দেবতা জিউস । এই দেবতার নষ্টামির বর্ণনা গ্রিক পুরাণে রয়েছে। অসম্ভব ক্ষমতাপরায়ণ দেবতা জিউস। জিউস টাইটানদের উৎখাত করে পৃথিবীতে তাঁর শাসন কায়েম করেছিলেন। ( ইউরেনাস এবং গেইয়ার বারো সন্তান টাইটানরা হিসেবে পরিচিত । এদের গ্রিক পুরাণে প্রি-অলিম্পিয়ান দেবতা বলা হয়। এরা এককালে পৃথিবী শাসন করত। )
প্রোমেথিউস ছিলেন টাইটানদেরই একজন। টাইটান হলেও মানুষ পছন্দ করতেন। মানবসমাজে ঘৃনা ক্রোধ অসুখ দারিদ্র নেই। (কারণ তখনও প্যান্ডোরার অশুভ বাক্সটি খোলা হয়নি) প্রোমেথিউস মানুষকে যথাসাধ্য সাহায্যও করতেন। তবে তিনি লক্ষ করেছেন মানুষ শীতরাত্রে কাঁপে, কাঁচা মাংস খায়। তিনি উপলব্দি করেছিলেন মানুষের দরকার আগুন । আগুন পেলেই সে উন্নত এক মানবসমাজ নির্মান করতে পারবে। তবে দেবতা জিউস আগুন দেবে না। কেন ? দেবতা জিউস এর ধারণা আগুন পেলেই মানুষ এর অপব্যবহার করবে। নিজেকে ধ্বংস করবে। অথচ প্রোমেথিউস-এর বিশ্বাস ভালো মানুষ আগুনের সঠিক ব্যবহারই করবে। (এ প্রসঙ্গে আমরা বর্তমানকালের পরমাণু শক্তির ব্যবহার এবং দূর্ঘটনার আশঙ্কায় ইউরোপে পরমাণু শক্তির ব্যবহার বিরোধী আন্দোলনের কথা স্মরণ করতে পারি...) যা হোক। প্রোমেথিউস স্বর্গ থেকে চুরি করে মানুষকে দিলেন। দেবতা জিউস ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলেন। পাহাড়চূড়ায় প্রোমেথিউসকে শেকল দিয়ে বাঁধলেন। যেন শকুন এসে প্রতিদিন প্রোমেথিউসের শরীরের মাংস ঠুকরে খেতে পারে!
মানবপ্রেমিক প্রমিথিউস। ভোগ করছেন ঈর্ষাকাতর দেবতার শাস্তি।
দেবতা জিউস এবার মানবজাদিকে কঠিন শাস্তি দেবার কথা ভাবলেন। সূক্ষ্ম পরিকল্পনা আঁটলেন। কামার দেবতা হেফুস্তুস কে ডেকে পাঠালেন দেবতা জিউস। কামার দেবতা হেফুস্তুস এলেন।
দেবতা জিউস কামার দেবতা হেফুস্তুস কে বললেন, আমার ইচ্ছে তুমি
জলকাদা দিয়ে মূতি তৈরি কর।
কামার দেবতা হেফুস্তুস বললেন, আপনার আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করব দেবরাজ।
দেবতা জিউস এবার সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতিকে ডাকলেন।
আফ্রোদিতি এলেন।
দেবতা জিউস সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতিকে বললেন, সুন্দর ভঙ্গিমায় এখানে দাঁড়াও।
কেন? আফ্রোদিতি তো অবাক।
দেবতা জিউস বললেন, কামার দেবতা হেফুস্তুস তোমাকে দেখে জলকাদা দিয়ে একটি মূর্তি তৈরি করবে।
ও। বলে আফ্রোদিতি সুন্দর ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন।
গ্রিক কামার দেবতা হেফুস্তুস। চিত্রকর পিটার পল রুবেন্সের আঁকা। ইনিই জলকাদা দিয়ে নারীমূর্তি তৈরি করেছিলেন।
মূর্তি নির্মাণ শেষ হল।
দেবতা জিউস মূর্তি তে জীবন দান করলেন।
প্রাণ পেল পৃথিবীর প্রথম নারী। অপরূপ সুন্দর। কেননা, সুন্দরী আফ্রোদিতির আদলে গড়া হয়েছে।
পৃথিবীর প্রথম নারী প্যান্ডোরা।
দেবতা জিউস এবার অন্যান্য দেবতাদের ডাকলেন। একে একে দেবতারা সব এলেন। অ্যাপোলো। হার্মিস। দেবতা জিউস তাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর প্রথম নারীর পরিচয় করিয়ে দিলেন । বললেন, এ হল আমার কন্যা। একে তোমাদের গুণ দান কর।
