঁস অলিন্দে উঠে এসেছিল। কিশোর বিমল সেটিকে ‘হুশ’, ‘হুশ’ করে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। বুদ্ধের মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা। যেনবা এই মুহূর্তে চিত্রায়িত হল তাঁর শৈশব । অবশ্য সন্ন্যাসীদের পিছন ফিরে তাকাতে নেই ...
হরিবালা রান্নাঘরে চাল ধুচ্ছিল। অতিথিদের জন্য ভাত বসাবে। আম্রপালী রান্নাঘরে এসে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল । তোর আবার কি হল-বলে বিধবা হরিবালা হাঁড়ি ফেলে আম্রপালীর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আম্রপালী ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। হরিবালা বলল, ওলো, অত কাঁদিস নে লো। আজ যে আকাশ থেকে চাঁদ লেমে এসেছে। বেবুশ্যের ঘরে সাক্ষাৎ গৌতম মুনি এয়েচেন। তোর কান্নায় আকাশে অমাবশ্যা ঘনাবে উঠবে যে।
তবু আম্রপালীর কান্না থামে না।
আজ এই শুভ দিনে তার কত কথা মনে পড়ে যায় ...
... আম্রপালী অজ্ঞাতকুলশীল । সে জানে না কারা তার বাবা-মা। আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে বৈশালীর রাজকীয় আম্রকুঞ্জে তাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। রাজকীয় উদ্যানের মালি শ্রীনাথের বউ হরিবালা ...হরিবালাই তাকে লালনপালন করেছে। শিশুকন্যাটিকে আমগাছের তলায় পাওয়া গিয়েছিল বলে হরিবালা নাম দিয়েছে আম্রপালী। কিশোরী বয়েসে আম্রপালীর দূরন্ত রূপে দগ্ধ হতে থাকে অভিজাত লিচ্ছবি গোষ্ঠীর পুরুষগন । অভিভাবকহীন হলে যা হয়-আম্রপালীকে স্পর্শ করার জন্য রাজপুরুষগন হয়ে ওঠে লালায়িত। তারাই বৈশালী নগরের দক্ষিণে আম্রকুঞ্জের ভিতরে হরিবালার তত্ত্বাবধানে কিশোরী আম্রপালীর জন্য সুরম্য একটি মর্মরপাথরের প্রমোদ ভবন তৈরি করে দেয়। কামার্ত রাজপুরুষেরা আম্রপালীর সম্ভোগসুখের আকর্ষনে প্রমোদ ভবনে নিয়মিত আসতে থাকে। কখনও একা, কখনও যৌথভাবে। আম্রপালীর অতুলনীয় দৈহিক সৌন্দর্যর কথা মগধের তরুণ রাজপুত্র বিম্বিসার-এর কানেও পৌঁছেছিল। মগধ ছিল বৈশালীর চিরশত্রু। তথাপি অসম সাহসী রাজপুত্র বিম্বিসার ছদ্মবেশ ধারণ করে গোপনে আম্রপালীর মধুকুঞ্জে এসেছিল। তারপর কিশোরী আম্রপালীর প্রণয়ে মগ্ন হয়েছিল। তবে আশ্চর্য এই ... তরুণ বিম্বিসারকে সত্যি ভালোবেসেছিল আম্রপালী।(সম্ভবত বীরের প্রতি নারী অদম্য আকর্ষন বোধ করে ...আম্রপালীকে দেখার জন্য ঝুঁকি নিয়েছিল তরুণ বিম্বিসার...) ...আম্রপালী ভালোবেসে গর্ভে ধারণ করে রাজপুত্রের বীজ। ... সেই বিমল এখন কিশোর । বিম্বিসার মগধের রাজা হওয়ার পরআ¤্রপালী কিংবা পুত্র সন্তানের খোঁজ খবর নেয় নি । পুরুষেরা এমনই হয়। তারা সুন্দরী রূপাজীবা ভোগ করবে- কিন্তু কখনোই রানীর মর্যাদা দেবে না। আম্রপালী শুনেছে মগধের রানী তার তার তুলনায় রূপেগুণে হীন। এসব কারণেই আম্রপালীর বুকের ভিতর গাঢ় অভিমান থইথই করে । অতুল বিত্ত সত্ত্বেও নিজেকে নিঃস্ব মনে হয় তার ... আমার জীবন এমন হল কেন?
