চতুর্থ হিজরি। রবিউল আওয়াল মাস। মদিনা নগরে বসন্ত এসেছে। দিনভর পশ্চিমের লোহিত সাগর থেকে মৃদুমন্দ বাতাস উড়ে এসে নগরময় ছড়িয়ে যায়। এবং সন্ধ্যার মুখে সে বাতাস হয়ে ওঠে শীতল মধুর । সে মধুর বাতাসের স্পর্শে মদিনাবাসী পরম আনন্দ লাভ করে । বসন্তের আগমনে যেন মরুর আকাশের ধূসর বর্ণে লেগেছে নীল রঙের মৃদু ছোঁয়া । আর দূরবর্তী দিগন্তের পর্বতশ্রেণিকে যেন নমনীয় দেখায়।
মদিনা নগরের উপান্তে সারিবদ্ধ খেজুরকুঞ্জ; সেই খেজুরকুঞ্জের বাতানে অহোরাত্র খেজুর ফলের প্রগাঢ় গন্ধ ভাসে। খেজুরকুঞ্জজুড়ে উড়ে বেড়ায় গুঞ্জরণরত মধুমাছির ঝাঁক। খেজুর শাখায় দোল খায় সুখি আবাবিল পাখিরা; সুখে গান করে তারা।
খেজুরকুঞ্জের নিকটেই একটি ক্ষীণ জলস্রোত।
সে জলস্রোতে ছলছল করে পানির গতিময় ধারা।
খেজুরকুঞ্জের ওপারে দিগন্ত বিস্তৃত কমলা রঙের বালির সমুদ্র। সে কমলা রঙের বালির সমুদ্রে উটের রশি ধরে থাকা একটি বেইদুন বালকের মুখে অনাবিল হাসির ঝিলিক । বেদুইন বালকের মধ্যবয়েসি পিতার মুখেও আনন্দের হাসি। সেই হাসির কারণ কেবলই বসন্তের আগমনের জন্য নয় ... তার কারণ গতকাল মদিনা নগরে মক্কার পবিত্র নবীকে দেখেছে সে ...
শনিবার। অপরাহ্ন। কুবা মসজিদের প্রাঙ্গনে সাহাবিদের সঙ্গে বসে আছেন নবী । নবীর পরনের আলখাল্লাটি পুরনো হলেও অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। সবুজ পাগড়ী পরা শ্মশ্রুমন্ডিত মুখখানিও অত্যন্ত সুদর্শন । নবী মদিনায় পদাপর্ণ করেই কুবা মসজিদটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন। কুবা মসজিদের পিছনেই হযরত আলীর (রাঃ) বাড়ি। নবী প্রতি শনিবার কুবা মসজিদে আসেন। নামাজের পর সাহাবিদের সঙ্গে দ্বীন সম্পর্কে বয়ান করেন।
আজ নবী বললেন, এই কুবা মসজিদে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় একবার ওমরা করার ছোয়াবের সমান।
সাহাবিরা মন দিয়ে নবীর কথা শোনে।
প্রত্যেকের বুকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় ...
... দীর্ঘকাল ধরে আরব উপদ্বীপে জাহেলিয়া (অন্ধকার) বিরাজ করছে। সেই অন্ধকার দূর করতেই নবী আল্লাহ-নির্দেশিত সরল সঠিক সত্য পথের নির্দেশ আরববাসীকে দিয়ে যাচ্ছেন। আর সে পথ কেবলই আত্মিক মুক্তির পথ নয়, সে পথ অর্থনৈতিক মুক্তির পথও ... আরব সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টির জন্য মক্কার কুরাইশ গোত্রের ধনী অভিজাতদের লোভ-লালসা দায়ি। মক্কা নগরটি বানিজ্যপথের মধ্যবর্তী স্থানে হওয়ায় কর আরোপ করে এবং অন্যান্য উপায়ে কুরাইশ প্রচুর ধনসম্পদ অর্জন করেছে। ফলে কুরাইশরা হয়ে উঠেছে ভোগবাদী । জালিম। এবং সুদখোর। কুরাইশদের হাতেই কেবল ধনসম্পদ জমেছে ; সমগ্র আরবসমাজে সমানভাবে সে ধনসম্পদের বন্টন হয়নি। কাজেই আরবসমাজে সৃষ্টি হয়েছে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য। কুরাইশদের অবাধ ভোগ বিলাসের পাশাপাশি মরুচারী বেদুইনদের হাড়জিরজিরে শরীর নির্মম আর্থিক বৈষম্যের বাস্তবচিত্র। অথচ মরুসন্তান গরীব বেইদুনরা অত্যন্ত সহজসরল এবং উদার। তাদের দুঃখদুর্শশায় নবীর প্রাণ কাঁদে। নবী বিশ্বাস করেন: আল্লাহকে ভয় না-করলে ভোগী কুরাইশরা কখনোই ত্যাগী হবে না। নবীর লক্ষ স্বৈরাচারী কুরাইশদের মক্কা থেকে উৎখাত করে আরবসমাজে ধনবৈষম্য দূর করে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা । এ ছাড়া আরব কওম-এর অভ্যন্তরীণ সংঘাত দূর করে তাদের ইসলামের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করাও নবীর অন্যতম উদ্দেশ্য ... কওম-এর অভ্যন্তরীণ সংঘাত কেবলই অর্থহীন রক্তক্ষয় করে ...