অ্যাপোলে দান করলেন সংগীত। হার্মিস দান করলেন প্ররোচনার ক্ষমতা।
এ কারণে পৃথিবীর প্রথম নারীটির নাম রাখা হল প্যান্ডরা। অর্থ: ‘সর্ব-উপহার’।
দেবতা জিউস এবার প্যান্ডোরাকে একটি সুন্দর বাক্স দিলেন।তারপর বললেন, এই বাক্সটা কখনও খুলিস না মা।
কি আছে এতে? প্যান্ডোরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
দেবতা জিউস মনে মনে হাসলেন। তারপর বললেন, আহা, যাই থাক। বললাম তো বাক্সটা কখনোই খুলবি না।
প্যান্ডোরা কৌতূহল বোধ করলেও বলল, আচ্ছা বাবা। খুলব না। কথা দিলাম।
দেবতা জিউস এবার পরিকল্পনা মাফিক তাঁর কন্যাকে পৃথিবীতে, অর্থাৎ গ্রিসে পাঠালেন ।
হাতে সেই রহস্যময় বাস্কটা নিয়ে গ্রিসের এক গভীর অরণ্যে বসে থাকে প্যান্ডোরা। এই ছবিটি দান্তে গ্যাব্রেয়েল রসেটির আঁকা।
সেই অরণ্য-পথে যাচ্ছিল এপিমেথিউস। সম্পর্কে সে প্রোমেথিউস- এর ভাই । এপিমেথিউস প্যান্ডোরাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। এই গভীর বনে কে এই সুন্দরী মানবী? মনে মনে ভাবল সে। নিঃসঙ্গ মানবীর দেহে অথই রূপ-যৌবন । রূপসী নারীকে একা পেতে চায় এপিমেথিউস ...
এপিমেথিউস প্যান্ডোরাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল।
এই গভীর অরণ্যে বসে থেকেই-বা কী লাভ! এই ভেবে প্যান্ডোরা বিয়েতে রাজি হল।
বিয়ের পর নবদম্পতির জীবন সুখে কাটছিল।
... ওদিকে পাহাড়ের চূড়ায় বন্দি প্রোমিথিউস।
প্রত্যহ উড়ে আসে ক্ষুধার্ত শকূন।
খুবলে খায় বিদ্রোহীর শরীর !
প্যান্ডোরার কাছে বাক্সটি দেখেছে এপিমেথিউস। তার যে কৌতূহল হয়নি তা কিন্তু নয়। কিন্তু প্যান্ডোরা স্বামীকে তার বলল, তুমি কখনও ওই বাক্স খুলো না। খুললেই কিন্তু সর্বনাশ হবে।
আচ্ছা। খুলব না। এপিমেথিউস স্ত্রীকে বলে।
প্যান্ডোরার বিবাহিত জীবন সুখে কাটছে ঠিকই তবে বাক্সে কি আছে তা দেখার জন্য তাকে সর্বক্ষণ এক অস্বস্তিকর কৌতূহল গ্রাস করে রাখে। । এ এক ভীষণ যন্ত্রণা। না পারে খুলতে, না পারে সইতে ...
একদিন। এপিমেথিউস ঘুমিয়ে ছিল।
বাক্সটা খোলার জন্য প্যান্ডোরার কৌতূহলের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেল।
ও বাক্সটা খুলল।
কৌতূহল চেপে রাখতে না-পেরে বাক্সটি খুলেছিল প্যান্ডোরা।
বাক্স খুলতেই পৃথিবীময় ঘৃনা ক্রোধ অসুখ দারিদ্র ইত্যাদি নানা অশুভ ছড়িয়ে পড়ে; প্যান্ডোরা চটজলদি বাক্স বন্ধ করে দেয়।
তার আগেই অবশ্য আশা বেরিয়ে পড়ে।
সুতরাং, আজও মানবসমাজের সার্বিক পরিস্থিতি যতই মন্দ হোক না কেন- মানুষ কখনোই আশা হারায় না।
কিন্তু, মানবসমাজে আশা জিইয়ে রাখাটাও কি দেবতা জিউস- এর পরিকল্পনার অংশ?
সম্ভবত। কারণ তিনি সবই জানতেন।
আর গ্রিক পুরাণরচয়িতারা তো দেবরাজ জিউসকে অত বিবেচনাবোধহীন করে উপস্থাপন করতে পারেন না ...
প্যান্ডোরা ব্র্যান্ডের অলংকার। যা আজও প্যান্ডোরার উপাখ্যানটিকে মনে করিয়ে দেয় যেন ...
প্যান্ডোরার বাক্স ; বাক্সটি একেক শিল্পী একেক ভাবে এঁকেছেন।
ছবি: ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১১ সকাল ১১:৩৩