আম্রপালী অলিন্দে ফিরে এল।
তারপর আমবনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। দূর থেকে জয়নাথ আসতে দেখল। জয়নাথ লিচ্ছবি গোত্রের রাজকীয় দূত। আম্রপালীর পূর্ব পরিচিত। কিন্তু, জয়নাথ আসছে কেন? মৃদু উদ্বেগ টের পায় আম্রপালী।
অলিন্দে উঠে এসে বুদ্ধকে প্রণাম করে দূত জয়নাথ। তারপর বলল, তথাগত, আমি জয়নাথ। লিচ্ছবিরাজ জয়ন্তের দূত।
তুমি কুশলে আছ তো? বুদ্ধ নম্রস্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, তথাগত। আমি কুশলেই আছি।
ভিক্ষু সারিপুত্র জিজ্ঞেস করল, তোমার আসার কারণ জানতে পারি জয়নাথ?
দূত বলল, লিচ্ছবিরাজ জয়ন্ত ভগবান বুদ্ধকে রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি আপনাদের খোঁজে নগর তোড়ণদ্বারে গিয়েছিলাম। আপনাদের ওখানে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। তখন চরের মুখে শুনলাম আপনারা আম্রপালীর গৃহের দিকে গিয়েছেন।
আম্রপালীর মুখ শুকিয়ে গেল। এখন যদি তথাগত রাজপ্রাসাদে চলে যান। আম্রপালীর কান্না পায়।
বুদ্ধ ভিক্ষু আনন্দের দিকে তাকালেন। ভিক্ষু আনন্দ বললেন, লিচ্ছবিরাজ জয়ন্তের নিমন্ত্রণ রক্ষা করা এই মুহূর্তে সম্ভব না।
তার কারণ জানতে পারি? দূতের কন্ঠস্বর গম্ভীর।
ভিক্ষু উপালী বললেন, আম্রপালী পূর্বেই তথাগতকে নিমন্ত্রন করেছে।
দূত বিব্রত বোধ করে। লিচ্ছবি গোত্র বৈশালীর একচ্ছত্র শাসক। এদের নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা সহজ না। তবে ভগবান বুদ্ধ এতদ্বঞ্চলে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় । দূত কি করবে বুঝতে পারছে না । ওদিকে রাজা জয়ন্ত অপেক্ষা করে আছেন। এখনি রাজার কাছে গিয়ে বুদ্ধের অপারগতার কথা সবিস্তারে জানাতে হবে।
দূত চলে যায়।
আম্রপালীর চোখে জল এসে যায়। এই প্রথম কেউ মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিল। কেবলই অচ্ছুত রূপাজীবা ভবল না। এ কেবল তথাগতর পক্ষেই সম্ভব। তথাগতর বিশাল হৃদয়ের কথা আর্যাবর্তে কে না জানে ।
... একবার বৎস রাজ্যের রাজধানী কৌশাম্বী নগরের রাজপথে একটি বৃদ্ধ হাতি দেখে মর্মাহত হন বুদ্ধ । খোঁজ নিয়ে জানলেন হাতিটি বৎস রাজ্যের রাজা উদয়নের। বুড়িয়ে যাওয়ায় হাতিটিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হাতিকে ফিরিয়ে নিতে তথাগত রাজাকে অনুরোধ করেন । রাজা উদয়ন হাতি ফিরিয়ে নিয়ে হাতিটির তত্ত্বাবধানের জন্য একজন মাহুত নিযুক্ত করেছিলেন ...
আম্রপালী জানে ...মগধের রূপাজীবারা ভোরবেলা দেবতার নাম নেওয়ার আগে তথাগতর নাম নেয় ...