নবী দ্বীনের আলোচনা ছাড়াও সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বিশ্লেষন করেন । চার বছর হতে চলল মক্কা থেকে হিজরত করেছেন নবী । মদিনায় বসবাসরত নও মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এদের মধ্যে বিরাজ করছে অভাব অনটন। এখন জালিম কুরাইশদের ধনসম্পদ কেড়ে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। নও মুসলিমদের একটি দল আজ সকালে কুরাইশ বণিকদের কাফেলা আক্রমন করতে গেছে। এখনও তারা মদিনায় ফিরে আসেনি।
এসব কারণে নবীকে কেমন চিন্তিত দেখায় ...
একজন সাহাবি নবীকে কি প্রশ্ন করতে যাবে- নবী তাকে হাত তুলে থামালেন। নবী দূরে আহারোন কে আসতে দেখলেন । আহোরোন লোকটি মদীনাবাসী। ইহুদি ...
... মদিনার স্থানীয় ইহুদিরা অনেকেই মক্কার নবীকে গভীর শ্রদ্ধা করে। ইহুদিদের মধ্যে কখনও বিরোধ সৃষ্টি হলে দুই পক্ষই নবীর কাছে আসে। নবী বিরোধের মীমাংসা করে দেন। ইহুদি গোত্রে কোনও নবজাতক জন্মালে নবীর কাছে নিয়ে আসে। নবী নবজাতকের নাম রখেন। নবীকে গুরুত্ব দেওয়ায় ইহুদি ধর্মগুরুরা নবীর উপর নাখোশ!
আহারোন মসজিদ প্রাঙ্গনে এসে মাথা নীচু করে নবীকে বলে, ‘শালোম’।
নবী মৃদু হেসে বললেন, কুশলে আছ তো আহারোন?
জ্বী, হুজুর। বলে আহারোন মাথা নাড়ে।
মহান আল্লাহ তোমার রহমত দান করুন। বস।
আহারোন বসল। তারপর বলে, হে নবী, আপনি আমাকে তিনদিন পর দেখা করতে বলেছিলেন।
হ্যাঁ। আমার মনে আছে। বলে হাসলেন নবী।
আহারোন চুপ করে থাকে। মসজিদ প্রাঙ্গনে অপরাহ্নের নম্র আলো আলো ছড়িয়ে আছে। চারধারে কেমন এক মিষ্টি সৌরভ বাতাসে ভাসছিল। মসজিদ প্রাঙ্গনের চারিদিকে মাটির অনুচ্চ দেওয়াল। দেয়াল ঘেঁষে খেজুর গাছ। তারপর সংকীর্ণ গলিপথ। শেষবেলার ফিরোজা রঙের আকাশের নীচে মসজিদের ওপাশের বাড়িগুলোর দেয়ালে হলুদ আলোর প্রতিফলন। গলিপথে একদল বালক চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল। উলটো দিক থেকে উটের সারি আসছিল । উটগুলি মদিনার ধনী বণিক আবদুল ফাত্তাহর। নবীর মধুর ব্যবহারে সম্প্রতি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছে আবদুল ফাত্তাহ। আহারোন শ্বাস ফেলে। নবীর দিকে তাকায়। অবশ্য সে স্বর্গীয় মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছিল না। আহারোন দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়।
নবী বললেন, তোমার ছেলেকে বলো যে আমি ওকে মিষ্টি কম খেতে বলেছি । বলে নবী মিটমিট করে হাসতে লাগলেন।
আহারোন মাথা নাড়ল। তারপর বলল, হে নবী, আমি আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।
উপস্থিত সাহাবিরা অনেকেই বিস্মিত হল। তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল। তাদের চোখে প্রশ্ন। নবী সাহাবিদের মনোভাব টের পেলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আজ থেকে তিন দিন আগে মদিনার আল হাকাম সড়কে আমার সঙ্গে আহারোনের দেখা হয়েছিল। আমাকে আহোরন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, হে নবী, আমার নাম আহোরন। আমি এক পুত্রসন্তানের পিতা । তবে আমি দরিদ্র। আমি ছোট একটি রুটির দোকানে কাজ করি । আমার ছেলেটি খুব মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। কিন্তু প্রতিদিন অত মিষ্টি কেনা আমার পক্ষে সম্ভব না। হে নবী, আমার ছেলে আপনাকে শ্রদ্ধা করে। ওর মা আপনার গল্প বলে বলে ওকে ঘুম পারায়। হে আমার প্রিয় নবী, আপনি আমার ছেলেকে কম করে মিষ্টি খেতে বলবেন কি? তাহলে আমার ছেলে শুনবে। সব শুনে আমি আহোরোনকে তিনদিন পরে আসতে বললাম।
এক সাহাবি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর নবী, আহোরোন যখন দরিদ্র তখন আপনি সেদিনই তার ছেলেকে মিষ্টি কম খেতে বললেন না কেন?
নবী মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, কেমন করে নিষেধ করি বল? আমিও যে মিষ্টি খেতে ভালোবাসি। আমি এই তিনদিন মিষ্টি কম খেয়ে ছিলাম। তাই এখন আহারোনের ছেলেকে মিষ্টি কম খেতে বললাম।
সাহাবিদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে।
আহারোন অভিভূত হল। সে জানে- জগতে অনেক মানুষ। তবে সৎ মানুষের সংখ্যা জগতে নিতান্তই অল্প। সৌভাগ্যক্রমে একজন সৎ মানুষের সান্নিধ্য লাভ করে জীবন ধন্য বোধ করে আহারোন । তার চোখের কোণে পানি এসে যায়। নবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে তার মাথা। আর ঠিক তখনই শেষবেলায় ফিরোজা রঙের আকাশে উড়ে যায় একঝাঁক আবাবিল পাখি ...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:০৯