প্রাচীন মিশরের মানচিত্রে নাওক্রাটিস নগরের অবস্থান। নগরটি অবস্থিত ছিল নীল নদের মোহনায়। নাওক্রাটিস নগরে ক্যারাক্সস নামে একজন ধনী গ্রিক ব্যবসায়ী বাস করতেন। ক্যারাক্সস এর আদি বাড়ি ছিল গ্রিসের লেসবস দ্বীপে। ব্যবসার কাজে মিশরে আসতেন ক্যারাক্সস এবং বৃদ্ধ বয়েসে নাওক্রাটিস নগরের নগরে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন।
ক্যারাক্সস এক দিন আগোরা (বাজারে) গেলেন। যেখানে দাসদাসী বিক্রি হচ্ছিল সেখানে একটি সুন্দরী অল্পবয়েসি দাসী দেখে থমকে দাঁড়ালেন ক্যারাক্সস । মেয়েটির গায়ের রং শ্বেতকায়, সবুজ চোখ, রক্তিম গাল। ক্যারাক্সস দেখেই বুঝলেন মেয়েটি গ্রিক। দরদ উথলে উঠল তার। তিনি মেয়েটিকে কিনে নিলেন এবং বাড়ি নিয়ে এলেন। ক্যারাক্সস- এর বাড়িতে অন্য আরও দাসী ছিল। তাদের সঙ্গে রাডোহপেস - এর পার্থক্য ছিল। দাসীদের সিধে কালো চুল; রাডোহপেস-এর চুল সোনালি কুঞ্চিত। দাসীদের বাদামী চোখ এবং গায়ের রং তামাটে; রাডোহপেস- এর গায়ের রং ফ্যাকাশে উজ্জ্বল। যা হোক। ক্যারাক্সস মেয়েটির নাম রাখলেন - রাডোহপেস। এই গ্রিক শব্দটির অর্থ: ‘লালচে গাল’। যা হোক। ক্যারাক্সস ছিলেন অলস। সারাদিন বুড়ো বাগানে গাছের তলায় ঘুমাতেন। তখন দাসীরা রাডোহপেস এর উপর নির্যাতন করত। এটা কর, ওটা কর; সেলাই কর, হাঁস তাড়িয়ে আন, বাগান সাফ কর, রুটি বানাও। নদীতে যাও (ক্যারাক্সস এর বাড়ির কাছেই নীল নদ বইছে তরতর করে) ... কাপড় ধোও।
রাডোহপেস।
রাডোহপেস-এর স্বভাব ছিল শান্ত। ও মুখ বুজে রাতদিন কাজ করে যেত। কোনও প্রতিবাদ করত না। দাসীরা কেউই ওর বন্ধু হয়নি। নদীতে কাপড় ধোওয়ার সময় পাখিরা এসে বসত ওর কাছে। তার হাত থেকে খাবার খেত। আরও কিছু বন্ধু হল ওর। একটি বানর আর একটি জলহস্তী। রাডোহপেস বাড়ির কথা মনে পড়ত। দুঃখ ভোলার জন্য গাইত। আর নাচত। চমৎকার নাচত রাডোহপেস। নাচার সময় পা শুন্যে থাকত। মাটি স্পর্শ করত না পা । একদিন। রাডোহপেস - এর গান শুনে ক্যারাক্সস ঘুম ভেঙে গেল। রাডোহপেস - এর নাচ দেখে ক্যারাক্সস খুশি। যে এমন নাচে তার পায়ে জুতা নেই কেন? এই ভেবে রাডোহপেস কে এক জোড়া গোলাপি রঙের সুন্দর জুতা কিনে দিলেন ক্যারাক্সস ।
ফারাও দ্বিতীয় আমাসিস । আগেই উল্লেখ করেছি যে ফারাও দ্বিতীয় আমাসিস-এর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০ থেকে ৫২৬ ঐতিহাসিকেরা তাকে last great ruler of Egypt before the Persian conquest বলে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন মিশরের সিনডেরেলা রাডোহপেস- এর কাহিনী এই সম্রাটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
মিশরের ফারাও দ্বিতীয় আমাসিস। তাঁর রাজধানী মেমফিস। তিনি এক ভোজসভার আয়োজন করবেন ঠিক করলেন । রাজ্যের যুবরাজ আর সুন্দরী নর্তকীদের আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। ভোজসভায় গানবাজনা হবে। রাডোহপেস এত সুন্দর নাচে যখন- ওর ভোজসভায় যেতে ইচ্ছে করাই স্বাভাবিক। ক্যারাক্সস-এর বাড়ির দাসীরা সুন্দর পোশাক পরে মেমফিস রওনা হল। যাওয়ার আগে রাডোহপেস কে রাজ্যের কাজ চপিয়ে দিয়ে গেল। চোখ রাঙিয়ে বলল, আমরা ফেরার আগেই কাজগুলি করে রাখিস। নইলে মজা বুঝবি!