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আম্রপালীর ।
ভিক্ষু শুভব্রত বলল, লিচ্ছবিরাজ জয়ন্তের নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়া কি ঠিক হল? গত বছর মহামায়া বিহারে সহস্র কার্ষাপন (বুদ্ধযুগের মুদ্রার নাম) দান করলেন।
খানিকটা বিরক্ত হয়ে ভিক্ষু সারিপুত্র বললেন, দয়া করে আপনি এখন চুপ করে থাকুন তো।
হরিবালার রান্না শেষ। আম্রপালী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করল। সন্ন্যাসীদের আহারের উপকরণ সামান্য । দুধমনি ধানের ধোঁওয়া-ওঠা শুভ্র অন্ন আর ঘরে তৈরি টকদধি। শিষ্যদের সঙ্গে বসে সামান্য নুন মিশিয়ে বুদ্ধ তাই তৃপ্তি ভরে খেয়ে উঠলেন। অথচ রাজপুরুষ এলে চৌদ্দ পদ রেঁধে সাজিয়ে দিতে হয়। রান্না বিস্বাদ ঠেকলে কটূ ভাষায় তিরস্কার করে। তীর ছুড়ে ময়ূর, হরিণ বা রাজহাঁস শিকার করে। (গতবছর এক লিচ্ছবি যুবাপুরুষ আম্রপালীর প্রিয় রাজহাঁস কান্তাশ্রী- কে অযাথা তীর ছুড়ে মেরে ফেলল! ) ...তাছাড়া রাজপুরুষরা মদ্য পান করে। আশ্চর্য! জগতের সকল ক্ষমতা এদেরই থাকে। আর সংযমী সন্ন্যাসীরা সমাজের পক্ষ থেকে পায় কেবলই উপেক্ষা ...
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আম্রপালী।
ভিক্ষু শুভব্রত কিছু মুখে দিল না। আন্ত্রিক গোলযোগের অজুহাত দিল।
আম্রপালী অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, একটু দই অন্তত মুখে দিন। আজই প্রথম এলেন যখন।
থাক। ওকে জোর করো না মা। বুদ্ধ বললেন।
ভগবান বুদ্ধ আমাকে মা বললেন! আম্রপালীর কেঁপে উঠল।
হরিবালা এসে এঁটো বাসনকোসন নিয়ে গেল।
এই প্রগাঢ় দুপুরে অলিন্দের উপর শরতের সাদা রোদ ছড়িয়ে আছে। পদ্মাসনে অপূর্ব ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন বুদ্ধ। বুদ্ধের অপরূপ পুরুষালি রূপ আম্রপালী কে অভিভূত করে, আচ্ছন্ন করে। আম্রপালী অদূরে বসে দেখতে থাকে সে রূপ । নির্জন অলিন্দের বাতাসে শুষ্ক পদ্মের সৌরভ ছড়িয়েছে। শুষ্ক পদ্মের সৌরভ কি বুদ্ধের পবিত্র দেহ থেকে নির্গত হচ্ছে? আম্রপালী ভাবিত হয়ে পড়ে। বুদ্ধের এখন মধ্যবয়স। অথচ কী অক্লান্ত পরিব্রাজক। ধর্ম প্রচারের জন্য ক্রোশের পর ক্রোশ হাঁটছেন। অথচ কী প্রাণবন্ত। আম্রপালী নারী বলেই ভাবল: তথাগতর স্ত্রী এমন স্বামীর সান্নিধ্য পাচ্ছেন না। ভাবতেই বিষন্ন বোধ করে আম্রপালী ।
বুদ্ধ বললেন, এবার আমি উঠি মা। এখন একবার মহামায়াবিহারে যাব। ওখান থেকে একবার রাজপ্রাসাদে যাব। নিমন্ত্রণ রক্ষা না-করায় লিচ্ছবিরাজ ক্ষুব্দ হয়েছেন। তাঁর ক্ষোভ প্রশমিত করতে হবে।
আম্রপালী বলল, তথাগত, আপনার কাছে আমার কিছু নিবেদন ছিল।
বল মা।
এই আম্রকুঞ্জটি আমি আপনার বৌদ্ধসংঘকে দান করতে চাই। আপনি গ্রহন করলে বাধিত হব।
আর্যাবর্তের অন্যকোনও ধর্মনেতা হলে অচ্ছুত রূপাজীবার আম্রকুঞ্জ গ্রহন করতেন না। বুদ্ধ সেরকম নন। তিনি বললেন, বেশ। আমার সংঘের জন্য তোমার আম্রকুঞ্জটি গ্রহন করলাম।
আম্রকুঞ্জে একখানি বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠা করলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হব।
বেশ। আর?
আম্রপালী এবার বিমলকে ডাকল। বিমল এল। বিমলকে দেখিয়ে আম্রপালী বলল, এর নাম বিমল। আমার একমাত্র সন্তান। একে আপনার সংঘে গ্রহন করলে আমি শান্তি পাব।
ভিক্ষু শুভব্রত বলল, শুনেছি এই বালকের পিতা রাজা বিম্বিসার ?
আম্রপালী দৃঢ়কন্ঠে বললেন, আমি বিমলের মা।
মুহূর্তেই ভিক্ষু শুভব্রত কেমন মিইয়ে গেল।
বুদ্ধ মনে মনে এই প্রবল ব্যাক্তিত্বময়ী নারীকে প্রণাম করলেন। তারপর বললেন, বিমল এখন বালকমাত্র। আগে ও বড় হোক মা। যথাসময়ে ওকে বৌদ্ধসংঘে গ্রহন করব। আর কিছু বলবে?
আম্রপালী বলল, আমি ...আমি আমার পেশা ত্যাগ করতে চাই।
বেশ। আর?
শুনেছি আপনার প্রিয় শিষ্য আনন্দের অনুরোধে আপনার মাতা গৌতমীর নেতৃত্বে একটি ভিক্ষুণী সংঘ স্থাপন হয়েছে?
বুদ্ধ মাথা নাড়লেন।
ছোট্ট শ্বাস ফেলে আম্রপালী বলল, আমি ভিক্ষুনী সংঘে যোগ দেব ঠিক করেছি।
বেশ।
আম্রপালী তার দেহের ভিতরে অনাবিল শান্তির অনুভূতি টের পায়। যেন তার নবজন্ম লাভ হল। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকে সে । তারপর চোখ খুলে বলে, এবার আমাকে উপদেশ দিন তথাগত। আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব।
বুদ্ধ খানিক ক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে রইলেন। সম্ভবত কথাগুলি গুছিয়ে নিচ্ছেন। বুদ্ধ ছোট্ট শ্বাস টানলেন। তারপর বললেন, সর্বদা স্মৃতিমান, সজ্ঞান ও সচেতন থাকবে। জীবন ক্ষণভঙ্গুর এবং ততোধিক ক্ষণভঙ্গুর এই জীবনাধার এই দেহ, এই কথা মনে রেখে নিজেকে সর্বদা পর্যবেক্ষন করবে। সুখ-দুঃখ জাত যে সব অনুভূতি মনে উৎপন্ন হয়- সেগুলির উপর লক্ষ রেখ। হিংসা-লালসা জাত কুপ্রবৃত্তিকে মন থেকে দূর করে দেওয়ার জন্য সর্বদা স্মৃতিমান জাগ্রত থেকো। সব কাজ ও ইচ্ছাতেই সজ্ঞান ও সচেতন থাকতে হবে ...
বুদ্ধ প্রসন্নচিত্তে বলে যেতে থাকেন ...
আম্রপালী আমবাগানের দিকে তাকায়। আশ্বিন মাসের বেলা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আমবাগানের পাতায় পাতায় লেপ্টে থাকা রোদের রং ম্লান হয়ে উঠছে । আমবাগান জুড়ে কাকপাখিদের সমস্বরে চিৎকার। ফিরোজা রঙের আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা; ভাসমান মেঘমালা নানান দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে ... বেলা শেষের আলোয় প্রাঙ্গনের রথের উপর একটি সাদা রঙের কবুতর উড়ে এসে বসেছে। বালক বিমল চঞ্চলতাহেতু সে দিকে দৌড়ে যায় হই হই করে ...
তথ্যসূত্র:
শ্রী শান্তিকুসুম দাশ গুপ্ত রচিত বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম এবং প্রাচীন বৌদ্ধসমাজ
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Ambapali
Click This Link