পাইরামাস ও থিসবি।... প্রাচীনকালে পাইরামাস ও থিসবি কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল করুণ এক মর্মান্তিক প্রেমকাহিনী। যে কাহিনী স্বয়ং উইলিয়াম শেকসপীয়র কে গভীর ভাবে আলোড়িত করেছিল এবং ওই প্রতিভাবান নাট্যকার পাইরামাস ও থিসবি-র ট্যাজিক উপাখ্যানটি নতুন ভাবে রূপায়ন করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পাইরামাস এবং থিসবির কাহিনীটি লোকমুখে প্রাচীনকাল থেকেই পশ্চিম এশিয়ায় প্রচলিত ছিল। তবে বিশিষ্ট রোমান কবি ওভিদ-এর রচনার মাধ্যমে ইউরোপ প্রথম পাইরামাস এবং থিসবির কাহিনীটি জানতে পারে। এবং পাইরামাস ও থিসবি-র বিয়োগান্তক উপাখ্যানটির মর্ম অনুধাবন করে ইউরোপীয় পাঠক শোকে স্তব্দ হয়ে যায়। কেননা, সভ্যসমাজের প্রেমের ভিতরে ছলনার পরিমানই বেশি; পক্ষান্তরে পাইরামাস ও থিসবি-র সুগভীর প্রেম আত্বত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল ... এ কারণেই কি পাইরামাস ও থিসবি কে ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকে পুনুরুজ্জীবিত করে অমর করে রেখেছেন শেকসপীয়র?
ওভিদ। (৪৩ খ্রিস্টপূর্ব-১৭ খ্রিস্টপূর্ব) বিশিষ্ট রোমান কবি।
ওভিদ গ্রিক ও রোমান উপকথা অবলম্বনে ১৫ খন্ডে লিখেছিলেন Metamorphoses নামে একটি বিখ্যাত আকর গ্রন্থ। ওভিদের সরস রচনার কারণে গ্রিক ও রোমান উপকথায় নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছিল । পাইরামাস ও থিসবি-র উপাখ্যানটিও ওভিদের রচনায় রয়েছে।
ব্যাবিলন নগরের মানচিত্র । পাইরামাস ও থিসবি-র ট্যাজিক উপাখ্যানটির সূত্রপাত মেসোপটেমিয়ার বিখ্যাত ব্যাবিলন নগরে।
সুদর্শন তরুণ পাইরামাস ও রূপসী তরুণি থিসবি। তারা ব্যাবিলন নগরের দু-জন তরুণ-তরুণি। পাশাপাশি বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই একে অপরকে দেখছে। কৈশরে উপনীত হয়ে তারা একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কিন্তু, সমস্যা ওখানেই। পাইরামাস ও থিসবি-র মাবাবা ওদের বিয়েতে মত দেয়নি। শুধু তাই না-দুটি বাড়ির মাঝখানে সীমানাপ্রাচীর তুলে দিল তারা! প্রতিটি ট্যাজিক ঘটনায় এক বা একাধিক খলনায়ক বা ভিলেন থাকে । এ ক্ষেত্রে পাইরামাস ও থিসবির সংকীর্ণমনা অভিভাকই খলনায়ক।
প্রাচীরের দু’পাশে দুটি উষ্ণ আর কাতর হৃদয়। কাতরায় ... কাঁদে ... গুমরায় ...
থিসবি একদিন ফুঁসে উঠে বলল, পাষান-প্রাচীর, পাষান-প্রাচীর তোর কি দয়া হয় না?
পাষান প্রাচীরের দয়া হবে কি ভাবে? সে যে মূক! প্রাচীরের মাঝখানে একটি ছোট ছিদ্র তৈরি কলল পাইরামাস । ওই ছিদ্র দিয়েই লুকিয়ে কথা বলে পৃথক যুগল।
থিসবি। জন উইলিয়াম ওয়াটার হাউজের আঁকা।
পাইরামাস লুকিয়ে থিসবির জন্য একটি আকাশি রঙের ওড়না কিনেছিল।
সে ওড়না প্রাচীরের ওধারে ছুড়ে ফেলল সে । ওড়না পেয়ে ভারি খুশি হল থিসবি।
কিন্তু, এভাবে আর কত দিন! এভাবে কথা বলে কি আর মন ভরে? যদি না তার স্পর্শের সুখ নাই পাওয়া যায়?
একদিন থিসবি কথাটা বলেই ফেলল। বলল, এভাবে আর কত দিন প্রিয় পাইরামাস?
পাইরামাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমিও তো তাইই ভাবছি থিসবি।
চল, আমরা নিনেভ নগরে পালিয়ে যাই। বিয়ে করি। থিসবি ফিসফিস করে বলল।
পাইরামাস বলল, আমিও তাইই ভাবছি।
থিসবি প্রাচীরের ওধারে শ্বাস টানল।
পাইরামাস জিজ্ঞেস করল, তুমি কি রাজা নিনাসের সমাধিসৌধ চেন থিসবি?
হ্যাঁ, চিনি। রাজা নিনাসের সমাধিসৌধ পিছনে দেবী ইশতারের গুহায়। গত বসন্ত উৎসবে মার সঙ্গে গিয়েছিলাম।
পাইরামাস মাথা ঝাঁকাল। সে জানে রাজা নিনাসের সমাধিসৌধ পিছনে ঘন সিডার বন। ওখানেই দেবী ইশতারের গুহা। ব্যাবিলন নগরের কুমারী মেয়েদের একবার যেতে হয় ওই দেবী ইশতারের গুহায়।
পাইরামাস চাপাস্বরে বলল, কাল খুব ভোরে তুমি রাজা নিনাসের সমাধিসৌধ অপেক্ষ করবে । সমাধিসৌধের প্রাঙ্গনে একটা মালবেরি গাছ আছে। তার তলায়। আমি আসব।
ঠিক আছে। থিসবি ফিসফিস করে বলল।
ওর বুক কাঁপছে।
১৯০৬ সালে পাইরামাস ও থিসবির এই ছবিটি এঁকেছেন চিত্রকর স্যার লরেন্স আলমা-টাডেমা।
কুয়াশাময় ভোর। ঘুমন্ত ব্যাবিলন নগরটি নির্জন হয়ে রয়েছে। থিসবিদের বাড়িটা দেবতা শামাশ-এর উপাসনালয়ের পাশের গলিতে। লুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গলিতে হাঁটছিল থিসবি; পরনে আপাদমস্তক কালো পোশাক। পাইরামাস-এর উপহার সেই আকাশি রঙের ওড়নাটি বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। গতরাতে এক ফোঁটা ঘুম হয়নি থিসবির। সারারাত ভোরের অপেক্ষায় ছটফট করেছে। পাইরামাস-এর সঙ্গে মিলনের স্বপ্ন উত্তেজিত ছিল। আবার কান্নাও পাচ্ছিল। চিরকালের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে ... গলিতে পাতলা কুয়াশা ছড়িয়ে আছে। সতর্ক হয়ে হাঁটছিল থিসবি। উলটো দিক একটি রথ আসছিল। থিসবি চটজলদি বাঁ পাশে একটি থামের আড়ালে সরে যায়। ওর বুক কাঁপছে। বুক কাঁপলে চলবে কেন? অনেক দূর যেতে হবে। থিবসি নিজেকে সান্ত¦না দেয়। রাজা নিনাসের সমাধিসৌধটি এনলিল দরওয়াজার কাছে।
ব্যাবিলন নগরে রাজা নিনাসের সমাধিসৌধ। রাজা নিনাসের প্রাচীন নিনেভ নগরের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়।
রাজা নিনাসের সমাধিসৌধের প্রাঙ্গনে পৌঁছল থিসবি। প্রাচীন সমাধিসৌধটির প্রাঙ্গন ভাঙাচোরা। বহুকাল হল পরিত্যক্ত। প্রাঙ্গনে একটি মালবেরি গাছ । কিন্তু কই, পাইরামাস কে তো দেখা যাচ্ছে না। ও তো আমাকে এখানে আসতে বলল। কি হল ওর? এখনও ঘুমিয়ে আছে বুঝি?
...অভিমানে অভিমানে ভরে ওঠে থিসবির মন।
হঠাৎই মৃদু জান্তব গর্র্জনে চমকে উঠল থিসবি। ধূসর কুয়াশায় একটা সিংহের আবছা অবয়ব চোখে পড়ল। হিংস্র পশুটা এদিকেই আসছে। তখনই কুয়াশা ফুঁড়ে রোদ উঠল। থিসবি স্পস্ট দেখল সিংহটার মুখে রক্ত লেগে আছে। শিকার ধরে খেয়েছিল বুঝি। থিসবির শরীরে আতঙ্ক স্রোত বয়ে গেল। পায়ে পায়ে পিছিয়ে যেতে থাকে ও। সমাধিসৌধের পিছনে নিবিড় সিডার বন। সে নিবিড় সিডার বনে দেবী ইশতারের গুহা। সে গুহায় আশ্রয় নিতে পিছন ফিরে প্রাণপন ছুটল থিসবি। আগে সিংহটা চলে যাক। তার পরে আসব ...