বলে দুঃখী রাডোহপেস কে নীল নদের পাড়ে রেখে দাসীরা ভেলা ভাসাল।
প্রাচীন মিশরের মানচিত্রে মেমফিস-এর অবস্থান। নাওক্রাটিস নগরের এর দক্ষিণে। তখনকার দিনে জলপথেই যাতায়াত সহজ ছিল।
রাডোহপেস নদীর ধারে বসে কাপড় কাচতে লাগল।
আর গাইতে লাগল দুঃখের গান:
‘কাপড় ধোও, বাগানের আগাছা পরিস্কার কর, শষ্য পিষ।’
জলহস্তী একঘেঁয়ে গানে ক্লান্ত বিরক্ত বোধ করে পানিতে ডুব দিল। তাতে পানি ছলকে উঠে জুতা ভিজে গেল। জুতা তুলে মুছে পাড়ে শুকাতে দিল রাডোহপেস । তারপর আকাশের আলো ধীরে ধীরে মেঘে ঢেকে গেল। হঠাৎ কোত্থেকে এক বাজপাখি উড়ে এসে ছোঁ মেরে একপাটি জুতা নিয়ে উড়ে গেল! রাডোহপেস গ্রিক হলেও অনেক দিন ধরে মিশরে রয়েছে; মিশরের দেবদেবীর কথা জানে মেয়েটি। বাজপাখিটিকে ওর দেবতা হোরাস বলে মনে হল। কেননা দেবতা হোরাস-এর মাথা বাজপাখির মাথার মতো । রাডোহপেস -এর মনে হল কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে দেবতা হোরাস এক পাটি জুতা নিয়ে নিয়ে গেছেন। রাডোহপেস জুতার অন্য পাটিটি লুকিয়ে রাখল।
হোরাসরূপী বাজপাখি রাডোহপেস এর একপাটি জুতা নিয়ে উড়ে গিয়েছিল
রাজকীয় ভোজসভা চলছে। ফারাও দ্বিতীয় আমাসিস সিংহাসনে বসে আছেন। হলরুমে অতিথিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাচগান চলছে। খানাপিনা চলছে। তবে ফারাও বিষন্ন বোধ করছেন। সিংহাসনে বসে থাকার চেয়ে মরুভূমিতে রথে চড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন তিনি । সহসা বাজপাখি গোত্তা খেয়ে নীচে নেমে গোলাপি রঙের এক পাটি জুতা ফারাও এর কোলের উপর ফেলে উড়ে গেল। ফারাও বিস্মিত। বাজপাখি মানেই দেবতা হোরাস। ফারাও যা বোঝার বুঝতে পারলেন। তিনি ঘোষনা করলেন মিশরের প্রত্যেক কুমারীকে জুতা পরে দেখতে হবে। জুতা যার পায়ে ভালো মতো আঁটবে সেই হবে মিশরের রানী।
এরপর ফারাও রথে চেপে নিজেই কুমারীর সন্ধানে বের হলেন।
প্রাচীন মিশরের সিনডেরেলা ... "cinderella" শব্দটির অর্থ who unexpectedly achieves recognition or success after a period of obscurity and neglect. কিন্তু ইউরোপে কখন এ কাহিনী প্রচলিত হল? ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে জিয়ামবাতিস্তা বাসিল নামে নেপোলিয়নের একজন সৈন্য ‘লো কুনটো দে লি কুনতি’ (গল্পের গল্প) নামে একটি গ্রন্থে সেনেরেনতোলা নামে এক দুঃখী মেয়ের কথা লেখেন। সৎ মা এবং সৎবোনেরা সেনেরেনতোলা কে জ্বালাতন করত। সেনেরেনতোলার জুতা হারিয়ে যায় এবং রাজা খুঁজে বার করেন। ‘লো কুনটো দে লি কুনতি’ পেন্টামেরোন নামেও পরিচিত।
স্থলপথে ঘুরে কুমারীর সন্ধান পেলেন না ফারাও। ফারাও এবার বেগুনি রঙের পাল তোলা একটি নৌযানে উঠে নীলনদে ভাসালেন। মাঝে মাঝে তীরে ভিড়ছেন। কুমারীদের জুতা পরে দেখতে বলছেন। কারও পায়ে ঠিক মতো লাগছে না। ফারাওয়ের নৌযান এবার রাডোহপেস -এর বাড়ির সামনের ঘাটে এসে ভিড়ল। বেগুনি পাল আর বাজনার শব্দে দাসীরা তীরে ছুটে গেল। রাডোহপেস কিন্তু গেল না। ও একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইল। দাসীরা রাডোহপেস-এর জুতা চিনতে পারল। কিন্তু তারা কিছু না বলে জুতা পরার চেস্টা করল। ফারাও রাডোহপেস কে ঝোপের আড়ালে দেখতে পেলেন। জুতা পরতে বললেন। রাডোহপেস পরল। ওর পায়ে জুতা ঠিক ঠিক মানিয়ে গেল। রাডোহপেস এবার অন্য জোড়া বার করে পরল।
ফারাও খুশি হয়ে বললেন, তুমিই হবে মিশরের রানী।
দাসীরা চিৎকার করে উঠল। বলল, মহারাজ, রাডোহপেস দাসী। এমনকী ও মিশরীয় না।
ফারাও হেসে বললেন, ও মিশরের সেরা কন্যা। নীল নদের মতো সবুজ ওর চোখ। চুল প্যাপিরাসের পাতার মতো, ত্বক পদ্ম ফুলের মতো।
গ্রিক ঐতিহাসি স্ট্রাবো (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩/২৪ খ্রিস্টাব্দ) ইনিই প্রথম তাঁর জিওগ্রাফিকা গ্রন্থের ১৭ অধ্যায়ের ১.৩৩ অনুচ্চেদে রাডোহপেস- এর কাহিনী বর্ণিত করেছেন।
ছবি। ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
Click This Link
http://www.perankhgroup.com/cinderella.htm
Click This Link
Click This Link