যাওয়ার সময় সমাধি সৌধের প্রাঙ্গনের ওপর থিসবির ওড়নাটা পড়ে গেল।
সমূহ শিকারটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় সিংহটি ক্রদ্ধ গর্জন করে উঠল ... থিসবির ফেলে যাওয়া ওড়নাটি ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলল। ওড়নার ওপর সিংহের মুখ থেকে ঝরে পড়ল রক্ত। ওড়না ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করার পর গর্জন করতে করতে চলে গেল সিংহ।
পাইরামাস তখনই সমাধি সৌধের প্রাঙ্গনে এল।
সিংহের গর্জন শুনতে পেয়েছিল সে। অজানা আশংকায় তার মন ছেয়ে যায়। থিসবি কি এসে গেছে? থিসবির কিছু হল না তো? থিসবি কোথায় তুমি? মনে মনে বলল পাইরামাস।হঠাৎ চোখ আটকে গেল আকাশি রঙের ওড়নার ওপর । থিসবি তাহলে এসেছে? ছুটে এসে ওড়াটি বুকে তুলে নিল পাইরামাস । কিন্তু...কিন্তু ওড়নাটা এভাবে কে ছিঁড়ল ? একি ! ওড়নায় রক্ত কেন? হায়! ক্ষুধার্ত সিংহ আমার থিসবিকে হত্যা করেছে ... হায়, আমি থিসবিকে এখানে আসতে বলেছিলাম। ওর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ি।
আর্তনাদ করতে করতে তরবারি বের করে বুকে বসিয়ে দিল পাইরামাস ।
রক্ত ছিটকে লাগল মালবেরি গাছে ...
ওদিকে দেবী ইশতারের গুহায় দাঁড়িয়ে থিসবি ভাবছিল: সিংহ হয়তো এতক্ষণে চলে গেছে। আর পাইরামাস বুঝি আমায় অপেক্ষা করে আছে। ও পাইরামাসকে এক নজর দেখার জন্য উতলা বোধ করে। পায়ে পায়ে রাজা নিনাসের সমাধিসৌধের দিকে যেতে থাকে থিসবি ।
দূর থেকে দেখল পাইরামাস মালবেরি গাছের নীচে শুয়ে আছে।
একি! পাইরামাস মাটিতে শুয়ে আছে কেন? ওকি আমার ওপর অভিমানী করেছে? শায়িত পাইরামাস-এর কাছে ছুটে আসে থিসবি।
একি! পাইরামাস-এর বুকে বিদ্ধ তরবারি কেন! ... এত রক্ত কেন! আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠল থিসবি।
সে আর্তনাদে রাজা নিনাসের সমাধিসৌধের প্রাচীন খিলান -কপাট -অলিন্দ কেঁপে কেঁপে ওঠে ... কেঁপে কেঁপে ওঠে ।
মালবেরি গাছের পাতারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভোরের বাতাসে মালবেরি পাতারা বিষন্ন মর্মর ধ্বনি তোলে ...
হায়, পাইরামাস! তোমার বুকে বিদ্ধ তরবারি কেন! ... এত রক্ত কেন!
খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পর রক্তমাখা আকাশি রঙের ওড়নাটি দেখে যা বোঝার বুঝে নিল থিসবি ।
ক্ষানিক ক্ষণ স্তব্দ বিষন্ন হয়ে রইল মেয়েটি । কি যেন ভাবছে ...
যখন পাইরামাস মৃত
তখন আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন ...
পাইরামাস বুক থেকে রক্তাক্ত তরবারি নিয়ে খুলে নিল থিসবি।
তারপর মুহূর্তে নিজের বুকে আমূল বসিয়ে দিল তরবারি ।
রক্ত ছিটকে লাগল পাশ্ববর্তী মালবেরি গাছে ...
সেই থেকে ... মালবেরি ফল লাল ।
দুটি বিশুদ্ধ আত্মার প্রেমিক-প্রেমিকার পবিত্র রক্ত মালবেরি গাছের শিকড় স্পর্শ করেছিল বলে ...
মালবেরির লাল ফল।
ছবি: ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
http://thanasis.com/thisbe.htm
রোমান মিথ: পাইরামাস ও থিসবি-র করুণ উপাখ্যান
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কাঁঠালের আমসত্ত্ব
কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে
এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে । ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন